ইঁদুর কারা, আয়না কাদের? by অনুপম দেব কানুনজ্ঞ
নির্বাচনের ফলাফল আগে দেওয়া নিয়ে বেসরকারি
টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ইঁদুর দৌঁড় এবং পরবর্তীতে আয়নায় চেহারা দেখা
সংক্রান্ত পাল্টা একটি লেখা আমার দৃষ্টি কাড়ে।
সময়
টেলিভিশনের বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ এবং একাত্তর টেলিভিশনের যুগ্ম
বার্তা সম্পাদক পলাশ আহসান-এর তুলনায় ব্রডকাস্ট জার্নালিজমে আমি একেবারেই
‘নাক টিপলে দুধ বের হবে’ টাইপের শিশু হলেও কিছু লেখার ধৃষ্টতা সামলাতে
পারলাম না।
একটা সময় ছিল, যখন পরিবারের সবাই মিলে বিটিভি-এর রাত ৮টার সংবাদ দেখতাম। সংবাদ শুরু হতো ‘প্রধানমন্ত্রী …বলেছেন’ দিয়ে। ৮টার সংবাদ মোটেও দেশের খবর জানার জন্য না, আমরা আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ৮টার সংবাদ শেষ হওয়ার পর থেকে ১০টার নিউজ এট টেন শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুর জন্য। কারণ ওই সময়টুকুতেই তখনকার দিনে আকর্ষণীয় সব নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখাত।
সায়মন ড্রিং-এর একুশে টিভি এসে সব ধারণা ওলট-পালট করে দিলো। ভালো কিছু সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় ইটিভি যা দেখাতো, তাই গোগ্রাসে গিলতাম। এক বছরেরও বেশি সময় বিটিভি বলে যে একটা টিভি আছে, সেটাই ভুলে যেতে বসেছিলাম আমরা। এরপর সিএসবি আসে দেশের প্রথম নিউজ চ্যানেল হিসেবে। সংবাদ পরিবেশন ও সংগ্রহ সম্পর্কে এক নতুন ধারণা তৈরি হয় দর্শকদের মধ্যে।
এই দুই চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে নতুন নতুন নিউজ ও এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল আসায় অনুষ্ঠান ও নাটকের মান যেমন পড়তে থাকে, সংবাদের মানও পড়তে থাকে। তবে আমার কথা শুধু মান নিয়ে নয়, জ্ঞান নিয়ে। ইটিভি ও সিএসবি, এই দুই চ্যানেলের কর্মীরাই এখন বেশিরভাগ চ্যানেলের উচ্চ আসনে আসীন আছেন। সংবাদ জগতে এই দুই চ্যানেলের কর্মীদের ধরে নেওয়া হয় গুরুর কাতারে। তাই আজকের অবস্থার জন্য দায় তারাও কি এড়াতে পারেন?
যে দু’টি লেখার প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা, সে দু’টির মতো কোন সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের নাম উল্লেখ করতে চাই না। তবে যারা নিয়মিত টেলিভিশনে চোখ রাখেন, তাদের জন্য ইশারাই কাফি বলে ধরে নিয়ে কয়েকটি ঘটনার কথা বলতে চাই। ঘটনাগুলো কারো কাছ থেকে শোনা নয়, মাঠে থেকে প্রত্যক্ষ করা।
ঘটনা-১
ঘটনাস্থলঃ মোহাম্মদপুর। কোন এক হরতাল। বসে আছি কিছু ঘটার আশায়। সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলের আরো ক’জন কর্মী। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কিছু না পেয়ে আমরা খুব হতাশ, চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য থামলাম।
‘হরতালে কোথায় কি হয়, সব জানে”-খ্যাতি প্রাপ্ত আমাদের এক সহকর্মীই হঠাৎ বললেন, “কিছু না হলে কেমন হয়? দিনতাই তো মাটি তাহলে। দাঁড়াও দেখি কিছু করা যায় কি না।”
এই বলে তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেনো ফোন করলেন। ফোনে কার সঙ্গে কি কথা হলো তা আর শুনিনি, তবে ফোন রেখেই আমাদের বললেন, “চলো, জিগাতলার দিকে বাসে আগুন লাগবে।”
প্রতিক্রিয়া
সবার অফিস জ্বলন্ত বাসের ঝকঝকে ছবি চকচকে স্ক্রিনে চালাচ্ছে। অন্য এক চ্যানেলের সহকর্মী ভাই আমার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকায় ছবিটি পাননি। ফলশ্রুতি, অফিস থেকে ঝাড়ি। একটা ক্যাসেট নিয়ে দৌঁড়ে এসে আমাদের কাছ থেকে ফুটেজ নিয়ে অফিসে পাঠালেন, এবার অফিস শান্তি!!!
