রঙ্গব্যঙ্গ-পদ্মা সেতুর আত্মকাহিনী by মোস্তফা কামাল
ছোটবেলায় আমরা একটি নদীর আত্মকাহিনী, বটগাছের আত্মকাহিনী ইত্যাদি পড়েছি। এবার আমরা পদ্মা সেতুর আত্মকাহিনী কল্পনা করতে পারি_ জন্মের আগেই আমার নাম দেওয়া হইয়াছে। আমার নাম পদ্মা সেতু। পরে হয়তো অন্য কোনো নাম ধারণ করিব। কিন্তু আমার জন্মের আগেই আমাকে নিয়া যে ষড়যন্ত্র চলিতেছে, দুর্নীতি শুরু হইয়াছে, তাহাতে আমি আমার জীবন নিয়া শঙ্কিত বোধ করিতেছি।
আমার শঙ্কার কথা আমি সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশে তুলিয়া ধরিতে চাই। দেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার উভয় তীরের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ, বিশেষ করিয়া রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে আমাকে সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হইয়াছে। বহুকাল আগে থেকেই আমাকে নিয়া আলোচনা চলিয়াছে। আন্দোলনও করিয়াছেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। অনেক লেখালেখিও হইয়াছে। দীর্ঘদিন পরে সরকার মহোদয় বুঝিতে পারিয়াছে, আমাকে বড়ই প্রয়োজন।
সরকার মহোদয় আমার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা দাতাদের কাছে ধরনা দিয়াছে। তাহারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করিবার পর শুরু হইল আমাকে নিয়া সম্ভাব্যতা যাচাই। আমার নাম কী হইবে, কোথায় আমাকে স্থাপন করা হইবে, আমার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কত হইবে, আমাকে নির্মাণ করিতে কত টাকা খরচ পড়িবে, সেই খরচের কত অংশ দাতারা সাহায্য দিবে, তাহা লিপিবদ্ধ করা হইল। তাহাতে বলা হইল, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং শরীয়তপুুরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করিব আমি। আমার দৈর্ঘ্য হইবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ২১ দশমিক ১০ মিটার। আমাকে নির্মাণ করিতে খরচ হইবে তিন শত কোটি ডলার। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, নকশা প্রণয়ন এবং বেতন-ভাতা ও গাড়ি কেনা বাবদ খরচ হইয়াছে এক হাজার ২১ কোটি টাকা।
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টিনন্দন নকশা দেখিয়া পুলক বোধ করিতেছেন। আমার জন্য গঠিত প্রকল্প কর্মকর্তারা নতুন গাড়ি হাঁকাইয়া বেশ মজা লইতেছেন। শুনিয়াছি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নাকি জন্মসূত্রে আমার পিতা। কিন্তু সেই পিতা যেইভাবে আমার নাম ভাঙ্গাইয়া, আমার পরিচর্যার অর্থ লুটপাট করিয়া নিজের পকেট ভারী করিয়া চলিয়াছেন, তাহাতে আমার কপালে কী ঘটিতে পারে তাহা নিয়া আমি ভীষণ চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছি। জন্মের আগেই বুঝি আমাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইতেছে। কী পরিমাণ অনিশ্চয়তা আর নিদারুণ কষ্টে যে আমার দিন কাটিতেছে তাহা শুনিলে আপনারা নিশ্চয়ই স্তম্ভিত ও মর্মাহত হইবেন।
লোকমুখে শুনিয়াছি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওপর দাতারা (বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক) আস্থা রাখিতে পরিতেছে না। আস্থাহীনতার কারণে সেতুর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে কানাডা সরকার তদন্ত শুরু করিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ সব ধরনের কাজের দরপত্র অনুমোদন আটকাইয়া দিয়াছেন দাতারা। আমার ভাগ্যনির্ধারক বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরো সরকার মহোদয়কে জানাইয়া দিয়াছেন যে আমার প্রকল্পে দুর্নীতির আশঙ্কা করিতেছেন তাঁহারা। আমার তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দরপত্রে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠিয়াছে তাহা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নাকি ঠিকাদার নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হইবে না। ইহা ছাড়া সেতু বিভাগ যে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করিয়াছিল, তাহার অনুমোদনও আট মাস ধরিয়া বিশ্বব্যাংক আটকাইয়া রাখিয়াছে।
