বিপজ্জনক সড়ক by এম আবদুল হাফিজ
রাজনীতির চলমান ডামাডোলের মধ্যে প্রসঙ্গটি
প্রায় হারিয়েই গেছে। অতীতে মাঝে মধ্যেই এ নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক নতুন মাত্রা
নিয়ে হাজির হতো উদ্বিগ্ন এ দেশের মানুষের কাছে, যারা রাজপথে বা মহাসড়কে
নগ্নভাবে নিরাপত্তাহীন।
কিছু প্রতিক্রিয়াও পরিদৃষ্ট হতো
সরকারের উঁচু মহলে, শোনা যেত কিছু হাঁকডাক, প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতি। নিরাপদ
সড়কের কুশীলবরা নড়েচড়ে বসতেন, নিদেনপক্ষে তারা বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন। অন্তত
কিছুটা চাঞ্চল্য বিরাজ করত যখন সড়কের সাক্ষাৎ দানব কেড়ে নিত কিছু বিশিষ্ট
লোকের প্রাণ। সেসব কিছু এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে সরকারের বা সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষের নির্বিকারত্বে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মেজাজ তো বেশি দিন
ধরেও রাখা যায় না। তা ছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত ও অকল্যাণকর কোনো কিছুর স্মৃতি
অন্তরে পুষে রাখাও দুঃসহ। তাই সে যাতনা থেকে মুক্তির পথই বিস্মৃতি।
আসলে সময়ের কোনো বিন্দুতেই সড়ক দুর্ঘটনার মতো বেদনা সঞ্চারক বিষয়টি দেশ ও সমাজ থেকে চলে যায়নি। বরং আমরাই এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তা না হলে অতীতের কথা বাদই দিলাম, ইদানীংকালে টেলিভিশন খুললেই অনেক সংঘাতের সঙ্গে যে বিষয়টি সংবাদ শিরোনামের চলন্ত লাইনে থাকবেই তা হলো সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে প্রাণহানির সংখ্যা। গত কিছুদিন ধরেই দেখছি যে এর সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কয়েক দিনও এসব অস্বাভাবিক অপমৃত্যুর প্রাত্যহিক হিসাবটাও মনের কোটরে সংরক্ষিত হতে পারছে না।
তবে সেগুলো সাধারণভাবে অনুভূতিতে একটি ছাপ রেখে যায়, যা খুব বিষণ্ন, বেদনাদায়ক। সঙ্গে একটি গ্গ্নানিও রেখে যায় যে, আমরা এত বছরে এর কোনো বিহিতও করতে পারলাম না। অথচ কিছু কিছু পরিসংখ্যান তো রয়েছে, যার সাহায্য নিয়ে সদিচ্ছা থাকলে নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন কিন্তু কোনো মোহ বা মায়াজাল নয়। সড়কের নিরাপত্তা বাস্তবায়িত অবশ্যই হতে পারে। এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অনেক আলোচনা হলেও অবস্থাদৃষ্টে ভাবা যায় যে, নিরাপদ সড়ক কোনো সরকারের আমলেই এর প্রাপ্য অগ্রাধিকার পায়নি।
শোনা যায় যে, দেশে এত এতসংখ্যক অমুক অমুক ক্যাটাগরির যান্ত্রিক যান রয়েছে, যার বিপরীতে ইস্যুকৃত চালক লাইসেন্সের সংখ্যা নগণ্য। এই নিবন্ধকারের অভিজ্ঞতায় যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, নিকটবর্তী কোনো ফাঁড়ির পুলিশের সাহায্য নিয়ে দুর্ঘটনার একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, অপরাধী গাড়িটির চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্সই নেই। আমাদের সমস্যা হলো এই যে, অশুভ কোনো কিছুকে প্রতিরোধ করতে যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা গ্রহণের স্বতঃস্ফূর্ততা কদাচিৎ কারও মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশই ভাবে যে, এই ঝামেলায় গিয়ে আমার কী লাভ?
সড়ক দুর্ঘটনার সিংহভাগ ঘটে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের অভাবে। অবশ্য যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়ক ব্যবস্থা এবং চালকের শৃঙ্খলা বোধের অভাব এর জন্য কম দায়ী নয়। অনেক চালককে বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে অপচিত সময়ের খেসারত দিতে গাড়ির গতিবেগ তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিক বৃদ্ধি করতে হয়। রাত্রি জাগরণে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ায় বা অসতর্ক বাঁক পরিবর্তনের সময় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর প্রতিবিধান খুব একটা দুঃসাধ্য না হলেও সংশ্লিষ্ট সব মহলের অনীহা আজও সড়ক দুর্ঘটনার দানবকে কার্যত অপ্রতিরোধ্যই করে রেখেছে। ফলে যারা অহরহ জীবনের তাগিদে রাতবিরাতে সড়ক ব্যবহারে বাধ্য হন, তারা এর ঝুঁকিকে নিয়তি হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজ্ঞাতপরিচয় শিকারদের ভাগ্য ট্র্যাজেডির আরেক ডাইমেনশনের উপজীব্য। এমন অপমৃত্যু তাদের মুহূর্তে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে, অনেক সময় তাদের স্বজনরাও জানতে পারে না কোথায় হারিয়ে গেল এক জলজ্যান্ত মানুষ। যদিওবা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাদের ঠাঁই মেলে কোনো অজ্ঞাত কবরে, অনেক সময় সে খবরটিও পেঁৗছে না তার একান্ত প্রিয়জনের কাছে। অথচ মানুষের দুঃখানুভূতি কোনো কৌলীন্য বা বংশ পরিচিতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত নয়। কবিগুরুর 'কিনু গোয়ালার গলি'র শেষ ক'টি পঙ্ক্তির মর্মানুযায়ী মানুষের দুঃখানুভূতিতে হরিপদ কেরানি ও আকবর বাদশার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।
