অন্যায়-অবিচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চির সোচ্চার মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী by জুলফিকার আহমদ কিসমতী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হচ্ছপকথার নায়কতুল্য বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমিত-তেজ বিমূর্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের অন্যতম নির্ভীক সিপাহসালার। দেশ-জাতিধর্মের মর্যাদা রক্ষা, জনগণের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
ইসলামের এক অনাড়ম্বর খাদেম ‘অত্যাচারী শাসকের আমলে ন্যায় ও সত্য কথা বলাই উত্তম জিহাদ’ হাদিসটির তিনি ছিলেন এক জীবন্ত প্রতীক। তার রাজনৈতিক জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, আজীবন তিনি রাজনীতি করলেও সব সময় ক্ষমতার রাজনীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং অপরকে ক্ষমতায় পাঠিয়ে তাকে দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইতেন। দুর্লভ এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিত্বকে বাংলার মানুষ এ জন্যই স্মরণ করে। জাতীয় যেকোনো দুর্যোগ মুহূর্তে এ কারণেই অবলীলাক্রমে সবার মুখে উচ্চারিত হতে দেখা যায়—‘এ সময় নেতা দরকার, ভাসানীর ন্যায় সোচ্চার।’ জাতির ওই দরদী নেতা বাংলাদেশের বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের ধনগড়া নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানীর পিতা হাজি শারাফত আলী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তার পেশা ছিল চাষাবাদ। মওলানা ভাসানী চাষী পরিবারে জন্মলাভ করে চাষীদের পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন, গড়ে ওঠেন, যেই চাষীরা বেঁচে থাকার তাগিদে অপরিসীম কষ্ট, পরিশ্রম ও সংগ্রাম সাধনার মধ্যে নিজেদের সদা নিয়োজিত রাখেন। যুবক ভাসানীর ভবিষ্যত্ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে পরিবেশগত তার এ অবস্থান সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ (শুক্রবার) ছিল এই সংগ্রামী নেতার ১২৯তম জন্মদিন। দিনটি অতীব শ্রদ্ধানিবেদনের সঙ্গে উদযাপিত হয়। এদিনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, ‘দেশের বর্তমান জটিল রাজনৈতিক অবস্থান থেকে পরিত্রাণের জন্য আজ ভাসানীর মতো একজন বলিষ্ঠ নেতার বড় প্রয়োজন ছিল।’মুসলিম পারিবারিক শিক্ষার ঐতিহ্যগত ধারা অনুযায়ী মওলানা ভাসানী প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। তবে তিনি সৌভাগ্যক্রমে শাহ্ সুফী নাসিরুদ্দীন বাগদাদীর ন্যায় একজন আধ্যাত্মিক নেতার সংসর্গ লাভ করেছিলেন। এ ছাড়া বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষার পাদপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের সুবিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং উপমহাদেশের অন্যতম সুপরিচিত রাজনীতিক আজাদী সংগ্রামের নির্ভীক মরহুম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর সাহচর্যেও দুই বছর অতিবাহিত করেন। শাহ সুফী বাগদাদীর মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের সংসর্গ এবং কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানে পরিপকস্ফ মহাপণ্ডিত ও বুজর্গ মাওলানা মাদানীর সাহচর্য ভাসানী চরিত্রকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় বৈশিষ্ট্যে করেছিল বিমণ্ডিত।
রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ : বিংশ শতকের প্রথম দশকে মওলানা ভাসানী ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনবিরোধী মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আজাদী সংগ্রামে রত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলীর সঙ্গে কাজ করার তার সুযোগ ঘটে। খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯২৩ সাল থেকে খেলাফত আন্দোলন অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। উপরন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে (১৯২৫) স্বরাজ পার্টির নীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই দুটি ঘটনার পর তার রাজনৈতিক তত্পরতা ছিল অবহেলিত বাংলা আসামের গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক।
১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী বাংলা-আসামের লাখ লাখ কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯২৪ সালে ভাসানচরে অনুষ্ঠিত বাংলা-আসামের জিরাতিয়া প্রজাদের এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলনের সূচনা করেন। শোষক সামন্তবাদী জোতদার মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে মুসলিম চাষী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৯৩০ সালে বাংলা-আসামের মুসলমানদের এক বিরাট সম্মেলনের আয়োজন করেন। তত্কালীন বৃহত্তর মোমেনশাহী জেলার সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের লক্ষে চাষী সাধারণকে সংগঠিত করেন। এসব তত্পরতার কারণে ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার এ জেলায় তার তত্পরতা বন্ধ করে দেয়।
