ম্যান্ডেলা নামের মেটাফর by মাসরুর আরেফিন
১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন। তিনি বন্দি
থাকাকালে, তাঁর ৭০তম জন্মদিনে প্রকাশিত হয়েছিল এক অনন্য গ্রন্থ। সেটি নিয়ে
তাঁর জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২০১১ সালের শুরুর দিকের কথা।
বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম দ্য
নিউইয়র্কার-এ চোখে পড়ল সাইমন আরমিটেজ নামের এক আমেরিকান কবির একটু
অদ্ভুতদর্শন এক কবিতা—অদ্ভুতদর্শন এ অর্থে যে কবিতাটি পাতার ওপর সাজানো ছিল
মোটামুটি ইংরেজি অক্ষর ‘X’ বা কাটা চিহ্নের আকারে, যেমনটা দেখা যায় ষোড়শ
শতকের নামকরা কবি জর্জ হার্বার্টে। তো, সেই কবিতারই দুটি লাইন ছিল এ রকম:
‘দরজার বাইরে ধাক্কা দেয় ম্যান্ডেলা চাকা/ তাতে দীর্ঘ যুগ পরে নিদ্রা মতো
আসে’। আড়াই বছর আগে এ লাইন দুটো পড়ে যেমন বিমোহিত হয়েছিলাম, আজও ঠিক
তেমন—অবাক ও হতভম্ব! তার মানে ‘ম্যান্ডেলা’ এখন মেটাফর (রূপকালংকার)?
‘ম্যান্ডেলা চাকা’? যেমন অ্যাংলো-স্যাক্সন মিথে ‘তিমির রাস্তা’ (মানে
সমুদ্র) কিংবা বেওউলফের ‘মানব জাল’ (মানে ভিড় করে থাকা অনেক মানুষ) কিংবা
কিপলিংয়ের ‘এক গোলাপ লাল শহর, সময়ের অর্ধেক বয়সী’? সাহিত্যে সম্ভব এমন কোটি
কোটি মেটাফর থেকে ইচ্ছে করেই এখানে তুলে ধরলাম তিনটে একটু আজব মেটাফর, যা
এক সেকেন্ডের জন্য হলেও মস্তিষ্কে নাড়া দেয়। তেমনই ‘ম্যান্ডেলা চাকা’—খুব
কঠিন কোনো মেটাফর নয়, টেকনিক্যালি পরিষ্কার ব্যাখ্যাযোগ্য: এর বাহন
ম্যান্ডেলা, আর এর ভিত্তি ম্যান্ডেলার সঙ্গে চাকার যে সম্পর্ক, তা যা-ই হোক
না কেন, সেটা। এই ‘ভিত্তি’টাই আসলে মাথা ঘোরানো। পৃথিবীর অন্যায়-অবিচার ও
শোষণের বিস্তৃত থাবা দেখে হতাশ ও ক্লান্ত কবির দীর্ঘদিন পরে মনে একটু
স্বস্তি এসেছে, সেই স্বস্তি তাঁর চোখে একটু নিদ্রা এনে দিয়েছে, কারণ, কবি
শুনতে পাচ্ছেন, দরজার বাইরে ধাক্কা দিচ্ছে এক ‘চাকা’, যার নাম ‘ম্যান্ডেলা
চাকা’। অর্থাৎ, ইতিহাসের অমোঘ এক চক্রাকার গতি, যাতে আশাবাদী কবি বিশ্বাস
করেন যে চাকার মতো ঘুরে একদিন অন্যায়ের পরে আসবে ন্যায়, অবিচারের পরে আসবে
বিচার—যেমনটা সম্ভব করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, এই আমাদেরই কালে।
যেটা হয়, সাহিত্যে মনে ধরেছে এমন কোনো একটা কিছুর উল্লেখ বা পরোক্ষ-উল্লেখ পাঠককে সাধারণত নিয়ে যায় এক ভাষার সাহিত্য থেকে অন্য ভাষারটায়, এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে। তা-ই হলো। এই শক্তিশালী ও অভিনব মেটাফর ‘ম্যান্ডেলা চাকা’ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল দক্ষিণ আফ্রিকার নিষ্ঠুর বর্ণবাদী ইতিহাসের একদম গভীরে—গান্ধী থেকে নিয়ে এএনসি ইয়ুথ লিগ, রোবেন দ্বীপ থেকে নিয়ে নাদিন গর্ডিমার কিংবা জে এম কুটসি (সাহিত্যে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই নোবেল বিজয়ী, দুজনই বর্ণবাদ ও শোষণ নিয়ে অনেক লিখেছেন) পর্যন্ত। সেই পথপরিক্রমাতেই বছর দুয়েক আগে হাতে এল এক অমূল্য দলিল ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ—এ মিসসেলেনি অব নেলসন ম্যান্ডেলা অন হিস সেভেনটিথ বার্থডে—আকারে বেশি বড় নয়, শ খানেক পাতার, কিন্তু ঘন বুনটে ঠাসা এক বই, যাতে আছে ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন (উদ্যাপন বলা যায় কি? কারণ, ম্যান্ডেলা তখনো জেলে, যেমন ছিলেন তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতেও) উপলক্ষে পৃথিবীর অনেক নামীদামি কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রবন্ধ, কবিতা, সাক্ষাৎকারের এক সংকলন।
নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিন মানে, স্বাভাবিক, ১৯৮৮ সাল, যেমনটা কিনা আর পাঁচ দিন পরই (১৮ জুলাই তারিখে) আসছে তাঁর পঁচানব্বইতম জন্মদিন। মানুষের জীবনে ‘সত্তর’ অনেক বড় সংখ্যা—যখন মানুষ সাধারণত সত্তর বছর বাঁচত না, সেই ১৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ও দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস হা-হুতাশ করেছিলেন এ কথা বলে যে ‘আহা, পৃথিবীর বয়স তো মনে হয় কত বেশি, আর সামান্য সত্তরটা বছরও কিনা মানুষ বাঁচে না!’ মার্কাস অরেলিয়াসেরই বিখ্যাত মেডিটেশনস বইতে আছে, ‘তুমি জন্ম নিয়েছ ক্রীতদাস রূপে, তোমার কণ্ঠ নেই কোনো’ (খণ্ড ১১, লাইন ৩০)।
তো, দুই অর্থেই প্রাসঙ্গিক বলে মার্কাস অরেলিয়াসকে টেনে আনলাম এখানে। নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবনের উল্লেখযোগ্য মাইলফলক সত্তরকে ছোঁয়া, তিনি তখন কেপটাউনের পোলস্মুর কারাগারে ছয় বছর শেষ করে ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে পা রাখার দ্বারপ্রান্তে, তারই উদ্যাপন করলেন ডাকসাইটে সব লেখক-সাহিত্যিক, ক্রীতদাসত্বের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ন্যায্যতা আরও একবার খুব সরবে প্রতিপন্ন করতেই।
ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ বইয়ের লেখক তালিকাটা খুব ঈর্ষণীয়: এতে আছেন বর্তমানের তিন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক স্যামুয়েল বেকেট, গুন্টার গ্রাস ও সিমাস হিনি; এঁদের তিনজনেরই সমান (কিংবা অনেকের কাছেই বেশি) বিখ্যাত নাইজেরিয়ান কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে; সাত-আট বছর আগে বুকার পুরস্কার জেতা, দীর্ঘদিন ধরে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় আলো ফেলা আইরিশ ঔপন্যাসিক জন ব্যানভিল, আইরিশ কবি টমাস কিনসেলা, যিনি আমার মতো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের কবি হিসেবে বাংলাদেশেও বেশ পরিচিত, আছেন এডওয়ার্ড বন্ড, পৃথিবীর জীবিত বড় মাপের নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি; আরেক বড় কবি মাইকেল লঙলি, ২০০১ সালে ‘কুইনস গোল্ড মেডাল ফর পোয়েট্রি’ জেতা কবি তিনি, যাঁকে আমাদের এখানে মানুষ মোটামুটি চেনে তাঁর বিখ্যাত ‘যুদ্ধবিরতি’ (সিজফায়ার) কবিতাটার কারণে, যেখানে পিতা আগামেমনন বীর অ্যাকিলিসের কাছে এসেছে প্রিয় পুত্র হেক্টরের লাশ ফিরিয়ে নিতে, আর কবিতার শেষ লাইনে সে বলছে: ‘আমি বসলাম হাঁটুর ’পরে আর করলাম যা করা প্রয়োজন/ আমার ছেলের খুনি অ্যাকিলিসের হাতে রাখলাম চুম্বন।’ নিজের ছেলের হত্যাকারীর হাতে কোনো বাবা চুমু খাচ্ছেন! কী ভয়ংকর! ততখানিই ভয়ংকর এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ চিনুয়া আচেবের ‘সাহিত্য যখন উদ্যাপন’। আচেবেকে একবার স্টকহোমে সুইডিশ এক সাংবাদিক বলেন, ‘তোমরা (অর্থাৎ আফ্রিকানরা) কত ভাগ্যবান। সরকাররা তোমাদের জেলে ভরে। আর এখানে সুইডেনে, আমরা যা-ই লিখি না কেন, কেউ কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না।’ আচেবে কী বলবেন বুঝতে না পেরে ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে! এরপর আচেবে বলছেন: ‘জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এ, পুরো উপন্যাসে, কনরাড মাত্র দেড়জন আফ্রিকানকে স্রেফ ডজন খানেক শব্দ বলতে দিয়েছেন: এক নরমাংসভোজী চরিত্র যে বলে “ধরো ওকে...খাও ওকে”, আর এক আধা সংকর লোক যে ঘোষণা করে “মিস্টা (মিস্টার নয়) কুর্ৎজ্—মরে গেছে”।’
জোসেফ কনরাডের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী চেহারাটা পাঠককে ধরিয়ে দেওয়ার পরই এবার আচেবের আক্রমণ স্বদেশি নোবেলজয়ী লেখক ওলে সোইংকার ওপরে: ‘যখন সোইংকা আমাদের নেগ্রিচুড আন্দোলনকে (কালো আফ্রিকানদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার চেতনাবিষয়ক জেগে-ওঠার আন্দোলন) খারিজ করে দেওয়ার জন্য তাঁর মিডিয়াতে অতি-বিজ্ঞাপিত এক চাতুর্যপূর্ণ রসিকতায় বললেন যে, টাইগার কখনো টাইগ্রিচুড নিয়ে কথা বলে না, তখন সেংঘর (কবি লিওপোল্ড সেদার সেংঘর, এই আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা) যথাযোগ্য এক উত্তর দিলেন, বললেন: “কিন্তু টাইগার তো কথাই বলে না।” এটা শুধু সোইংকাকে দেওয়া জবাবই ছিল না, এর মধ্যে ছিল আফ্রিকান সাহিত্যেরই সংক্ষিপ্ত মেনিফেস্টো। নিগ্রোরা কথা বলে। আর কথা বলার বিষয়টা মানুষ বলে গণ্য হওয়া বা না হওয়ারই একটা মাপকাঠি, যা ঔপনিবেশিকতাবাদ আমাদের অগ্রাহ্য করেছিল। আফ্রিকান সাহিত্য, নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিনে, সেটারই উদ্যাপন করছে।’
এবার আসি গুন্টার গ্রাসের প্রবন্ধে, নাম দ্য রাইটার, অলওয়েজ এ ম্যান অব হিজ টাইম। এ বইয়ের প্রধান সুর, মানুষের মুক্তি এবং বর্ণবাদ ও অন্যান্য ঘৃণাশ্রয়ী মতবাদের বিরুদ্ধে লেখকের সজাগ চেতনা, মেনেই গ্রাস তাঁর লেখায় পরিষ্কার বলে দিলেন, লেখকের জন্য রাজনৈতিক বিষয়গুলো সামান্য বিষয় হতে পারে না, কোনো নন্দনতাত্ত্বিক চিত্তবিক্ষেপ বা খেয়ালের রূপ নিতে পারে না তা, বরং ‘রাজনীতি’ই লেখকের প্রতিরোধের আসল বনিয়াদ, তাঁর কলমের অস্তিত্বের প্রধান কারণ। এরপর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, নেরুদা, হেমিংওয়ে, আঁদ্রে মালরো, জর্জ অরওয়েল হয়ে গ্রাস এসে থামলেন এক বড় প্রশ্নের সামনে। ইতিহাসের সরকারি যে ভাষ্য, তা যেহেতু মিথ্যা ও একপেশে, সেহেতু এমনটা কি বলা যায় যে, ইতিহাস-আশ্রয় করে লেখা ভালো সাহিত্যকর্মগুলো আসলে সরকারি ইতিহাসেরই এক বড় অভাব পূরণের কাজ করে যাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে গ্রাস অন্য লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখ করলেন আমাদের বঙ্গদেশে বহুল-পঠিত এরিখ মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এবং লুই-ফার্দিনান্দ সেলিনের জার্নি টু দি এন্ড অব দ্য নাইট উপন্যাস দুটিরও। আমাদের সরকারগুলো কীভাবে তাদের শাসনের সুবিধার্থে লেখকদের প্রথমেই সরাসরি ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ননকমিউনিস্ট’ নামের দুটো খোপের ভেতরে ফেলে বিচার করে, সে প্রসঙ্গে গ্রাস বললেন ইসরায়েলের আমোস ওজ, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, দক্ষিণ আফ্রিকান নাদিন গর্ডিমার—এঁদের কথা, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ দেশের জনমানুষের শোষিত হওয়ার রূপটিকে কোনো না কোনো বড় মাপের লেখায় ভাষা দিয়েছেন।