ঘটনা-২
ঘটনাস্থলঃ রানা প্লাজা, সাভার। জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার পর হঠাৎ করেই একটি কক্ষে কয়েকজন জীবিতের সন্ধান মেলে। সাত তলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত কংক্রিট গর্ত করে আটকে পড়াদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে উদ্ধারকারী বাহিনী। প্রায় ঝিমিয়ে পড়া মিডিয়া আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার আগে সবশেষ ছবিটি যতো ঝুঁকি নিয়েই হোক দেখাতে হবে।
২৪ ঘণ্টা সংবাদভিত্তিক একটি চ্যানেলের একজন সিনিয়র নারী সাংবাদিক ঢুকে গেলেন এমন এক গর্তের ভেতরে। আটকে পড়াদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একা না, সঙ্গে তার ক্যামেরাম্যান। উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত হচ্ছে, তাই দমকল বাহিনীর উদ্ধারকারীরা বাধা দেওয়ার মৃদু চেষ্টা করলো।
সিনিয়র রিপোর্টার ঝাড়ি দিলেন, “বেশি কথা বলবেন না, আমাকে কাজ করতে দিন।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারীরাও ভয়ে কিছু বললেন না, কারণ তাদের বিরুদ্ধে এমনিতেই উদ্ধারকাজে অবহেলার অভিযোগ ছিলই। কয়েক ফুট গর্তের ভেতর দিয়ে চার তলা নিচে নেমে যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আটকে পড়াদের সাক্ষাতকার নিয়ে আসেন আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, তাতে প্রায় ৩০ মিনিটের মতো বন্ধ ছিলো উদ্ধারকাজ।
প্রতিক্রিয়া
কিছুক্ষণ পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক চ্যানেলের এক ছোট ভাই বললো, “ভাই থাকেন, আসতেছি।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কই যাও?” “আর বইলেন না। গর্তে যাই। অফিস অমুক টিভিতে দেখসে তমুকরে গর্তে নাইমা ইন্টারভিউ নিসে। আমারে ফোন কইরা বলে, তুমি সাভারে বইসা বইসা করো টা কি?”
