পবিত্র কোরআনের আলো-হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ

৮. ফালাম্মা রাআশ্শামছা বা-যিগাতান ক্বা-লা হা-যা রাব্বী হা-যা আকবার। ফালাম্মা আফালাত্ ক্বা-লা ইয়া-ক্বাওমি ইন্নী বারীউম্ মিম্মা তুশরিকূন। ৭৯. ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাচ্ছামা-ওয়া-তি ওয়ালআরদ্বা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ৮০. ওয়াহা-জ্জাহূ ক্বাওমাহূ; ক্বা-লা আতুহা-জ্জূন্নী ফিল্লা-হি ওয়া ক্বাদ হাদা-নি ওয়া লা আখা-ফু মা তুশরিকূনা বিহী ইল্লা- আঁইয়্যাশা-আ রাব্বী শাইআ; ওয়াছিআ' রাব্বী কুল্লা শাইয়িন ই'লমা; আফালা তাতাযাক্কারূন।


৮১. ওয়া কাইফা আখা-ফু মা আশ্রাকতুম ওয়ালা তাখা-ফূনা আন্নাকুম আশরাক্তুম বিল্লা-হি মা লাম ইউনায্যিল্ বিহী আ'লাইকুম ছুলত্বা-না; ফাআইয়্যুল ফারীক্বাইনি আহাক্কু বিলআমনি ইন কুনতুম তা'লামূন। [সুরা : আল আনয়াম, আয়াত : ৭৮-৮১]
অনুবাদ : ৭৮. এরপর তিনি যখন সূর্যের প্রতি লক্ষ করলেন, সূর্য আলো বিচ্ছুরণ করছে; তখন মনে মনে বললেন, হয়তো এটাই আমার প্রভু, এটাই বড়। এটাও যখন ডুবে গেল, তখন ইব্রাহিম (সত্য উপলব্ধিতে সক্ষম হয়ে) তাঁর জাতিকে ডেকে বললেন, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা, তোমরা যে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে অন্য কিছুকে শরিক বানাও তা থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।
৭৯. (ইব্রাহিম বললেন) আমি নিষ্ঠার সঙ্গে সেই মহান প্রভুর দিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ করছি, যিনি এই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আমি আর মুশরিকদের দলভুক্ত নই।
৮০. এরপর তাঁর গোত্রের লোকেরা তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিল। তিনি বললেন, তোমরা কি আমার সঙ্গে স্বয়ং আল্লাহর ব্যাপারে তর্ক করছ? অথচ তিনিই আমাকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আমি আর ভয় করি না তোমাদের সেই মিথ্যা প্রভুদের, যাদের তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার বানাও_তবে আমার প্রভু যদি অন্য কিছু চান, সেটা ভিন্ন কথা। আমার প্রভুর জ্ঞান সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। এর পরও কি তোমরা সতর্ক হবে না?
৮১. আমি কিভাবে এ সবকে ভয় করব, যেগুলোকে তোমরা আল্লাহর সঙ্গে শরিক বানাও, অথচ তোমরা আল্লাহর সঙ্গে শরিক বানাতে ভয় করো না_এ ব্যাপারে তো আল্লাহর কাছ থেকে পাঠানো কোনো দলিলও তোমাদের কাছে নেই। সুতরাং দুই দলের মধ্যে কোন দলটি নিরাপত্তালাভের বেশি অধিকারী? বলো, যদি তোমরা সত্যিই জ্ঞানী হয়ে থাকো।
ব্যাখ্যা : এই আয়াতগুলোও আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এসেছে। এখানেও প্রসঙ্গ ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই সংগ্রামের কাহিনী। একত্ববাদের ভাবাদর্শই প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছিলেন। প্রথমে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন দুর্দান্ত প্রতাপশালী তাঁর পিতৃপুরুষদের সঙ্গে। পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি সংগ্রাম করেছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষদের সত্য ও ন্যায়ের পথে আনতে, মানুষের অধিকার ও আল্লাহর একক সার্বভৌমত্ব দুনিয়াবাসীর কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে। সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি সূর্যকেও জগতের প্রভু বলে কল্পনা করে দেখেছেন। কিন্তু সত্যের অন্বেষায় ও যুক্তির বিচারে তা টেকেনি। তিনি যেহেতু দুনিয়ার সব লোভ-লালসা ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহকেই খুঁজে ফিরেছেন, সেহেতু আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি সত্য জ্ঞানও লাভ করেছিলেন।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর যুগের মানুষরা সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ইত্যাদির পূজা করত। এগুলোকে তারা শক্তির অধিকর্তা বলেও বিশ্বাস করত। সে যুগের মানুষ শক্তিশালী পশু, বড় বৃক্ষ বা পাহাড়-পর্বতেরও পূজা করত। তবে তাঁর নিজ গোত্রের দেবতা ছিল শক্তির দেবতা। তিনি যখন সত্য জ্ঞান লাভ করলেন, তখন তাঁর গোত্রের মানুষদের মিথ্যা উপাস্যের আনুগত্য পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং সত্য-ন্যায়ের আনুগত্য করার আহ্বান জানালেন। এভাবেই নিজ গোত্রের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক শুরু হয় এবং বিরোধ ও শত্রুতার সূচনা হয়। এভাবেই তিনি নিজের যে অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন তা ৮৯ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা একত্ববাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষদের এক চিরন্তন ঘোষণা। ৮০ ও ৮১ নম্বর আয়াতে হজরত ইব্রাহিমের তর্ক-বিতর্ক ও যুক্তি খণ্ডনের বিষয় বিস্তারিত বলা হয়েছে। ইব্রাহিম (আ.) তাঁর জাতিকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন যে তারা শিরক, ভুল ধারণা ও অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত রয়েছে। তারা যদি শান্তি চায় তাহলে তাদের এক পালনকর্তার বিশ্বাস এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে আসতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইব্রাহিমের জাতি শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের পথে আসেনি। এদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে বহুদূর লোহিত সাগরের তীরে মক্কা এবং পরে ভূমধ্যসাগরের তীরে ফিলিস্তিনে চলে গিয়েছিলেন।
গ্রন্থনা : মাওলানা হোসেন আলী

No comments

Powered by Blogger.