পুরো বইটির সব না হলেও অন্তত প্রতিনিধিত্বশীল মূল লেখাগুলো পড়ার পর পরিষ্কার এমন একটি বোধ জাগে যে, এর সব লেখকই এখানে কথা বলছেন এক রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে—তাকে যেমন সাহস দিচ্ছেন এটা বলে যে, দ্যাখো, আমরা বিশ্ববিবেক তোমার পাশে আছি; তেমনই সাহস নিচ্ছেন তাঁর বন্দিজীবনের আপাত শান্ত-সুস্থির দিনগুলোর উপরিতলের নিচে বহমান মারাত্মক এক নির্বাক প্রতিবাদ থেকে। সেই রাজনৈতিক বন্দী নিঃসন্দেহে এখানে নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৮৮ সালে যখন এ বইয়ের প্রকাশ, তখন পৃথিবী নামক গ্রহে ‘ফ্রি ম্যান্ডেলা’ বা ‘ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই’ আন্দোলন তুঙ্গে। কিন্তু শুধু কি ম্যান্ডেলারই দীর্ঘ বন্দিজীবনের ‘উদ্যাপন’ আছে এখানে? না। ম্যান্ডেলাকে উপলক্ষ করে এই মহান সব লেখক এখানে সেই ‘উদ্যাপন’টা সেরে নিচ্ছেন আরও বড়, বিস্তৃত এক পরিসরের দিকে তাকিয়ে। সে কথা স্পষ্ট এ বইয়ের মধ্যভাগে নোবেলজয়ী কবি সিমাস হিনির ‘নতুন পৃথিবী’ কবিতায়। হিনি বলছেন: তৃপ্ত পর্যটক ফিরে আসে আরও কিছু পাবার আশায়/ সে কৃতজ্ঞ তার বিশেষ অধিকার ক্ষমা পেয়ে গেছে বলে।/ এই দেশে কবিতা বিদায় নিয়েছে আমাদের ফেলে/ তাদের সুইমিংপুলগুলোর মতো বলদায়ী এক ভাষায় চড়ে/ অনেক কবি আছে যারা করে যাচ্ছে দাবি/ তাদের কবিতা নাকি জন্ম দিচ্ছে বহু নতুন পৃথিবী।
বিত্তশালী, দুর্নীতিপরায়ণ শাসকের সুইমিংপুলগুলো শাসকদের শরীরে নতুন বল দেয়, আর কবিরা তাঁদের ভাষার মধ্যে সে রকম বল সঞ্চারিত করে নতুন পৃথিবীর উদ্ভাসনের গীতি লেখেন। এখানে হিনির খোঁটা ও বিদ্রূপ বুঝতে কারোই অসুবিধা হয় না। সিমাস হিনি এই বইয়ের মুদ্রার অন্য পাশটাও এভাবে দেখিয়ে দেন যথেষ্ট পষ্ট করেই—সব সাহিত্যই ম্যান্ডেলাদের মুক্তির কথা বলে, কিন্তু সব সাহিত্যিকই তাদের কমিটমেন্টের দিক থেকে আন্তরিক নন, শাসকগোষ্ঠীর পদলেহনকারী ভণ্ড মানবতাবাদী লেখক-সাহিত্যিকেরও এ পৃথিবীতে কমতি নেই কোনো।
নেলসন ম্যান্ডেলা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁকে উপলক্ষ করে এসব বড় মাপের কবি-সাহিত্যিকের সম্মিলন ঘটিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এ বইটি—ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ—নিয়ে স্বাভাবিক যে আবার কিছুটা নাড়াচাড়া পড়বে বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডলে। কারণটা সহজেই বোধগম্য। ম্যান্ডেলা এ পৃথিবীতে একজনই। আর আরও অনেক ম্যান্ডেলা আছে দেশ থেকে দেশে, শোষণের বিরুদ্ধে মুঠি তুলে। কিন্তু আমরা তাদের ম্যান্ডেলা নামে চিনি না, তবে ‘ম্যান্ডেলা’ যেহেতু এখন মেটাফর, ‘ম্যান্ডেলা’ যেহেতু এখন ইতিহাসের ‘চাকা’, সেহেতু ম্যান্ডেলাই দেশ থেকে দেশে হাতকড়া পরা সব রাজবন্দীর প্রতীকী নাম। অতএব, সেই মানুষের শেষবিদায়ের ঘণ্টা যখন বাজছে, তখন প্রকাশের পরে ১৯ লাখ কপি বিক্রি হওয়া বইটি যে আবার আলোয় আসবে, তাতে অস্বাভাবিকতার কী আছে।