ঘটনা-৩
ঘটনাস্থলঃ গাজীপুর। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন। টঙ্গীর লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান এসেছেন ভোট দিতে। স্বভাবতই মেয়র প্রার্থী একা আসেন নি। একগাদা লোক নিয়ে তিনি ঢুকেছেন একতলা, পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট ছোট্ট এই কেন্দ্রে। যে কক্ষে তিনি ভোট দেবেন, সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে আছে দশ-বারোটি টেলিভিশন ক্যামেরা, আজমত ভোট দিচ্ছেন এই ছবিটা সবার খুব ভালো করে চাই। ফলে জনসংখ্যার চাপে অন্য চারটি বুথেও বন্ধ হয়ে গেলো ভোটগ্রহণ।
অন্য সবাই তার বাইট/শট বা সাক্ষাতকার নেওয়ার জন্য বাইরে অপেক্ষা করলেও ‘সবার আগে দেখাতে হবে’, এই চিন্তায় কক্ষের ভেতরে লাইভ শুরু করলেন একটি ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের রিপোর্টার। তিনি লাইভে আজমত উল্লা খানের বক্তব্য প্রচার করে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেলেন। ফলাফল, প্রায় ২০ মিনিটের মতো ভোট গ্রহণ স্থগিত।
এখানেই ঘটনা শেষ হতে পারতো। কিন্তু ঠিক কেন্দ্রের প্রবেশ মুখেই উপস্থিত ছিলেন আরেক চ্যানেলের এক নারী সহকর্মী। ‘ভোটারদের অসুবিধা হবে, আমরা বাইরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বক্তব্য নেই’, সহকর্মীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওই জায়গাতেই আজমত উল্লা খানের বক্তব্য নিতে তিনি বদ্ধপরিকর।
শেষ পর্যন্ত জনস্রোতে ওই জায়গা থেকে সরে এলেও বাইরে এসে শুরু হয় বক্তব্য নেওয়ার যুদ্ধ। সবাইকেই আগে বক্তব্য নিতে হবে, সব ভিডিওগ্রাফারকেই পেতে হবে ভালো পজিশন। এই ধাক্কায় আমিসহ আরো কয়েকজন সহকর্মী ছিটকে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই, সবার শেষ হলে আমরা তার সঙ্গে আলাদা কথা বলবো।
প্রতিক্রিয়া
সব চ্যানেলকে বক্তব্য দেওয়ার পর আমরা বাকি কয়েকজন আজমত উল্লা খানকে আবার থামাই। “আবার কথা বলতে হবে আপনাকে।” তিনিও হাসিমুখেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
লাইভ ফিড সবারই রেডি থাকায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা ঢাকায়ও পাঠিয়ে দিলাম। তবে সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। একটু পরে দেখি এক সহকর্মী মন খারাপ করে বসে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য চ্যানেলগুলো আজমতের বক্তব্য আগের বুলেটিনেই দেখিয়ে দিয়েছে। এজন্য অফিস থেকে ঝাড়ি খেতে হয়েছে ওই সহকর্মীকে।
এমন আরো অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ হয়তো করতে পারতাম, কিন্তু এগুলো মাঠে কাজ করা আমার সহকর্মীদের সবারই জানা থাকায় আর চর্বিত চর্বন করলাম না।
আমার প্রশ্ন হলো, সবার আগে, এবং এক্সক্লুসিভ কিছু দেখানোর দৌঁড়ে আমরা এতোটাই মত্ত হচ্ছি দিন কে দিন যে, একজন রিপোর্টার কোন জিনিস কিভাবে মাঠ থেকে সংগ্রহ করলো, তা আমরা কেন চিন্তা করার প্রয়োজনও বোধ করছি না? পরোক্ষভাবে কি উচ্চ আসনে আসীন জ্যেষ্ঠতর কর্মীরাই মাঠকর্মীদের উৎসাহিত করছি না যেনতেন প্রকারের সংবাদ সংগ্রহে? যারা না বুঝেই এমন কাজ করছে, প্রক্রিয়াটা যে সঠিক নয় তাদের শেখাবে কে?
যারা বুঝেই এ কাজগুলো না করছে, তাদের হতে হচ্ছে তিরস্কৃত, এ দায় কাদের? ‘স্পিড’ আর ‘এক্যুরেসি’ –এরও আগে যে এথিক্স বলে সংবাদে একটা জিনিস আছে, তা আমরা ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীরা শিখবো কার কাছ থেকে?
নির্বাচনের ফলাফল কেউ আগেই দিয়ে দিয়েছেন বলে জিতে গিয়েছেন, অথবা, পিছিয়ে থেকেছেন বলেই নৈতিকতার দিক থেকে জয়ী হয়েছেন, এমন দাবি করার সময় কি এখনই চলে এসেছে?
