ভালো থাকো ভালো চাই পত্রের যেন উত্তর পাই by সালেহা চৌধুরী
কবে কখন এমন করে চিঠির শেষে লিখতাম মনে
করতে গেলে মনে পড়ে_ ছোটবেলায় এমন সব কথা চিঠিতে লেখা হতো_ যাও পাখি বলো
তারে/সে যেন ভোলে না মোরে। তারপর ইদায়। এবং এবার ৮০।
চিঠির মতো এমন কিছু কি ছিল আমাদের সময়ে? সব পোস্টম্যানই ছিল অমলের পোস্ট
অফিসের সেই বিশেষ লোকটি, যিনি স্বর্গ থেকে নিয়ে আসবেন কিছু খুশির খবর।
ছোটবেলায় বেদনার চিঠি ভাবা যেত না। চিঠি মানেই মজার খবর, চিঠি মানেই কোনো
খুশির পাখি। পরে অবশ্য বেদনার চিঠির কথা জানা হয়েছিল। আমার ভাই আমেরিকায়
পড়তে গিয়েছিলেন। তাঁর একটা চিঠির দাম ছিল সেকালে আট আনা। বিদেশের সেই বিশেষ
চিঠি এলেই আমার মা পোস্টম্যানকে আট আনা দিতেন। আর সে চিঠি মায়ের হাতে তুলে
দেওয়ার কৃতিত্ব প্রায়ই আমারই হতো। আসত আরও নানা আত্মীয়-পরিজনের চিঠি।
দুলাভাইদের মজার চিঠি। আপাদের আদর আর শাসন মাখানো চিঠি। যেন আমার জীবনের
দুরন্ত ছেলেবেলা নিয়ে তাদের রাতের ঘুম নষ্ট হতে বসেছে। সেগুলো অগ্রাহ্য
করলেও ওদের চিঠির অপেক্ষা থাকত। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত গান_
রানার।
আমার আব্বা স্কুল ইন্সপেক্টর বলে পণ্ডিতদের নানারকম চিঠি পেতেন। একবার একজন পণ্ডিত লিখেছিলেন_ স্যার দয়া করিয়া আমাদের ইশকুলে আপনার পায়ের ধুলা পড়িবে এই কথা জানিয়া আমরা খুব গরীবি হালে ষড়যন্ত্র করিতেছে। জোগাড়যন্ত্র লিখতে গিয়ে বোধকরি ষড়যন্ত্র লিখেছিলেন। আব্বা কেবল বলেছিলেন_ তোরাই বল ওখানে যাওয়া কি ঠিক হবে? যেভাবে ওরা ষড়যন্ত্র করছে।
আমার ভাই আমেরিকা থেকে লিখেছিলেন_ তুই যদি উঠোনের মধ্যে ফুটো করতে থাকিস তাহলে একদিন আমার কাছে চলে আসবি। চেষ্টা চালিয়ে যা। কয়দিন চেষ্টা চালানোর পর হাল ছেড়েছিলাম। একজন প্রেমিক বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে। তার ছোটবোনকে দিয়ে বই পাঠাতেন। বইয়ের ভেতর চিঠি থাকত। প্রথম চিঠিটা মনে আছে ভয়ে ভয়ে আমি পায়খানার ভেতরে নিয়ে গিয়ে পড়েছিলাম। মোটেই রোমান্টিক নয় ব্যাপারটা, তাই না? কী করব। এমন অভিজ্ঞতা আগে ছিল না কি-না। প্রথম দিকে চিঠিগুলো ভালোবাসার চিনি/গুড়ে মাখামাখি থাকলেও পরের দিকে সেগুলো কঠিন হতে থাকে। কারণ আমি কোনো উত্তর দেইনি। শেষ চিঠিটা এমন ছিল_ এরপর যদি উত্তর না পাই রাস্তায় বেরুলে তোমার পা ভেঙে দেব। তারপরও যখন উত্তর পেলেন না, উনি আমার পা ভাঙতে না পেরে ফরিদপুর থেকে বোনের বাড়ি ময়মনসিংহে চলে গিয়েছিলেন। আমরা যতদিন ছিলাম উনি আর ফরিদপুরে ফিরে আসেননি। এটা নিশ্চয়ই একটি মহৎ ও বড় প্রেম বলতেই হয়। ঠিক ওই সময়ই আমার প্রয়াত স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী চিঠিতে লিখেছিলেন_ আমি তোমাকে ভালোবাসি। কয়েক বছর পরে তিনি অনেক বলে_ কয়ে আমার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে করেন। তখন আমি কেবল য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকেছি। বাড়ির কেউ রাজি নন। তিনি আমার মায়ের পা ধরে বলেছিলেন_ আমি কথা দিচ্ছি আপনার মেয়েকে পড়াব [তিনি কথা রেখেছিলেন]। তিনি দুই বছর লেসোথোতে ছিলেন প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। অনেক চিঠি লেখালেখি হয়েছিল। আমি লন্ডনে বাড়ি, চাকরি আর সংসার সামলাতাম। ওর আর আমার চিঠিগুলো একটি সুন্দর বাক্সে সাজানো আছে।