এই দিকে দাতারাও আমার জন্ম নিয়া ছিনিমিনি খেলিতেছে। আমার দরপত্র ও ঠিকাদার নিয়োগ বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী হইবে নাকি অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের নীতিমালাও অনুসরণ করা হইবে, তাহা লইয়া বিতর্ক শুরু হইয়াছে। বিশ্বব্যাংক বলিতেছে, তাহারা যেহেতু সমন্বয়কারী ও সর্বাধিক অর্থদাতা, তাই তাহাদের নীতিমালা অনুযায়ী হইবে। কিন্তু এডিবি তাহাতে রাজি হইতেছে না। ফলে নতুন করিয়া জটিলতা সৃষ্টি হইতেছে।
প্রিয় পাঠক, এইবার ভাবুন তো, আমি কী পরিমাণ পেরেশানিতে আছি! আমার মাতা পদ্মাও মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি আমার জন্য প্রতিদিন চোখের পানি ফেলিতেছেন। তিনি গর্ভপাত হইবার ভয়ে কাতর হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি ভাবিতেছেন, দুষ্টু পিতার অন্যায়-অপকর্মের কারণে মাতৃগর্ভেই বুঝি আমার মৃত্যু ঘটিবে। যদিও পিতা বলিতেছেন, তিনি নিজ হাতে তাঁহার সন্তানকে গলা টিপিয়া মারিবেন না। কিন্তু তাঁহার কাজকর্ম দেখিয়া কেহ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেছেন না। সবাই বলিতেছেন, আমার যদি মাতৃগর্ভেই মৃত্যু হয় তাহা হইলে পিতার কারণেই হইবে।
আমি মাতৃগর্ভে বসিয়া বিধাতার দরবারে হাত তুলিয়া বলিতেছি, হে আমার পরম করুণাময়, তুমি আমার ভ্রূণ সৃষ্টি করিয়াছ। এইবার আমাকে পৃথিবীটা দেখিবার সুযোগ করিয়া দাও। আমার চমকপ্রদ নকশা দেখিয়া মানুষ যেইভাবে উল্লাস প্রকাশ করিতেছে, তাহারা যদি সত্যিকারের আমাকে দেখিতে পায় তাহা হইলে তাহাদের মনে আনন্দের বন্যা বইবে। এই আনন্দ হইতে মানুষকে তুমি বঞ্চিত করিও না।
প্রিয় দেশবাসী, আপনারাও আমার জন্য দোয়া করিবেন। আমার ওপর হইতে যেন সকল বালামুসিবত কাটিয়া যায়। আমিন আমিন; ছুম্মা আমিন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সরকার মহোদয় আমার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা দাতাদের কাছে ধরনা দিয়াছে। তাহারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করিবার পর শুরু হইল আমাকে নিয়া সম্ভাব্যতা যাচাই। আমার নাম কী হইবে, কোথায় আমাকে স্থাপন করা হইবে, আমার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কত হইবে, আমাকে নির্মাণ করিতে কত টাকা খরচ পড়িবে, সেই খরচের কত অংশ দাতারা সাহায্য দিবে, তাহা লিপিবদ্ধ করা হইল। তাহাতে বলা হইল, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং শরীয়তপুুরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করিব আমি। আমার দৈর্ঘ্য হইবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ২১ দশমিক ১০ মিটার। আমাকে নির্মাণ করিতে খরচ হইবে তিন শত কোটি ডলার। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, নকশা প্রণয়ন এবং বেতন-ভাতা ও গাড়ি কেনা বাবদ খরচ হইয়াছে এক হাজার ২১ কোটি টাকা।
