ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ভাঙচুর-চারুকলা অনুষদ ও উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ককটেল নিক্ষেপ, আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগের পিটুনি
চাকরিতে সব ধরনের কোটা এবং ৩৪তম বিসিএসের
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল বাতিল করার দাবিতে আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক
সংঘর্ষ হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা যানবাহন, উপাচার্যের বাসভবন,
চারুকলা অনুষদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালায়। চারুকলা
অনুষদের ভেতরে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম বা মোটিফ ভাঙচুর করে
আগুন দেওয়া হয়।
এ আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ছাত্রশিবির তাণ্ডব চালাচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগ মিছিল বের করে। জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। আটক করা হয়েছে ৯ জনকে। দুপুর ২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় অচেনা পাঁচ শতাধিক লোককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হামলার ঘটনা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এতে শিবির জড়িত থাকতে পারে। আন্দোলনকারীদের দাবি দেখবে পিএসসি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এতে সম্পৃক্তও না।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বুধবার পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের দাবি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তারা করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতেই ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে হামলা চালায়।'
এদিকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা সংঘর্ষের ফলে কাঁটাবন মোড় থেকে মৎস্য ভবন এবং রূপসী বাংলা হোটেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে লোকজন। এ যানজটের প্রভাব পড়ে রাজধানীর প্রায় সব এলাকায়।
এ বিষয়ে রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। ঘটনাস্থল থেকে ৯ জনকে আটক করা হয়েছে।'
আন্দোলনের কর্মী সিরাজুল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল না করলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। এ পদ্ধতি বহাল থাকলে আমাদের আন্দোলন চলবে।'
৩৪তম বিসিএসে অংশ নেওয়া সাইফুল্লাহ জুয়েল বলেন, 'দেশ স্বাধীন করা হয়েছে সব বৈষম্য দূর করতে। কিন্তু এখন কোটা পদ্ধতি চালু করে প্রকৃত মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে।'
এদিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষে গতকাল বিকেল ৪টায় বিএল কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আজ শুক্রবার বিকেলে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও তিনি জানান।
চারুকলা অনুষদে হামলা : সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। শাহবাগ মোড় থেকে একটি অংশ কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের গেটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের আরেকটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে যায়। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের চারুকলা অনুষদের বকুলতলার গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। চারুকলার ভেতর থেকেও আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। একপর্যায়ে গেটের ভেতরে ও বাইরে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। চারুকলা অনুষদের ভেতরে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম বা মোটিফ টেনে রাস্তায় নিয়েও তারা ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়।
ওই সময় পুলিশ পিছু হটে শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেয়। দুপুর ১টার দিকে চারুকলার সামনে আবার পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আহত হয় একজন আন্দোলনকারী।
উপাচার্য ভবনে হামলা : আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে টিএসসি থেকে নীলক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায়। নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশ বাধা দিলে আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা টিয়ার শেল ছোড়ে। এ সময় মিছিলের একটি অংশ উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালায়। তারা বাসভবনের ফটক এবং এর ভেতরে থাকা বেশ কয়েকটি ফুলের টব ভেঙে ফেলে। তবে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, উপাচার্যের বাসায় হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। হামলার সময় উপাচার্য বাসায় ছিলেন না। বাংলোর দারোয়ান মো. মনির জানান, ৩০টির মতো ফুলের টব, দুটি দেবদারু গাছ এবং লাইটপোস্টের দুটি বাতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া গেটে মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে।
প্রশাসনিক ভবনে হামলা : দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে হামলা চালায়। ইট মেরে বেশ কয়েকটি জানালার গ্লাস ভেঙে দেয় তারা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা এমন হামলা চালাতে পারেন না। ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হামলা হলে তারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে শুধু।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয় এমন অনেক বিক্ষোভকারীকে ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল দেখা যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অপরাজেয় বাংলার আশপাশে লাঠি হাতে ঘুরছিলেন একজন বিক্ষোভকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের ইচ্ছা।' নাম জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
বাদ যায়নি কলাভবনও : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চারুকলা ও টিএসসি থেকে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দৌড়াতে থাকা বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ কলাভবন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে প্রক্টরের কার্যালয়-সংলগ্ন জাপানিজ স্টাডিজ সেন্টারের জানালার কাচ ভেঙে যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন অনেক শিক্ষার্থী। ওই গেটে অবস্থানরত এক শিক্ষার্থী বলেন, 'কোটা থাকবে কি না, সেই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো আর পিএসসি না। তা ছাড়া এভাবে কলাভবনে ইটপাটকেল ছুড়বে কেন?'
গণমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার : আন্দোলনকারী কয়েকজন দুপুর ১২টার দিকে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজ ও একাত্তর টিভির গাড়ি ভাঙচুর করে। সময় টিভির সিনিয়র রিপোর্টার ওমর ফারুকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কয়েকজন। এ সময় তারা গণমাধ্যমের প্রতি ব্যাপক বিষোদ্গার করে।
হামলায় ছাত্রলীগও : কোটাবিরোধীরা উপাচার্যের বাসভবন, কলাভবন ও প্রশাসনিক ভবনে হামলা চালানোর পর শাহবাগের দিকে যেতে থাকে। মিছিলটি মধুর ক্যান্টিনের সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
জানা যায়, মধুর ক্যান্টিনের আমতলা থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ওই মিছিল লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। উভয় পক্ষের ছোড়া ইটপাটকেলে দুজন সংবাদকর্মী আহত হন। তাঁরা হলেন দৈনিক জনতার ফখরুল ইসলাম ও আজকালের খবরের তরিকুল ইসলাম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হামলার সময় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান, সম্পাদক ওমর শরীফ এবং কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ছাড়াও হল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিল। এরপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রলীগ বিক্ষোভ মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগান দেয়। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে লাঠিসোঁটা দেখা যায়।
অর্ধশত আহত : সংঘর্ষে ৫০ জনের মতো আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে ২০ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। অন্যরা চিকিৎসা নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে। আহতদের মধ্যে ৩৩ জনের নাম জানা গেছে।
কোটা বাতিল, না সংস্কার : বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, 'বিসিএস পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়া আমাদের যৌক্তিক দাবি। কোটা পদ্ধতির কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সরকারের নির্দেশে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।'
আন্দোলনে অংশ না নিলেও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন রিয়াজুল কবির আরাফাত। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষার্থী বলেন, 'কোটা সংস্কার করা খুবই জরুরি। কোটার মাধ্যমে যেমন দুর্নীতি হয়, অন্যদিকে মেধাবীরাও বাদ পড়ে যায়। তবে সব কোটা উঠিয়ে দিলে বিরাট অমানবিক কাজ হয়ে যাবে, যা কাম্য নয়।'
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সংবাদ সম্মেলন : সংঘর্ষের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংগ্রাম পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসুসহ সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সোহাগ বলেন, 'আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানাই। তাদের ধৃষ্টতার জন্য শাস্তি দাবি করছি।' তিনি আরো বলেন, 'আমরা কোটা পদ্ধতি সংকোচনের পক্ষে, তবে তা হতে হবে পিএসসির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে। দাবি আদায়ে স্মারকলিপি প্রদান করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করা যায়।' তিনি দাবি করেন, বহিরাগতদের দিয়ে উপাচার্য ও প্রক্টর অফিসে হামলা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগের কেউ এখানে হামলা করেনি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ হামলা করে থাকতে পারে।
বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার নিন্দা জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সৈকত মল্লিক, সাইফুজ্জামান সাকন, এস এম শুভ প্রমুখ।
কোটা বাতিলের দাবিতে শিবিরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি : কোটা প্রথা বাতিল দাবি করে ছাত্রশিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে গতকাল বিকেলে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের পাঠানো ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'আজ ছাত্ররা কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলনে নেমেছে, তা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।' শিবিরের পক্ষ থেকে বলা হয়, 'যেখানে মাসের পর মাস সরকারের মদদে নাস্তিক্যবাদী ব্লগারচক্রের জমায়েত চলতে পারে, সেখানে ছাত্রদের এক দিনের অবস্থানেই সরকার নিপীড়নমূলক আচরণের পথ কেন বেছে নিয়েছে?'
