পথের ফুল দ্রোণপুষ্প by মোকারম হোসেন

ছেলেবেলায় নানাবাড়ির পুরোনো দালানের ফাটল আর মসজিদের প্রশস্ত আঙিনায় প্রথম দেখি। খেলার সঙ্গীরা শিখিয়েছিল ফুল ছিঁড়ে কীভাবে গোড়ার মধু খেতে হয়। বড় হয়ে জেনেছি, এ এক আশ্চর্য গুণের ঔষধি গাছ। অনেক রোগের মহৌষধ।


নগরের যান্ত্রিক জীবনে ছেলেবেলার সেই ফুলটি আর খুঁজে পাই না। কিন্তু বুকের ভেতর তার শুভ্রতা আলো ছড়ায় অনুক্ষণ। শহর ছাড়িয়ে দুই পা ফেললেই তৃষ্ণার্ত চোখ খুঁজে ফেরে হাতিশুঁড়, দ্রোণপুষ্প, রক্তদ্রোণ, ফণিমনসা, ভাঁটফুলসহ আরও অনেক অনেক পথফুল। মাঝেমধ্যে পথের ধারে, খেতের আলপথে কিংবা চষা খেতে খুঁজে পাই দণ্ডকলস বা দ্রোণপুষ্প। ভাগ্যিস, ওদের কোনো দারুমূল্য নেই, জ্বালানি হিসেবেও উৎকৃষ্ট নয়! তাই রক্ষা। তা না হলে অনেক আগেই দুর্লভ হয়ে যেত। তা ছাড়া গবাদিপশুও এই উদ্ভিদ খায় না। এদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার এটাও একটা অন্যতম কারণ।
এদের আরও অনেক নাম—দ্রোণপুষ্প, দেবদ্রোণ, হলকসা, ঘলঘসে, হলকুষা। এই নামগুলো সাধারণত স্থানীয়ভাবেই বেশি ব্যবহূত হয়। তবে দণ্ডকলস সংস্কৃত নাম। প্রাচীন রাজনিঘণ্টুতেও এই গাছের উল্লেখ আছে, ‘দ্রোণপুষ্পা কটুঃ সোষ্ণা রুচ্যা বাতকফাপহা।/ অগ্নিমান্দ্যহরা চৈব পথ্যা বাতাপহারিণী’।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘শাদা ভাঁটপুষ্পের তোড়া আলোকলতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফুল বাসকের গায়’। একটিমাত্র বাক্যে তিনি চার-চারটি ফুলের প্রসঙ্গ এনেছেন।
দণ্ডকলস বর্ষজীবী ঘনপাতাবিশিষ্ট উদ্ভিদ। কাণ্ড দুই থেকে তিন ফুট উঁচু হতে পারে। পাতা দুই থেকে চার ইঞ্চি লম্বা, আগা সরু, গভীর শিরাযুক্ত, কিনারা অসমান ও কোমল কাঁটাযুক্ত। ফুল সাদা এবং কাণ্ডের শীর্ষভাগে ফোটে, পর্যায়ক্রমে। বোঁটা আধা ইঞ্চির মতো লম্বা। বাইরের আবরণ ফিকে, পরিপূর্ণ ফুল দেখতে ধামার মতো, পাপড়ির গোড়ার দিকে ওপরের অংশটুকু ছোট ও রোমশ।
সাধারণত গাছ হওয়ার দু-তিন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে, পরে বীজ হয়। আবার চৈত্র-বৈশাখে গাছ মরে যায়। আগের বছর মাটিতে ছড়িয়ে থাকা বীজ থেকেই আবার চারা হয়। আমাদের দেশে দু-তিন জাতের দণ্ডকলস দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, Laucas aspera ও L. zeylanica প্রজাতির ফুল।
জ্বরে মরিচচূর্ণসহ এ গাছের পাতার রস বেশ কার্যকর। নিঘণ্টুকারের মতে, ‘ইহা সুস্বাদু, উগ্র, পিত্ত ও বায়ুর শান্তিকারক, ক্রিমি ও শ্লেষ্মানাশক।’ ঘলঘসা-জাতীয় গাছগুলো পাঁচড়ার ওষুধ, তা ছাড়া মাথাধরা ও সর্দিতেও কার্যকর। পাতার রস অন্য গাছে দিলে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

No comments

Powered by Blogger.