য়ুনিভার্সিটির প্রথম বেঞ্চিতে বসে আমরা প্রচুর নোট বা চিরকুট চালাচালি করতাম। সেটা একজন আর একজনকে পাস করত। একবার মনিরুজ্জামান স্যারের ক্লাসে সেলিনা ডেইজি একটু ছোট চিরকুটে লিখল_ সেই মধুমুখ, সেই মধুহাসি, সেই সুধাভরা হাসি/চিরদিন মোরে বি প্লাস দিল/চিরদিন দিল ফাঁকি। সেই সুধামুখের মনিরুজ্জামান স্যার গম্ভীর মুখে আমাদের দেখতে লাগলেন_ আমাদের প্রাণপণ হাসি গোপন করবার প্রাণান্তকর প্রয়াস বুঝতে পেরে বিশেষ কিছু বললেন না। তিনি সত্যিই বড় চমৎকার হাসিখুশির একজন ছিলেন। একবার ফেরদৌসী মজুমদার একটা চিরকুটে লিখেছিল মনে আছে_ চর্যাপদের এই সব পদকর্তার নামের শেষে 'পাদ' যুক্ত কেন জানিস? [ কাহ্ন পাদ, ভুসুকু পাদ, লুই পাদ ইত্যাদি] ওরা সব বায়ুভুক ছিলেন। প্রফেসর আবদুল হাই বেশ কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন সামনের বেঞ্চের মেয়েরা সব হাসি চাপার প্রয়াসে এক একজন লাল হয়ে উঠছে কেন?
এই চিরকুট কিন্তু সময় বিশেষে চিঠির চাইতেও মজার হতো। আমরা চিরকুট চালাচালিতে জানতাম বর্তমানে ক্লাসের কোনো ছেলে বা কোনো মেয়ে কার প্রতি বিশেষ নজর দিতে চেষ্টা করছে ইত্যাদি। আমার বিয়ে হয়ে গেছে; কাজেই সকলের নানা সুখ-দুঃখের কথা আমাকেই শুনতে হতো মহান খালাম্মার মতো। আমার ময়মনসিংহের এক সহপাঠী আর এক সহপাঠিনীকে লিখেছিলেন_ আমার দুঃখের কথা কী আর বলিব? কাল ভুরে চুর আসিয়া আমার সব কাপড় নিয়া গেছে। বলা বাহুল্য, আমার প্রিয় বান্ধবী তাকে পত্রপাঠ বিদায় করেছিল।
আজকাল আর চিঠি লেখা হয় না এই দুঃখে আমি আর ঝর্ণা রহমান বেশ কিছুদিন একজন আর একজনকে চিঠি লিখতাম। কী যে মজার চিঠি ছিল সেসব। ঢাকা-লন্ডনের দূরত্ব কমে গিয়েছিল এসব চিঠিতে। ওর বাড়ির সব খবর আর আমার বাড়ির সব খবর থাকত সেখানে। যে পথ দিয়ে আমি হেঁটে যাই আমার প্রিয় বিশাল মেডোতে, শেষ বিকেলে, তার ছবি আঁকারও চেষ্টা করেছিলাম মনে আছে। ও যার নাম দিয়েছিল_ সচিত্র চিঠি।
কালিদাস যক্ষ প্রিয়াকে চিঠি লিখতে নির্বাচন করেছিলেন মেঘ। মেঘের কাছে তার যে আকুলিবিকুলি তা যারা মেঘদূত পড়েছেন তারা জানেন। সেই মেঘদূতের ক্লাসে নীলিমা আপা কয়েকটা বিশেষ লাইন বাদ দিয়ে পড়াতে থাকেন। আদিরসের বর্ণনা আমাদের বড় হয়ে উঠবার জন্য স্বাস্থ্যকর হবে না হয়তো এমন ভাবনায়। তিনি জানতেন না ওই লাইনগুলো আমরা ঠোঁটস্থ করে ফেলেছি। সামনের সারির দুটো বেঞ্চ মেয়েদের জন্য নির্ধারিত থাকত। দুই নম্বর বেঞ্চের একদম শেষে বসেছিল ফেরদৌসী। সেখান থেকে প্রথম বেঞ্চের প্রথমে বসা আমাকে পাঠিয়েছিল চিরকুট। একজন একজন করে সেটা চলে আসে আমার কাছে। লেখা ছিল_ সালেহা, আপা যে লাইনগুলো বাদ দিল তোর কি মনে আছে? আমি লিখলাম_ বসন ধরে আছে শিথিল হাতে যেন/তেমনি ঝুঁকে আছে বেতের শাখা/সহজে প্রস্থান হবে না সম্ভব/তুমি যে তারপরে লম্বমান/বিব্রত জঘনার বারেক পেলে স্বাদ/কে আর পারে বল ছাড়াতে। সেটা আবার এক এক করে চলে গিয়েছিল ওর কাছে। পরের দিকে এই 'লম্বমান' শব্দটা একটা প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতাম_ যেমন কল্পনার পেছনে দিনেশ লেগেছে, মানে দিনেশ এখন লম্বমান হতে চায়, এইসব। মজার দিন ছিল সেগুলো। আর ফেরদৌসী মজুমদার? আমাদের য়ুনিভার্সিটির জটিল কঠিন পাঠ্যপুস্তকের মাঝখানে_ সস বা লবণের মতো প্রয়োজনীয় ছিল ও।