ফলাফলে বড় ধরনের তারতম্য হওয়ায় সবার নজর এখন গাজীপুর নির্বাচনের দিকে। কিন্তু আমরা প্রতিটি চ্যানেলের সাংবাদিক প্রতিদিনই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে চলেছি মাঠেঘাটে।
আমার মনে হয়, পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইঁদুর আর আয়নার হর্তাকর্তাদেরই আজ ভাবতে হবে, কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com
একটা সময় ছিল, যখন পরিবারের সবাই মিলে বিটিভি-এর রাত ৮টার সংবাদ দেখতাম। সংবাদ শুরু হতো ‘প্রধানমন্ত্রী …বলেছেন’ দিয়ে। ৮টার সংবাদ মোটেও দেশের খবর জানার জন্য না, আমরা আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ৮টার সংবাদ শেষ হওয়ার পর থেকে ১০টার নিউজ এট টেন শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুর জন্য। কারণ ওই সময়টুকুতেই তখনকার দিনে আকর্ষণীয় সব নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখাত।
সায়মন ড্রিং-এর একুশে টিভি এসে সব ধারণা ওলট-পালট করে দিলো। ভালো কিছু সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় ইটিভি যা দেখাতো, তাই গোগ্রাসে গিলতাম। এক বছরেরও বেশি সময় বিটিভি বলে যে একটা টিভি আছে, সেটাই ভুলে যেতে বসেছিলাম আমরা। এরপর সিএসবি আসে দেশের প্রথম নিউজ চ্যানেল হিসেবে। সংবাদ পরিবেশন ও সংগ্রহ সম্পর্কে এক নতুন ধারণা তৈরি হয় দর্শকদের মধ্যে।
এই দুই চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে নতুন নতুন নিউজ ও এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল আসায় অনুষ্ঠান ও নাটকের মান যেমন পড়তে থাকে, সংবাদের মানও পড়তে থাকে। তবে আমার কথা শুধু মান নিয়ে নয়, জ্ঞান নিয়ে। ইটিভি ও সিএসবি, এই দুই চ্যানেলের কর্মীরাই এখন বেশিরভাগ চ্যানেলের উচ্চ আসনে আসীন আছেন। সংবাদ জগতে এই দুই চ্যানেলের কর্মীদের ধরে নেওয়া হয় গুরুর কাতারে। তাই আজকের অবস্থার জন্য দায় তারাও কি এড়াতে পারেন?
যে দু’টি লেখার প্রেক্ষিতে আমার এই লেখা, সে দু’টির মতো কোন সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের নাম উল্লেখ করতে চাই না। তবে যারা নিয়মিত টেলিভিশনে চোখ রাখেন, তাদের জন্য ইশারাই কাফি বলে ধরে নিয়ে কয়েকটি ঘটনার কথা বলতে চাই। ঘটনাগুলো কারো কাছ থেকে শোনা নয়, মাঠে থেকে প্রত্যক্ষ করা।
ঘটনা-১
ঘটনাস্থলঃ মোহাম্মদপুর। কোন এক হরতাল। বসে আছি কিছু ঘটার আশায়। সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলের আরো ক’জন কর্মী। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কিছু না পেয়ে আমরা খুব হতাশ, চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য থামলাম।
‘হরতালে কোথায় কি হয়, সব জানে”-খ্যাতি প্রাপ্ত আমাদের এক সহকর্মীই হঠাৎ বললেন, “কিছু না হলে কেমন হয়? দিনতাই তো মাটি তাহলে। দাঁড়াও দেখি কিছু করা যায় কি না।”
এই বলে তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেনো ফোন করলেন। ফোনে কার সঙ্গে কি কথা হলো তা আর শুনিনি, তবে ফোন রেখেই আমাদের বললেন, “চলো, জিগাতলার দিকে বাসে আগুন লাগবে।”
প্রতিক্রিয়া
সবার অফিস জ্বলন্ত বাসের ঝকঝকে ছবি চকচকে স্ক্রিনে চালাচ্ছে। অন্য এক চ্যানেলের সহকর্মী ভাই আমার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকায় ছবিটি পাননি। ফলশ্রুতি, অফিস থেকে ঝাড়ি। একটা ক্যাসেট নিয়ে দৌঁড়ে এসে আমাদের কাছ থেকে ফুটেজ নিয়ে অফিসে পাঠালেন, এবার অফিস শান্তি!!!