শেষ করছি বইটির সম্পাদক, সাহিত্য-ইতিহাসবিদ ডব্লিউ জি ম্যাক করম্যাকের ‘ভূমিকা’ অংশের অন্তিমটুকু তুলে ধরে:
‘এই ক্ষুদ্র সংকলনটি নেলসন ম্যান্ডেলার আজীবন কারাদণ্ডের মধ্যে প্রতীকায়িত নৈতিকতার কেলেঙ্কারির দিকে সবার নিঃশঙ্ক মনোযোগের দাবি রাখছে। কোনো মৌখিক শ্রদ্ধার ফুলের তোড়া এখানে অনুপস্থিত...কারণ, উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে একমাত্র তারাই পারে, যারা কঠোরভাবে চিন্তা করতে রাজি, যেমন করেছেন ডব্লিউ এইচ অডেন: ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ/ টিচ দ্য ফ্রি ম্যান হাউ টু প্রেইজ (তাঁর সময়ের কয়েদখানায় বসে/ যারা মুক্ত তাদের শেখায় সে স্তুতির রীতি।) নেলসন ম্যান্ডেলা তেমনই এক মানুষ। শুভেচ্ছা ও স্তুতি সেদিনই পুরোপুরি যথার্থ হবে, যেদিন মুক্তি আসবে দক্ষিণ আফ্রিকার।’
১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার, আর সেদিন থেকেই ম্যান্ডেলা সংগ্রাম ও আশাবাদের মেটাফর হলেন।
যেটা হয়, সাহিত্যে মনে ধরেছে এমন কোনো একটা কিছুর উল্লেখ বা পরোক্ষ-উল্লেখ পাঠককে সাধারণত নিয়ে যায় এক ভাষার সাহিত্য থেকে অন্য ভাষারটায়, এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে। তা-ই হলো। এই শক্তিশালী ও অভিনব মেটাফর ‘ম্যান্ডেলা চাকা’ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল দক্ষিণ আফ্রিকার নিষ্ঠুর বর্ণবাদী ইতিহাসের একদম গভীরে—গান্ধী থেকে নিয়ে এএনসি ইয়ুথ লিগ, রোবেন দ্বীপ থেকে নিয়ে নাদিন গর্ডিমার কিংবা জে এম কুটসি (সাহিত্যে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই নোবেল বিজয়ী, দুজনই বর্ণবাদ ও শোষণ নিয়ে অনেক লিখেছেন) পর্যন্ত। সেই পথপরিক্রমাতেই বছর দুয়েক আগে হাতে এল এক অমূল্য দলিল ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ—এ মিসসেলেনি অব নেলসন ম্যান্ডেলা অন হিস সেভেনটিথ বার্থডে—আকারে বেশি বড় নয়, শ খানেক পাতার, কিন্তু ঘন বুনটে ঠাসা এক বই, যাতে আছে ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন (উদ্যাপন বলা যায় কি? কারণ, ম্যান্ডেলা তখনো জেলে, যেমন ছিলেন তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতেও) উপলক্ষে পৃথিবীর অনেক নামীদামি কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রবন্ধ, কবিতা, সাক্ষাৎকারের এক সংকলন।
নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিন মানে, স্বাভাবিক, ১৯৮৮ সাল, যেমনটা কিনা আর পাঁচ দিন পরই (১৮ জুলাই তারিখে) আসছে তাঁর পঁচানব্বইতম জন্মদিন। মানুষের জীবনে ‘সত্তর’ অনেক বড় সংখ্যা—যখন মানুষ সাধারণত সত্তর বছর বাঁচত না, সেই ১৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ও দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস হা-হুতাশ করেছিলেন এ কথা বলে যে ‘আহা, পৃথিবীর বয়স তো মনে হয় কত বেশি, আর সামান্য সত্তরটা বছরও কিনা মানুষ বাঁচে না!’ মার্কাস অরেলিয়াসেরই বিখ্যাত মেডিটেশনস বইতে আছে, ‘তুমি জন্ম নিয়েছ ক্রীতদাস রূপে, তোমার কণ্ঠ নেই কোনো’ (খণ্ড ১১, লাইন ৩০)।
তো, দুই অর্থেই প্রাসঙ্গিক বলে মার্কাস অরেলিয়াসকে টেনে আনলাম এখানে। নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবনের উল্লেখযোগ্য মাইলফলক সত্তরকে ছোঁয়া, তিনি তখন কেপটাউনের পোলস্মুর কারাগারে ছয় বছর শেষ করে ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে পা রাখার দ্বারপ্রান্তে, তারই উদ্যাপন করলেন ডাকসাইটে সব লেখক-সাহিত্যিক, ক্রীতদাসত্বের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ন্যায্যতা আরও একবার খুব সরবে প্রতিপন্ন করতেই।
ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ বইয়ের লেখক তালিকাটা খুব ঈর্ষণীয়: এতে আছেন বর্তমানের তিন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক স্যামুয়েল বেকেট, গুন্টার গ্রাস ও সিমাস হিনি; এঁদের তিনজনেরই সমান (কিংবা অনেকের কাছেই বেশি) বিখ্যাত নাইজেরিয়ান কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে; সাত-আট বছর আগে বুকার পুরস্কার জেতা, দীর্ঘদিন ধরে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় আলো ফেলা আইরিশ ঔপন্যাসিক জন ব্যানভিল, আইরিশ কবি টমাস কিনসেলা, যিনি আমার মতো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের কবি হিসেবে বাংলাদেশেও বেশ পরিচিত, আছেন এডওয়ার্ড বন্ড, পৃথিবীর জীবিত বড় মাপের নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি; আরেক বড় কবি মাইকেল লঙলি, ২০০১ সালে ‘কুইনস গোল্ড মেডাল ফর পোয়েট্রি’ জেতা কবি তিনি, যাঁকে আমাদের এখানে মানুষ মোটামুটি চেনে তাঁর বিখ্যাত ‘যুদ্ধবিরতি’ (সিজফায়ার) কবিতাটার কারণে, যেখানে পিতা আগামেমনন বীর অ্যাকিলিসের কাছে এসেছে প্রিয় পুত্র হেক্টরের লাশ ফিরিয়ে নিতে, আর কবিতার শেষ লাইনে সে বলছে: ‘আমি বসলাম হাঁটুর ’পরে আর করলাম যা করা প্রয়োজন/ আমার ছেলের খুনি অ্যাকিলিসের হাতে রাখলাম চুম্বন।’ নিজের ছেলের হত্যাকারীর হাতে কোনো বাবা চুমু খাচ্ছেন! কী ভয়ংকর! ততখানিই ভয়ংকর এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ চিনুয়া আচেবের ‘সাহিত্য যখন উদ্যাপন’। আচেবেকে একবার স্টকহোমে সুইডিশ এক সাংবাদিক বলেন, ‘তোমরা (অর্থাৎ আফ্রিকানরা) কত ভাগ্যবান। সরকাররা তোমাদের জেলে ভরে। আর এখানে সুইডেনে, আমরা যা-ই লিখি না কেন, কেউ কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না।’ আচেবে কী বলবেন বুঝতে না পেরে ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে! এরপর আচেবে বলছেন: ‘জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এ, পুরো উপন্যাসে, কনরাড মাত্র দেড়জন আফ্রিকানকে স্রেফ ডজন খানেক শব্দ বলতে দিয়েছেন: এক নরমাংসভোজী চরিত্র যে বলে “ধরো ওকে...খাও ওকে”, আর এক আধা সংকর লোক যে ঘোষণা করে “মিস্টা (মিস্টার নয়) কুর্ৎজ্—মরে গেছে”।’