১৯৩৭ সালে অল ইন্ডিয়া লক্ষেষ্টৗ কনফারেন্সের অব্যবহিত আগে মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং রাজা গজনফর আলীর অনুরোধে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। গণভোটে সিলেটবাসী যাতে আদৌ কোনো ভুল না করে, সেজন্য মওলানা ভাসানী সারা সিলেটে ঝটিকা সফর করে পাকিস্তানের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। ’৪৭-এর আজাদী আন্দোলনে এই সংগ্রামী নেতার রয়েছে অসামান্য অবদান।
মুসলিম লীগ ত্যাগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন : ১৯৪৮ সালে তিনি উত্তর টাঙ্গাইল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব-পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাদের দলীয় মেনিফেস্টো মোতাবেক কাজ না করায় তিন মাস পর তিনি তার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন। এক বছর পর তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার প্রতিবাদে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র দু’টি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বায়ত্তশাসিত দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণা থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার জনগণ থেকে ভোট আদায় করলেও পশ্চিম পাকিস্তানেই এর রাজধানী স্থাপন করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা অর্থনৈতিক ও অন্য নানান বৈষম্যের শিকার হয়। মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে লাহোর প্রস্তাব কেন্দ্রিক মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী তাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৪৯ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এই নবগঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তার এ সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি এবং বাগদাদ প্যাক্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজদলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। এ কারণে আবারও তিনি নিজ দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ সঙ্গে তার রাজনৈতিক যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই দলই আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারা ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জিত হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি নতুন দল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হিসেবেও মওলানা ভাসানীকেই নির্বাচিত করা হয়।
উল্লিখিত বছরগুলোয় মওলানা ভাসানী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষকদের স্বার্থেই কাজ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ‘কৃষক সমিতি’ নামে এদেশের কৃষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংগঠন কায়েম করেন। কৃষক সমিতিরও সভাপতি মওলানা ভাসানীই ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানী পাকশিতে এক বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সম্মেলনে প্রায় আড়াই লাখ কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি প্রায় অনুরূপ আরেকটি বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন ১৯৭০ সালে। এই সম্মেলনেও দুই লাখ কৃষক অংশ নেয়। একই সালে তিনি মহিপুরেও এক বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। মহিপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ কৃষক সমবেত হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান : মওলানা ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের আহ্বান জানান। তিনিই ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা না দেয়ায় ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন, ঢাকার সরকার তো মূলত বিদেশি রাষ্ট্রের তাঁবেদার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে, তখন তিনি আর নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নিজের সব আরাম হারাম করে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আবার তিনি রাজপথে নেমে পড়েন। তিনি দেখলেন, সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম প্রধান এদেশের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় সব মূল্যবোধ ধ্বংসের কাজ করছে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত প্রভু ও পতাকা বদল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের স্বার্থরক্ষা আর বাংলাদেশের মুসলমানদের শোষণেরই ব্যবস্থা হয়েছে, তখন মওলানা ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার অনুসারীদের সংগঠিত করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখে, যেন তিনি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে কোথাও বের হতে না পারেন।
হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী যখন বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি গঠন করেন, তখন এই পদক্ষেপ তার জীবনের একটি তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে তার নবগঠিত দল ‘হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি’ গঠনের মূল দর্শন ব্যাখ্যা করেন। রাজনৈতিক তত্পরতার সঙ্গে সঙ্গে মওলানা ভাসানী তার জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দর্শনের অনুকূলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য চিন্তা করেন। মূলত মওলানা ভাসানী কর্তৃক টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি তার শিক্ষাসংক্রান্ত চিন্তাধারা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নেরই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে আসেন। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের উদ্যোগ দেখে অনেক ইসলামপন্থী ব্যক্তিত্ব যারা আগে তার থেকে দূরে ছিলেন, সন্তোষে গিয়ে তাকে মোবারকবাদ জানান এবং তার এ উদ্যোগের প্রতি তারা সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ : মওলানা ভাসানীর সংগ্রামমুখর জীবনের সর্বশেষ ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ। বাংলাদেশে মরু প্রক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দাও, উড়িয়ে দাও’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ ও ১৭ মে রাজশাহী থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে ভাসানী লংমার্চ শুরু করেন। সেই লংমার্চের উদ্দীপনাপূর্ণ স্মৃতি প্রতিটি মানুষকে এখনও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে।
খোদায়ী খেদমতগার দল : মওলানা ভাসানীর জীবনের সর্বশেষ সংগঠনটি ছিল ‘খোদায়ী খেদমতগার দল’। তিনি ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে এটির ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে সন্তোষে তার দরবার স্থলে সব খেদতমতগারের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন সেটিই ছিল এই নেতার জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। সেদিন মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল—‘আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যতসব দলই বদল করি না কেন কোনো ফলোদয় হবে না, যদি না শাসকরা চরিত্রবান হয়, আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর শাসন কায়েম করতে পারে। আমি তাই হুকুমতে রাব্বানীয়ার আশ্রয় নিয়েছি। দোয়া করি, আল্লাহর মর্জি হোক, বিশ্ব মানবতার জয় হোক’।
ইন্তেকাল : ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্তোষে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
ভাসানী জীবনের শিক্ষা : যে কোনো সমাজে কোনো আদর্শ বাস্তবায়নের দ্বারা ওই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে হলে সেই আদর্শকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত করতে হয়। ওই আদর্শের বাস্তবায়ন দ্বারা জনগণের কী কী কল্যাণ সাধিত হয় সেটা বোধগম্য ভাষায় তাদের সামনে তুলে ধরতে হয়। অন্যথায় আদর্শের ধারকবাহকরা সংশ্লিষ্ট সমাজের শত কল্যাণকামী হলেও জনগণ কখনও তাদের নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে না। তাদের প্রতি বাহ্যিকভাবে সম্মান জানালেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আসনে বসার সুযোগ তাদের কখনও দিতে চায় না। আদর্শের প্রচারকদের কর্তব্য হলো নিজের কথা, আচার-আচরণ ও একই সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা জনচিত্তকে জয় করা। বলা বাহুল্য, মওলানা ভাসানী তার গোটা সংগ্রামমুখর জীবনে জনপ্রিয়তার যেই উত্তুঙ্গ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন, এর পেছনে তার উল্লিখিত গুণাবলীই অধিক কাজ করেছিল। সমাজের সাধারণ গণমানুষ সব সময় এই অনাড়ম্বর মহান ব্যক্তিত্বকে দেখেছে নিজেদের আপন মানুষ হিসেবে। তাদের দুঃখ-দুর্গতির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে এবং এজন্য দায়ী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে তাকেই জনগণ সব সময় কাছে পেয়েছে। তারা দেখেছে, ক্ষমতায় না গিয়েও এই নিঃস্বার্থ মজলুম জননেতাকে সব সময় তাদের সমস্যাবলী নিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে সভা করে বেড়াতে এবং অত্যাচারী শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখতে।
জীবন-ঘনিষ্ঠ সমস্যাবলীর সমাধানে সোচ্চারতাই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায় ভাসানীকে : সবচেয়ে বড় কথা হলো, মওলানা ভাসানী এদেশের মানুষের কল্যাণে তাদের বোধগম্য ভাষায় যে কথা বলতেন, তারা সে কথা বুঝত। তাদের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে তিনিই প্রথম সোচ্চার হয়ে উঠতেন। পক্ষান্তরে একই ‘মওলানা’ লকবে ভূষিত আরও বহু আলেম যারা নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা নিঃস্বার্থভাবে এ দেশ-জাতির সেবা করে আসছেন এবং তাদের ইহ-পরলৌকিক মুক্তির সন্ধান দিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর হৃদয় সে রকম জয় করতে পারেননি; যেমনটি পেরেছিলেন মওলানা ভাসানী। অথচ তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক বড় বড় এমন পণ্ডিতও ছিলেন ও আছেন; যাদের ইলমের পরিধি হয়তো মওলানা ভাসানীর চেয়েও ব্যাপক ছিল। এর কারণ হলো রাজনৈতিক অঙ্গনে জনগণের জীবন-ঘনিষ্ঠ সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে তিনিই তাদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেন, সরকারের কাছে জোরালো ভাষায় দাবি তুলতেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য নয়, জনগণের কথা বলেই মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সময় জেল খেটেছেন।
এদেশের গরিব জনগণের হৃদয় কাঙ্ক্ষিতভাবে জয় করতে ভাসানীর অনুরূপ অন্য ইসলামপন্থীরা সফল হননি। তাদের ব্যর্থতার এই ছিদ্রপথেই আমাদের দেশ-জাতির বড় সর্বনাশটি সাধিত হয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, নাস্তিকতাবাদী ও খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থাগুলো কোটি কোটি তাওহীদি জনতার সাক্ষাত্ সমস্যাবলীর সূত্র ধরে এদেশের মুসলমানদের ওলামা নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এভাবেই আমাদের দেশের ওলামা শ্রেণী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও পরে অবহেলিত হয়ে পড়েছেন; আর এ সুযোগে আজ জাতির ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ সুযোগে ইসলামের আন্তর্জাতিক বৈরীশক্তি তার সুযোগ নিতে তত্পর হয়ে উঠেছে শান্তিকামী এই মুসলিম সমাজে অনৈক্যের সৃষ্টি করে গোটা জাতির সর্বনাশ সাধনে তত্পর হয়েছে। এই আলোকে চিন্তা করলেও সংগ্রামী নেতা মওলানা।
রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ : বিংশ শতকের প্রথম দশকে মওলানা ভাসানী ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনবিরোধী মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি খেলাফত আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আজাদী সংগ্রামে রত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলীর সঙ্গে কাজ করার তার সুযোগ ঘটে। খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯২৩ সাল থেকে খেলাফত আন্দোলন অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। উপরন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে (১৯২৫) স্বরাজ পার্টির নীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই দুটি ঘটনার পর তার রাজনৈতিক তত্পরতা ছিল অবহেলিত বাংলা আসামের গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক।
১৯৩০ সালে মওলানা ভাসানী বাংলা-আসামের লাখ লাখ কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯২৪ সালে ভাসানচরে অনুষ্ঠিত বাংলা-আসামের জিরাতিয়া প্রজাদের এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলনের সূচনা করেন। শোষক সামন্তবাদী জোতদার মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে মুসলিম চাষী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৯৩০ সালে বাংলা-আসামের মুসলমানদের এক বিরাট সম্মেলনের আয়োজন করেন। তত্কালীন বৃহত্তর মোমেনশাহী জেলার সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের লক্ষে চাষী সাধারণকে সংগঠিত করেন। এসব তত্পরতার কারণে ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার এ জেলায় তার তত্পরতা বন্ধ করে দেয়।
১৯৩৭ সালে অল ইন্ডিয়া লক্ষেষ্টৗ কনফারেন্সের অব্যবহিত আগে মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং রাজা গজনফর আলীর অনুরোধে মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সিলেট জেলা গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। গণভোটে সিলেটবাসী যাতে আদৌ কোনো ভুল না করে, সেজন্য মওলানা ভাসানী সারা সিলেটে ঝটিকা সফর করে পাকিস্তানের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। ’৪৭-এর আজাদী আন্দোলনে এই সংগ্রামী নেতার রয়েছে অসামান্য অবদান।
মুসলিম লীগ ত্যাগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন : ১৯৪৮ সালে তিনি উত্তর টাঙ্গাইল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব-পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাদের দলীয় মেনিফেস্টো মোতাবেক কাজ না করায় তিন মাস পর তিনি তার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন। এক বছর পর তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতার প্রতিবাদে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র দু’টি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এভাবে স্বায়ত্তশাসিত দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণা থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার জনগণ থেকে ভোট আদায় করলেও পশ্চিম পাকিস্তানেই এর রাজধানী স্থাপন করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা অর্থনৈতিক ও অন্য নানান বৈষম্যের শিকার হয়। মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে লাহোর প্রস্তাব কেন্দ্রিক মতবিরোধের ফলে মওলানা ভাসানী তাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৪৯ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এই নবগঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তার এ সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি এবং বাগদাদ প্যাক্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজদলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। এ কারণে আবারও তিনি নিজ দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগের’ সঙ্গে তার রাজনৈতিক যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই দলই আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারা ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জিত হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি নতুন দল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হিসেবেও মওলানা ভাসানীকেই নির্বাচিত করা হয়।
উল্লিখিত বছরগুলোয় মওলানা ভাসানী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কৃষকদের স্বার্থেই কাজ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ‘কৃষক সমিতি’ নামে এদেশের কৃষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংগঠন কায়েম করেন। কৃষক সমিতিরও সভাপতি মওলানা ভাসানীই ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানী পাকশিতে এক বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সম্মেলনে প্রায় আড়াই লাখ কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি প্রায় অনুরূপ আরেকটি বিরাট কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন ১৯৭০ সালে। এই সম্মেলনেও দুই লাখ কৃষক অংশ নেয়। একই সালে তিনি মহিপুরেও এক বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। মহিপুরের কৃষক সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ কৃষক সমবেত হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান : মওলানা ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের আহ্বান জানান। তিনিই ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা না দেয়ায় ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পূর্বপাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা প্রদান করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন, ঢাকার সরকার তো মূলত বিদেশি রাষ্ট্রের তাঁবেদার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে, তখন তিনি আর নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। নিজের সব আরাম হারাম করে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে আবার তিনি রাজপথে নেমে পড়েন। তিনি দেখলেন, সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলিম প্রধান এদেশের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় সব মূল্যবোধ ধ্বংসের কাজ করছে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত প্রভু ও পতাকা বদল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের স্বার্থরক্ষা আর বাংলাদেশের মুসলমানদের শোষণেরই ব্যবস্থা হয়েছে, তখন মওলানা ভাসানী ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার অনুসারীদের সংগঠিত করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দি করে রাখে, যেন তিনি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে কোথাও বের হতে না পারেন।
হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯৪৭ সালে মওলানা ভাসানী যখন বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি গঠন করেন, তখন এই পদক্ষেপ তার জীবনের একটি তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে তার নবগঠিত দল ‘হুকুমতে রাব্বানী সোসাইটি’ গঠনের মূল দর্শন ব্যাখ্যা করেন। রাজনৈতিক তত্পরতার সঙ্গে সঙ্গে মওলানা ভাসানী তার জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দর্শনের অনুকূলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য চিন্তা করেন। মূলত মওলানা ভাসানী কর্তৃক টাঙ্গাইলের সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি তার শিক্ষাসংক্রান্ত চিন্তাধারা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নেরই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকেই তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে আসেন। অবশেষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের উদ্যোগ দেখে অনেক ইসলামপন্থী ব্যক্তিত্ব যারা আগে তার থেকে দূরে ছিলেন, সন্তোষে গিয়ে তাকে মোবারকবাদ জানান এবং তার এ উদ্যোগের প্রতি তারা সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ : মওলানা ভাসানীর সংগ্রামমুখর জীবনের সর্বশেষ ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ। বাংলাদেশে মরু প্রক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দাও, উড়িয়ে দাও’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৬ ও ১৭ মে রাজশাহী থেকে হাজার হাজার লোক নিয়ে ভাসানী লংমার্চ শুরু করেন। সেই লংমার্চের উদ্দীপনাপূর্ণ স্মৃতি প্রতিটি মানুষকে এখনও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে।
