শেকড়ের ডাক-যে ঐতিহ্য আমাদের নেই by ফরহাদ মাহমুদ
পৃথিবীর প্রায় সব সভ্য দেশেই নিজস্ব ঐতিহ্যকে অনেক বেশি মূল্য দেওয়া হয়। সে দেশের মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতিকে তাদের অন্তরে ধারণ করে। এমনকি নিজস্ব প্রথা, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতিনীতিকেও তারা বিসর্জন দেয় না। সভ্যতার মাপকাঠিতে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্য দুনিয়ার উন্নত রীতিনীতিকে তারা আয়ত্ত করে।
জাপান, ব্রিটেনসহ অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশও তাদের রাজতন্ত্রকে 'গুড বাই' বলেনি। কিন্তু আমাদের মধ্যে ঐতিহ্য রক্ষার সেই চেষ্টা কতটুকু আছে? ঐতিহ্যের যে ছিটেফোঁটা ছিল, তা থেকেও যেন আমরা কেবলই দূরে সরে যাচ্ছি। কেন?
মহাজোট সরকারের বয়স প্রায় তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে যেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে রয়েছে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগের বিপন্ন দশা এবং দ্রব্যমূল্যের অনবরত ঊর্ধ্বগতি। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই ব্যর্থতাগুলো ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার কিছু মন্ত্রীর বেফাঁস উক্তিও মানুষকে আহত করেছে। ফলে বিভিন্ন মহল থেকে যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো এই দাবিতে রাস্তায়ও নেমেছে। গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান যেন অনেকটাই অনড়। কেন? তার কারণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব সেই ঐতিহ্যহীনতা। একবার ক্ষমতা পেলে তা থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য যে আমাদের নেই। তেমন উদারতা দেখানোর মানসিকতাও আমরা আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি।
আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিন্তু তেমন মানসিকতা এবং ঐতিহ্য_দুটিই আছে। ১৯৫৬ সালে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১১২ জন মারা যাওয়ার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে লালবাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন, যদিও সেদিন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। সেই ধারা ভারতবর্ষে এখনো অব্যাহত আছে। এই সেদিনের কথা। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন জোট বিজয়ী হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সে সময়ই তাঁর ইতালীয় জন্মসূত্র নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ব্যস, তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলেন। মুম্বাইয়ে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে প্রায় ২০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল পদত্যাগ করেছিলেন। মাত্র কয়েক দিন আগের কথা, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। ভারতের বর্তমান মন্ত্রিসভার বয়স বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার চেয়ে তিন মাস কম। কিন্তু এরই মধ্যে সেই মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী রদবদল হয়েছেন। আমরা কথায় কথায় বলি, দুই দেশের অভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। সেটি মিথ্যা নয়। প্রাচীনকালের অনেক অভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার প্রশ্নে বা আমাদের অবস্থানে অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। তাই আমরা মন-মানসিকতায় দূরবর্তী দুই দ্বীপের বাসিন্দা।
শুধু ভারত নয়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি আছে এমন যেকোনো দেশেই জনমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তো কথাই নেই। জাপানে ২০০৬ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ মাসে সর্বশেষ পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প এবং তৎপরবর্তী সুনামির কারণে জাপানে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফলতা দেখাতে পারেননি বলে তিনি পদত্যাগ করেছেন। এর জন্য জাপানে যে তাঁর খুব বেশি সমালোচনা হয়েছিল বা দাবি উঠেছিল, তা কিন্তু নয়। তিনি নিজেই অনুভব করেছেন এবং অন্য কাউকে আরো যোগ্যভাবে সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য পথ করে দিয়েছেন। ইউরোপ, আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের চেয়ে সামান্য অগ্রসর দেশ ব্রাজিলেও গত আট মাসে চারজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ কিছু অভিযোগ উঠেছিল। সারা দুনিয়ায় এমন ভূরি ভূরি নজির রয়েছে, যেখানে রাস্তায় আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না, সামান্য বিতর্কের পরই কিংবা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অনেকে পদত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের তেমন নজির নেই বললেই চলে।