জোসেফ কনরাডের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী চেহারাটা পাঠককে ধরিয়ে দেওয়ার পরই এবার আচেবের আক্রমণ স্বদেশি নোবেলজয়ী লেখক ওলে সোইংকার ওপরে: ‘যখন সোইংকা আমাদের নেগ্রিচুড আন্দোলনকে (কালো আফ্রিকানদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার চেতনাবিষয়ক জেগে-ওঠার আন্দোলন) খারিজ করে দেওয়ার জন্য তাঁর মিডিয়াতে অতি-বিজ্ঞাপিত এক চাতুর্যপূর্ণ রসিকতায় বললেন যে, টাইগার কখনো টাইগ্রিচুড নিয়ে কথা বলে না, তখন সেংঘর (কবি লিওপোল্ড সেদার সেংঘর, এই আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা) যথাযোগ্য এক উত্তর দিলেন, বললেন: “কিন্তু টাইগার তো কথাই বলে না।” এটা শুধু সোইংকাকে দেওয়া জবাবই ছিল না, এর মধ্যে ছিল আফ্রিকান সাহিত্যেরই সংক্ষিপ্ত মেনিফেস্টো। নিগ্রোরা কথা বলে। আর কথা বলার বিষয়টা মানুষ বলে গণ্য হওয়া বা না হওয়ারই একটা মাপকাঠি, যা ঔপনিবেশিকতাবাদ আমাদের অগ্রাহ্য করেছিল। আফ্রিকান সাহিত্য, নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মদিনে, সেটারই উদ্যাপন করছে।’
এবার আসি গুন্টার গ্রাসের প্রবন্ধে, নাম দ্য রাইটার, অলওয়েজ এ ম্যান অব হিজ টাইম। এ বইয়ের প্রধান সুর, মানুষের মুক্তি এবং বর্ণবাদ ও অন্যান্য ঘৃণাশ্রয়ী মতবাদের বিরুদ্ধে লেখকের সজাগ চেতনা, মেনেই গ্রাস তাঁর লেখায় পরিষ্কার বলে দিলেন, লেখকের জন্য রাজনৈতিক বিষয়গুলো সামান্য বিষয় হতে পারে না, কোনো নন্দনতাত্ত্বিক চিত্তবিক্ষেপ বা খেয়ালের রূপ নিতে পারে না তা, বরং ‘রাজনীতি’ই লেখকের প্রতিরোধের আসল বনিয়াদ, তাঁর কলমের অস্তিত্বের প্রধান কারণ। এরপর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, নেরুদা, হেমিংওয়ে, আঁদ্রে মালরো, জর্জ অরওয়েল হয়ে গ্রাস এসে থামলেন এক বড় প্রশ্নের সামনে। ইতিহাসের সরকারি যে ভাষ্য, তা যেহেতু মিথ্যা ও একপেশে, সেহেতু এমনটা কি বলা যায় যে, ইতিহাস-আশ্রয় করে লেখা ভালো সাহিত্যকর্মগুলো আসলে সরকারি ইতিহাসেরই এক বড় অভাব পূরণের কাজ করে যাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে গ্রাস অন্য লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখ করলেন আমাদের বঙ্গদেশে বহুল-পঠিত এরিখ মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এবং লুই-ফার্দিনান্দ সেলিনের জার্নি টু দি এন্ড অব দ্য নাইট উপন্যাস দুটিরও। আমাদের সরকারগুলো কীভাবে তাদের শাসনের সুবিধার্থে লেখকদের প্রথমেই সরাসরি ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ননকমিউনিস্ট’ নামের দুটো খোপের ভেতরে ফেলে বিচার করে, সে প্রসঙ্গে গ্রাস বললেন ইসরায়েলের আমোস ওজ, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, দক্ষিণ আফ্রিকান নাদিন গর্ডিমার—এঁদের কথা, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ দেশের জনমানুষের শোষিত হওয়ার রূপটিকে কোনো না কোনো বড় মাপের লেখায় ভাষা দিয়েছেন।
পুরো বইটির সব না হলেও অন্তত প্রতিনিধিত্বশীল মূল লেখাগুলো পড়ার পর পরিষ্কার এমন একটি বোধ জাগে যে, এর সব লেখকই এখানে কথা বলছেন এক রাজনৈতিক বন্দীর সঙ্গে—তাকে যেমন সাহস দিচ্ছেন এটা বলে যে, দ্যাখো, আমরা বিশ্ববিবেক তোমার পাশে আছি; তেমনই সাহস নিচ্ছেন তাঁর বন্দিজীবনের আপাত শান্ত-সুস্থির দিনগুলোর উপরিতলের নিচে বহমান মারাত্মক এক নির্বাক প্রতিবাদ থেকে। সেই রাজনৈতিক বন্দী নিঃসন্দেহে এখানে নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৮৮ সালে যখন এ বইয়ের প্রকাশ, তখন পৃথিবী নামক গ্রহে ‘ফ্রি ম্যান্ডেলা’ বা ‘ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই’ আন্দোলন তুঙ্গে। কিন্তু শুধু কি ম্যান্ডেলারই দীর্ঘ বন্দিজীবনের ‘উদ্যাপন’ আছে এখানে? না। ম্যান্ডেলাকে উপলক্ষ করে এই মহান সব লেখক এখানে সেই ‘উদ্যাপন’টা সেরে নিচ্ছেন আরও বড়, বিস্তৃত এক পরিসরের দিকে তাকিয়ে। সে কথা স্পষ্ট এ বইয়ের মধ্যভাগে নোবেলজয়ী কবি সিমাস হিনির ‘নতুন পৃথিবী’ কবিতায়। হিনি বলছেন: তৃপ্ত পর্যটক ফিরে আসে আরও কিছু পাবার আশায়/ সে কৃতজ্ঞ তার বিশেষ অধিকার ক্ষমা পেয়ে গেছে বলে।