ব্যথার চিঠি বা বেদনার চিঠি আমরা পেতাম কেউ মারা গেলে। সেটা অনেকদিন দুঃখের কারণ হতো। নানা, নানি, খালা, চাচাদের মৃত্যু সংবাদগুলো মনে আছে। মৃত্যু সংবাদের পর এর পরের লাইন আর কেউ পড়তে পারত না। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল। যখন আমরা লন্ডনে আমার শ্বশুর চিঠিতে আমার স্বামীকে লিখেছিলেন_ বৌমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনবার পর ... । এরপর আর কী? আমার কান্না শুনে নিচতলা থেকে বাড়িওয়ালা ছুটে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করেন। তারপর চিঠিটি নিজে পড়ে হেসে ওঠেন। ওখানে লেখা ছিল_ তোমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনবার পর বৌমার মা বগুড়া যান এবং সেখানে গিয়া দেখেন বৌমার মা দিব্যি ভালো আছেন। আমাদের ভুল সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল। এরপর? চোখের পানি মুছে আমিও হাসতে শুরু করি।
ভালো চিঠি প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় পাঠকের চিঠি। নানা সুন্দর সুন্দর কথা থাকে সেখানে। একবার লন্ডনের 'জনমত' পত্রিকায় আমি একটি লেখা লিখি, নাম ছিল_ এ ব্ল্যাক গার্ল ইন সার্চ অব গড। এটি জর্জ বার্নার্ড শর একটি উপন্যাসের নাম। আমার আব্বার জীবন ছিল সেখানে। সেটি পড়বার পর ব্রিটেনের নানা জায়গা থেকে চিঠি আসতে শুরু করে। সকলেই লেখাটি পড়ে তাদের সুন্দর মতামত জানিয়েছিলেন। আর সোফিয়া রাহমান, যাকে এখন আমি সোফিয়া আপা বলি; জনমত অফিসে ফোন করে আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমার লন্ডনের প্রিয় মানুষদের ভেতরে তিনি অন্যতম।
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ আমাকে নিজের হাতে চিঠি লিখেছিলেন। আমার একটি চিঠির উত্তর ছিল সেটি। তাঁর আঙুল তাঁর কথা শোনে না। বাত সেখানে। তারপরেও কত কষ্ট করে তিনি সেই চিঠি লিখেছিলেন নিজের হাতে। সেখানে লেখা ছিল_ তুমি অনেকটা তোমার চাচার মতো [আমার আব্বার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আব্বা ফয়জুর রহমানের খুবই মিল ছিল বলে আমি তাঁকে চাচা বলে সম্বোধন করি]। আমার মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট এটি। ভালো চিঠি প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় উইলিয়াম র্যাদিচের চিঠি, যিনি আমার ইংরেজি কবিতার বইয়ের ভূমিকা এবং এর সঙ্গে চিঠি লিখেছিলেন। আমার কবিতার বইয়ের নাম কী হতে পারে সেটা তিনি জানিয়েছিলেন। তাঁর আরও চিঠি আছে। মনে পড়ে পরিচয় পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক অমিতাভ দাশগুপ্তের চিঠি। আমার একটি প্রবন্ধ 'পরিচয়ে' ছাপিয়ে তিনি দুই লাইন চিঠি পাঠিয়েছিলেন_ মনা, তোমার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এবার কবিতা নিয়ে কিছু লেখ। তিনি মারা গেছেন। আমার সেই লেখা এরপরের সম্পাদক ছাপাননি না পাননি জানি না।
আমি একবার 'দেশে' গল্প পাঠিয়েছিলাম এমন বিশ্বাসে যে ভালো গল্প হলে তদবির ছাড়াই ছাপা হবে। গল্পটি পেয়ে ই-মেইলে চিঠি লিখেছিলেন হর্ষ দত্ত_ রোমানাইজ করে_ 'মাননীয়াসু একটি অসাধারণ গল্পের জন্য ধন্যবাদ। এমন গল্প আরও পাঠাবেন।' তবে বুঝতে পারছি না সেই অসাধারণ গল্প আজও ছাপা হলো না কেন। সেলিনা হোসেন আমার ইংরেজি কবিতার বই পাঠ করবার পর তাঁর ভালো লাগা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন_ ইংরেজি কবিতা লিখে ওই দেশে বিখ্যাত হবেন এমন আশা করছি। সেই চিঠি আমাকে ভয়ানক আনন্দিত করেছিল। আমি অবশ্য জানি ওদেশে ইংরেজি কবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়া কঠিন। দুটো ইংরেজি কবিতার বই ছাপানোর পর আমি আর ও পথে হাঁটি না। অনেকটা মধুসূদনের মতো ব্যাপার আর কি। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিচারকের সামনে বসে কবিতা লেখায় পুরস্কার পাওয়ার পরেও জানি, ওসব লিখে আর যা-ই হোক বিখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ রকম আরও কিছু চিঠি আছে, যা আমি জমিয়ে রেখেছি।