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের অধিবাসী। মাঝখানে সামরিক শাসনের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশের পরও আমরা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চা করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা রীতিনীতি থেকে এখনো আমরা অনেকটাই দূরে রয়ে গেছি। আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দল তথা দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই প্রধান একে অপরের ছায়া মাড়ান না। জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় না। বিরোধী দলে যাঁরাই থাকুন না কেন, তাঁরা ক্রমাগত সংসদ বর্জন করে যান। ক্ষমতা থেকে 'টেনে নামানোর' কৌশল হিসেবে 'লাগাতার হরতাল' বা 'ট্রাম্প কার্ড' ব্যবহারের হুমকি দেন। হরতালের আগের রাতে এক-দুই ডজন যানবাহনে অগি্নসংযোগ করা হয়। পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়। গণ-গ্রেপ্তারের মতো পরিস্থিতি দেখতে হয়। শুধু তা-ই নয়, সরকারি বা বিরোধী দল_কোনো পক্ষই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তাই সৎ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এখন সরকারি বা বিরোধী দলের সমালোচনা করার আগে সাতবার চিন্তা করেন। অথচ সমালোচনার অধিকার গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত। আমরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করি। এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত আমরা স্বাধীনভাবে চলতে দিই না বা দিতে চাই না। এরপর একটি দেশে কিভাবে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হতে পারে? সংগত কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালী হয়নি। ফলে নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক দেশের কাতার থেকেও আমরা উঠে আসতে পারিনি। আর যেহেতু গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি, তাই সুশাসন থেকেও দেশটি দূরে থেকে যাচ্ছে।
আসলে সত্যিকার গণতন্ত্রে কোনো অনড় অবস্থান নেই বা থাকতে পারে না। জনগণের মতোই সেখানে প্রাধান্য পাবে। ক্ষমতাসীনদের জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফোর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল। লোকসভায় তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগানও ধ্বনিত হয়েছিল। প্রতিনিয়তই সেখানে মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। মন্ত্রীরা দায়িত্ব থেকেও সরে যাচ্ছেন অথবা তাঁদের সরে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। আদালত সেখানে তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারছে। তার পরও সেখানে প্রবীণ ও খ্যাতনামা সমাজকর্মী আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। উচ্চ আদালত থেকেই তাঁকে অনশনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সরকার প্রথমে কিছুটা অনমনীয় মনোভাব দেখালেও পরে তাঁর কাছে নতিস্বীকার করে এবং তাঁর তিনটি দাবিই মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই বাধ্য হওয়াটার মধ্যে কোনো অসম্মান নেই। সোনিয়া গান্ধী কিংবা প্রয়াত লালবাহাদুর শাস্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোয় কিংবা দাঁড়াতে চেয়ে কোনো ভুল করেননি। বরং এতে তাঁদের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে, মানুষ তাঁদের আরো বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। আমরাও কি এমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অধিকারী হতে পারি না?
লেখক : সাংবাদিক, fmahmud53@yahoo.com
মহাজোট সরকারের বয়স প্রায় তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে যেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে রয়েছে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগের বিপন্ন দশা এবং দ্রব্যমূল্যের অনবরত ঊর্ধ্বগতি। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই ব্যর্থতাগুলো ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার কিছু মন্ত্রীর বেফাঁস উক্তিও মানুষকে আহত করেছে। ফলে বিভিন্ন মহল থেকে যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো এই দাবিতে রাস্তায়ও নেমেছে। গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান যেন অনেকটাই অনড়। কেন? তার কারণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব সেই ঐতিহ্যহীনতা। একবার ক্ষমতা পেলে তা থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য যে আমাদের নেই। তেমন উদারতা দেখানোর মানসিকতাও আমরা আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি।
আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিন্তু তেমন মানসিকতা এবং ঐতিহ্য_দুটিই আছে। ১৯৫৬ সালে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১১২ জন মারা যাওয়ার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে লালবাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন, যদিও সেদিন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। সেই ধারা ভারতবর্ষে এখনো অব্যাহত আছে। এই সেদিনের কথা। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন জোট বিজয়ী হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সে সময়ই তাঁর ইতালীয় জন্মসূত্র নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ব্যস, তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলেন। মুম্বাইয়ে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে প্রায় ২০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল পদত্যাগ করেছিলেন। মাত্র কয়েক দিন আগের কথা, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। ভারতের বর্তমান মন্ত্রিসভার বয়স বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার চেয়ে তিন মাস কম। কিন্তু এরই মধ্যে সেই মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী রদবদল হয়েছেন। আমরা কথায় কথায় বলি, দুই দেশের অভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। সেটি মিথ্যা নয়। প্রাচীনকালের অনেক অভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার প্রশ্নে বা আমাদের অবস্থানে অনেক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। তাই আমরা মন-মানসিকতায় দূরবর্তী দুই দ্বীপের বাসিন্দা।
শুধু ভারত নয়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি আছে এমন যেকোনো দেশেই জনমতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তো কথাই নেই। জাপানে ২০০৬ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ মাসে সর্বশেষ পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প এবং তৎপরবর্তী সুনামির কারণে জাপানে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফলতা দেখাতে পারেননি বলে তিনি পদত্যাগ করেছেন। এর জন্য জাপানে যে তাঁর খুব বেশি সমালোচনা হয়েছিল বা দাবি উঠেছিল, তা কিন্তু নয়। তিনি নিজেই অনুভব করেছেন এবং অন্য কাউকে আরো যোগ্যভাবে সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য পথ করে দিয়েছেন। ইউরোপ, আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের চেয়ে সামান্য অগ্রসর দেশ ব্রাজিলেও গত আট মাসে চারজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ কিছু অভিযোগ উঠেছিল। সারা দুনিয়ায় এমন ভূরি ভূরি নজির রয়েছে, যেখানে রাস্তায় আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না, সামান্য বিতর্কের পরই কিংবা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অনেকে পদত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের তেমন নজির নেই বললেই চলে।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের অধিবাসী। মাঝখানে সামরিক শাসনের অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশের পরও আমরা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চা করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা রীতিনীতি থেকে এখনো আমরা অনেকটাই দূরে রয়ে গেছি। আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দল তথা দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই প্রধান একে অপরের ছায়া মাড়ান না। জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় না। বিরোধী দলে যাঁরাই থাকুন না কেন, তাঁরা ক্রমাগত সংসদ বর্জন করে যান। ক্ষমতা থেকে 'টেনে নামানোর' কৌশল হিসেবে 'লাগাতার হরতাল' বা 'ট্রাম্প কার্ড' ব্যবহারের হুমকি দেন। হরতালের আগের রাতে এক-দুই ডজন যানবাহনে অগি্নসংযোগ করা হয়। পুড়িয়ে মানুষ মারা হয়। গণ-গ্রেপ্তারের মতো পরিস্থিতি দেখতে হয়। শুধু তা-ই নয়, সরকারি বা বিরোধী দল_কোনো পক্ষই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তাই সৎ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এখন সরকারি বা বিরোধী দলের সমালোচনা করার আগে সাতবার চিন্তা করেন। অথচ সমালোচনার অধিকার গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত। আমরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করি। এমনকি বিচার বিভাগকে পর্যন্ত আমরা স্বাধীনভাবে চলতে দিই না বা দিতে চাই না। এরপর একটি দেশে কিভাবে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হতে পারে? সংগত কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালী হয়নি। ফলে নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক দেশের কাতার থেকেও আমরা উঠে আসতে পারিনি। আর যেহেতু গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি, তাই সুশাসন থেকেও দেশটি দূরে থেকে যাচ্ছে।
আসলে সত্যিকার গণতন্ত্রে কোনো অনড় অবস্থান নেই বা থাকতে পারে না। জনগণের মতোই সেখানে প্রাধান্য পাবে। ক্ষমতাসীনদের জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফোর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল। লোকসভায় তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগানও ধ্বনিত হয়েছিল। প্রতিনিয়তই সেখানে মন্ত্রী-আমলাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। মন্ত্রীরা দায়িত্ব থেকেও সরে যাচ্ছেন অথবা তাঁদের সরে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। আদালত সেখানে তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারছে। তার পরও সেখানে প্রবীণ ও খ্যাতনামা সমাজকর্মী আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন। উচ্চ আদালত থেকেই তাঁকে অনশনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সরকার প্রথমে কিছুটা অনমনীয় মনোভাব দেখালেও পরে তাঁর কাছে নতিস্বীকার করে এবং তাঁর তিনটি দাবিই মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই বাধ্য হওয়াটার মধ্যে কোনো অসম্মান নেই। সোনিয়া গান্ধী কিংবা প্রয়াত লালবাহাদুর শাস্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোয় কিংবা দাঁড়াতে চেয়ে কোনো ভুল করেননি। বরং এতে তাঁদের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে, মানুষ তাঁদের আরো বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখছে। আমরাও কি এমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অধিকারী হতে পারি না?
লেখক : সাংবাদিক, fmahmud53@yahoo.com
No comments