চারদিক-শতবর্ষী এক স্কুলের গল্প
সাগর আর নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে ধীরে ধীরে পলি জমল। হয়ে উঠল বসবাসের উপযোগী। মগ আর পর্তুগিজরা সন্ধান পেল উর্বর এই ভূমির। ছড়িয়ে পড়ল নোয়াখালী জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হাতিয়া নামের এই দ্বীপের খবর। আজ যেটি উপজেলা, সেদিনের সেই মাটির টুকরোতে একদিন গড়ে উঠল বসতভিটা।
দূরে কোথাও থেকে মানুষের কোলাহলে জমে উঠল সেই শূন্য ভূমি। তাও কত আগে? সময়সীমা কল্পনার চার দেয়ালের বাইরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপূর্ণ সুবিশাল জলরাশি ভেদ করে ক্রমান্বয়ে উর্বর ও প্রায় সমতল এই হাতিয়া দ্বীপ সৃষ্টির অমোঘ রহস্যের আলোয় গড়ে ওঠে। ১৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ টলেমির বিবরণ (তিন হাজার বছরের নোয়াখালী) এবং ড. আবদুল করিম বিরচিত বাংলার ইতিহাস গ্রন্থের সূত্রে জুগীদিয়া, সোনাদিয়া, ট্রগিগদিয়া, গোয়াকুল, বামনী, সন্দ্বীপ, ভুলুয়া, হাতিয়া প্রভৃতি দ্বীপ তখনো জনবসতিপূর্ণ ছিল। এর অর্থ হচ্ছে ১৫০ খ্রিষ্টাব্দেও হাতিয়া একটি সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আর এ থেকেই অনুমান করা যায়, হাতিয়ার বর্তমান বয়স প্রায় তিন হাজার বছর।
যে কথা বলার জন্য এই দ্বীপের ইতিহাসের এত কথা সেই গল্প এবার। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত এই হাতিয়া দ্বীপে ছিল না কোনো মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পড়ালেখা করতে যেতে হতো বহুদূরের কোনো শহরে। প্রজন্ম বাড়ছিল এমন পরিবেশেই। এক প্রজন্ম হঠাৎ করেই বিপ্লব ঘটিয়ে বসল। অল্পসংখ্যক শিক্ষিতের মধ্যে কেউ কেউ চাইতেন দ্বীপের মানুষ মুক্তি পাক অশিক্ষার অন্ধকার থেকে। তাই দ্বীপ হাতিয়ায় শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল ব্যক্তি কচিকাঁচার দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করেন হাতিয়া ইউনিয়ন ইংলিশ হাইস্কুল। পরবর্তী সময়ে যেটি হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল হাইস্কুল নামে পরিচিতি পায়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে ১৯১৪ সালে। হাতিয়া, রামগতি ও মনপুরার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করত শিক্ষার্থীরা। বহু কৃতী শিক্ষার্থী গড়ে তোলার পেছনে এই প্রতিষ্ঠানের ছিল অসীম ভূমিকা। আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল যাঁর, তিনি প্রয়াত আবদুল মোতালেব। যিনি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। ২০১২ সালে বিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করবে। শতবর্ষের এই সময়ে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতার প্রতিও জানাতে হয় অবনত শ্রদ্ধা। শতবর্ষী এই স্কুল সাগরের বুকে বেড়ে ওঠা হাতিয়া দ্বীপের বুকে দীপ জ্বেলেছে। শুধু হাতিয়ারই নয়, আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের শিক্ষিত হওয়ার দুয়ারও খুলে দিয়েছে এই স্কুল। এই প্রতিষ্ঠান বহু শিক্ষার্থীকে কৃতী বানিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। যিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুব, ক্রীড়া ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন, যিনি ছিলেন গণপরিষদ সদস্য এবং সংবিধানপ্রণেতার মধ্যে অন্যতম। নাসার সদস্য একুশে পদকপ্রাপ্ত প্লাজমা বিজ্ঞানী ডা. মফিজ উদ্দিনের মতো অনেকেই এই বিদ্যাপীঠে শিক্ষার শুরুটা করেছিলেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকায় ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিদ্যালয়টি সরকার কর্তৃক মডেল হিসেবে উপাধি পায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়টি চারবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণরূপে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা। বারবার ভাঙে, বারবার গড়ে। তবু মাথা নোয়ানোর নয়। হাতিয়ার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে প্রতিষ্ঠানটি আলো বিলিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কাছে, সে কি খুব সহজে হার মানে? না, মানে না বলেই ১৯৯২ সাল থেকে আবার নতুন করে তার বিভিন্ন দিক অর্থাৎ অবকাঠামো ও শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রয়াস চলে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও অবকাঠামো ক্রম-উন্নতির দিকে। দ্বীপে এখনো নামকরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শতবর্ষের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোচিত।
আগেই পড়েছেন, ২০১২ সালে বিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করবে। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে শতবর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী ১৩-১৪ জানুয়ারি ২০১২ শতবর্ষ উদ্যাপন এবং প্রাক্তন ছাত্রদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৩০ নভেম্বর ধার্য করে রফিকুল আলমকে সভাপতি ও সামছুত তিব্রিজকে সমন্বয়কারী করে এই বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্যাপনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ বছরের পথচলায় যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখান থেকে বেরিয়েছে, তাদের অনেকেই জানেন না এই খবর। তবু তাঁদের পদভারে তাঁদেরই প্রিয় স্কুলের আঙিনা ভরে উঠবে—এমন আশা শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির, সর্বোপরি পুরো হাতিয়াবাসীরও। এই উৎসব এখন আর কেবল এই স্কুলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একার নয়, উৎসব পুরো হাতিয়ার প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের। তাই সবার তরফ থেকেই আগ্রহী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নাম নিবন্ধনের অনুরোধ করা হলো। বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ০১৭১২৮০২২১৩ অথবা ০১৭২০৪০৭৯৭৮ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধও জানিয়েছে উদ্যাপন কমিটি।
সাইফুদ্দিন রবিন
যে কথা বলার জন্য এই দ্বীপের ইতিহাসের এত কথা সেই গল্প এবার। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত এই হাতিয়া দ্বীপে ছিল না কোনো মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পড়ালেখা করতে যেতে হতো বহুদূরের কোনো শহরে। প্রজন্ম বাড়ছিল এমন পরিবেশেই। এক প্রজন্ম হঠাৎ করেই বিপ্লব ঘটিয়ে বসল। অল্পসংখ্যক শিক্ষিতের মধ্যে কেউ কেউ চাইতেন দ্বীপের মানুষ মুক্তি পাক অশিক্ষার অন্ধকার থেকে। তাই দ্বীপ হাতিয়ায় শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল ব্যক্তি কচিকাঁচার দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করেন হাতিয়া ইউনিয়ন ইংলিশ হাইস্কুল। পরবর্তী সময়ে যেটি হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল হাইস্কুল নামে পরিচিতি পায়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে ১৯১৪ সালে। হাতিয়া, রামগতি ও মনপুরার একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করত শিক্ষার্থীরা। বহু কৃতী শিক্ষার্থী গড়ে তোলার পেছনে এই প্রতিষ্ঠানের ছিল অসীম ভূমিকা। আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল যাঁর, তিনি প্রয়াত আবদুল মোতালেব। যিনি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। ২০১২ সালে বিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করবে। শতবর্ষের এই সময়ে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতার প্রতিও জানাতে হয় অবনত শ্রদ্ধা। শতবর্ষী এই স্কুল সাগরের বুকে বেড়ে ওঠা হাতিয়া দ্বীপের বুকে দীপ জ্বেলেছে। শুধু হাতিয়ারই নয়, আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের শিক্ষিত হওয়ার দুয়ারও খুলে দিয়েছে এই স্কুল। এই প্রতিষ্ঠান বহু শিক্ষার্থীকে কৃতী বানিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। যিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুব, ক্রীড়া ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন, যিনি ছিলেন গণপরিষদ সদস্য এবং সংবিধানপ্রণেতার মধ্যে অন্যতম। নাসার সদস্য একুশে পদকপ্রাপ্ত প্লাজমা বিজ্ঞানী ডা. মফিজ উদ্দিনের মতো অনেকেই এই বিদ্যাপীঠে শিক্ষার শুরুটা করেছিলেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকায় ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিদ্যালয়টি সরকার কর্তৃক মডেল হিসেবে উপাধি পায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়টি চারবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণরূপে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা। বারবার ভাঙে, বারবার গড়ে। তবু মাথা নোয়ানোর নয়। হাতিয়ার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে প্রতিষ্ঠানটি আলো বিলিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কাছে, সে কি খুব সহজে হার মানে? না, মানে না বলেই ১৯৯২ সাল থেকে আবার নতুন করে তার বিভিন্ন দিক অর্থাৎ অবকাঠামো ও শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রয়াস চলে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও অবকাঠামো ক্রম-উন্নতির দিকে। দ্বীপে এখনো নামকরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শতবর্ষের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোচিত।
আগেই পড়েছেন, ২০১২ সালে বিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করবে। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের উদ্যোগে শতবর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী ১৩-১৪ জানুয়ারি ২০১২ শতবর্ষ উদ্যাপন এবং প্রাক্তন ছাত্রদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৩০ নভেম্বর ধার্য করে রফিকুল আলমকে সভাপতি ও সামছুত তিব্রিজকে সমন্বয়কারী করে এই বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্যাপনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ বছরের পথচলায় যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখান থেকে বেরিয়েছে, তাদের অনেকেই জানেন না এই খবর। তবু তাঁদের পদভারে তাঁদেরই প্রিয় স্কুলের আঙিনা ভরে উঠবে—এমন আশা শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির, সর্বোপরি পুরো হাতিয়াবাসীরও। এই উৎসব এখন আর কেবল এই স্কুলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একার নয়, উৎসব পুরো হাতিয়ার প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের। তাই সবার তরফ থেকেই আগ্রহী প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নাম নিবন্ধনের অনুরোধ করা হলো। বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ০১৭১২৮০২২১৩ অথবা ০১৭২০৪০৭৯৭৮ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধও জানিয়েছে উদ্যাপন কমিটি।
সাইফুদ্দিন রবিন
No comments