এ আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ছাত্রশিবির তাণ্ডব চালাচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগ মিছিল বের করে। জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। আটক করা হয়েছে ৯ জনকে। দুপুর ২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় অচেনা পাঁচ শতাধিক লোককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হামলার ঘটনা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এতে শিবির জড়িত থাকতে পারে। আন্দোলনকারীদের দাবি দেখবে পিএসসি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এতে সম্পৃক্তও না।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বুধবার পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের দাবি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তারা করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতেই ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে হামলা চালায়।'
এদিকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা সংঘর্ষের ফলে কাঁটাবন মোড় থেকে মৎস্য ভবন এবং রূপসী বাংলা হোটেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে লোকজন। এ যানজটের প্রভাব পড়ে রাজধানীর প্রায় সব এলাকায়।
এ বিষয়ে রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। ঘটনাস্থল থেকে ৯ জনকে আটক করা হয়েছে।'
আন্দোলনের কর্মী সিরাজুল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল না করলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। এ পদ্ধতি বহাল থাকলে আমাদের আন্দোলন চলবে।'
৩৪তম বিসিএসে অংশ নেওয়া সাইফুল্লাহ জুয়েল বলেন, 'দেশ স্বাধীন করা হয়েছে সব বৈষম্য দূর করতে। কিন্তু এখন কোটা পদ্ধতি চালু করে প্রকৃত মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে।'
এদিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষে গতকাল বিকেল ৪টায় বিএল কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আজ শুক্রবার বিকেলে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও তিনি জানান।
চারুকলা অনুষদে হামলা : সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয়। শাহবাগ মোড় থেকে একটি অংশ কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের গেটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের আরেকটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে যায়। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের চারুকলা অনুষদের বকুলতলার গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। চারুকলার ভেতর থেকেও আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। একপর্যায়ে গেটের ভেতরে ও বাইরে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। চারুকলা অনুষদের ভেতরে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম বা মোটিফ টেনে রাস্তায় নিয়েও তারা ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়।
ওই সময় পুলিশ পিছু হটে শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেয়। দুপুর ১টার দিকে চারুকলার সামনে আবার পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আহত হয় একজন আন্দোলনকারী।
উপাচার্য ভবনে হামলা : আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে টিএসসি থেকে নীলক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায়। নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশ বাধা দিলে আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা টিয়ার শেল ছোড়ে। এ সময় মিছিলের একটি অংশ উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালায়। তারা বাসভবনের ফটক এবং এর ভেতরে থাকা বেশ কয়েকটি ফুলের টব ভেঙে ফেলে। তবে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, উপাচার্যের বাসায় হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। হামলার সময় উপাচার্য বাসায় ছিলেন না। বাংলোর দারোয়ান মো. মনির জানান, ৩০টির মতো ফুলের টব, দুটি দেবদারু গাছ এবং লাইটপোস্টের দুটি বাতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া গেটে মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে।
প্রশাসনিক ভবনে হামলা : দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে হামলা চালায়। ইট মেরে বেশ কয়েকটি জানালার গ্লাস ভেঙে দেয় তারা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরা এমন হামলা চালাতে পারেন না। ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হামলা হলে তারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে শুধু।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয় এমন অনেক বিক্ষোভকারীকে ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল দেখা যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অপরাজেয় বাংলার আশপাশে লাঠি হাতে ঘুরছিলেন একজন বিক্ষোভকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের ইচ্ছা।' নাম জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
বাদ যায়নি কলাভবনও : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চারুকলা ও টিএসসি থেকে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দৌড়াতে থাকা বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ কলাভবন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে প্রক্টরের কার্যালয়-সংলগ্ন জাপানিজ স্টাডিজ সেন্টারের জানালার কাচ ভেঙে যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন অনেক শিক্ষার্থী। ওই গেটে অবস্থানরত এক শিক্ষার্থী বলেন, 'কোটা থাকবে কি না, সেই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো আর পিএসসি না। তা ছাড়া এভাবে কলাভবনে ইটপাটকেল ছুড়বে কেন?'
গণমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার : আন্দোলনকারী কয়েকজন দুপুর ১২টার দিকে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজ ও একাত্তর টিভির গাড়ি ভাঙচুর করে। সময় টিভির সিনিয়র রিপোর্টার ওমর ফারুকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কয়েকজন। এ সময় তারা গণমাধ্যমের প্রতি ব্যাপক বিষোদ্গার করে।
হামলায় ছাত্রলীগও : কোটাবিরোধীরা উপাচার্যের বাসভবন, কলাভবন ও প্রশাসনিক ভবনে হামলা চালানোর পর শাহবাগের দিকে যেতে থাকে। মিছিলটি মধুর ক্যান্টিনের সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
জানা যায়, মধুর ক্যান্টিনের আমতলা থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ওই মিছিল লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। উভয় পক্ষের ছোড়া ইটপাটকেলে দুজন সংবাদকর্মী আহত হন। তাঁরা হলেন দৈনিক জনতার ফখরুল ইসলাম ও আজকালের খবরের তরিকুল ইসলাম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হামলার সময় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান, সম্পাদক ওমর শরীফ এবং কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ছাড়াও হল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিল। এরপর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রলীগ বিক্ষোভ মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগান দেয়। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে লাঠিসোঁটা দেখা যায়।
অর্ধশত আহত : সংঘর্ষে ৫০ জনের মতো আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে ২০ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। অন্যরা চিকিৎসা নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে। আহতদের মধ্যে ৩৩ জনের নাম জানা গেছে।
কোটা বাতিল, না সংস্কার : বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, 'বিসিএস পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়া আমাদের যৌক্তিক দাবি। কোটা পদ্ধতির কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সরকারের নির্দেশে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।'
আন্দোলনে অংশ না নিলেও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন রিয়াজুল কবির আরাফাত। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষার্থী বলেন, 'কোটা সংস্কার করা খুবই জরুরি। কোটার মাধ্যমে যেমন দুর্নীতি হয়, অন্যদিকে মেধাবীরাও বাদ পড়ে যায়। তবে সব কোটা উঠিয়ে দিলে বিরাট অমানবিক কাজ হয়ে যাবে, যা কাম্য নয়।'
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সংবাদ সম্মেলন : সংঘর্ষের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংগ্রাম পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসুসহ সংগ্রাম পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সোহাগ বলেন, 'আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানাই। তাদের ধৃষ্টতার জন্য শাস্তি দাবি করছি।' তিনি আরো বলেন, 'আমরা কোটা পদ্ধতি সংকোচনের পক্ষে, তবে তা হতে হবে পিএসসির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে। দাবি আদায়ে স্মারকলিপি প্রদান করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করা যায়।' তিনি দাবি করেন, বহিরাগতদের দিয়ে উপাচার্য ও প্রক্টর অফিসে হামলা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগের কেউ এখানে হামলা করেনি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ হামলা করে থাকতে পারে।
বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার নিন্দা জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সৈকত মল্লিক, সাইফুজ্জামান সাকন, এস এম শুভ প্রমুখ।
কোটা বাতিলের দাবিতে শিবিরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি : কোটা প্রথা বাতিল দাবি করে ছাত্রশিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে গতকাল বিকেলে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের পাঠানো ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'আজ ছাত্ররা কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলনে নেমেছে, তা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।' শিবিরের পক্ষ থেকে বলা হয়, 'যেখানে মাসের পর মাস সরকারের মদদে নাস্তিক্যবাদী ব্লগারচক্রের জমায়েত চলতে পারে, সেখানে ছাত্রদের এক দিনের অবস্থানেই সরকার নিপীড়নমূলক আচরণের পথ কেন বেছে নিয়েছে?'
No comments