অপমৃত্যুর শিকার হয়ে যে মানুষটি নীরবে-নিভৃতে বিদায় নেয়, তার হিসাব তো জীবনের খাতা থেকে চুকেবুকেই গেল। আসুন, আমরা এমন বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এমন কিছু করি, যাতে আরও দুঃখ, গ্গ্নানি এবং স্বজন হারানোর ব্যথা এই দেশকে, সমাজকে ভারাক্রান্ত না করতে পারে।
স ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
আসলে সময়ের কোনো বিন্দুতেই সড়ক দুর্ঘটনার মতো বেদনা সঞ্চারক বিষয়টি দেশ ও সমাজ থেকে চলে যায়নি। বরং আমরাই এই ট্র্যাজেডির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তা না হলে অতীতের কথা বাদই দিলাম, ইদানীংকালে টেলিভিশন খুললেই অনেক সংঘাতের সঙ্গে যে বিষয়টি সংবাদ শিরোনামের চলন্ত লাইনে থাকবেই তা হলো সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে প্রাণহানির সংখ্যা। গত কিছুদিন ধরেই দেখছি যে এর সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কয়েক দিনও এসব অস্বাভাবিক অপমৃত্যুর প্রাত্যহিক হিসাবটাও মনের কোটরে সংরক্ষিত হতে পারছে না।
তবে সেগুলো সাধারণভাবে অনুভূতিতে একটি ছাপ রেখে যায়, যা খুব বিষণ্ন, বেদনাদায়ক। সঙ্গে একটি গ্গ্নানিও রেখে যায় যে, আমরা এত বছরে এর কোনো বিহিতও করতে পারলাম না। অথচ কিছু কিছু পরিসংখ্যান তো রয়েছে, যার সাহায্য নিয়ে সদিচ্ছা থাকলে নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন কিন্তু কোনো মোহ বা মায়াজাল নয়। সড়কের নিরাপত্তা বাস্তবায়িত অবশ্যই হতে পারে। এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে অনেক আলোচনা হলেও অবস্থাদৃষ্টে ভাবা যায় যে, নিরাপদ সড়ক কোনো সরকারের আমলেই এর প্রাপ্য অগ্রাধিকার পায়নি।
শোনা যায় যে, দেশে এত এতসংখ্যক অমুক অমুক ক্যাটাগরির যান্ত্রিক যান রয়েছে, যার বিপরীতে ইস্যুকৃত চালক লাইসেন্সের সংখ্যা নগণ্য। এই নিবন্ধকারের অভিজ্ঞতায় যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, নিকটবর্তী কোনো ফাঁড়ির পুলিশের সাহায্য নিয়ে দুর্ঘটনার একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, অপরাধী গাড়িটির চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্সই নেই। আমাদের সমস্যা হলো এই যে, অশুভ কোনো কিছুকে প্রতিরোধ করতে যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা গ্রহণের স্বতঃস্ফূর্ততা কদাচিৎ কারও মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশই ভাবে যে, এই ঝামেলায় গিয়ে আমার কী লাভ?
সড়ক দুর্ঘটনার সিংহভাগ ঘটে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের অভাবে। অবশ্য যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়ক ব্যবস্থা এবং চালকের শৃঙ্খলা বোধের অভাব এর জন্য কম দায়ী নয়। অনেক চালককে বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে অপচিত সময়ের খেসারত দিতে গাড়ির গতিবেগ তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিক বৃদ্ধি করতে হয়। রাত্রি জাগরণে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ায় বা অসতর্ক বাঁক পরিবর্তনের সময় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর প্রতিবিধান খুব একটা দুঃসাধ্য না হলেও সংশ্লিষ্ট সব মহলের অনীহা আজও সড়ক দুর্ঘটনার দানবকে কার্যত অপ্রতিরোধ্যই করে রেখেছে। ফলে যারা অহরহ জীবনের তাগিদে রাতবিরাতে সড়ক ব্যবহারে বাধ্য হন, তারা এর ঝুঁকিকে নিয়তি হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অজ্ঞাতপরিচয় শিকারদের ভাগ্য ট্র্যাজেডির আরেক ডাইমেনশনের উপজীব্য। এমন অপমৃত্যু তাদের মুহূর্তে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে, অনেক সময় তাদের স্বজনরাও জানতে পারে না কোথায় হারিয়ে গেল এক জলজ্যান্ত মানুষ। যদিওবা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তাদের ঠাঁই মেলে কোনো অজ্ঞাত কবরে, অনেক সময় সে খবরটিও পেঁৗছে না তার একান্ত প্রিয়জনের কাছে। অথচ মানুষের দুঃখানুভূতি কোনো কৌলীন্য বা বংশ পরিচিতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত নয়। কবিগুরুর 'কিনু গোয়ালার গলি'র শেষ ক'টি পঙ্ক্তির মর্মানুযায়ী মানুষের দুঃখানুভূতিতে হরিপদ কেরানি ও আকবর বাদশার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।
অপমৃত্যুর শিকার হয়ে যে মানুষটি নীরবে-নিভৃতে বিদায় নেয়, তার হিসাব তো জীবনের খাতা থেকে চুকেবুকেই গেল। আসুন, আমরা এমন বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এমন কিছু করি, যাতে আরও দুঃখ, গ্গ্নানি এবং স্বজন হারানোর ব্যথা এই দেশকে, সমাজকে ভারাক্রান্ত না করতে পারে।
স ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল
হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments