নষ্টের সাধনা by সুভাষ সাহা
ব্যবস্থাটি চমৎকার। এমনকি নিখুঁতও বলা
যায়। এই ব্যবস্থায় শরিকদের রাজনৈতিক দলের রঙ মাখানো আছে। তবে সে রঙ কোন
দলের সেটা কিন্তু ঠাওর করা মুশকিল। বিরোধী দল-সরকারি দল,
ইসলামপন্থি-ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদার, রক্ষণশীল-উদারপন্থি_ সবার রঙ মিলেমিশে
একাকার।
রঙধনু রঙ যেন। অথচ এরাই আবার দলীয় রাজনীতির
বন্ধনীতে গলাছাড়া ক্ষেপা বাউলের ছন্দের মতো উদ্বাহু নৃত্যে পারদর্শী। এসব
বিচিত্র মানুষের স্বার্থের মিলটা কিন্তু অদ্ভুত। তাও আবার দেশের আদিবাসীদের
ভূমি গ্রাস করার বেলায়। দুষ্টের যেমন তার অপকর্মের জন্য ছলের অভাব হয় না;
রাজনৈতিক দলের এসব অনুসারীরও পরের ধন লোপাট করতে বাধে না। আসলে এরা
রাজনৈতিক দলের আড়ালে ভূমিদস্যু। নানা অভিঘাত সয়েও উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে
দিনাজপুরের যেসব আদিবাসী সমতলে এখনও পৈতৃক ভিটা আঁকড়ে পড়ে আছেন এবং মাথার
ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলান, তাদের ভূমিটুকু হাতিয়ে
নিতে একদল লোক এখন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। রাজনৈতিক পরিচিতিকে এরা ব্যবহার
করছে, যেন এর বিরুদ্ধে আদিবাসীরা টুঁ শব্দটি করার সাহস না পায়। অন্য কারণটি
হচ্ছে, এই পরিচিতি ব্যবহার করে স্থানীয় প্রশাসনকেও তাঁবে রাখা। এ কারণেই
বিষয়টি এখন স্থানীয় পর্যায়ে মীমাংসার অতীত বলেই বোধ হচ্ছে। আদিবাসীরা শেষ
পর্যন্ত রাজধানীতে এসে সংবাদ সম্মেলন করে, সেমিনার করে সরকারের হস্তক্ষেপ
কামনা করতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজনৈতিক পরিচিতি ব্যবহার করে একটি সম্প্রদায়কে
এভাবে ভূমিহারা করার অপচেষ্টা কি মেনে নেওয়া যায়! আর স্থানীয় পর্যায়ে
সাধারণ মানুষের কি এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা আছে! সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বা
সমাজের অভ্যন্তর থেকে যদি এসব ভূমিদস্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতো,
তাহলে আর যা-ই হোক এসব সুযোগসন্ধানী সিন্ডিকেট করে আদিবাসীদের ভূমি দখল
করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ফাঁদতে সাহস পেত না। এ কারণেই দুর্বল শ্রেণীর
স্বার্থ রক্ষায় প্রশাসনের বেশি করে সক্রিয়তা প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থ লোভের কারণে স্থানীয় প্রশাসনও এসব জঘন্য অপরাধ
দেখেও না দেখার ভান করে। এ কারণেই ভূমিদস্যুরা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে আদিবাসী
পল্লী ও চার্চে হামলা চালিয়েও ডেমকেয়ার মনোভাব দেখাতে পারে। মঙ্গলবার ঢাকা
রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ
উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা আদিবাসীদের ভূমি জবরদখলের হাত থেকে
রক্ষার আহ্বান জানিয়ে আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তের আবশ্যকতা তুলে
ধরেছেন। সরকার কি তাদের এ আহ্বানে সাড়া দেবে? আদিবাসীদের ভূমি দখলের জন্য
বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর যে সিন্ডিকেট সক্রিয়, তার বিরুদ্ধে কি কোনো
ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন? আসলে আদিবাসীদের নিজ দেশে নিজ ভূমিতে বাস করা ও
উপার্জন করে বেঁচে থাকার অধিকার সংবিধান দিয়েছে। সে অধিকারটুকু আজ নানাভাবে
ভূলুণ্ঠিত। এদের ভূমি দখল করে নিয়ে বাণিজ্য করার চমৎকার বুদ্ধি ফেঁদেছে এই
দুষ্ট রাজনৈতিক চক্র। মাঝে মধ্যে আদিবাসী পল্লীতে হামলা চালানো, আগুন
লাগানো, আদিবাসী নারীদের সম্ভ্রমহানির অপচেষ্টা, আরও কত কী তরিকা রয়েছে
রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে গড়ে ওঠা এই অশুভ আঁতাতকারী দলের। প্রশাসনের উচিত এদের
অপচেষ্টাকে সমূলে উৎপাটন করে আদিবাসীদের নিরাপত্তা বিধান করা। এ জন্য
সমাজের দায়িত্বও কম নেই। স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি ও গণ্যমান্য
ব্যক্তিবর্গের উচিত এসব অধিকারবঞ্চিত ও নিজ ভূমি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টারত
মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাদের অভয় দেওয়া এবং যাতে প্রশাসন এদের ব্যাপারে
সংবেদনশীল থাকে, সে জন্য বারবার প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের শরণাপন্ন হওয়া।
প্রশাসনের উদ্যোগ এবং সামাজিক আন্দোলনের যোগফলই পারে রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে
গড়ে ওঠা দুষ্টদের নষ্ট সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে।
No comments