সচল থাকবে হুমায়ূনের সোনার কলম by মুহম্মদ নূরুল হুদা
আজ পহেলা আশ্বিন ১৪১৮। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১। শুক্রবার। ছুটির দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটি দৈনিকের পাতায় পড়লাম হুমায়ূন আহমেদের নতুন গল্প 'মাইন্ড গেম'। আমাদের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশরীতি যেমন সহজ-সরল, তেমনি পাঠক-পাঠিকাগ্রাসী। শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। আমিও পারলাম না।
বলতে গেলে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। পড়েই কিছুটা কাতর হলাম। তবে কি হুমায়ূনের সত্যি সত্যি ক্যান্সার হয়েছে? পত্রিকার সংবাদই তাহলে সত্য?
কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিল হুমায়ূন। ওপেন হার্ট সার্জারির পর এটি তার রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা। তখনই নাকি ডাক্তাররা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল হুমায়ূন। তারপর ফিরে এল নিজের স্বভাবে। এই ভীতিকর সংবাদ মোকাবিলা করার প্রধান অস্ত্র নিজের সৃষ্টিশীলতাকে উসকে দেওয়া। কোনো কিছু গ্রাহ্য না করাই তো হুমায়ূনের স্বভাব। সমকালীন বাংলা ভাষায় অপ্রতিরোধ্য সৃষ্টিশীলতার প্রতীক হুমায়ূন তার সেই স্বকীয় স্বভাবই কাজে লাগাল। লিখল 'মাইন্ড গেম' নামের অত্যাশ্চর্য এক গল্প, যা আকারে ছোটগল্পের চেয়ে ছোট আর অণুগল্পের চেয়ে বড়।
মনস্তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক সত্য, সৃষ্টিকল্পনা ও প্রাত্যহিক জীবনবীক্ষণের নিরিখে প্রায় অবলীলায় রচিত গল্পটি হুমায়ূনের সৃষ্টিক্ষমতার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন। মা-বাবার মধ্যে শিশু কাকে বেশি ভালোবাসে_এই দ্বন্দ্বাকুল মনস্তত্ত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি, এরপর তাতে এসেছে মানুষের মানবিকতা ও বিমানবিকতার ব্যাখ্যাতীত সংঘর্ষের প্রসঙ্গ। সব শেষে আছে চিরায়ত এক প্রশ্ন : মানুষ কবে পশুত্বের স্তর পেরিয়ে পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠবে? বিড়াল যেমন কখনো কখনো আপন বাচ্চাকে হত্যা করে তার মাংস খায়, তেমনি কোনো কোনো মানবীও কেন হঠাৎ তার সন্তানহত্যায় প্রবৃত্ত হয়? অথচ মা-বাবাকে বাঁচানোর প্রশ্ন এলে তো সন্তান আপন স্বভাবেই মায়ের পক্ষ নেয়। আমার ধারণা, জীবনের এক সংকটতম মুহূর্তে হুমায়ূন মহত্ত্বখচিত এমন একটি রচনা লিখল, যা তাকে চিরকাল অমর করে রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আবার প্রমাণ করল, সৃষ্টিশীলতাই এই মরজগতে নশ্বরতাজয়ের অভ্রান্ত ব্রহ্মাস্ত্র।
আমার অহংকার, হুমায়ূন আমার বন্ধু। আমরা শুধু ১৯৬৫ সালে একই সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করিনি, লেখালেখিও শুরু করেছি একই সময়ে_বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষার্ধে। আমার সম্পাদিত 'অধোরেখ' শীর্ষক এক ফর্মার এক কবিতাপত্রে তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। ওটি ছিল ছন্দোবদ্ধ মিষ্টি প্রেমের কবিতা। শক্তি আর জীবনানন্দের মিশেল ছিল সেই কবিতায়। তার পরই হুমায়ূন লিখল সেই বিখ্যাত গল্প_'নন্দিত নরকে'। শুরুতে একটি বড়গল্পই ছিল রচনাটি। এর প্রথম পাঠক আমি আর ডিলু। ডিলু আজকের ডাকসাইটে ইংরেজির অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। জন্মসূত্রে সে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই। আমরা তিন বন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে থাকতাম, আর রাতে ডিলুর রুমে আড্ডা দিতাম। আড্ডার প্রধান বিষয় ছিল নিজ নিজ রচনা পাঠ। হুমায়ূন প্রায়ই আমার চাটগাঁইয়া উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করে প্রমিত উচ্চারণ বাতলে দিত। একরাতে তেমন এক আড্ডায় হুমায়ূন গল্পটি পড়ল। আমি আর ডিলু আঁচ করলাম, এ যেমন-তেমন লেখা নয়, সাংঘাতিক কিছু! আমার কাছে তখন মাঝেমধ্যে আসতেন আহমদ ছফা। তাঁর সঙ্গে বাংলাবাজারের বেশ যোগাযোগ ছিল। পরের রাতেই আমরা ছফা ভাইকে লেখাটি শুনিয়ে দিই। প্রাণখোলা হাসি আর অমিত সৃষ্টি-উল্লাসী ছফা ভাই লেখাটি শুনেই তাঁর স্বভাবসুলভ ঠা ঠা হাসিতে ঘর ফাটালেন। তারপর বাংলাবাজারের প্রকাশক খান ব্রাদার্স থেকে বইটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। বই ছাপার সময় হুমায়ূন আদি রচনার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ও বেশ পরিবর্ধন করল। আমাদের শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ বইটির একটি জুতসই ভূমিকা লিখলেন। তার পরের গল্প সবারই জানা। হুমায়ূন এল, দেখল আর জয় করল। অচিরেই সে আমাদের সবচেয়ে পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক হয়ে গেল। আমরা, তার বন্ধুরা, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের মধ্য থেকেই উঠে এল বাংলা কথাসাহিত্যের এক চিরায়ত কারুকৃৎ। এ আমাদের কম গর্ব নয়।
একসময় তার মনে হলো, বইটির ইংরেজি অনুবাদ করা যেতে পারে। হুমায়ূন বন্ধুদের প্রতি চিরকাল অসম্ভব পক্ষপাতপ্রবণ। কী ভেবে সে অনুবাদের দায়িত্বটি দিল আমাকেই। আমি অনুবাদ করলাম, আর নাম দিলাম 'বি্লসফুল হেল'। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চার দশকেরও বেশি সময় গড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গায় অনেক চরাও পড়েছে। হুমায়ূনের সাম্রাজ্য মোগল সাম্রাজ্যের মতো বিশাল হয়ে উঠেছে। আমরা অনেকেই ছিটকে পড়েছি তার সংস্রব থেকে। মাঝখানে অবশ্য আজিমপুর সুপারমার্কেটে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে, আমার নূশা কম্পিউটার্স থেকে কম্পোজ হয়েছে তার ৫০টির বেশি উপন্যাস। সে সময় আমরা প্রায় প্রতিদিন মিলিত হতাম। নূশা কম্পিউটার্স উঠে গেলে আমরা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। দেখা হতো কালেভদ্রে। হুমায়ূন প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গেল, নুহাশ-পল্লী করল। আজ হুমায়ূন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তার দেখা পাওয়া, ফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে পারাটা কতকটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
এবারের রমজান মাসে হঠাৎ করেই আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। আমার বন্ধু, প্রকাশক ও গল্পকার আলমগীর রহমান দাওয়াত দিল ইফতারের। কবুল না করে উপায় থাকল না। গিয়ে দেখি, টেবিল আলো করে বসে আছে স্বয়ং হুমায়ূন। আমাকে দেখেই বলল, 'হুদা, তোমার কথা শুনেই এলাম। বহুদিন দেখা হয় না।' সেই আগের মতো সজ্জন, সেই আগের মতো প্রাণখোলা। এরপর এল তার স্ত্রী শাওন আর ছেলে নিষাদ ও নিনিত। হুমায়ূন তেমন কিছু খেল না, তবে স্বভাববশত অনেক মজার মজার গল্প বলল। ভোজনরসিক আলমগীরের ডাইনিং টেবিল জুড়ে রকমারি খাবার। অন্তত পনেরো রকমের! তাই দেখে হুমায়ূন মুহসীন হলে আমার ডালভাত ও আধাকাঁচা মুরগি রান্না নিয়ে ফোড়ন কাটল। জানতে পারলাম, হুমায়ূন সপরিবারে আলমগীরের ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকে। ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে হুমায়ূন বিদায় নিল। আমি লক্ষ করলাম, তাকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু তার আচরণে এর কোনো ছাপ নেই। স্বাস্থ্য নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্নও করিনি।
তাই হঠাৎ পত্রিকায় খবর দেখে বিস্মিত হলাম। ভালো লাগল এই ভেবে যে হুমায়ূন মানসিকভাবে মোটেই বিচলিত নয়। আমিও তা-ই ভাবি। আগেই বলেছি, কোনো অবস্থায় ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ নয় হুমায়ূন আহমেদ। অসুখটা কোন পর্যায়ের তা আমেরিকার ডাক্তাররা অবশ্যই নিরূপণ করবেন। তারপর যথাযথ চিকিৎসাও হবে। হুমায়ূন ইনশা আল্লাহ আরোগ্য লাভ করেই দেশে ফিরবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার মতো হুমায়ূন-বন্ধুদের কিংবা বাংলাভাষী অঞ্চলজুড়ে অগণিত হুমায়ূন-ভক্তের। তার সোনার কলম যেমন সচল আছে, তেমনি থাকবে_এ বিশ্বাস যেমন তার, তেমনি আমাদেরও। জয়তু হুমায়ূন, জয়তু তার সৃষ্টিশীলতা।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১
কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিল হুমায়ূন। ওপেন হার্ট সার্জারির পর এটি তার রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা। তখনই নাকি ডাক্তাররা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শুনে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল হুমায়ূন। তারপর ফিরে এল নিজের স্বভাবে। এই ভীতিকর সংবাদ মোকাবিলা করার প্রধান অস্ত্র নিজের সৃষ্টিশীলতাকে উসকে দেওয়া। কোনো কিছু গ্রাহ্য না করাই তো হুমায়ূনের স্বভাব। সমকালীন বাংলা ভাষায় অপ্রতিরোধ্য সৃষ্টিশীলতার প্রতীক হুমায়ূন তার সেই স্বকীয় স্বভাবই কাজে লাগাল। লিখল 'মাইন্ড গেম' নামের অত্যাশ্চর্য এক গল্প, যা আকারে ছোটগল্পের চেয়ে ছোট আর অণুগল্পের চেয়ে বড়।
মনস্তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক সত্য, সৃষ্টিকল্পনা ও প্রাত্যহিক জীবনবীক্ষণের নিরিখে প্রায় অবলীলায় রচিত গল্পটি হুমায়ূনের সৃষ্টিক্ষমতার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন। মা-বাবার মধ্যে শিশু কাকে বেশি ভালোবাসে_এই দ্বন্দ্বাকুল মনস্তত্ত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে গল্পটি, এরপর তাতে এসেছে মানুষের মানবিকতা ও বিমানবিকতার ব্যাখ্যাতীত সংঘর্ষের প্রসঙ্গ। সব শেষে আছে চিরায়ত এক প্রশ্ন : মানুষ কবে পশুত্বের স্তর পেরিয়ে পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠবে? বিড়াল যেমন কখনো কখনো আপন বাচ্চাকে হত্যা করে তার মাংস খায়, তেমনি কোনো কোনো মানবীও কেন হঠাৎ তার সন্তানহত্যায় প্রবৃত্ত হয়? অথচ মা-বাবাকে বাঁচানোর প্রশ্ন এলে তো সন্তান আপন স্বভাবেই মায়ের পক্ষ নেয়। আমার ধারণা, জীবনের এক সংকটতম মুহূর্তে হুমায়ূন মহত্ত্বখচিত এমন একটি রচনা লিখল, যা তাকে চিরকাল অমর করে রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ূন আবার প্রমাণ করল, সৃষ্টিশীলতাই এই মরজগতে নশ্বরতাজয়ের অভ্রান্ত ব্রহ্মাস্ত্র।
আমার অহংকার, হুমায়ূন আমার বন্ধু। আমরা শুধু ১৯৬৫ সালে একই সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করিনি, লেখালেখিও শুরু করেছি একই সময়ে_বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষার্ধে। আমার সম্পাদিত 'অধোরেখ' শীর্ষক এক ফর্মার এক কবিতাপত্রে তার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। ওটি ছিল ছন্দোবদ্ধ মিষ্টি প্রেমের কবিতা। শক্তি আর জীবনানন্দের মিশেল ছিল সেই কবিতায়। তার পরই হুমায়ূন লিখল সেই বিখ্যাত গল্প_'নন্দিত নরকে'। শুরুতে একটি বড়গল্পই ছিল রচনাটি। এর প্রথম পাঠক আমি আর ডিলু। ডিলু আজকের ডাকসাইটে ইংরেজির অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। জন্মসূত্রে সে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই। আমরা তিন বন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে থাকতাম, আর রাতে ডিলুর রুমে আড্ডা দিতাম। আড্ডার প্রধান বিষয় ছিল নিজ নিজ রচনা পাঠ। হুমায়ূন প্রায়ই আমার চাটগাঁইয়া উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করে প্রমিত উচ্চারণ বাতলে দিত। একরাতে তেমন এক আড্ডায় হুমায়ূন গল্পটি পড়ল। আমি আর ডিলু আঁচ করলাম, এ যেমন-তেমন লেখা নয়, সাংঘাতিক কিছু! আমার কাছে তখন মাঝেমধ্যে আসতেন আহমদ ছফা। তাঁর সঙ্গে বাংলাবাজারের বেশ যোগাযোগ ছিল। পরের রাতেই আমরা ছফা ভাইকে লেখাটি শুনিয়ে দিই। প্রাণখোলা হাসি আর অমিত সৃষ্টি-উল্লাসী ছফা ভাই লেখাটি শুনেই তাঁর স্বভাবসুলভ ঠা ঠা হাসিতে ঘর ফাটালেন। তারপর বাংলাবাজারের প্রকাশক খান ব্রাদার্স থেকে বইটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। বই ছাপার সময় হুমায়ূন আদি রচনার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ও বেশ পরিবর্ধন করল। আমাদের শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ বইটির একটি জুতসই ভূমিকা লিখলেন। তার পরের গল্প সবারই জানা। হুমায়ূন এল, দেখল আর জয় করল। অচিরেই সে আমাদের সবচেয়ে পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক হয়ে গেল। আমরা, তার বন্ধুরা, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের মধ্য থেকেই উঠে এল বাংলা কথাসাহিত্যের এক চিরায়ত কারুকৃৎ। এ আমাদের কম গর্ব নয়।
একসময় তার মনে হলো, বইটির ইংরেজি অনুবাদ করা যেতে পারে। হুমায়ূন বন্ধুদের প্রতি চিরকাল অসম্ভব পক্ষপাতপ্রবণ। কী ভেবে সে অনুবাদের দায়িত্বটি দিল আমাকেই। আমি অনুবাদ করলাম, আর নাম দিলাম 'বি্লসফুল হেল'। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চার দশকেরও বেশি সময় গড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গায় অনেক চরাও পড়েছে। হুমায়ূনের সাম্রাজ্য মোগল সাম্রাজ্যের মতো বিশাল হয়ে উঠেছে। আমরা অনেকেই ছিটকে পড়েছি তার সংস্রব থেকে। মাঝখানে অবশ্য আজিমপুর সুপারমার্কেটে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে, আমার নূশা কম্পিউটার্স থেকে কম্পোজ হয়েছে তার ৫০টির বেশি উপন্যাস। সে সময় আমরা প্রায় প্রতিদিন মিলিত হতাম। নূশা কম্পিউটার্স উঠে গেলে আমরা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। দেখা হতো কালেভদ্রে। হুমায়ূন প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গেল, নুহাশ-পল্লী করল। আজ হুমায়ূন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তার দেখা পাওয়া, ফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে পারাটা কতকটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
এবারের রমজান মাসে হঠাৎ করেই আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। আমার বন্ধু, প্রকাশক ও গল্পকার আলমগীর রহমান দাওয়াত দিল ইফতারের। কবুল না করে উপায় থাকল না। গিয়ে দেখি, টেবিল আলো করে বসে আছে স্বয়ং হুমায়ূন। আমাকে দেখেই বলল, 'হুদা, তোমার কথা শুনেই এলাম। বহুদিন দেখা হয় না।' সেই আগের মতো সজ্জন, সেই আগের মতো প্রাণখোলা। এরপর এল তার স্ত্রী শাওন আর ছেলে নিষাদ ও নিনিত। হুমায়ূন তেমন কিছু খেল না, তবে স্বভাববশত অনেক মজার মজার গল্প বলল। ভোজনরসিক আলমগীরের ডাইনিং টেবিল জুড়ে রকমারি খাবার। অন্তত পনেরো রকমের! তাই দেখে হুমায়ূন মুহসীন হলে আমার ডালভাত ও আধাকাঁচা মুরগি রান্না নিয়ে ফোড়ন কাটল। জানতে পারলাম, হুমায়ূন সপরিবারে আলমগীরের ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকে। ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে হুমায়ূন বিদায় নিল। আমি লক্ষ করলাম, তাকে কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু তার আচরণে এর কোনো ছাপ নেই। স্বাস্থ্য নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্নও করিনি।
তাই হঠাৎ পত্রিকায় খবর দেখে বিস্মিত হলাম। ভালো লাগল এই ভেবে যে হুমায়ূন মানসিকভাবে মোটেই বিচলিত নয়। আমিও তা-ই ভাবি। আগেই বলেছি, কোনো অবস্থায় ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ নয় হুমায়ূন আহমেদ। অসুখটা কোন পর্যায়ের তা আমেরিকার ডাক্তাররা অবশ্যই নিরূপণ করবেন। তারপর যথাযথ চিকিৎসাও হবে। হুমায়ূন ইনশা আল্লাহ আরোগ্য লাভ করেই দেশে ফিরবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার মতো হুমায়ূন-বন্ধুদের কিংবা বাংলাভাষী অঞ্চলজুড়ে অগণিত হুমায়ূন-ভক্তের। তার সোনার কলম যেমন সচল আছে, তেমনি থাকবে_এ বিশ্বাস যেমন তার, তেমনি আমাদেরও। জয়তু হুমায়ূন, জয়তু তার সৃষ্টিশীলতা।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১
No comments