আহসান হাবীব- তিরিশি কাব্যতত্ত্বের প্রথম বিদ্রোহী by আবিদ আনোয়ার
কবি আহসান হাবীবের কবিতা নিয়ে আমার পাঁচটি
লেখা ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর শিরোনাম : ১.
আহসান হাবীব-এর কবিতা : খালেক নিকিরির স্বজন-পরিজন, ২. কবি ও সম্পাদক আহসান
হাবীব,
৩. আহসান হাবীব : আধুনিক না উত্তরাধুনিক, ৪.
আহসান হাবীব-এর কবিতার নির্মাণকলা এবং ৫. ইংরেজি ভাষায়, ম্যান বিহাইন্ড দ্য
শ্যাডো ডিয়ার [ছায়া হরিণের অনুসন্ধানী একজন]। আমার ও মাহবুব সাদিকের
সম্পাদনায় অনন্যা থেকে প্রকাশিত 'আহসান হাবীবের শ্রেষ্ঠ কবিতায় মুদ্রিত
সম্পাদকীয়টির প্রথমাংশ আমার লেখা। এ ছাড়াও আহসান হাবীব-সংক্রান্ত আমার
কাজের মধ্যে রয়েছে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ তাঁর কবিতার বেশকিছু অনুবাদ, যা
রেডিও বাংলাদেশের [বাংলাদেশ বেতার] এক্সটারনাল সার্ভিস থেকে প্রচারিত হয়েছে
এবং বাংলা একাডেমীর ইংরেজি প্রকাশনা, বাংলাদেশ অবজার্ভার, বাংলাদেশ টাইমস,
ঢাকা টুডে ও বাংলাদেশ ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে প্রকাশিত হয়েছে। উপরোক্ত ২ ও ৩
সূচক লেখা দুটি গ্রন্থিত হয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত
আমার 'চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য' নামের বইটিতে এবং বাকিগুলোও গ্রন্থিত
হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাঁর সমসাময়িক এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কারও কারও
কবিতা নিয়ে লিখতে গিয়েও আমার রচনায় অনিবার্যভাবে এসে গেছে আহসান হাবীবের
কাব্যকৃতির প্রসঙ্গ।
উপরোক্ত তথ্য দিয়ে বর্তমান লেখাটি শুরু করতে হলো কারণ তাঁর ২৮তম মৃত্যুদিবসে কিছু একটা লেখার তাগিদে প্রথমেই যে ভাবনায় তাড়িত হলাম তা হলো : নতুন করে তাঁর সম্পর্কে আমার আর কী লেখার আছে! অনেক ভেবেচিন্তে তাঁর কবিতার একটিমাত্র বিশিষ্টতাকে এ লেখার বিষয় করেছি। আহসান হাবীব-সংক্রান্ত আমার অন্য লেখাগুলোতেও প্রসঙ্গটির উল্লেখ রয়েছে। তবে বর্তমান লেখায় রয়েছে এর বিস্তৃত আলোচনা যেহেতু একেই একমাত্র বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি। অকাতরে স্বীকার করে নিচ্ছি লেখাটির জন্য আমি আমার অন্য লেখাগুলো থেকে কিছু ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়েছি।
আমরা যাকে আজ তিরিশোত্তর কাব্যধারা বলতে অভ্যস্ত তাঁর প্রথম বিদ্রোহী আহসান হাবীব, অন্তত কবিতার আধেয় বা বিষয়বস্তুর বিবেচনায়। শামসুর রাহমানের কবিতার বিশদ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর অগ্রজ আহসান হাবীবকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ যা লিখেছেন তা এ রকম :
"আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাত্রিশেষ' বেরোয় ১৯৪৭-এ; এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিংশ-শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন... 'বন্ধ্যা মাটি', 'ঝরাপালকের ভস্মস্তূপ'ধর্মী চিত্রকল্পের সাহায্যে তিনি চেষ্টা করলেন আপন বিশ্ব রচনার...' [ভূমিকা, শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ/শেরপা]।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখায় 'বিংশ-শতকী চেতনা' বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো বোদলেয়ার-উত্তর আধুনিকতার চর্চা যা বাংলা কবিতা আলিঙ্গন করেছিল গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে, মূলত বুদ্ধদেব বসুর পৌরোহিত্যে। বুদ্ধদেব নিজে, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে তাঁদের রচনাকর্মে কথিত 'বিংশ-শতকী চেতনা'কে ধারণ করে রবীন্দ্রোত্তর একটি কাব্যধারা প্রবর্তন করেছিলেন যাকে আমরা এখন 'তিরিশি আধুনিকতা' বলে গণ্য করি।
বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকায়নের মূলমন্ত্র ছিল পূর্ববর্তী রোমান্টিক যুগের একরোখা সৌন্দর্যবোধ থেকে উত্তরণের জন্য বস্তুবিশ্বের কলুষতা ও নির্বেদকে আলিঙ্গন করা এবং একই সঙ্গে কেতাবি ভাষার পরিবর্তে আটপৌরে ভাষায় কবিতা লেখা ও নির্মাণকলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল অনেক আগেই। ১৮৫৭ সালে ফরাসি কবি বোদলেয়ারের কবিতা-সংকলন 'ল্যা ফ্লার দ্যু মল' প্রকাশের পর কাব্যবোদ্ধারা বুঝতে পারেন : এই কবির সৌন্দর্যচেতনা পূর্ববর্তী রোমান্টিক কবিদের চেয়ে ভিন্ন শুভ ও অশুভর সম্মিলনে জীবন তার সামগ্রিকতা নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে এসব কবিতায়।
ফরাসি ও জার্মান কবিতারাজ্যে ঝড়ের গতিতে সেই আধুনিকতা সংক্রমিত হলেও মাত্র ২৬ মাইল ইংলিশ চ্যানেল পার হতে তা সময় নেয় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। প্রথমে আইরিশ ও পরে ব্রিটিশ কবিদের সংবেদনশীলতায় তা অভিঘাত তৈরি করে ১৯১৪ সালের দিকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবিতাঙ্গনেও লাগে সেই ঢেউ। ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশদের উপনিবেশ; প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির নিজ মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও বেশ আয়ত্তে ছিল। অতএব বোদলেয়রীয় কাব্যকলার উত্তরসূরি ইংরেজি ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি, বিশেষ করে টিএস এলিয়ট ও আইরিশ কবি ডবি্লউ বি ইয়েটসের কবিতা, এর সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বোদলেয়ারের কবিতাও, শিক্ষিত বাঙালি কবিদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে ওঠে। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে সেই নব্য আধুনিকতা বিষয়ে অবহিত হন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় দেখতে পান রোমান্টিক যুগের সেই একরোখা সৌন্দর্যবোধ, নির্মাণকলায় কেতাবি শব্দের প্রাধান্য এবং ছন্দ-প্রকরণ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একঘেঁয়েমি।
এরা আটপৌরে মুখের ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে কবি ও কবিতাবোদ্ধাদের মধ্যে এই উপলব্ধি জাগ্রত হয় যে, কবিতার ভাষার আটপৌরে চারিত্র্য দান কোনোকালেই পরিপূর্ণভাবে সম্ভব নয়। কেতাবি ও আটপৌরে ভাষাভঙ্গির মিশ্রণই হবে কবিতার শেষ নিয়তি। ফলে তিরিশিদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার ফসল হিসেবে শব্দ ব্যবহার, ছন্দ-প্রকরণ, অঙ্গসৌষ্ঠব ও অলঙ্কার নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব আধুনিক কৌশল আমরা পেয়ে গেলাম তা হলো :
ক্রিয়াপদ ব্যবহারের স্বাভাবিকতা অর্থাৎ নামধাতুজ শব্দ 'টঙ্কারিছে', 'বিচরিয়া', 'গুঞ্জরিলো' ইত্যাদি থেকে মুক্তি লাভ।
বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন স্থানে স্বাভাবিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা, যা ছন্দ-প্রকরণকে অক্ষুণ্ন রেখেও বাক্যকে গদ্যসুলভ ধ্বনিব্যঞ্জনা দান করে।
সমমাত্রিক পঙ্ক্তিবিন্যাসের চেয়ে অসমমাত্রিক পঙ্ক্তিবিন্যাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া_ অর্থাৎ দীর্ঘ পঙ্ক্তির সঙ্গে নিদ্বর্িধায় যে কোনো দৈর্ঘ্যের ছোট পঙ্ক্তি ব্যবহার করা_ যাকে 'মুক্তক' আঙ্গিক বলা হয়। অনেকে 'মুক্তক' বলতে ছন্দ-প্রকরণে শৈথিল্যকে বুঝে থাকেন। প্রকৃত অর্থে মুক্তক আঙ্গিকে বিন্যস্ত ছন্দের কবিতায় মাত্রা-বিচ্যুতির কোনো সুযোগ নেই, কেবল পঙ্ক্তির সংকোচন-প্রসারণই এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার নির্মাণে যতটা সম্ভব বিসদৃশ উপমান-উপমেয়র সঙ্গম ঘটানো। প্রচলিত পন্থার উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপকের চেয়ে সমান্তরাল রূপক ও প্রতীক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ। সমাসোক্তি ও অন্যাসক্তকে তাদের প্রচলিত রূপ থেকে উন্নীত করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে বাড়তি শক্তি দান।
উপমান আহরণে বস্তুবিশ্বের চেনা পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে প্রায়শ অবচেতনায় পরিভ্রমণ_ অর্থাৎ চিত্রকল্প নির্মাণে পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টির প্রয়াস।
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতার এসব নির্মাণ-কৌশল পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করলেও আহসান হাবীব ছিলেন বিষয়বস্তু চয়নের বিবেচনায় তিরিশি কাব্যতত্ত্বের প্রথম বিদ্রোহী। অন্তত এ বিষয়ে তিরিশি কাব্যতত্ত্বে নিজেকে বিসর্জন দিতে আহসান হাবীবের কবিসত্তা ছিল দ্বন্দ্ব-জর্জরিত। তাই প্রবেশলগ্নেই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল তিরিশি কাব্যতত্ত্বের সেই বিশেষ সুচিবায়ুগ্রস্ততার প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস। বুদ্ধদেব বসুর 'প্রান্তরে কিছু নেই, জানালায় পর্দা টেনে দে' কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'সহে না সহে না এ জনতার জঘন্য মিতালি'_ এসব উক্তি ছাড়াও বিভিন্ন নিবন্ধে কবিতাকে জনজীবন থেকে দূরে রেখে অন্তর্মুখিনতায় ডুব দিয়ে যে কলাকৈবল্যবাদী কাব্যচর্চার ঘোষণা ছিল রবীন্দ্রোত্তর তিরিশি আন্দোলনে তাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি কবি আহসান হাবীব। 'ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়/তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়' এই দুটিমাত্র পঙ্ক্তি থেকেই জানা যায় আহসান হাবীবের দ্বন্দ্ব-মুখর মানসলোকের পরিচয়। আমরা এই রূপকধর্মী চিত্রকল্পটিতে দেখি : ঝরাপালক-আচ্ছাদিত নীড়ে বসে এক পাখি [রূপকার্থে কবি] সবুজ পাতার স্বপ্ন দেখছে। প্রকাশিত ভাবনা ছাড়াও পরপর দুটি 'তবু' শব্দের ব্যবহার উলি্লখিত দ্বন্দ্বকে আরও পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। উল্লেখ্য, আহসান হাবীবের এই 'ঝরাপালক' শব্দবন্ধটি তিরিশি কাব্যধারার মৌল ভাবনা জীবনানন্দের 'ঝরাপালক' কাব্যে প্রকাশিত বিনষ্টি-চেতনা, নৈরাশ্য ও বিমানবিকতার ইঙ্গিতবহ। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান তাঁর প্রবেশলগ্নে তিরিশিদের কাব্য-ভাবনায় আমূল জারিত হয়ে কবিতায় জনজীবন বিচ্ছিন্নতার আত্মঘোষণা দিয়েছিলেন এভাবে : 'আমার খামার নেই, শস্যকণা নেই কোন/আছে শুধু একটি নিবিড় আকাশ' কিংবা তাঁর প্রবেশলগ্নে রচিত বিখ্যাত কবিতা 'রুপালি স্নান'-এর 'শুধু দুই টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ/অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ/শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের কাছে এসে রোজ/চাই নি তো আমি... হাজার যুগের তারার উৎস ওই যে আকাশ/তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে... শান্ত রূপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।' সেই অন্তর্মুখী শামসুর রাহমানও তাঁর মধ্য-পর্যায়ে এসে কেবল 'স্বর্গ-শিশিরে' স্নান করার বাসনা ছেড়ে সমকালীন মনুষ্য-জীবন ও রাজনীতিকে তাঁর কবিতার বিষয় করে তুললেন এবং হয়ে উঠলেন এতটাই বহির্মুখী যেন কবিতায় আমাদের জনপ্রতিনিধি। তিরিশের জীবনানন্দ দাশও তাঁর 'রূপসী বাংলা'য় এসে স্বদেশের রূপ-সৌন্দর্য দিয়ে তাঁর মানসলোক রাঙিয়েছিলেন। তবে জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে জনজীবনের চিত্র নেই; আছে লক্ষ্মীপেঁচা, শঙ্খচিল, ইঁদুর, শালিক পাখি, মৎস্যকন্যা আর গঙ্গা-ফড়িংদের প্রাধান্য; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য একান্তই ব্যক্তিমানুষের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এসব পাখি। প্রত্যক্ষ মানুষ যে ক'জন আছে তারাও স্বপ্নের রাজকন্যা বা বেহুলার মতো পৌরাণিক মানুষ।
পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তাঁর মধ্য-পর্যায়ের বিচ্যুতির আগে পর্যন্ত স্বাদেশিকতা ও জীবন-ঘনিষ্ঠতার প্রতি আহসান হাবীবের মতো প্রবলভাবেই নিবিষ্ট থেকেছেন। কোনো কোনো [ফেরার পিপাসা, প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি] কবিতায় তিরিশি ধারার প্রতি দারুণ বিবমিষাও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর 'কালের কলস' কাব্যে 'ভেদাভেদ' শিরোনামের একটি কবিতায় এই বিবমিষায় যুক্ত হয়েছে তিরিশি আধুনিকতা নিয়ে প্রবল শেষোক্তিও : 'যারা মেতেছিলো আধুনিকতার দ্বন্দ্বে/আজো বেঁচে আছে তাদেরই কতেক ভক্ত/কেবল কয়টি পদ্যের দুর্গন্ধে/অর্ধশতক করে যাবে উত্ত্যক্ত।' পঞ্চাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ শামসুল হকের রচনাকর্মও এ দেশের মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। কেবল শহীদ কাদরী বাদে পঞ্চাশ ও ষাটোত্তর প্রজন্মের কোনো কবিই জনজীবন বিচ্ছিন্নতার ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেননি বরং একে আরও নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে ব্রতী হয়েছেন ও হচ্ছেন। সঙ্গতকারণে আহসান হাবীবকেই যদি এই তিরিশোত্তর কাব্যধারার আদি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় তবে নিদ্বর্িধায় বলা চলে : আধেয় বা বিষয়বস্তুর বিবেচনায় বাংলাদেশের কবিতার মূলধারা কোনোকালেই তিরিশি কাব্যতত্ত্বে নিবিষ্ট ছিল না।