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টিনন্দন নকশা দেখিয়া পুলক বোধ করিতেছেন। আমার জন্য গঠিত প্রকল্প কর্মকর্তারা নতুন গাড়ি হাঁকাইয়া বেশ মজা লইতেছেন। শুনিয়াছি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নাকি জন্মসূত্রে আমার পিতা। কিন্তু সেই পিতা যেইভাবে আমার নাম ভাঙ্গাইয়া, আমার পরিচর্যার অর্থ লুটপাট করিয়া নিজের পকেট ভারী করিয়া চলিয়াছেন, তাহাতে আমার কপালে কী ঘটিতে পারে তাহা নিয়া আমি ভীষণ চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছি। জন্মের আগেই বুঝি আমাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইতেছে। কী পরিমাণ অনিশ্চয়তা আর নিদারুণ কষ্টে যে আমার দিন কাটিতেছে তাহা শুনিলে আপনারা নিশ্চয়ই স্তম্ভিত ও মর্মাহত হইবেন।
লোকমুখে শুনিয়াছি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওপর দাতারা (বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক) আস্থা রাখিতে পরিতেছে না। আস্থাহীনতার কারণে সেতুর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানে পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে কানাডা সরকার তদন্ত শুরু করিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ সব ধরনের কাজের দরপত্র অনুমোদন আটকাইয়া দিয়াছেন দাতারা। আমার ভাগ্যনির্ধারক বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গুয়েরেরো সরকার মহোদয়কে জানাইয়া দিয়াছেন যে আমার প্রকল্পে দুর্নীতির আশঙ্কা করিতেছেন তাঁহারা। আমার তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দরপত্রে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠিয়াছে তাহা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নাকি ঠিকাদার নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হইবে না। ইহা ছাড়া সেতু বিভাগ যে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করিয়াছিল, তাহার অনুমোদনও আট মাস ধরিয়া বিশ্বব্যাংক আটকাইয়া রাখিয়াছে।
এই দিকে দাতারাও আমার জন্ম নিয়া ছিনিমিনি খেলিতেছে। আমার দরপত্র ও ঠিকাদার নিয়োগ বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী হইবে নাকি অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের নীতিমালাও অনুসরণ করা হইবে, তাহা লইয়া বিতর্ক শুরু হইয়াছে। বিশ্বব্যাংক বলিতেছে, তাহারা যেহেতু সমন্বয়কারী ও সর্বাধিক অর্থদাতা, তাই তাহাদের নীতিমালা অনুযায়ী হইবে। কিন্তু এডিবি তাহাতে রাজি হইতেছে না। ফলে নতুন করিয়া জটিলতা সৃষ্টি হইতেছে।
প্রিয় পাঠক, এইবার ভাবুন তো, আমি কী পরিমাণ পেরেশানিতে আছি! আমার মাতা পদ্মাও মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি আমার জন্য প্রতিদিন চোখের পানি ফেলিতেছেন। তিনি গর্ভপাত হইবার ভয়ে কাতর হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি ভাবিতেছেন, দুষ্টু পিতার অন্যায়-অপকর্মের কারণে মাতৃগর্ভেই বুঝি আমার মৃত্যু ঘটিবে। যদিও পিতা বলিতেছেন, তিনি নিজ হাতে তাঁহার সন্তানকে গলা টিপিয়া মারিবেন না। কিন্তু তাঁহার কাজকর্ম দেখিয়া কেহ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেছেন না। সবাই বলিতেছেন, আমার যদি মাতৃগর্ভেই মৃত্যু হয় তাহা হইলে পিতার কারণেই হইবে।
আমি মাতৃগর্ভে বসিয়া বিধাতার দরবারে হাত তুলিয়া বলিতেছি, হে আমার পরম করুণাময়, তুমি আমার ভ্রূণ সৃষ্টি করিয়াছ। এইবার আমাকে পৃথিবীটা দেখিবার সুযোগ করিয়া দাও। আমার চমকপ্রদ নকশা দেখিয়া মানুষ যেইভাবে উল্লাস প্রকাশ করিতেছে, তাহারা যদি সত্যিকারের আমাকে দেখিতে পায় তাহা হইলে তাহাদের মনে আনন্দের বন্যা বইবে। এই আনন্দ হইতে মানুষকে তুমি বঞ্চিত করিও না।
প্রিয় দেশবাসী, আপনারাও আমার জন্য দোয়া করিবেন। আমার ওপর হইতে যেন সকল বালামুসিবত কাটিয়া যায়। আমিন আমিন; ছুম্মা আমিন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments