বরিশাল আধুনিক নৌবন্দর-নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ by সাইফুর রহমান
বরিশাল নৌবন্দরের নতুন ভবন নির্মাণ, পন্টুন স্থাপনসহ বিভিন্ন কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ কাজ যথাযথভাবে না করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে দুটি দুর্ঘটনায় বন্দরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কাজে সমস্যা থাকায় ঠিকাদারেরা নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরও করতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, পন্টুন বেঁধে রাখার থামগুলো সঠিক মাপের লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়নি। একই সঙ্গে এ থামগুলোর গোড়া মাটির ৪৫ ফুট নিচে পোঁতার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ১৫ ফুট পর্যন্ত করা হয়েছে। এ কারণেই লঞ্চের সামান্য ধাক্কায় ওই থাম ভেঙে গেছে এবং পন্টুনসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি একটি লঞ্চের ধাক্কায় ৩২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভবন নির্মাণে নিম্নমানের টাইলস ও ফিটিংস ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে নৌমন্ত্রী শাজাহান চৌধুরী ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান মালেক মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল আধুনিক নৌবন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৪ দশমিক ২১ বর্গফুটের দ্বিতল ভবন ও প্রাচীর নির্মাণের জন্য দুই কোটি ৪৪ লাখ, পন্টুন নির্মাণের জন্য সাত কোটি ৫৫ লাখ, বন্দর এলাকায় খনন বাবদ তিন কোটি, জেনারেটর ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) স্থাপনে ২৫ লাখ এবং বাকি টাকা অন্যান্য কাজে ব্যয় করার কথা। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। নির্মাণকাজ পায় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, ভবন নির্মাণের কাজ মেসার্স ছালাম এন্টারপ্রাইজ, পন্টুন ও গ্যাংওয়ে নির্মাণের কাজ মেসার্স বিজলী কনস্ট্রাকশন এবং সীমানা প্রাচীর, পার্কিং শেডসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ পেয়েছে মেসার্স অনুকুল চন্দ্র সরকার নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
২০১০ সালের ৪ মার্চ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ২০১১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। পরে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় ওই সময়সীমা আগস্ট মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু সমস্যা থেকে যাওয়ায় আবারও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঠিকাদারদের বন্দর বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকাদারেরা ওই সময়েও নৌবন্দর হস্তান্তর করেননি।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, কার্যাদেশ অনুযায়ী, পন্টুন ও স্পাটের (লোহার থাম) জন্য ১৩ মিলিমিটার পুরু স্টিলের পাত ব্যবহার করার কথা। একইভাবে গ্যাংওয়ে নির্মাণের জন্য ছয় মিলিমিটার পাত এবং তিন ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি ব্যাসের লোহার অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করার কথা।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, পন্টুন ও স্পাট নির্মাণে দরপত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী স্টিলের পাত ব্যবহার করা হয়নি। এ কারণেই লঞ্চের সামান্য ধাক্কায় নৌবন্দরের পন্টুন, স্পাট, গ্যাংওয়ে, যাত্রী পারাপার সিঁড়ি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কাজে তদারকি না থাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেনতেনভাবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২৪ জুন বরিশাল নৌবন্দর পরিদর্শন শেষে সার্কিট হাউসের সভাকক্ষে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, বরিশাল বাংলাদেশের অন্যতম নৌবন্দর। এ বন্দর আধুনিক করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যে মানের কাজ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১২ জুলাই বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়া বরিশাল নৌবন্দর পরিদর্শন শেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দুর্বলতার কারণেই এ সমস্যা হয়েছে। আমরা সঠিকভাবে তদারকি করতে পারিনি। ওই সুযোগ নিয়েছেন ঠিকাদারেরা।’
মেসার্স ছালমা এন্টারপ্রাইজের অংশীদার নাহিদ সেরনিয়াবাত বলেন, ‘কাজ নিম্নমানের হয়নি। দরজা-জানালাসহ কিছু ফিটিংস সম্পর্কে অভিযোগ ছিল। আমরা সেটা ঠিক করে দিয়েছি।’ তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘কম দরে কাজ নেওয়ায় আমাদের লোকসানে পড়তে হয়েছে।’
মেসার্স বিজলী এন্টারপ্রাইজের অংশীদার জাকির হোসেন দাবি করেন, লঞ্চঘাট স্থানান্তর করে কাজ করার অনুরোধ করলেও তা করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁরা দরপত্র অনুযায়ী কাজ করেছেন। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ সঠিক নয়। খুব শিগগিরই বন্দর হস্তান্তর করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী এ জেড এম শাহনেওয়াজ কবির বলেন, ‘আমাদের বিকল্প কোনো নৌবন্দর না থাকায় একদিকে লঞ্চ নোঙর ও আনুষঙ্গিক কাজ করতে গিয়ে ভালোভাবে স্পাট বসানো সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষেত্রে বন্দর ভবনের কিছুটা সমস্যা ছিল। তবে পরে ঠিকাদারেরা এগুলো ঠিক করে দিয়েছেন।
No comments