বিখ্যাত চিঠি লেখক ছিলেন খলিল জিব্রান। তিনি মে. জিয়াদের সঙ্গে প্রায় সতেরো বছর পত্রবন্ধুত্ব করেন। একজন ছিলেন লেবাননে আর একজন ছিলেন আমেরিকায়। কেউ কাউকে দেখেননি। প্রিয় বান্ধবী মেরি এলিজাবেথ হাসকেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের চিঠি নিয়ে লেখা বইটির নাম 'বিলাভেড প্রফেট'। পাঁচশ' পাতার সেই বইটি আমার সংগ্রহের সবচাইতে মূল্যবান বই। আমারও ভীষণভাবে মনে হতো_ আমি একজন খলিল জিব্রানকে পাব, যাকে মনের সুখে একটার পর একটা চিঠি লিখব। সেটা হয়নি।
আমার সংগ্রহে চিঠিপত্রের আর একটি বই আছে। বইটার নাম_ বিখ্যাতদের ভালোবাসার চিঠি। লাভ লেটারস অব গ্রেট মেন। সেখানে সবাই মেয়েদের চিঠি লিখেছেন। কেবল একজন পুরুষকে লিখেছেন। তিনি সমকামী অসকার ওয়াইল্ড। তিনি একজন বিশাল প্রভাবশালী বড়লোক 'মার্কিস অব কুইন্স বেরির' ছেলে আলফ্রেড ডগলাসের সঙ্গে প্রেম করতেন। এই কারণে তার বাবা অসকার ওয়াইল্ডের নামে কেস করেন। কেসে হেরে তিনি জেলে যান এবং জেল থেকে বেরিয়ে প্যারিসে যান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০০ সালের নভেম্বর মাসে মারা যান। এখন ব্রিটেনে সমকামীরা একজন আর একজনকে বিয়ে করতে পারে, সন্তান করতে পারে, নানাভাবে। আর এই গগনচুম্বী প্রতিভা এই কারণে মারা গেলেন? ইস। সেই বইটিতে অনেক সাহিত্যিক আর শিল্পীর চিঠি আছে, রাজনীতিবিদ আর রাজার চিঠি আছে, বারবার আমি চিঠিগুলো পড়ি। একদিন হয়তো সব চিঠি অনুবাদ করে ফেলব। মরতে মরতে কিটস যে চিঠি লিখেছিলেন ফ্যানিকে। আহা! হৃদয় ছুঁয়ে যায় সে চিঠিতে। কতসব চিঠি সেখানে।
বিদেশে অনেক চিঠি পেয়েছি চাকরির কারণে। যখন চাকরি পেয়েছি আর পাইনি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো চিঠি আমার স্কুলের শিক্ষকতা পাবার চিঠি। _ 'আই অ্যাম ডিলাইটেড টু সে ইউ বিন সাকসেসফুল। উই আর হ্যাপি উইথ ইয়োর ইন্টারভিউ। টেল মি হোয়েন ক্যান ইউ জয়েন আস। আর্চি পিয়ার্স।' এমনি কিছু লেখা ছিল সেখানে। সেদিন? কেঁদেছিলাম। তাহলে আমি ব্রিটেনে শিক্ষক হতে পেরেছি? কোথায় গেল সেইসব চিঠির দিনকাল? এখন চলে এসেছে ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ। চিঠি এখন লুপ্তপ্রায়। কেবল বিলের চিঠি বা ব্যাংকের চিঠি ছাড়া তেমন করে আসে না আর কোনো ভালোবাসার বা খবরের চিঠি, পায়রার পাখায় ভর করে। টেক্সট আর ই-মেইলে সবাই সংক্ষেপ করে ফেলেছে ভাষা। একদিন হয়তো এই ভাষাই আমরা ব্যবহার করব। এত কষ্ট করে তিন অক্ষরে ইউ না লিখে সোজা একটি লেটার ইউ লিখে দেব।
ঝর্ণা আর চিঠি লেখে না। এখন সোজা টেলিফোনের এপারে আর ওপারে আমরা। জীবনে খলিল জিব্রানের মতো কাউকে পাইনি। চিঠির জন্য অনন্তকালের হাহাকার আছে।
আমার রফিক স্যার বা ডক্টর রফিকুল ইসলাম বেশ কতগুলো চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। তিনি তখন 'আজকের সভ্যতার' সম্পাদক। প্রথমেই লিখতেন_ সালেহা কেমন আছো বল। কী অপূর্ব সে সব চিঠি। আমি লিখেছিলাম একবার_ আপনারা চলে গেলে আমাদের পৃথিবী শূন্য হয়ে যাবে। যদি নূহের নৌকার মতো একটি জাহাজে চেপে আমরা একসঙ্গে মহাকালের দিকে যাত্রা করি তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়, তাই না স্যার?