/ এই দেশে কবিতা বিদায় নিয়েছে আমাদের ফেলে/ তাদের সুইমিংপুলগুলোর মতো বলদায়ী এক ভাষায় চড়ে/ অনেক কবি আছে যারা করে যাচ্ছে দাবি/ তাদের কবিতা নাকি জন্ম দিচ্ছে বহু নতুন পৃথিবী।
বিত্তশালী, দুর্নীতিপরায়ণ শাসকের সুইমিংপুলগুলো শাসকদের শরীরে নতুন বল দেয়, আর কবিরা তাঁদের ভাষার মধ্যে সে রকম বল সঞ্চারিত করে নতুন পৃথিবীর উদ্ভাসনের গীতি লেখেন। এখানে হিনির খোঁটা ও বিদ্রূপ বুঝতে কারোই অসুবিধা হয় না। সিমাস হিনি এই বইয়ের মুদ্রার অন্য পাশটাও এভাবে দেখিয়ে দেন যথেষ্ট পষ্ট করেই—সব সাহিত্যই ম্যান্ডেলাদের মুক্তির কথা বলে, কিন্তু সব সাহিত্যিকই তাদের কমিটমেন্টের দিক থেকে আন্তরিক নন, শাসকগোষ্ঠীর পদলেহনকারী ভণ্ড মানবতাবাদী লেখক-সাহিত্যিকেরও এ পৃথিবীতে কমতি নেই কোনো।
নেলসন ম্যান্ডেলা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁকে উপলক্ষ করে এসব বড় মাপের কবি-সাহিত্যিকের সম্মিলন ঘটিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এ বইটি—ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ—নিয়ে স্বাভাবিক যে আবার কিছুটা নাড়াচাড়া পড়বে বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডলে। কারণটা সহজেই বোধগম্য। ম্যান্ডেলা এ পৃথিবীতে একজনই। আর আরও অনেক ম্যান্ডেলা আছে দেশ থেকে দেশে, শোষণের বিরুদ্ধে মুঠি তুলে। কিন্তু আমরা তাদের ম্যান্ডেলা নামে চিনি না, তবে ‘ম্যান্ডেলা’ যেহেতু এখন মেটাফর, ‘ম্যান্ডেলা’ যেহেতু এখন ইতিহাসের ‘চাকা’, সেহেতু ম্যান্ডেলাই দেশ থেকে দেশে হাতকড়া পরা সব রাজবন্দীর প্রতীকী নাম। অতএব, সেই মানুষের শেষবিদায়ের ঘণ্টা যখন বাজছে, তখন প্রকাশের পরে ১৯ লাখ কপি বিক্রি হওয়া বইটি যে আবার আলোয় আসবে, তাতে অস্বাভাবিকতার কী আছে।
শেষ করছি বইটির সম্পাদক, সাহিত্য-ইতিহাসবিদ ডব্লিউ জি ম্যাক করম্যাকের ‘ভূমিকা’ অংশের অন্তিমটুকু তুলে ধরে:
‘এই ক্ষুদ্র সংকলনটি নেলসন ম্যান্ডেলার আজীবন কারাদণ্ডের মধ্যে প্রতীকায়িত নৈতিকতার কেলেঙ্কারির দিকে সবার নিঃশঙ্ক মনোযোগের দাবি রাখছে। কোনো মৌখিক শ্রদ্ধার ফুলের তোড়া এখানে অনুপস্থিত...কারণ, উপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে একমাত্র তারাই পারে, যারা কঠোরভাবে চিন্তা করতে রাজি, যেমন করেছেন ডব্লিউ এইচ অডেন: ইন দ্য প্রিজন অব হিজ ডেজ/ টিচ দ্য ফ্রি ম্যান হাউ টু প্রেইজ (তাঁর সময়ের কয়েদখানায় বসে/ যারা মুক্ত তাদের শেখায় সে স্তুতির রীতি।) নেলসন ম্যান্ডেলা তেমনই এক মানুষ। শুভেচ্ছা ও স্তুতি সেদিনই পুরোপুরি যথার্থ হবে, যেদিন মুক্তি আসবে দক্ষিণ আফ্রিকার।’
১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার, আর সেদিন থেকেই ম্যান্ডেলা সংগ্রাম ও আশাবাদের মেটাফর হলেন।
No comments