খোদায়ী খেদমতগার দল : মওলানা ভাসানীর জীবনের সর্বশেষ সংগঠনটি ছিল ‘খোদায়ী খেদমতগার দল’। তিনি ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে এটির ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে সন্তোষে তার দরবার স্থলে সব খেদতমতগারের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন সেটিই ছিল এই নেতার জীবনের সর্বশেষ ভাষণ। সেদিন মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল—‘আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যতসব দলই বদল করি না কেন কোনো ফলোদয় হবে না, যদি না শাসকরা চরিত্রবান হয়, আর চরিত্রবান লোকেরাই কেবল আল্লাহর শাসন কায়েম করতে পারে। আমি তাই হুকুমতে রাব্বানীয়ার আশ্রয় নিয়েছি। দোয়া করি, আল্লাহর মর্জি হোক, বিশ্ব মানবতার জয় হোক’।
ইন্তেকাল : ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সন্তোষে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
ভাসানী জীবনের শিক্ষা : যে কোনো সমাজে কোনো আদর্শ বাস্তবায়নের দ্বারা ওই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে হলে সেই আদর্শকে প্রথমে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত করতে হয়। ওই আদর্শের বাস্তবায়ন দ্বারা জনগণের কী কী কল্যাণ সাধিত হয় সেটা বোধগম্য ভাষায় তাদের সামনে তুলে ধরতে হয়। অন্যথায় আদর্শের ধারকবাহকরা সংশ্লিষ্ট সমাজের শত কল্যাণকামী হলেও জনগণ কখনও তাদের নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে না। তাদের প্রতি বাহ্যিকভাবে সম্মান জানালেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের আসনে বসার সুযোগ তাদের কখনও দিতে চায় না। আদর্শের প্রচারকদের কর্তব্য হলো নিজের কথা, আচার-আচরণ ও একই সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা জনচিত্তকে জয় করা। বলা বাহুল্য, মওলানা ভাসানী তার গোটা সংগ্রামমুখর জীবনে জনপ্রিয়তার যেই উত্তুঙ্গ চূড়ায় সমাসীন ছিলেন, এর পেছনে তার উল্লিখিত গুণাবলীই অধিক কাজ করেছিল। সমাজের সাধারণ গণমানুষ সব সময় এই অনাড়ম্বর মহান ব্যক্তিত্বকে দেখেছে নিজেদের আপন মানুষ হিসেবে। তাদের দুঃখ-দুর্গতির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে এবং এজন্য দায়ী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে তাকেই জনগণ সব সময় কাছে পেয়েছে। তারা দেখেছে, ক্ষমতায় না গিয়েও এই নিঃস্বার্থ মজলুম জননেতাকে সব সময় তাদের সমস্যাবলী নিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে সভা করে বেড়াতে এবং অত্যাচারী শাসকদের সন্ত্রস্ত করে রাখতে।
জীবন-ঘনিষ্ঠ সমস্যাবলীর সমাধানে সোচ্চারতাই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায় ভাসানীকে : সবচেয়ে বড় কথা হলো, মওলানা ভাসানী এদেশের মানুষের কল্যাণে তাদের বোধগম্য ভাষায় যে কথা বলতেন, তারা সে কথা বুঝত। তাদের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে তিনিই প্রথম সোচ্চার হয়ে উঠতেন। পক্ষান্তরে একই ‘মওলানা’ লকবে ভূষিত আরও বহু আলেম যারা নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা নিঃস্বার্থভাবে এ দেশ-জাতির সেবা করে আসছেন এবং তাদের ইহ-পরলৌকিক মুক্তির সন্ধান দিচ্ছেন, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশবাসীর হৃদয় সে রকম জয় করতে পারেননি; যেমনটি পেরেছিলেন মওলানা ভাসানী। অথচ তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও বৈষয়িক বড় বড় এমন পণ্ডিতও ছিলেন ও আছেন; যাদের ইলমের পরিধি হয়তো মওলানা ভাসানীর চেয়েও ব্যাপক ছিল। এর কারণ হলো রাজনৈতিক অঙ্গনে জনগণের জীবন-ঘনিষ্ঠ সমস্যাবলীর সমাধানকল্পে তিনিই তাদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেন, সরকারের কাছে জোরালো ভাষায় দাবি তুলতেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য নয়, জনগণের কথা বলেই মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সময় জেল খেটেছেন।
এদেশের গরিব জনগণের হৃদয় কাঙ্ক্ষিতভাবে জয় করতে ভাসানীর অনুরূপ অন্য ইসলামপন্থীরা সফল হননি। তাদের ব্যর্থতার এই ছিদ্রপথেই আমাদের দেশ-জাতির বড় সর্বনাশটি সাধিত হয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, নাস্তিকতাবাদী ও খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থাগুলো কোটি কোটি তাওহীদি জনতার সাক্ষাত্ সমস্যাবলীর সূত্র ধরে এদেশের মুসলমানদের ওলামা নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এভাবেই আমাদের দেশের ওলামা শ্রেণী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও পরে অবহেলিত হয়ে পড়েছেন; আর এ সুযোগে আজ জাতির ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ সুযোগে ইসলামের আন্তর্জাতিক বৈরীশক্তি তার সুযোগ নিতে তত্পর হয়ে উঠেছে শান্তিকামী এই মুসলিম সমাজে অনৈক্যের সৃষ্টি করে গোটা জাতির সর্বনাশ সাধনে তত্পর হয়েছে। এই আলোকে চিন্তা করলেও সংগ্রামী নেতা মওলানা।
No comments