মন্দ নয়। তবে নূহের নৌকা পাওয়া যাচ্ছে কোথায়? উত্তরে এমনি কিছু লিখেছিলেন তিনি।
আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন, গুরুজন, স্নেহভাজন, সহপাঠী আর সহপাঠিনী সবার জন্যই থাকল শ্রেণীমতো সালাম, কদমবুচি, ভালোবাসা আর স্নেহাশীষ। ভালো থাকো ভালো চাই/পত্রের যেন উত্ত
আমার আব্বা স্কুল ইন্সপেক্টর বলে পণ্ডিতদের নানারকম চিঠি পেতেন। একবার একজন পণ্ডিত লিখেছিলেন_ স্যার দয়া করিয়া আমাদের ইশকুলে আপনার পায়ের ধুলা পড়িবে এই কথা জানিয়া আমরা খুব গরীবি হালে ষড়যন্ত্র করিতেছে। জোগাড়যন্ত্র লিখতে গিয়ে বোধকরি ষড়যন্ত্র লিখেছিলেন। আব্বা কেবল বলেছিলেন_ তোরাই বল ওখানে যাওয়া কি ঠিক হবে? যেভাবে ওরা ষড়যন্ত্র করছে।
আমার ভাই আমেরিকা থেকে লিখেছিলেন_ তুই যদি উঠোনের মধ্যে ফুটো করতে থাকিস তাহলে একদিন আমার কাছে চলে আসবি। চেষ্টা চালিয়ে যা। কয়দিন চেষ্টা চালানোর পর হাল ছেড়েছিলাম। একজন প্রেমিক বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে। তার ছোটবোনকে দিয়ে বই পাঠাতেন। বইয়ের ভেতর চিঠি থাকত। প্রথম চিঠিটা মনে আছে ভয়ে ভয়ে আমি পায়খানার ভেতরে নিয়ে গিয়ে পড়েছিলাম। মোটেই রোমান্টিক নয় ব্যাপারটা, তাই না? কী করব। এমন অভিজ্ঞতা আগে ছিল না কি-না। প্রথম দিকে চিঠিগুলো ভালোবাসার চিনি/গুড়ে মাখামাখি থাকলেও পরের দিকে সেগুলো কঠিন হতে থাকে। কারণ আমি কোনো উত্তর দেইনি। শেষ চিঠিটা এমন ছিল_ এরপর যদি উত্তর না পাই রাস্তায় বেরুলে তোমার পা ভেঙে দেব। তারপরও যখন উত্তর পেলেন না, উনি আমার পা ভাঙতে না পেরে ফরিদপুর থেকে বোনের বাড়ি ময়মনসিংহে চলে গিয়েছিলেন। আমরা যতদিন ছিলাম উনি আর ফরিদপুরে ফিরে আসেননি। এটা নিশ্চয়ই একটি মহৎ ও বড় প্রেম বলতেই হয়। ঠিক ওই সময়ই আমার প্রয়াত স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী চিঠিতে লিখেছিলেন_ আমি তোমাকে ভালোবাসি। কয়েক বছর পরে তিনি অনেক বলে_ কয়ে আমার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে করেন। তখন আমি কেবল য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকেছি। বাড়ির কেউ রাজি নন। তিনি আমার মায়ের পা ধরে বলেছিলেন_ আমি কথা দিচ্ছি আপনার মেয়েকে পড়াব [তিনি কথা রেখেছিলেন]। তিনি দুই বছর লেসোথোতে ছিলেন প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। অনেক চিঠি লেখালেখি হয়েছিল। আমি লন্ডনে বাড়ি, চাকরি আর সংসার সামলাতাম। ওর আর আমার চিঠিগুলো একটি সুন্দর বাক্সে সাজানো আছে।
য়ুনিভার্সিটির প্রথম বেঞ্চিতে বসে আমরা প্রচুর নোট বা চিরকুট চালাচালি করতাম। সেটা একজন আর একজনকে পাস করত। একবার মনিরুজ্জামান স্যারের ক্লাসে সেলিনা ডেইজি একটু ছোট চিরকুটে লিখল_ সেই মধুমুখ, সেই মধুহাসি, সেই সুধাভরা হাসি/চিরদিন মোরে বি প্লাস দিল/চিরদিন দিল ফাঁকি। সেই সুধামুখের মনিরুজ্জামান স্যার গম্ভীর মুখে আমাদের দেখতে লাগলেন_ আমাদের প্রাণপণ হাসি গোপন করবার প্রাণান্তকর প্রয়াস বুঝতে পেরে বিশেষ কিছু বললেন না। তিনি সত্যিই বড় চমৎকার হাসিখুশির একজন ছিলেন। একবার ফেরদৌসী মজুমদার একটা চিরকুটে লিখেছিল মনে আছে_ চর্যাপদের এই সব পদকর্তার নামের শেষে 'পাদ' যুক্ত কেন জানিস? [ কাহ্ন পাদ, ভুসুকু পাদ, লুই পাদ ইত্যাদি] ওরা সব বায়ুভুক ছিলেন। প্রফেসর আবদুল হাই বেশ কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন সামনের বেঞ্চের মেয়েরা সব হাসি চাপার প্রয়াসে এক একজন লাল হয়ে উঠছে কেন?