ঘটনা-২
ঘটনাস্থলঃ রানা প্লাজা, সাভার। জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার পর হঠাৎ করেই একটি কক্ষে কয়েকজন জীবিতের সন্ধান মেলে। সাত তলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত কংক্রিট গর্ত করে আটকে পড়াদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে উদ্ধারকারী বাহিনী। প্রায় ঝিমিয়ে পড়া মিডিয়া আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার আগে সবশেষ ছবিটি যতো ঝুঁকি নিয়েই হোক দেখাতে হবে।
২৪ ঘণ্টা সংবাদভিত্তিক একটি চ্যানেলের একজন সিনিয়র নারী সাংবাদিক ঢুকে গেলেন এমন এক গর্তের ভেতরে। আটকে পড়াদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একা না, সঙ্গে তার ক্যামেরাম্যান। উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত হচ্ছে, তাই দমকল বাহিনীর উদ্ধারকারীরা বাধা দেওয়ার মৃদু চেষ্টা করলো।
সিনিয়র রিপোর্টার ঝাড়ি দিলেন, “বেশি কথা বলবেন না, আমাকে কাজ করতে দিন।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারীরাও ভয়ে কিছু বললেন না, কারণ তাদের বিরুদ্ধে এমনিতেই উদ্ধারকাজে অবহেলার অভিযোগ ছিলই। কয়েক ফুট গর্তের ভেতর দিয়ে চার তলা নিচে নেমে যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আটকে পড়াদের সাক্ষাতকার নিয়ে আসেন আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, তাতে প্রায় ৩০ মিনিটের মতো বন্ধ ছিলো উদ্ধারকাজ।
প্রতিক্রিয়া
কিছুক্ষণ পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক চ্যানেলের এক ছোট ভাই বললো, “ভাই থাকেন, আসতেছি।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কই যাও?” “আর বইলেন না। গর্তে যাই। অফিস অমুক টিভিতে দেখসে তমুকরে গর্তে নাইমা ইন্টারভিউ নিসে। আমারে ফোন কইরা বলে, তুমি সাভারে বইসা বইসা করো টা কি?”
ঘটনা-৩
ঘটনাস্থলঃ গাজীপুর। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন। টঙ্গীর লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান এসেছেন ভোট দিতে। স্বভাবতই মেয়র প্রার্থী একা আসেন নি। একগাদা লোক নিয়ে তিনি ঢুকেছেন একতলা, পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট ছোট্ট এই কেন্দ্রে। যে কক্ষে তিনি ভোট দেবেন, সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে আছে দশ-বারোটি টেলিভিশন ক্যামেরা, আজমত ভোট দিচ্ছেন এই ছবিটা সবার খুব ভালো করে চাই। ফলে জনসংখ্যার চাপে অন্য চারটি বুথেও বন্ধ হয়ে গেলো ভোটগ্রহণ।
অন্য সবাই তার বাইট/শট বা সাক্ষাতকার নেওয়ার জন্য বাইরে অপেক্ষা করলেও ‘সবার আগে দেখাতে হবে’, এই চিন্তায় কক্ষের ভেতরে লাইভ শুরু করলেন একটি ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের রিপোর্টার। তিনি লাইভে আজমত উল্লা খানের বক্তব্য প্রচার করে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেলেন। ফলাফল, প্রায় ২০ মিনিটের মতো ভোট গ্রহণ স্থগিত।
