কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়
১৬ জানুয়ারি প্ল্যান বাংলাদেশের সহযোগিতায় ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
এম এম নিয়াজ উদ্দিন
মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
ডা. মোহাম্মদ শরীফ
ডিরেক্টর, এমসিএইচ সার্ভিস ও লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ
সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি।
প্রফেসর এ কে এম নূর-উন-নবী
প্রকল্প পরিচালক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. মেহতাব খানম
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ডা. ইশরাত জাহান
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (এআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
ডা. সেলিনা আমিন
কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ।
অ্যাডভোকেট সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি।
ডা. কামরুন নাহার
সহযোগী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআর’বি।
সৈয়দা সেলিনা পারভীন
দলনেতা, প্রিসেট প্রজেক্ট, হাসাব
ডা. রাবেয়া খাতুন
ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার, কৈশোর স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ডা. তাহমিনা মির্জা
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য, প্ল্যান বাংলাদেশ।
লায়লা রহমান
জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা, পপুলেশন কাউন্সিল।
ডা. ইফতেখার হাসান খান
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্ল্যান বাংলাদেশ।
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি সাধারণত আলোচনায় আসে না। একজন শিশু যখন বড় হয়, তখন তার শরীর ও মনে কিছু পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনটা তার কাছে নতুন মনে হয়। এ সময় সে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। তাকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে জানতে হবে যে তার সমস্যাটা কী, করণীয় কী এবং সমাধানটা কী। এ জায়গাটায় একটা বিরাট শূন্যতা আছে। অভিভাবকেরা মনে করেন, এটাতে বলার কী আছে, আবার বলতে গেলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এসব বিষয়ে আলোচনা করছেন প্রধান অতিথি, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম এম নিয়াজউদ্দিন।
এম এম নিয়াজউদ্দিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিটি করপোরেশনের বস্তি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কিশোর-কিশোরী সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাদের মধ্যে এ প্রচার আরও বেশি করা দরকার। বাংলাদেশ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকল্প রয়েছে। আমাদের কর্মীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কিন্তু আমি মনে করি, এটা যথেষ্ট নয়। কারণ তাঁরা সব কিশোর-কিশোরীর কাছে যেতে পারছেন না। শিশুরা যখন কৈশোরে পদার্পণ করে, তখন তাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তনটা মোকাবিলা করার যথেষ্ট জ্ঞান যদি না থাকে, তাহলে অনেক সময় তারা বিপথগামী হবে। একসময় এটা জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু অভিভাবকেরা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে ইতস্তত বোধ করেন। তার থেকে বড় কথা হলো, অনেক অভিভাবক জানেন না বিষয়টি কী এবং কীভাবে আলোচনা করতে হবে। এমনকি যাঁরা শিক্ষিত, তাঁরাও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন না। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রজননস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি ছোট বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয়েছে।
আমাদেরই অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন যে তিনি একটা বই গোপনে তাঁর সন্তানের টেবিলে রেখে আসবেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর সন্তানের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে পারছেন না। শুধু উনি কেন, আমরা অনেকেই পারছি না। এ থেকে সাধারণ মানুষের অবস্থা খুব সহজেই বোঝা যায়।
এদিক থেকে আমাদের মায়েরা কিছুটা এগিয়ে আছেন। তাঁরা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে মেয়েদের সহযোগিতা করেন। আমি তাঁদের প্রশংসা করি। কিন্তু ব্যাপক প্রচার ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আমরা আপনাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাই। আপনাদের পরামর্শ সরকারকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’, ‘মা ও শিশুর যত্ন নিন’, ‘কিশোর-কিশোরীদের সহযোগিতা করুন’—এ স্লোগানগুলো খুব ছোট করে গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে, তাহলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু জাতির অনেক উপকার হবে।
সেলিনা আমিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও অভিভাবকদের করণীয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য জানার জন্য এখন কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ ব্যাপারে সরকারও একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি কর্মকৌশলপত্র বের করা হয়। কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অনেক বিষয় এখানে খুব ভালোভাবে উল্লেখ থাকে। যেমন, কী করতে হবে, কখন করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য এটি খুব সহযোগিতা করে। অতএব, এটিকে আমরা সামনে নিয়ে আসতে পারি। ২০০৬ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে একটি গবেষণাপত্র বের করা হয়েছিল। সেখানে কিশোরদের সঙ্গে বাবা-মায়ের আচরণের ধরন (গুড প্যারেন্টিং) উল্লেখ আছে। যেমন, একেক বয়সে সন্তানদের সঙ্গে একেক রকম আচরণ করতে হবে। সন্তানদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাদের ভালো পরিবেশ দিতে হবে। তারা যেন ভাবতে পারে বাবা-মা তাদের বন্ধু। তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাবা-মায়ের মধ্যে সব সময় হাসিখুশি সম্পর্ক থাকবে। আরও নানা দিক এখানে উল্লেখ আছে। আমরা প্ল্যান বাংলাদেশ থেকে কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রজননস্বাস্থ্য পরামর্শসহ কিছু সেবাদানের ব্যবস্থা করছি।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনা থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে আসছে, তা হলো, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা-বাবার খুব যত্ন নিয়ে কথা বলতে হবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠ্যপুুস্তকেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এবার বলবেন ডা. তাহমিনা মির্জা।
তাহমিনা মির্জা
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের এক-পঞ্চমাংশ কিশোর-কিশোরী। এদের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বিবাহিত। এরা প্রজনন-প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট। কিন্তু প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের অনেকের সঠিক ধারণা নেই। এ জন্য তারা গ্রাম্য চিকিৎসক, হকার-কবিরাজ ও বন্ধুদের কাছে যায়। সেখানে তারা প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে বিপদে পড়ে। এ বিষয়ে মা-বাবাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁরা যদি না জানেন, তাঁদের নিয়ে কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের কর্মশালা হয়। একজন মা কর্মশালা করার পর তাঁর মেয়েকে পাঠান। কারণ তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর মেয়ের জন্য এটি কত জরুরি। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব কিশোর-কিশোরী বাবা-মায়ের আদর-যত্ন কম পায়, তারা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হয়। যারা বেশি পারিবারিক সহায়তা পায়, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা কম। যেসব মা-বাবা প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বাসায় বা বাড়িতে কথা বলেন, তাঁদের সন্তানেরা অনেক পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে।
জহির উদ্দিন আহমেদ
ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবক সবার জন্য অবাধ তথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের যত বেশি তথ্য দেওয়া যাবে, তারা তত বেশি উপকৃত হবে। তথ্যের অভাব থাকলে নানাবিধ কুসংস্কার তাদের ঘিরে ধরবে। কিশোর-কিশোরীদের প্রজননতন্ত্র আলাদা এবং এর কার্যাবলিও ভিন্ন। ফলে এর গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে তাদের জানতে হবে। অবাধ মিলনের ফলে নানা রোগের সংক্রমণ ঘটে। এখনো বাংলাদেশের মেয়েরা স্বাস্থ্যসম্মত শোষক-পেটি (স্যানিটারি ন্যাপকিন) লুকিয়ে রাখে অন্ধকারে, স্যাঁতসেঁতে জায়গায়, বালিশের নিচে, এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে এ থেকেও মারাত্মক রোগ সংক্রমিত হতে পারে। এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অল্প বয়সে বিবাহের কারণে কিশোর-কিশোরীরা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়। ছেলেরা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত হয়। বিভিন্ন কারণে মেয়েদের শরীরে পুষ্টির অভাব থাকে, শরীর দুর্বল থাকে। এ অবস্থায় গর্ভধারণের মতো ঝুঁকি নিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। হস্তমৈথুন, স্বপ্নদোষ শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, কৈশোরের স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। যদি মনে করা হয়, এর কারণে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, তাহলে ক্ষতি হতে পরে। এখানে তথ্যের অভাব রয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন তথ্য সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করা দরকার। তাহলে তাদের মধ্যে একটা ভালো ধারণা গড়ে উঠবে। দেশের সব অভিভাবককে, কিশোর-কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে, আমরা একটি ভালো জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।
সালমা আলী
প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া দরকার সেটি যেমন হয় না, তেমনি এ বিষয়টিও আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার নয়। আমরা অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কত শতাংশ অভিভাবক এ বিষয়টি জানেন তা নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারে কিছু অধিকার আছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কিছু কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। ক্লিনিকগুলো সহিংসতার বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল, কিন্তু কোনো দিন তারা একটি ঘটনা নিয়েও আসেনি। আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থা এখনো ওই পর্যায়ে যায়নি যে বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন। আমি মনে করি, এ বিষয়ে কাজ যতটুকু হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দরকার ব্যাপক শিক্ষার উন্নতি, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে একটি বিস্তৃত পাঠক্রম। কিন্তু এখন যা আছে, সেটিও পড়ানো হয় না। শিক্ষকেরা বলেন, বাসায় পড়ে নিয়ো। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সনদে সুপারিশের কারণে নারীবান্ধব হাসপাতাল, শিশুবান্ধব হাসপাতাল করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কী অবস্থায় চলছে, তার কোনো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না। সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্য-পুষ্টির বিষয়টি এখনো সেভাবে নিশ্চিত হয়নি।
পারিবারিক সুরক্ষা ও প্রতিরোধ আইনে বৈবাহিক ও দৈহিক মিলনের বিষয়টি খুব ভালোভাবে এসেছে, যৌন হয়রানির কথা এসেছে—যেমন, স্বামী যদি যৌন নির্যাতন (অ্যাবিউজ) করে সেটা কিন্তু অ্যাবিউজ নয়, কিন্তু সে বিষয়টিও এখানে এসেছে।
যৌন নির্যাতনের মধ্যে জোর করে এবং অল্প বয়সে বিয়ের বিষয়টি আছে। শুধু এটি নয়, মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিও এখানে এসেছে।
যৌন হয়রানি নিয়ে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা (গাইড) আসছে, যেটি কিশোরীদের অনেক অধিকার নিশ্চিত করবে। এখানে বাড়ি, কর্মক্ষেত্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় নারীদের অধিকার যেন নিশ্চিত হয়, সে ব্যবস্থা আছে। এখন সময় এসেছে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাবার। প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা করতে হবে। সেটি বাড়িতে ও স্কুলে উভয় জায়গাতেই হওয়া উচিত। যৌন হয়রানি নিরসনে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দিতে হবে। যখন একজন ভুক্তভোগী আসবে তাকে আদালত, পুলিশ স্টেশন থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে হবে।
মোহাম্মদ শরীফ
কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আলোচনা হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর বিভাগীয় শহরগুলোতে একবার কর্মশালার আয়োজন করা ছাড়া খুব একটা কাজ হয় না। এ বার্তা নিয়ে কীভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
এটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে হবে। অভিভাবকদের পাশাপাশি বড় ভূমিকা স্কুলশিক্ষকদের, তাঁদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এর জন্য আমরা কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়েছি। মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণ হলো, কৈশোরে গর্ভধারণের মতো ঘটনা। এ জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব নিয়ে অধিদপ্তর থেকে আমরা কাজ করছি। এতে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করার হার বেড়েছে।
সারা দেশে স্কুল ও মাদ্রাসার প্রধানদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কৈশোরস্বাস্থ্য ও যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়। তাদের আগ্রহে বিষয়গুলো এখন পুস্তক আকারে প্রকাশের কাজ চলছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার দরকার। এখনো অনেক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। অনেক বাবা নিরাপত্তা ও সুপাত্রের জন্য মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
নূর-উন-নবী
আমাদের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার একটা অংশ আছে ‘দেখে শেখা’। মাস খানেক আগে আমরা উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা সহায়তাকেন্দ্রসহ কমিউনিটি হাসপাতালে আমরা গিয়েছি।
কমিউনিটি ক্লিনিক যখন যাত্রা শুরু করে, এর অবস্থা তখন ভালো ছিল না। মানুষের ধারণা জন্মেছিল, এটি একটি ছোট হাসপাতাল। যেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়নে একটি করে হাসপাতাল আছে। এ বিষয়ে তাদের ধারণার অভাব ছিল, কমতি ছিল সচেতনতারও। অনেকে ভাবতেন এটি যেহেতু ছোট হাসপাতাল, তাহলে ছোট রোগের ওষুধ পাওয়া যাবে।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল রাখতে হলে সমাজের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এ সম্পৃক্ততা গড়তে একটি সমর্থক দল (সাপোর্ট গ্রুপ) থাকতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবস্থান কোথায় হবে, এটি একটি বড় বিবেচ্য বিষয়। যেমন একটি বিদ্যালয়ের পাশে এ রকম ক্লিনিক থাকলে কিশোর-কিশোরীরা সহজে বিভিন্ন উপদেশ-সেবা পেতে পারে।
আমরা যে আলোচনাগুলো করি, তা সাধারণত বিমূর্ত পর্যায়ে, তার কার্যকর প্রতিফলন কী হবে, তা অনেক সময় বুঝতে পারি না, দেখতেও পারি না। আমরা যাদের জন্য পরামর্শ, সিদ্ধান্ত দিচ্ছি; তাদের এসব বিষয়ে অংশগ্রহণ করাতে হবে। কারণ, যে পরামর্শ তাদের জন্য দেব, সেটি যেন নির্দেশমূলক না হয়, তা যেন অংশগ্রহণমূলক হয়।
সামাজিক উন্নয়নে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অগ্রগতি অর্জন করলেও এ বিষয়ে আমরা খুব অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও যেমন এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা হতো, বর্তমান সময়েও তা-ই হচ্ছে।
সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব হবে কোনোভাবেই যেন কোনো সিদ্ধান্ত সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়। ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলতে হবে।
বিয়ের বয়স নিয়ে যে আইন আছে, তাতে একটি মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। আইনে নারীর ক্ষেত্রে ১৮ বছরে বিয়ে দিতে বলা হয়েছে। যদি কেউ এর ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে মা-বাবার শাস্তি হচ্ছে, কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। আরও দেখা যায়, কাবিননামায় লেখা হচ্ছে ১৮ বছর কিন্তু সত্যিকারের বয়স হচ্ছে ১৩ বা ১৪। এ জন্য জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক অনুশীলন করতে হবে।
লায়লা রহমান
আইনগতভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর। আবার সরকার ঘোষণা করেছে, ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে শিশু বলা হবে। তাহলে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই শিশুর বিয়েকে সমর্থন করছি। আইন আসলে একটি দিকনির্দেশনা দেয়; আইন যে পুরোপুরি অনুশীলন করা হয়, এমনটি নয়। আমরা সবাই এটি মেনে চলছি, তাই কেউ এর দায় এড়াতে পারি না।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ আইসিপিডি কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করে। তখন থেকে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এর জন্য কৃতিত্ব আছে সরকার, সাহায্যকারী সংস্থা ও এনজিওগুলোর। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে পপুলেশন কাউন্সিল অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে একটা গবেষণা করেছিল। এতে দেখা গেছে, শুরুতে অভিভাবকেরা প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে চান না; তাঁরা এটা শিক্ষকদের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁরা এ বিষয়ে জানতে ও জানাতে আগ্রহী হন। এখানে আমরা যাঁরা কথা বলছি, আমাদের কিন্তু দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পরিবর্তন এসেছে। অতএব, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য মিডিয়া ও শিক্ষকেরাও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। সে জন্য সংবেদনশীল ও উপস্থাপনের দক্ষতা আছে—এমন শিক্ষক নির্বাচন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
প্রজননস্বাস্থ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যৌনস্বাস্থ্য। কিন্তু এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে আমরা সংকোচ বোধ করি। বয়ঃসন্ধিকালে শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ও যৌন অনুভূতি হয়—এটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এর জন্য এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানতে ও জানাতে হবে। পপুলেশন কাউন্সিলের ওয়ান কারিকুলাম বইটি প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য এবং অধিকার বিষয়ে সম্যক ও সমৃদ্ধ দিকনির্দেশনা দেয়, যাতে ঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ ও আনন্দময় জীবন যাপন করা যায়। বইটি যে কেউ কাজে লাগাতে পারে।
রাবেয়া খাতুন
আমাদের প্রথম যেটি সক্রিয় হস্তক্ষেপের কেন্দ্র হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে নিজ ঘর। আসলে ঘর থেকেই সক্রিয় হতে হবে, যেখানে মা-বাবা প্রধান ভূমিকা পালন করেন। কৈশোরস্বাস্থ্যে কিছু সুস্পষ্ট প্রভাব অভিভাবকদের কাছ থেকে আসে। এর জন্য নিয়ন্ত্রিত আচরণ, পারিবারিক শ্রদ্ধা ও যথোপযুক্ত ব্যবহার অভিভাবকদের করা উচিত। অভিভাবকদের যা করণীয় তা যথাযথভাবে পালন করলে কিশোর-কিশোরীরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং এর মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তাদের জীবনের জন্য।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সব সময় সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এখন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি। বাংলাদেশে এইচপিএনএসডিপিতে এ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সম্মেলনে আমরা কিছু অঙ্গীকার করেছি, ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। এর মধ্যে কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অঙ্গীকার করেছি সেবা দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, অকাল গর্ভধারণ বন্ধে আমাদের কিছু অঙ্গীকার আছে। এর জন্য আমরা প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। সরকারকে এ বিষয়ে আমরা সহায়তা করেছি। তারাও এগিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত দুটি অধিদপ্তর যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে যে অঙ্গীকার করেছি, তা বাস্তবায়নে সুবিধা হবে।
সন্তান লালনপালনে অভিভাবকদের ভূমিকা কী হবে, তার দিকনির্দেশনা দরকার। এ ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যে কাজ করবে, তা নিয়ে আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখন তা করতে চেষ্টা করব।
ইশরাত জাহান
আমাদের প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়ের গভীরে ঢুকতে হবে। তা ছাড়া এর পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এ জন্য সঠিক তথ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের এর মধ্যে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। তা ছাড়া সম্প্রদায়ের ভূমিকা তো থাকতেই হবে।
আমাদের অধিকাংশ অভিভাবকই চিকিৎসার বিষয়ে খুব বেশি শিক্ষিত নন। অতএব কোন তথ্য দেব, কখন দেব, তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাঁদের তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন, তিনি একজন অভিভাবকও বটে। সে জন্য অভিভাবক ও শিক্ষক দুই পক্ষকেই কাজে লাগাতে হবে।
আমরা যখন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারণা চালিয়েছি, কৈশোরস্বাস্থ্যের যে পরিবর্তন তা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছি। এতে দেখা গেছে, মসজিদের ইমামসহ সবাই এ বিষয়ে খোলামেলা জানতে চেয়েছেন। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের কিন্তু আরও এগোতে হবে।
কামরুন নাহার
আমি অভিভাবকদের করণীয় বিষয়গুলো দুই ভাগে ভাগ করি। প্রথমত, অভিভাবকেরা নিজেরাই জানেন না, তাঁদের জানা দরকার। দ্বিতীয়ত, তাঁরা আসলে কিশোর-কিশোরীদের কী তথ্য জানাবেন?
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন আসে। এ সময় তাদের এ পরিবর্তন নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে তাদের এ তথ্যগুলো দিতে হবে। আজ বিশ্বায়নের যুগে তারা নানাভাবে তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু কোন তথ্য আমাদের সংস্কৃতির জন্য উপযুক্ত, সে জিনিসটি মাথায় রাখতে হবে।
কোন বয়সে কোন তথ্য দরকার, এটি নির্দিষ্ট করে তথ্য প্রদান যদিও কষ্টসাধ্য; তবু এ কাজটি করতে হবে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর বা কিশোরী তাদের অভিভাবক অথবা শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যগত তথ্য পাওয়ার চেয়ে তারা নিজেদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়াকে উপযুক্ত ভেবেছে। যেমন—এ বিষয়ে তারা যদি একটি বই পড়ে তাহলে কিন্তু আর অভিভাবক বা শিক্ষকের কাছে যেতে হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বি বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গবেষণা করছে। একজন কিশোর বা কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কোনো তথ্য দিতে গেলে কী কী বিষয়ে, কীভাবে দিলে তাদের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয় এবং তা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কতটা উপযোগী, এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করি, তাহলেই এ বিষয়গুলো সহজ হয়ে আসবে।
ইফতেখার হাসান খান
আমরা মূলত ঐতিহ্যগতভাবেই প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি। দেশের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই কিশোর-কিশোরী আর প্রতি এক হাজার জন গর্ভবতী মহিলার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছয়জন কিশোরী গর্ভবতী, যার সঙ্গে আবার বাল্যবিবাহ জড়িত। বাংলাদেশে চার কোটি কিশোর-কিশোরী আছে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো অন্যতম। এ ছাড়া অনেকে বাল্যবিবাহের কুফল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানে না।
বাল্যবিবাহ বন্ধে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, বিয়ে নিবন্ধন করা দরকার। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে এবং প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি।
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য সর্বজনীন করতে মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসতে পারে। তারা হটলাইনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে এ সেবা দিতে পারে। এর বাইরে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের পড়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে ‘প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায়’ দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সৈয়দা সেলিনা পারভীন
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অন্তত ১০ বছর ধরে কাজ হচ্ছে। এতে যে সমস্যাগুলো দেখা গেছে তার প্রধান হলো, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ধরে রাখা। যেহেতু এটি প্রকল্পভিত্তিক হয়ে থাকে, তার মেয়াদ শেষ হলেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারই পারে প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি রূপ দিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত যে অধিদপ্তর দুটি আছে, তাদের যে মাঠকর্মী এবং অবকাঠামো আছে, তা একটি বিরাট সুযোগ। মাঠকর্মীদের কাজের মধ্যে এ বিষয়টি সংযোজন করা যেতে পারে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। এ জন্য কর্মশালা, আলোচনা ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে দুটি বিষয় যোগ করতে হবে। প্রথমত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠকর্মীদের। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। কারণ, সংবাদপত্র পড়তে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে, কিন্তু টিভিতে প্রচারিত তথ্য সবার জন্যই বোধগম্য।
মেহতাব খানম
আমরা সবাই গণমাধ্যমের কথা বলছি। আমরা জানি, অধিকাংশ গণমাধ্যম কীভাবে চলছে, তাদের মান কেমন। আর সেখানে যাঁরা কাজ করছেন, সেসব গণমাধ্যমকর্মী এ বিষয়ে শিক্ষিত কি না, তা আগে দেখতে হবে।
প্রথমত, তাঁদের মনের উন্নতি ঘটাতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, গণমাধ্যমগুলোতে নেতিবাচক খবর বেশি প্রচার হয়। আমরা কেন ইতিবাচক খবর পরিবেশন করব না। শুধু বাল্যবিবাহ হলেই খবর প্রচারিত হবে, যেসব অভিভাবক বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন না, তাঁদের নিয়ে কেন খবর হবে না। এ দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিকভাবে সন্তান লালনপালন পদ্ধতি (প্যারেন্টিং)। এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, আমরা ভুলভাবে বাচ্চাদের বড় করছি। আজকাল ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু সন্তানের ওপর মা-বাবার শাস্তি কে বন্ধ করবে। এ জন্য বাড়িটাকে স্বাস্থ্যকর করতে হবে। কারণ, একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবকও বটে। আমাদের স্কুলগুলোতে দুটি বিষয় ঐচ্ছিক আছে। একটি কৃষি এবং অন্যটি গার্হস্থ্য শিক্ষা। এর মধ্যে গার্হস্থ্য শিক্ষা শুধু মেয়েদের পড়ানো হয়। আমি মনে করি, গার্হস্থ্য শিক্ষাকে আবশ্যিক করা উচিত। আর এ স্পর্শকাতর বিষয় পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা সবার আলোচনা শুনলাম। সবকিছু মিলিয়ে সমাপনী আলোচনা করছেন এম এম নিয়াজ উদ্দিন।
এম এম নিয়াজ উদ্দিন
আজ আলোচনার যে বিষয়গুলো এসেছে, তা যেন আমরা সবাই চর্চা করি, বিশেষ করে, গণমাধ্যমগুলো যেন এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে বিভাগীয় শহরগুলোতে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। যেখানে স্কুল, কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবী, জনপ্রশাসনের লোক, অভিভাবক এবং কিশোর-কিশোরীদের উপস্থিত রাখা হয়। এ কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যায়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে যতটা কাজ হওয়া দরকার, হয়তো ততটা হচ্ছে না। ব্যাপক কাজ কিন্তু হচ্ছে। এ অধিদপ্তরের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখানে দীর্ঘ ১৪ বছরে কোনো নিয়োগ ছিল না। প্রায় ১৫-২০ হাজার শূন্যপদ ছিল, যার মধ্যে সাত হাজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শূন্যপদগুলো পূরণ হলে আমরা আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারব।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ সবাইকে।
এম এম নিয়াজ উদ্দিন
মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
ডা. মোহাম্মদ শরীফ
ডিরেক্টর, এমসিএইচ সার্ভিস ও লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ
সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি।
প্রফেসর এ কে এম নূর-উন-নবী
প্রকল্প পরিচালক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. মেহতাব খানম
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ডা. ইশরাত জাহান
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (এআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
ডা. সেলিনা আমিন
কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ।
অ্যাডভোকেট সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি।
ডা. কামরুন নাহার
সহযোগী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআর’বি।
সৈয়দা সেলিনা পারভীন
দলনেতা, প্রিসেট প্রজেক্ট, হাসাব
ডা. রাবেয়া খাতুন
ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার, কৈশোর স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ডা. তাহমিনা মির্জা
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য, প্ল্যান বাংলাদেশ।
লায়লা রহমান
জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা, পপুলেশন কাউন্সিল।
ডা. ইফতেখার হাসান খান
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্ল্যান বাংলাদেশ।
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি সাধারণত আলোচনায় আসে না। একজন শিশু যখন বড় হয়, তখন তার শরীর ও মনে কিছু পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনটা তার কাছে নতুন মনে হয়। এ সময় সে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। তাকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে জানতে হবে যে তার সমস্যাটা কী, করণীয় কী এবং সমাধানটা কী। এ জায়গাটায় একটা বিরাট শূন্যতা আছে। অভিভাবকেরা মনে করেন, এটাতে বলার কী আছে, আবার বলতে গেলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এসব বিষয়ে আলোচনা করছেন প্রধান অতিথি, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম এম নিয়াজউদ্দিন।
এম এম নিয়াজউদ্দিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিটি করপোরেশনের বস্তি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কিশোর-কিশোরী সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাদের মধ্যে এ প্রচার আরও বেশি করা দরকার। বাংলাদেশ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকল্প রয়েছে। আমাদের কর্মীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কিন্তু আমি মনে করি, এটা যথেষ্ট নয়। কারণ তাঁরা সব কিশোর-কিশোরীর কাছে যেতে পারছেন না। শিশুরা যখন কৈশোরে পদার্পণ করে, তখন তাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তনটা মোকাবিলা করার যথেষ্ট জ্ঞান যদি না থাকে, তাহলে অনেক সময় তারা বিপথগামী হবে। একসময় এটা জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু অভিভাবকেরা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে ইতস্তত বোধ করেন। তার থেকে বড় কথা হলো, অনেক অভিভাবক জানেন না বিষয়টি কী এবং কীভাবে আলোচনা করতে হবে। এমনকি যাঁরা শিক্ষিত, তাঁরাও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন না। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রজননস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি ছোট বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয়েছে।
আমাদেরই অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন যে তিনি একটা বই গোপনে তাঁর সন্তানের টেবিলে রেখে আসবেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর সন্তানের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে পারছেন না। শুধু উনি কেন, আমরা অনেকেই পারছি না। এ থেকে সাধারণ মানুষের অবস্থা খুব সহজেই বোঝা যায়।
এদিক থেকে আমাদের মায়েরা কিছুটা এগিয়ে আছেন। তাঁরা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে মেয়েদের সহযোগিতা করেন। আমি তাঁদের প্রশংসা করি। কিন্তু ব্যাপক প্রচার ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আমরা আপনাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাই। আপনাদের পরামর্শ সরকারকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’, ‘মা ও শিশুর যত্ন নিন’, ‘কিশোর-কিশোরীদের সহযোগিতা করুন’—এ স্লোগানগুলো খুব ছোট করে গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে, তাহলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু জাতির অনেক উপকার হবে।
সেলিনা আমিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও অভিভাবকদের করণীয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য জানার জন্য এখন কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এ ব্যাপারে সরকারও একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি কর্মকৌশলপত্র বের করা হয়। কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অনেক বিষয় এখানে খুব ভালোভাবে উল্লেখ থাকে। যেমন, কী করতে হবে, কখন করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য এটি খুব সহযোগিতা করে। অতএব, এটিকে আমরা সামনে নিয়ে আসতে পারি। ২০০৬ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে একটি গবেষণাপত্র বের করা হয়েছিল। সেখানে কিশোরদের সঙ্গে বাবা-মায়ের আচরণের ধরন (গুড প্যারেন্টিং) উল্লেখ আছে। যেমন, একেক বয়সে সন্তানদের সঙ্গে একেক রকম আচরণ করতে হবে। সন্তানদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাদের ভালো পরিবেশ দিতে হবে। তারা যেন ভাবতে পারে বাবা-মা তাদের বন্ধু। তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাবা-মায়ের মধ্যে সব সময় হাসিখুশি সম্পর্ক থাকবে। আরও নানা দিক এখানে উল্লেখ আছে। আমরা প্ল্যান বাংলাদেশ থেকে কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রজননস্বাস্থ্য পরামর্শসহ কিছু সেবাদানের ব্যবস্থা করছি।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনা থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে আসছে, তা হলো, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা-বাবার খুব যত্ন নিয়ে কথা বলতে হবে। শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠ্যপুুস্তকেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এবার বলবেন ডা. তাহমিনা মির্জা।
তাহমিনা মির্জা
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের এক-পঞ্চমাংশ কিশোর-কিশোরী। এদের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বিবাহিত। এরা প্রজনন-প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট। কিন্তু প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের অনেকের সঠিক ধারণা নেই। এ জন্য তারা গ্রাম্য চিকিৎসক, হকার-কবিরাজ ও বন্ধুদের কাছে যায়। সেখানে তারা প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে বিপদে পড়ে। এ বিষয়ে মা-বাবাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁরা যদি না জানেন, তাঁদের নিয়ে কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের কর্মশালা হয়। একজন মা কর্মশালা করার পর তাঁর মেয়েকে পাঠান। কারণ তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর মেয়ের জন্য এটি কত জরুরি। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব কিশোর-কিশোরী বাবা-মায়ের আদর-যত্ন কম পায়, তারা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হয়। যারা বেশি পারিবারিক সহায়তা পায়, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা কম। যেসব মা-বাবা প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বাসায় বা বাড়িতে কথা বলেন, তাঁদের সন্তানেরা অনেক পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে।
জহির উদ্দিন আহমেদ
ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবক সবার জন্য অবাধ তথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের যত বেশি তথ্য দেওয়া যাবে, তারা তত বেশি উপকৃত হবে। তথ্যের অভাব থাকলে নানাবিধ কুসংস্কার তাদের ঘিরে ধরবে। কিশোর-কিশোরীদের প্রজননতন্ত্র আলাদা এবং এর কার্যাবলিও ভিন্ন। ফলে এর গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে তাদের জানতে হবে। অবাধ মিলনের ফলে নানা রোগের সংক্রমণ ঘটে। এখনো বাংলাদেশের মেয়েরা স্বাস্থ্যসম্মত শোষক-পেটি (স্যানিটারি ন্যাপকিন) লুকিয়ে রাখে অন্ধকারে, স্যাঁতসেঁতে জায়গায়, বালিশের নিচে, এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে এ থেকেও মারাত্মক রোগ সংক্রমিত হতে পারে। এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অল্প বয়সে বিবাহের কারণে কিশোর-কিশোরীরা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়। ছেলেরা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত হয়। বিভিন্ন কারণে মেয়েদের শরীরে পুষ্টির অভাব থাকে, শরীর দুর্বল থাকে। এ অবস্থায় গর্ভধারণের মতো ঝুঁকি নিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। হস্তমৈথুন, স্বপ্নদোষ শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, কৈশোরের স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। যদি মনে করা হয়, এর কারণে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, তাহলে ক্ষতি হতে পরে। এখানে তথ্যের অভাব রয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন তথ্য সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করা দরকার। তাহলে তাদের মধ্যে একটা ভালো ধারণা গড়ে উঠবে। দেশের সব অভিভাবককে, কিশোর-কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে, আমরা একটি ভালো জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।
সালমা আলী
প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া দরকার সেটি যেমন হয় না, তেমনি এ বিষয়টিও আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার নয়। আমরা অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কত শতাংশ অভিভাবক এ বিষয়টি জানেন তা নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারে কিছু অধিকার আছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কিছু কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। ক্লিনিকগুলো সহিংসতার বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল, কিন্তু কোনো দিন তারা একটি ঘটনা নিয়েও আসেনি। আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থা এখনো ওই পর্যায়ে যায়নি যে বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন। আমি মনে করি, এ বিষয়ে কাজ যতটুকু হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দরকার ব্যাপক শিক্ষার উন্নতি, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে একটি বিস্তৃত পাঠক্রম। কিন্তু এখন যা আছে, সেটিও পড়ানো হয় না। শিক্ষকেরা বলেন, বাসায় পড়ে নিয়ো। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সনদে সুপারিশের কারণে নারীবান্ধব হাসপাতাল, শিশুবান্ধব হাসপাতাল করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কী অবস্থায় চলছে, তার কোনো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না। সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্য-পুষ্টির বিষয়টি এখনো সেভাবে নিশ্চিত হয়নি।
পারিবারিক সুরক্ষা ও প্রতিরোধ আইনে বৈবাহিক ও দৈহিক মিলনের বিষয়টি খুব ভালোভাবে এসেছে, যৌন হয়রানির কথা এসেছে—যেমন, স্বামী যদি যৌন নির্যাতন (অ্যাবিউজ) করে সেটা কিন্তু অ্যাবিউজ নয়, কিন্তু সে বিষয়টিও এখানে এসেছে।
যৌন নির্যাতনের মধ্যে জোর করে এবং অল্প বয়সে বিয়ের বিষয়টি আছে। শুধু এটি নয়, মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিও এখানে এসেছে।
যৌন হয়রানি নিয়ে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা (গাইড) আসছে, যেটি কিশোরীদের অনেক অধিকার নিশ্চিত করবে। এখানে বাড়ি, কর্মক্ষেত্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় নারীদের অধিকার যেন নিশ্চিত হয়, সে ব্যবস্থা আছে। এখন সময় এসেছে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাবার। প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা করতে হবে। সেটি বাড়িতে ও স্কুলে উভয় জায়গাতেই হওয়া উচিত। যৌন হয়রানি নিরসনে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দিতে হবে। যখন একজন ভুক্তভোগী আসবে তাকে আদালত, পুলিশ স্টেশন থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে হবে।
মোহাম্মদ শরীফ
কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আলোচনা হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর বিভাগীয় শহরগুলোতে একবার কর্মশালার আয়োজন করা ছাড়া খুব একটা কাজ হয় না। এ বার্তা নিয়ে কীভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
এটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে হবে। অভিভাবকদের পাশাপাশি বড় ভূমিকা স্কুলশিক্ষকদের, তাঁদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এর জন্য আমরা কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়েছি। মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণ হলো, কৈশোরে গর্ভধারণের মতো ঘটনা। এ জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব নিয়ে অধিদপ্তর থেকে আমরা কাজ করছি। এতে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করার হার বেড়েছে।
সারা দেশে স্কুল ও মাদ্রাসার প্রধানদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কৈশোরস্বাস্থ্য ও যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়। তাদের আগ্রহে বিষয়গুলো এখন পুস্তক আকারে প্রকাশের কাজ চলছে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার দরকার। এখনো অনেক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। অনেক বাবা নিরাপত্তা ও সুপাত্রের জন্য মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
নূর-উন-নবী
আমাদের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার একটা অংশ আছে ‘দেখে শেখা’। মাস খানেক আগে আমরা উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা সহায়তাকেন্দ্রসহ কমিউনিটি হাসপাতালে আমরা গিয়েছি।
কমিউনিটি ক্লিনিক যখন যাত্রা শুরু করে, এর অবস্থা তখন ভালো ছিল না। মানুষের ধারণা জন্মেছিল, এটি একটি ছোট হাসপাতাল। যেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়নে একটি করে হাসপাতাল আছে। এ বিষয়ে তাদের ধারণার অভাব ছিল, কমতি ছিল সচেতনতারও। অনেকে ভাবতেন এটি যেহেতু ছোট হাসপাতাল, তাহলে ছোট রোগের ওষুধ পাওয়া যাবে।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল রাখতে হলে সমাজের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এ সম্পৃক্ততা গড়তে একটি সমর্থক দল (সাপোর্ট গ্রুপ) থাকতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবস্থান কোথায় হবে, এটি একটি বড় বিবেচ্য বিষয়। যেমন একটি বিদ্যালয়ের পাশে এ রকম ক্লিনিক থাকলে কিশোর-কিশোরীরা সহজে বিভিন্ন উপদেশ-সেবা পেতে পারে।
আমরা যে আলোচনাগুলো করি, তা সাধারণত বিমূর্ত পর্যায়ে, তার কার্যকর প্রতিফলন কী হবে, তা অনেক সময় বুঝতে পারি না, দেখতেও পারি না। আমরা যাদের জন্য পরামর্শ, সিদ্ধান্ত দিচ্ছি; তাদের এসব বিষয়ে অংশগ্রহণ করাতে হবে। কারণ, যে পরামর্শ তাদের জন্য দেব, সেটি যেন নির্দেশমূলক না হয়, তা যেন অংশগ্রহণমূলক হয়।
সামাজিক উন্নয়নে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অগ্রগতি অর্জন করলেও এ বিষয়ে আমরা খুব অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও যেমন এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা হতো, বর্তমান সময়েও তা-ই হচ্ছে।
সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব হবে কোনোভাবেই যেন কোনো সিদ্ধান্ত সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়। ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলতে হবে।
বিয়ের বয়স নিয়ে যে আইন আছে, তাতে একটি মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। আইনে নারীর ক্ষেত্রে ১৮ বছরে বিয়ে দিতে বলা হয়েছে। যদি কেউ এর ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে মা-বাবার শাস্তি হচ্ছে, কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। আরও দেখা যায়, কাবিননামায় লেখা হচ্ছে ১৮ বছর কিন্তু সত্যিকারের বয়স হচ্ছে ১৩ বা ১৪। এ জন্য জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক অনুশীলন করতে হবে।
লায়লা রহমান
আইনগতভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর। আবার সরকার ঘোষণা করেছে, ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে শিশু বলা হবে। তাহলে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই শিশুর বিয়েকে সমর্থন করছি। আইন আসলে একটি দিকনির্দেশনা দেয়; আইন যে পুরোপুরি অনুশীলন করা হয়, এমনটি নয়। আমরা সবাই এটি মেনে চলছি, তাই কেউ এর দায় এড়াতে পারি না।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ আইসিপিডি কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করে। তখন থেকে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এর জন্য কৃতিত্ব আছে সরকার, সাহায্যকারী সংস্থা ও এনজিওগুলোর। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে পপুলেশন কাউন্সিল অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে একটা গবেষণা করেছিল। এতে দেখা গেছে, শুরুতে অভিভাবকেরা প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে চান না; তাঁরা এটা শিক্ষকদের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁরা এ বিষয়ে জানতে ও জানাতে আগ্রহী হন। এখানে আমরা যাঁরা কথা বলছি, আমাদের কিন্তু দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পরিবর্তন এসেছে। অতএব, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য মিডিয়া ও শিক্ষকেরাও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। সে জন্য সংবেদনশীল ও উপস্থাপনের দক্ষতা আছে—এমন শিক্ষক নির্বাচন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
প্রজননস্বাস্থ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যৌনস্বাস্থ্য। কিন্তু এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে আমরা সংকোচ বোধ করি। বয়ঃসন্ধিকালে শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ও যৌন অনুভূতি হয়—এটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এর জন্য এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানতে ও জানাতে হবে। পপুলেশন কাউন্সিলের ওয়ান কারিকুলাম বইটি প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য এবং অধিকার বিষয়ে সম্যক ও সমৃদ্ধ দিকনির্দেশনা দেয়, যাতে ঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ ও আনন্দময় জীবন যাপন করা যায়। বইটি যে কেউ কাজে লাগাতে পারে।
রাবেয়া খাতুন
আমাদের প্রথম যেটি সক্রিয় হস্তক্ষেপের কেন্দ্র হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে নিজ ঘর। আসলে ঘর থেকেই সক্রিয় হতে হবে, যেখানে মা-বাবা প্রধান ভূমিকা পালন করেন। কৈশোরস্বাস্থ্যে কিছু সুস্পষ্ট প্রভাব অভিভাবকদের কাছ থেকে আসে। এর জন্য নিয়ন্ত্রিত আচরণ, পারিবারিক শ্রদ্ধা ও যথোপযুক্ত ব্যবহার অভিভাবকদের করা উচিত। অভিভাবকদের যা করণীয় তা যথাযথভাবে পালন করলে কিশোর-কিশোরীরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং এর মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তাদের জীবনের জন্য।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সব সময় সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। এখন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি। বাংলাদেশে এইচপিএনএসডিপিতে এ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সম্মেলনে আমরা কিছু অঙ্গীকার করেছি, ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। এর মধ্যে কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অঙ্গীকার করেছি সেবা দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, অকাল গর্ভধারণ বন্ধে আমাদের কিছু অঙ্গীকার আছে। এর জন্য আমরা প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। সরকারকে এ বিষয়ে আমরা সহায়তা করেছি। তারাও এগিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত দুটি অধিদপ্তর যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে যে অঙ্গীকার করেছি, তা বাস্তবায়নে সুবিধা হবে।
সন্তান লালনপালনে অভিভাবকদের ভূমিকা কী হবে, তার দিকনির্দেশনা দরকার। এ ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যে কাজ করবে, তা নিয়ে আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখন তা করতে চেষ্টা করব।
ইশরাত জাহান
আমাদের প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়ের গভীরে ঢুকতে হবে। তা ছাড়া এর পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এ জন্য সঠিক তথ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের এর মধ্যে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। তা ছাড়া সম্প্রদায়ের ভূমিকা তো থাকতেই হবে।
আমাদের অধিকাংশ অভিভাবকই চিকিৎসার বিষয়ে খুব বেশি শিক্ষিত নন। অতএব কোন তথ্য দেব, কখন দেব, তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাঁদের তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন, তিনি একজন অভিভাবকও বটে। সে জন্য অভিভাবক ও শিক্ষক দুই পক্ষকেই কাজে লাগাতে হবে।
আমরা যখন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারণা চালিয়েছি, কৈশোরস্বাস্থ্যের যে পরিবর্তন তা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছি। এতে দেখা গেছে, মসজিদের ইমামসহ সবাই এ বিষয়ে খোলামেলা জানতে চেয়েছেন। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের কিন্তু আরও এগোতে হবে।
কামরুন নাহার
আমি অভিভাবকদের করণীয় বিষয়গুলো দুই ভাগে ভাগ করি। প্রথমত, অভিভাবকেরা নিজেরাই জানেন না, তাঁদের জানা দরকার। দ্বিতীয়ত, তাঁরা আসলে কিশোর-কিশোরীদের কী তথ্য জানাবেন?
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন আসে। এ সময় তাদের এ পরিবর্তন নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে তাদের এ তথ্যগুলো দিতে হবে। আজ বিশ্বায়নের যুগে তারা নানাভাবে তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু কোন তথ্য আমাদের সংস্কৃতির জন্য উপযুক্ত, সে জিনিসটি মাথায় রাখতে হবে।
কোন বয়সে কোন তথ্য দরকার, এটি নির্দিষ্ট করে তথ্য প্রদান যদিও কষ্টসাধ্য; তবু এ কাজটি করতে হবে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর বা কিশোরী তাদের অভিভাবক অথবা শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যগত তথ্য পাওয়ার চেয়ে তারা নিজেদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়াকে উপযুক্ত ভেবেছে। যেমন—এ বিষয়ে তারা যদি একটি বই পড়ে তাহলে কিন্তু আর অভিভাবক বা শিক্ষকের কাছে যেতে হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বি বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গবেষণা করছে। একজন কিশোর বা কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কোনো তথ্য দিতে গেলে কী কী বিষয়ে, কীভাবে দিলে তাদের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয় এবং তা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কতটা উপযোগী, এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করি, তাহলেই এ বিষয়গুলো সহজ হয়ে আসবে।
ইফতেখার হাসান খান
আমরা মূলত ঐতিহ্যগতভাবেই প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি। দেশের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই কিশোর-কিশোরী আর প্রতি এক হাজার জন গর্ভবতী মহিলার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছয়জন কিশোরী গর্ভবতী, যার সঙ্গে আবার বাল্যবিবাহ জড়িত। বাংলাদেশে চার কোটি কিশোর-কিশোরী আছে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো অন্যতম। এ ছাড়া অনেকে বাল্যবিবাহের কুফল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানে না।
বাল্যবিবাহ বন্ধে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, বিয়ে নিবন্ধন করা দরকার। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে এবং প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি।
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য সর্বজনীন করতে মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসতে পারে। তারা হটলাইনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে এ সেবা দিতে পারে। এর বাইরে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের পড়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে ‘প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায়’ দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সৈয়দা সেলিনা পারভীন
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অন্তত ১০ বছর ধরে কাজ হচ্ছে। এতে যে সমস্যাগুলো দেখা গেছে তার প্রধান হলো, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ধরে রাখা। যেহেতু এটি প্রকল্পভিত্তিক হয়ে থাকে, তার মেয়াদ শেষ হলেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারই পারে প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি রূপ দিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত যে অধিদপ্তর দুটি আছে, তাদের যে মাঠকর্মী এবং অবকাঠামো আছে, তা একটি বিরাট সুযোগ। মাঠকর্মীদের কাজের মধ্যে এ বিষয়টি সংযোজন করা যেতে পারে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। এ জন্য কর্মশালা, আলোচনা ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে দুটি বিষয় যোগ করতে হবে। প্রথমত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠকর্মীদের। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। কারণ, সংবাদপত্র পড়তে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে, কিন্তু টিভিতে প্রচারিত তথ্য সবার জন্যই বোধগম্য।
মেহতাব খানম
আমরা সবাই গণমাধ্যমের কথা বলছি। আমরা জানি, অধিকাংশ গণমাধ্যম কীভাবে চলছে, তাদের মান কেমন। আর সেখানে যাঁরা কাজ করছেন, সেসব গণমাধ্যমকর্মী এ বিষয়ে শিক্ষিত কি না, তা আগে দেখতে হবে।
প্রথমত, তাঁদের মনের উন্নতি ঘটাতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, গণমাধ্যমগুলোতে নেতিবাচক খবর বেশি প্রচার হয়। আমরা কেন ইতিবাচক খবর পরিবেশন করব না। শুধু বাল্যবিবাহ হলেই খবর প্রচারিত হবে, যেসব অভিভাবক বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন না, তাঁদের নিয়ে কেন খবর হবে না। এ দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিকভাবে সন্তান লালনপালন পদ্ধতি (প্যারেন্টিং)। এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, আমরা ভুলভাবে বাচ্চাদের বড় করছি। আজকাল ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু সন্তানের ওপর মা-বাবার শাস্তি কে বন্ধ করবে। এ জন্য বাড়িটাকে স্বাস্থ্যকর করতে হবে। কারণ, একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবকও বটে। আমাদের স্কুলগুলোতে দুটি বিষয় ঐচ্ছিক আছে। একটি কৃষি এবং অন্যটি গার্হস্থ্য শিক্ষা। এর মধ্যে গার্হস্থ্য শিক্ষা শুধু মেয়েদের পড়ানো হয়। আমি মনে করি, গার্হস্থ্য শিক্ষাকে আবশ্যিক করা উচিত। আর এ স্পর্শকাতর বিষয় পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা সবার আলোচনা শুনলাম। সবকিছু মিলিয়ে সমাপনী আলোচনা করছেন এম এম নিয়াজ উদ্দিন।
এম এম নিয়াজ উদ্দিন
আজ আলোচনার যে বিষয়গুলো এসেছে, তা যেন আমরা সবাই চর্চা করি, বিশেষ করে, গণমাধ্যমগুলো যেন এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে বিভাগীয় শহরগুলোতে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। যেখানে স্কুল, কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবী, জনপ্রশাসনের লোক, অভিভাবক এবং কিশোর-কিশোরীদের উপস্থিত রাখা হয়। এ কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যায়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে যতটা কাজ হওয়া দরকার, হয়তো ততটা হচ্ছে না। ব্যাপক কাজ কিন্তু হচ্ছে। এ অধিদপ্তরের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখানে দীর্ঘ ১৪ বছরে কোনো নিয়োগ ছিল না। প্রায় ১৫-২০ হাজার শূন্যপদ ছিল, যার মধ্যে সাত হাজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শূন্যপদগুলো পূরণ হলে আমরা আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারব।
আব্দুল কাইয়ুম
আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ সবাইকে।
No comments