এই চিরকুট কিন্তু সময় বিশেষে চিঠির চাইতেও মজার হতো। আমরা চিরকুট চালাচালিতে জানতাম বর্তমানে ক্লাসের কোনো ছেলে বা কোনো মেয়ে কার প্রতি বিশেষ নজর দিতে চেষ্টা করছে ইত্যাদি। আমার বিয়ে হয়ে গেছে; কাজেই সকলের নানা সুখ-দুঃখের কথা আমাকেই শুনতে হতো মহান খালাম্মার মতো। আমার ময়মনসিংহের এক সহপাঠী আর এক সহপাঠিনীকে লিখেছিলেন_ আমার দুঃখের কথা কী আর বলিব? কাল ভুরে চুর আসিয়া আমার সব কাপড় নিয়া গেছে। বলা বাহুল্য, আমার প্রিয় বান্ধবী তাকে পত্রপাঠ বিদায় করেছিল।
আজকাল আর চিঠি লেখা হয় না এই দুঃখে আমি আর ঝর্ণা রহমান বেশ কিছুদিন একজন আর একজনকে চিঠি লিখতাম। কী যে মজার চিঠি ছিল সেসব। ঢাকা-লন্ডনের দূরত্ব কমে গিয়েছিল এসব চিঠিতে। ওর বাড়ির সব খবর আর আমার বাড়ির সব খবর থাকত সেখানে। যে পথ দিয়ে আমি হেঁটে যাই আমার প্রিয় বিশাল মেডোতে, শেষ বিকেলে, তার ছবি আঁকারও চেষ্টা করেছিলাম মনে আছে। ও যার নাম দিয়েছিল_ সচিত্র চিঠি।
কালিদাস যক্ষ প্রিয়াকে চিঠি লিখতে নির্বাচন করেছিলেন মেঘ। মেঘের কাছে তার যে আকুলিবিকুলি তা যারা মেঘদূত পড়েছেন তারা জানেন। সেই মেঘদূতের ক্লাসে নীলিমা আপা কয়েকটা বিশেষ লাইন বাদ দিয়ে পড়াতে থাকেন। আদিরসের বর্ণনা আমাদের বড় হয়ে উঠবার জন্য স্বাস্থ্যকর হবে না হয়তো এমন ভাবনায়। তিনি জানতেন না ওই লাইনগুলো আমরা ঠোঁটস্থ করে ফেলেছি। সামনের সারির দুটো বেঞ্চ মেয়েদের জন্য নির্ধারিত থাকত। দুই নম্বর বেঞ্চের একদম শেষে বসেছিল ফেরদৌসী। সেখান থেকে প্রথম বেঞ্চের প্রথমে বসা আমাকে পাঠিয়েছিল চিরকুট। একজন একজন করে সেটা চলে আসে আমার কাছে। লেখা ছিল_ সালেহা, আপা যে লাইনগুলো বাদ দিল তোর কি মনে আছে? আমি লিখলাম_ বসন ধরে আছে শিথিল হাতে যেন/তেমনি ঝুঁকে আছে বেতের শাখা/সহজে প্রস্থান হবে না সম্ভব/তুমি যে তারপরে লম্বমান/বিব্রত জঘনার বারেক পেলে স্বাদ/কে আর পারে বল ছাড়াতে। সেটা আবার এক এক করে চলে গিয়েছিল ওর কাছে। পরের দিকে এই 'লম্বমান' শব্দটা একটা প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতাম_ যেমন কল্পনার পেছনে দিনেশ লেগেছে, মানে দিনেশ এখন লম্বমান হতে চায়, এইসব। মজার দিন ছিল সেগুলো। আর ফেরদৌসী মজুমদার? আমাদের য়ুনিভার্সিটির জটিল কঠিন পাঠ্যপুস্তকের মাঝখানে_ সস বা লবণের মতো প্রয়োজনীয় ছিল ও।
ব্যথার চিঠি বা বেদনার চিঠি আমরা পেতাম কেউ মারা গেলে। সেটা অনেকদিন দুঃখের কারণ হতো। নানা, নানি, খালা, চাচাদের মৃত্যু সংবাদগুলো মনে আছে। মৃত্যু সংবাদের পর এর পরের লাইন আর কেউ পড়তে পারত না। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল। যখন আমরা লন্ডনে আমার শ্বশুর চিঠিতে আমার স্বামীকে লিখেছিলেন_ বৌমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনবার পর ... । এরপর আর কী? আমার কান্না শুনে নিচতলা থেকে বাড়িওয়ালা ছুটে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করেন। তারপর চিঠিটি নিজে পড়ে হেসে ওঠেন। ওখানে লেখা ছিল_ তোমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনবার পর বৌমার মা বগুড়া যান এবং সেখানে গিয়া দেখেন বৌমার মা দিব্যি ভালো আছেন। আমাদের ভুল সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল। এরপর? চোখের পানি মুছে আমিও হাসতে শুরু করি।