এখানেই ঘটনা শেষ হতে পারতো। কিন্তু ঠিক কেন্দ্রের প্রবেশ মুখেই উপস্থিত ছিলেন আরেক চ্যানেলের এক নারী সহকর্মী। ‘ভোটারদের অসুবিধা হবে, আমরা বাইরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বক্তব্য নেই’, সহকর্মীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ওই জায়গাতেই আজমত উল্লা খানের বক্তব্য নিতে তিনি বদ্ধপরিকর।
শেষ পর্যন্ত জনস্রোতে ওই জায়গা থেকে সরে এলেও বাইরে এসে শুরু হয় বক্তব্য নেওয়ার যুদ্ধ। সবাইকেই আগে বক্তব্য নিতে হবে, সব ভিডিওগ্রাফারকেই পেতে হবে ভালো পজিশন। এই ধাক্কায় আমিসহ আরো কয়েকজন সহকর্মী ছিটকে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই, সবার শেষ হলে আমরা তার সঙ্গে আলাদা কথা বলবো।
প্রতিক্রিয়া
সব চ্যানেলকে বক্তব্য দেওয়ার পর আমরা বাকি কয়েকজন আজমত উল্লা খানকে আবার থামাই। “আবার কথা বলতে হবে আপনাকে।” তিনিও হাসিমুখেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
লাইভ ফিড সবারই রেডি থাকায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা ঢাকায়ও পাঠিয়ে দিলাম। তবে সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়ে গেলো। একটু পরে দেখি এক সহকর্মী মন খারাপ করে বসে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য চ্যানেলগুলো আজমতের বক্তব্য আগের বুলেটিনেই দেখিয়ে দিয়েছে। এজন্য অফিস থেকে ঝাড়ি খেতে হয়েছে ওই সহকর্মীকে।
এমন আরো অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ হয়তো করতে পারতাম, কিন্তু এগুলো মাঠে কাজ করা আমার সহকর্মীদের সবারই জানা থাকায় আর চর্বিত চর্বন করলাম না।
আমার প্রশ্ন হলো, সবার আগে, এবং এক্সক্লুসিভ কিছু দেখানোর দৌঁড়ে আমরা এতোটাই মত্ত হচ্ছি দিন কে দিন যে, একজন রিপোর্টার কোন জিনিস কিভাবে মাঠ থেকে সংগ্রহ করলো, তা আমরা কেন চিন্তা করার প্রয়োজনও বোধ করছি না? পরোক্ষভাবে কি উচ্চ আসনে আসীন জ্যেষ্ঠতর কর্মীরাই মাঠকর্মীদের উৎসাহিত করছি না যেনতেন প্রকারের সংবাদ সংগ্রহে? যারা না বুঝেই এমন কাজ করছে, প্রক্রিয়াটা যে সঠিক নয় তাদের শেখাবে কে?
যারা বুঝেই এ কাজগুলো না করছে, তাদের হতে হচ্ছে তিরস্কৃত, এ দায় কাদের? ‘স্পিড’ আর ‘এক্যুরেসি’ –এরও আগে যে এথিক্স বলে সংবাদে একটা জিনিস আছে, তা আমরা ক্ষুদ্র সংবাদকর্মীরা শিখবো কার কাছ থেকে?
নির্বাচনের ফলাফল কেউ আগেই দিয়ে দিয়েছেন বলে জিতে গিয়েছেন, অথবা, পিছিয়ে থেকেছেন বলেই নৈতিকতার দিক থেকে জয়ী হয়েছেন, এমন দাবি করার সময় কি এখনই চলে এসেছে?
ফলাফলে বড় ধরনের তারতম্য হওয়ায় সবার নজর এখন গাজীপুর নির্বাচনের দিকে। কিন্তু আমরা প্রতিটি চ্যানেলের সাংবাদিক প্রতিদিনই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে চলেছি মাঠেঘাটে।
আমার মনে হয়, পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইঁদুর আর আয়নার হর্তাকর্তাদেরই আজ ভাবতে হবে, কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com
No comments