বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-ভিজিএফ কর্মসূচি : কার খাবার কে খায়! by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

ত ৮ সেপ্টেম্বর এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিবেদনে প্রকাশ, দুর্নীতির কারণে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া খাদ্য প্রকৃত গরিব মানুষের কাছে পেঁৗছায় না। দারিদ্র্যের কারণে খাদ্যঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া কর্মসূচি ভারনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) কর্মসূচির ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে তারা এই চিত্র উন্মোচন করেছে।


এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছে, শুধু সাতটি গ্রামের এক হাজার পরিবার ভিজিএফ কার্ড পেয়েছে; কিন্তু ছয়টি গ্রামের কোনো গরিব মানুষই কার্ড পায়নি। বরাদ্দকৃত কার্ড বিতরণের কিংবা তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুযোগে এ ক্ষেত্রে নানা কৌশলে দুর্নীতি হচ্ছে_এ অভিযোগ উঠেছিল প্রকল্পটি শুরুর পরপরই। রাজনৈতিক দলের অসাধু নেতা-কর্মী এসব কার্ডের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিজেদের পকেটস্থ করে নিচ্ছেন_এ খবরও আগেই মিডিয়ায় এসেছিল। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের তরফে রুটিন প্রতিক্রিয়া দেখানো দুঃখজনক, এবং প্রশ্নবোধকও। বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে যে ১০টি কর্মসূচি দেশব্যাপী বিস্তৃত, এর অন্যতম হলো ভারনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা অরক্ষিত শ্রেণীকে খাদ্য জোগানো। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে প্রকল্প দুর্নীতির অতীত যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে, তা অত্যন্ত অপ্রীতিকর। এর ফলে গরিবের বঞ্চনা যেমন ক্রমে বাড়ছে, তেমনি গরিবদের নিয়ে প্রতারণার নানা জালও বিস্তৃত হচ্ছে। আরো অভিযোগ রয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভৌতিক শ্রমিক পাওয়া গেছে, অর্থাৎ যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তা ছাড়া এসব প্রকল্পে নাম তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনও হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বিপুল জনরায়ে নির্বাচিত মহাজোট সরকারের আমলে অতীতের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটবে না; কিন্তু আশা শেষ পর্যন্ত দুরাশায়ই রূপান্তর হলো। একদিকে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই, অন্যদিকে যারা খাদ্যঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের ওপর থাবা বসানোর অপক্রিয়াও থেমে নেই।
আগেই বলেছি, সীমিত সম্পদ ও নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে সরকার দরিদ্রদের জন্য নানাভাবে ভর্তুকি দিয়ে আসছে, যার মধ্যে খাদ্য একটি। কিন্তু গরিবের অধিকারে থাবা বসানোর জন্য যে মহলটি ওত পেতে বসে থাকে, তারা অচিহ্নিত না হলেও এদের কেশাগ্র কোন রহস্যজনক কারণে স্পর্শ করা যায় না_এ এক অন্তহীন প্রশ্ন। অতিদরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্যসাহায্য দেওয়ার কর্মসূচি বা ভারনারেবল গ্রুপ ফিডিং কার্ড কারা পাওয়ার যোগ্য, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব অনেক জেলা-উপজেলায়ই নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। পাশাপাশি সংখ্যায় কম হলেও মহাজোটের শরিক অন্য দলের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। রাজশাহীর বাঘমারায় এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তখন ব্যাপক ঝড় উঠেছিল। রাজশাহীর বাঘমারা কিংবা গাইবান্ধার পলাশবাড়ী খণ্ডিত দৃষ্টান্ত বটে; কিন্তু সারা দেশেই কমবেশি এমন ঘটনা ঘটেছিল এবং ওই ঘটনার সূত্র ধরেই অনিয়ম-দুর্নীতির জাল পরে বিস্তৃত হয়। ক্ষমতাসংলগ্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সরকার ও মহাজোটের ঊর্ধ্বতন মহলের মধ্যে কোনো চেতনাই যে জাগায়নি, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিবেদনটি এরই সাক্ষ্যবহ। ভিজিএফ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রয়েছেন এবং রয়েছে কার্যালয়ও। যোগ্যতা বিচার করে ভিজিএফ কার্ডধারীদের নামের তালিকা তৈরি করে পিআইওর কার্যালয়ে পাঠানোর দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের পরামর্শ নেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু সেখানে ক্ষমতাসংলগ্ন নেতা-কর্মীরা কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করলেন_এ প্রশ্ন শুরুতেই উঠলেও এর কোনো প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধান হয়নি। আর হয়নি বলেই অসাধুদের আখের গোছানোর পথ প্রশস্ত হয় এবং তারা সংগতই মনে করে, তাদের স্পর্শ করবে আর কে! অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানরা এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন তা চরম আত্মঘাতীও বটে। তাঁদের অস্তিত্ব সর্বত্র। এই অপপ্রবণতা বাংলাদেশের অনেক অর্জনের মূলে কুঠারাঘাত করেছে, অনেক সম্ভাবনা অঙ্কুরেই ধ্বংস করেছে, অন্ধকার গাঢ় করেছে আর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার হোতাদের দাপট প্রবল হতে সহায়তা করেছে।
ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার খুঁটি খুব শক্ত। তাঁদের মাথার ওপর রয়েছে নীতিহীন, ক্ষমতাবান, অসাধু কোনো কোনো সংসদ সদস্যের স্নেহার্দ্র হাত। এমন কয়েকজন সংসদ সদস্যের নাম এর আগে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় দলীয়করণের বিরুদ্ধে কথা বললেও কাজে এর প্রমাণ মেলে খুব কম ক্ষেত্রেই। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতাসীন মহলের মহাক্ষমতাধর কোনো কোনো সংসদ সদস্য পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন, তাঁদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অভিযোগ, সাধারণ মানুষের মনোভাব আমলে তো নেনই না, উপরন্তু নানা রকম হুংকার ছাড়েন, 'দেখে নেওয়ার' মতো দম্ভ প্রকাশ করেন। কারো কারো এমন আচরণের খবরও প্রচারমাধ্যমে এখনো চোখে পড়ে। দল ও সরকারের কাছে অবহনযোগ্য, সাধারণ মানুষের কাছে পরিত্যাজ্য এই জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে দল কী ভাবছে, তা দলের নীতিনির্ধারকদের বিষয়; কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা ক্রমেই বিষফোড়াসম হয়ে উঠছেন_বিপত্তিটা এখানেই। ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসাধু সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা মেম্বারদের ঔদ্ধত্য সীমাহীনের সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দলের কাছে তাঁদের প্রয়োজন থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে যে তাঁরা কত বেশি অপ্রয়োজনীয় এবং পরিত্যাজ্য হয়ে পড়েছেন, এর প্রমাণ মিলবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। এই দেয়াললিখন কি ক্ষমতাসীন মহল পড়তে পারছে না? সাধারণ মানুষ এখন ভুল করে না; আর তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম অপচেষ্টা সত্ত্বেও তারা যথেষ্ট সচেতন। আশা, শক্তি ও ভরসার বিষয় সেটিই। আর এ কারণেই সব স্বপ্ন এখনো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়নি।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। ভিজিএফ কর্মসূচি যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো, তাহলে সরকারের এ কার্যক্রম সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। হতদরিদ্র মানুষের জন্য তা হতো খুবই সহায়ক। কিন্তু মাঠপর্যায়ের চিত্র কোনোভাবেই সুখকর নয়। এখনো সময় আছে। ভিজিএফ কার্ড প্রকল্পের অনিয়ম রোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব সময় কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, সময় বয়ে যাচ্ছে। দরিদ্রতম বা একেবারে নিঃস্ব মানুষের প্রাণরক্ষার জন্য যে নূ্যনতম কর্মসূচি সরকার নিয়েছে, এর বাস্তবায়নে যেকোনো মাত্রার অনিয়ম-দুর্নীতি অত্যন্ত অমানবিক ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত। জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে যে মহাজোট সরকার গঠন করেছে, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, তারা সরকারি দল বা জোটের মতলববাজ, দুর্নীতিপরায়ণদের লোভ-লালসার কারণে ভিজিএফ প্রকল্পের মতো জরুরি নূ্যনতম কর্মসূচিকেও দুর্নীতি-দলীয়করণের ঊধর্ে্ব রাখতে পারবে না_এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। অভিযোগ শুধু কার্ড বিতরণ কিংবা তালিকা তৈরির ক্ষেত্রেই নয়, অভিযোগ রয়েছে ভিজিএফের চাল বিতরণের ক্ষেত্রেও। ওজনে কম দেওয়া এবং খাওয়ার অযোগ্য নিম্নমানের চাল বিতরণের অভিযোগটিও কম পুষ্ট নয়। এর আগে কয়েকবার ভিজিএফের চাল পাচারকালে উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি যেন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে_'সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা'। কিন্তু এমনটি তো কোনোভাবেই নিয়তি হয়ে দাঁড়াতে পারে না। প্রায় পাঁচ কোটি হতদরিদ্রের মধ্যে চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৩ শতাংশ এবং ভাতা পাওয়ার যোগ্য ৩৩ শতাংশকে এ পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। সারা দেশের চিত্র মনোহরপুরের মতো মারাত্মক শোচনীয় না হলেও সার্বিক চিত্র প্রীতিকর নয়। দুর্নীতির এই দালিলিক প্রমাণ পাওয়ার পরও সরকারের বিকার নেই! এখন নতুন প্রত্যাশা হলো, এই চিত্র মুছে ফেলতে সরকার সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.