ভালো চিঠি প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় পাঠকের চিঠি। নানা সুন্দর সুন্দর কথা থাকে সেখানে। একবার লন্ডনের 'জনমত' পত্রিকায় আমি একটি লেখা লিখি, নাম ছিল_ এ ব্ল্যাক গার্ল ইন সার্চ অব গড। এটি জর্জ বার্নার্ড শর একটি উপন্যাসের নাম। আমার আব্বার জীবন ছিল সেখানে। সেটি পড়বার পর ব্রিটেনের নানা জায়গা থেকে চিঠি আসতে শুরু করে। সকলেই লেখাটি পড়ে তাদের সুন্দর মতামত জানিয়েছিলেন। আর সোফিয়া রাহমান, যাকে এখন আমি সোফিয়া আপা বলি; জনমত অফিসে ফোন করে আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমার লন্ডনের প্রিয় মানুষদের ভেতরে তিনি অন্যতম।
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ আমাকে নিজের হাতে চিঠি লিখেছিলেন। আমার একটি চিঠির উত্তর ছিল সেটি। তাঁর আঙুল তাঁর কথা শোনে না। বাত সেখানে। তারপরেও কত কষ্ট করে তিনি সেই চিঠি লিখেছিলেন নিজের হাতে। সেখানে লেখা ছিল_ তুমি অনেকটা তোমার চাচার মতো [আমার আব্বার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আব্বা ফয়জুর রহমানের খুবই মিল ছিল বলে আমি তাঁকে চাচা বলে সম্বোধন করি]। আমার মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট এটি। ভালো চিঠি প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় উইলিয়াম র্যাদিচের চিঠি, যিনি আমার ইংরেজি কবিতার বইয়ের ভূমিকা এবং এর সঙ্গে চিঠি লিখেছিলেন। আমার কবিতার বইয়ের নাম কী হতে পারে সেটা তিনি জানিয়েছিলেন। তাঁর আরও চিঠি আছে। মনে পড়ে পরিচয় পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক অমিতাভ দাশগুপ্তের চিঠি। আমার একটি প্রবন্ধ 'পরিচয়ে' ছাপিয়ে তিনি দুই লাইন চিঠি পাঠিয়েছিলেন_ মনা, তোমার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এবার কবিতা নিয়ে কিছু লেখ। তিনি মারা গেছেন। আমার সেই লেখা এরপরের সম্পাদক ছাপাননি না পাননি জানি না।
আমি একবার 'দেশে' গল্প পাঠিয়েছিলাম এমন বিশ্বাসে যে ভালো গল্প হলে তদবির ছাড়াই ছাপা হবে। গল্পটি পেয়ে ই-মেইলে চিঠি লিখেছিলেন হর্ষ দত্ত_ রোমানাইজ করে_ 'মাননীয়াসু একটি অসাধারণ গল্পের জন্য ধন্যবাদ। এমন গল্প আরও পাঠাবেন।' তবে বুঝতে পারছি না সেই অসাধারণ গল্প আজও ছাপা হলো না কেন। সেলিনা হোসেন আমার ইংরেজি কবিতার বই পাঠ করবার পর তাঁর ভালো লাগা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন_ ইংরেজি কবিতা লিখে ওই দেশে বিখ্যাত হবেন এমন আশা করছি। সেই চিঠি আমাকে ভয়ানক আনন্দিত করেছিল। আমি অবশ্য জানি ওদেশে ইংরেজি কবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়া কঠিন। দুটো ইংরেজি কবিতার বই ছাপানোর পর আমি আর ও পথে হাঁটি না। অনেকটা মধুসূদনের মতো ব্যাপার আর কি। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিচারকের সামনে বসে কবিতা লেখায় পুরস্কার পাওয়ার পরেও জানি, ওসব লিখে আর যা-ই হোক বিখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এ রকম আরও কিছু চিঠি আছে, যা আমি জমিয়ে রেখেছি।
বিখ্যাত চিঠি লেখক ছিলেন খলিল জিব্রান। তিনি মে. জিয়াদের সঙ্গে প্রায় সতেরো বছর পত্রবন্ধুত্ব করেন। একজন ছিলেন লেবাননে আর একজন ছিলেন আমেরিকায়। কেউ কাউকে দেখেননি। প্রিয় বান্ধবী মেরি এলিজাবেথ হাসকেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের চিঠি নিয়ে লেখা বইটির নাম 'বিলাভেড প্রফেট'। পাঁচশ' পাতার সেই বইটি আমার সংগ্রহের সবচাইতে মূল্যবান বই। আমারও ভীষণভাবে মনে হতো_ আমি একজন খলিল জিব্রানকে পাব, যাকে মনের সুখে একটার পর একটা চিঠি লিখব। সেটা হয়নি।
আমার সংগ্রহে চিঠিপত্রের আর একটি বই আছে। বইটার নাম_ বিখ্যাতদের ভালোবাসার চিঠি। লাভ লেটারস অব গ্রেট মেন। সেখানে সবাই মেয়েদের চিঠি লিখেছেন। কেবল একজন পুরুষকে লিখেছেন। তিনি সমকামী অসকার ওয়াইল্ড। তিনি একজন বিশাল প্রভাবশালী বড়লোক 'মার্কিস অব কুইন্স বেরির' ছেলে আলফ্রেড ডগলাসের সঙ্গে প্রেম করতেন। এই কারণে তার বাবা অসকার ওয়াইল্ডের নামে কেস করেন। কেসে হেরে তিনি জেলে যান এবং জেল থেকে বেরিয়ে প্যারিসে যান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০০ সালের নভেম্বর মাসে মারা যান। এখন ব্রিটেনে সমকামীরা একজন আর একজনকে বিয়ে করতে পারে, সন্তান করতে পারে, নানাভাবে। আর এই গগনচুম্বী প্রতিভা এই কারণে মারা গেলেন? ইস। সেই বইটিতে অনেক সাহিত্যিক আর শিল্পীর চিঠি আছে, রাজনীতিবিদ আর রাজার চিঠি আছে, বারবার আমি চিঠিগুলো পড়ি। একদিন হয়তো সব চিঠি অনুবাদ করে ফেলব। মরতে মরতে কিটস যে চিঠি লিখেছিলেন ফ্যানিকে। আহা! হৃদয় ছুঁয়ে যায় সে চিঠিতে। কতসব চিঠি সেখানে।
বিদেশে অনেক চিঠি পেয়েছি চাকরির কারণে। যখন চাকরি পেয়েছি আর পাইনি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো চিঠি আমার স্কুলের শিক্ষকতা পাবার চিঠি। _ 'আই অ্যাম ডিলাইটেড টু সে ইউ বিন সাকসেসফুল। উই আর হ্যাপি উইথ ইয়োর ইন্টারভিউ। টেল মি হোয়েন ক্যান ইউ জয়েন আস। আর্চি পিয়ার্স।' এমনি কিছু লেখা ছিল সেখানে। সেদিন? কেঁদেছিলাম। তাহলে আমি ব্রিটেনে শিক্ষক হতে পেরেছি? কোথায় গেল সেইসব চিঠির দিনকাল? এখন চলে এসেছে ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ। চিঠি এখন লুপ্তপ্রায়। কেবল বিলের চিঠি বা ব্যাংকের চিঠি ছাড়া তেমন করে আসে না আর কোনো ভালোবাসার বা খবরের চিঠি, পায়রার পাখায় ভর করে। টেক্সট আর ই-মেইলে সবাই সংক্ষেপ করে ফেলেছে ভাষা। একদিন হয়তো এই ভাষাই আমরা ব্যবহার করব। এত কষ্ট করে তিন অক্ষরে ইউ না লিখে সোজা একটি লেটার ইউ লিখে দেব।
ঝর্ণা আর চিঠি লেখে না। এখন সোজা টেলিফোনের এপারে আর ওপারে আমরা। জীবনে খলিল জিব্রানের মতো কাউকে পাইনি। চিঠির জন্য অনন্তকালের হাহাকার আছে।
আমার রফিক স্যার বা ডক্টর রফিকুল ইসলাম বেশ কতগুলো চিঠি লিখেছিলেন আমাকে। তিনি তখন 'আজকের সভ্যতার' সম্পাদক। প্রথমেই লিখতেন_ সালেহা কেমন আছো বল। কী অপূর্ব সে সব চিঠি। আমি লিখেছিলাম একবার_ আপনারা চলে গেলে আমাদের পৃথিবী শূন্য হয়ে যাবে। যদি নূহের নৌকার মতো একটি জাহাজে চেপে আমরা একসঙ্গে মহাকালের দিকে যাত্রা করি তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়, তাই না স্যার?
মন্দ নয়। তবে নূহের নৌকা পাওয়া যাচ্ছে কোথায়? উত্তরে এমনি কিছু লিখেছিলেন তিনি।
আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন, গুরুজন, স্নেহভাজন, সহপাঠী আর সহপাঠিনী সবার জন্যই থাকল শ্রেণীমতো সালাম, কদমবুচি, ভালোবাসা আর স্নেহাশীষ। ভালো থাকো ভালো চাই/পত্রের যেন উত্ত
No comments