তিরিশি কবিরা তাঁদের কাব্যতত্ত্বে ও রচনাকর্মে নৈরাশ্যবাদ, স্বকালের বন্ধ্যত্ব তথা বিশ-শতকীয় বিনষ্টি, বিমানবিকীকরণ ও জনজীবন বিচ্ছিন্নতার নানা দেয়াল তুলে দিয়ে এক রুদ্ধতার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন আধুনিক কবিতাকে। আহসান হাবীব তাঁর রচনাকর্মে আশাবাদ, স্বদেশলগ্নতা ও পুনমানবিকীকরণের উদ্বোধন ঘটিয়ে আধুনিকতার সংজ্ঞাকে মুক্ত ও সম্প্রসারিত করেছেন। আহসান হাবীবোত্তর আমাদের কবিতা তাই এসব তিরিশি ইজমের দাসত্ব করেনি; কৈবল্যবাদী, আত্মজৈবনিক, হতাশাব্যঞ্জক কাতরোক্তিই আধুনিকতার সূচক... এ কথা আর সত্য নয় এবং এ সত্য প্রথম উপলব্ধি করেছেন কবি আহসান হাবীব। আহসান হাবীব কবি হিসেবে আমাদের কাছে বরেণ্য কেবল এই ঐতিহাসিক কারণেই নয়... তিরিশোত্তরকালে আবির্ভূত আমাদের শ্রেষ্ঠতম কবিদেরও একজন তিনি, যার উপাত্তনির্ভর বিচার-বিশ্লেষণ রয়েছে আমার অন্য লেখাগুলোতে।
তিরিশি কাব্যাদর্শ নিয়ে আহসান হাবীব তাঁর অজস্র কবিতায় প্রশ্ন রেখেছেন :খালেক নিকিরি, কদম আলী, কিংবা জমিলার মায়ের নিকট-আত্মীয়টি যিনি বিদ্যালাভের কৃপায় এইমাত্র পুরনো কাঁথার ওম থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম রোদ পোহাচ্ছেন নাগরিক আবহাওয়ায়, যিনি সম্প্রতি বোদলেয়ার-কামু-কাফকা-সার্ত্রে-রিলকে-এলিয়ট-ইয়েটস-এর দারুণ ভক্ত হয়ে পড়েছেন, যার গায়ে লেগে আছে পচা পাট, কচুরিপানা আর ডানকিনা মাছের আঁশটে গন্ধ, পায়ের পাতায় লেপ্টে আছে শিশিরসম্পৃক্ত কাদা... অথচ স্মৃতিহননের এক উন্মত্ত খেলায় মেতে যিনি স্বপ্ন বেচে দিয়ে কেবলই দুঃস্বপ্ন কিনছেন, আর এক অলীক নাগরিক যন্ত্রণাবোধের শিকার হয়ে ছটফট করছেন নিজের বিবরে_ যিনি এই ক'দিন আগেও ঈশ্বর গায়েনের সুপারি বাগানে রানীবালার হাত ধরে ফেলেছিলেন... অথচ এখন কেবল 'নিঃসঙ্গ নিঃসঙ্গ' বলে হাহাকার করছেন, তার এই আধুনিকতাবোধ কি স্বদেশের শিকড়সম্পৃক্ত নাকি ধার করা? এই প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে আহসান হাবীব নির্মাণ করেছেন স্বদেশলগ্ন ও জীবনঘনিষ্ঠ অজস্র কবিতা এবং প্রভাবিত করেছেন তাঁর উত্তর-প্রজন্মের কবিদের রচনাকর্মকেও।
তিরিশি আন্দোলনের অব্যবহিত পর আহসান হাবীবের এ রকম উপলব্ধি সাক্ষ্য দেয় : বিষয় চয়নের বিবেচনায় তিনি ছিলেন তিরিশ কাব্যতত্ত্বের প্রথম দ্রোহী এবং তাঁর সেই কাব্যচিন্তন ছিল সুদূরপ্রসারী। হ
উপরোক্ত তথ্য দিয়ে বর্তমান লেখাটি শুরু করতে হলো কারণ তাঁর ২৮তম মৃত্যুদিবসে কিছু একটা লেখার তাগিদে প্রথমেই যে ভাবনায় তাড়িত হলাম তা হলো : নতুন করে তাঁর সম্পর্কে আমার আর কী লেখার আছে! অনেক ভেবেচিন্তে তাঁর কবিতার একটিমাত্র বিশিষ্টতাকে এ লেখার বিষয় করেছি। আহসান হাবীব-সংক্রান্ত আমার অন্য লেখাগুলোতেও প্রসঙ্গটির উল্লেখ রয়েছে। তবে বর্তমান লেখায় রয়েছে এর বিস্তৃত আলোচনা যেহেতু একেই একমাত্র বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি। অকাতরে স্বীকার করে নিচ্ছি লেখাটির জন্য আমি আমার অন্য লেখাগুলো থেকে কিছু ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়েছি।
আমরা যাকে আজ তিরিশোত্তর কাব্যধারা বলতে অভ্যস্ত তাঁর প্রথম বিদ্রোহী আহসান হাবীব, অন্তত কবিতার আধেয় বা বিষয়বস্তুর বিবেচনায়। শামসুর রাহমানের কবিতার বিশদ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর অগ্রজ আহসান হাবীবকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ যা লিখেছেন তা এ রকম :
"আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাত্রিশেষ' বেরোয় ১৯৪৭-এ; এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিংশ-শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন... 'বন্ধ্যা মাটি', 'ঝরাপালকের ভস্মস্তূপ'ধর্মী চিত্রকল্পের সাহায্যে তিনি চেষ্টা করলেন আপন বিশ্ব রচনার...' [ভূমিকা, শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ/শেরপা]।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখায় 'বিংশ-শতকী চেতনা' বলতে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো বোদলেয়ার-উত্তর আধুনিকতার চর্চা যা বাংলা কবিতা আলিঙ্গন করেছিল গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে, মূলত বুদ্ধদেব বসুর পৌরোহিত্যে। বুদ্ধদেব নিজে, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে তাঁদের রচনাকর্মে কথিত 'বিংশ-শতকী চেতনা'কে ধারণ করে রবীন্দ্রোত্তর একটি কাব্যধারা প্রবর্তন করেছিলেন যাকে আমরা এখন 'তিরিশি আধুনিকতা' বলে গণ্য করি।
বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকায়নের মূলমন্ত্র ছিল পূর্ববর্তী রোমান্টিক যুগের একরোখা সৌন্দর্যবোধ থেকে উত্তরণের জন্য বস্তুবিশ্বের কলুষতা ও নির্বেদকে আলিঙ্গন করা এবং একই সঙ্গে কেতাবি ভাষার পরিবর্তে আটপৌরে ভাষায় কবিতা লেখা ও নির্মাণকলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল অনেক আগেই। ১৮৫৭ সালে ফরাসি কবি বোদলেয়ারের কবিতা-সংকলন 'ল্যা ফ্লার দ্যু মল' প্রকাশের পর কাব্যবোদ্ধারা বুঝতে পারেন : এই কবির সৌন্দর্যচেতনা পূর্ববর্তী রোমান্টিক কবিদের চেয়ে ভিন্ন শুভ ও অশুভর সম্মিলনে জীবন তার সামগ্রিকতা নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে এসব কবিতায়।
ফরাসি ও জার্মান কবিতারাজ্যে ঝড়ের গতিতে সেই আধুনিকতা সংক্রমিত হলেও মাত্র ২৬ মাইল ইংলিশ চ্যানেল পার হতে তা সময় নেয় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। প্রথমে আইরিশ ও পরে ব্রিটিশ কবিদের সংবেদনশীলতায় তা অভিঘাত তৈরি করে ১৯১৪ সালের দিকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবিতাঙ্গনেও লাগে সেই ঢেউ। ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশদের উপনিবেশ; প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির নিজ মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও বেশ আয়ত্তে ছিল। অতএব বোদলেয়রীয় কাব্যকলার উত্তরসূরি ইংরেজি ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি, বিশেষ করে টিএস এলিয়ট ও আইরিশ কবি ডবি্লউ বি ইয়েটসের কবিতা, এর সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বোদলেয়ারের কবিতাও, শিক্ষিত বাঙালি কবিদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে ওঠে। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে সেই নব্য আধুনিকতা বিষয়ে অবহিত হন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় দেখতে পান রোমান্টিক যুগের সেই একরোখা সৌন্দর্যবোধ, নির্মাণকলায় কেতাবি শব্দের প্রাধান্য এবং ছন্দ-প্রকরণ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একঘেঁয়েমি।
এরা আটপৌরে মুখের ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করলেও পরবর্তীকালে কবি ও কবিতাবোদ্ধাদের মধ্যে এই উপলব্ধি জাগ্রত হয় যে, কবিতার ভাষার আটপৌরে চারিত্র্য দান কোনোকালেই পরিপূর্ণভাবে সম্ভব নয়। কেতাবি ও আটপৌরে ভাষাভঙ্গির মিশ্রণই হবে কবিতার শেষ নিয়তি। ফলে তিরিশিদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার ফসল হিসেবে শব্দ ব্যবহার, ছন্দ-প্রকরণ, অঙ্গসৌষ্ঠব ও অলঙ্কার নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব আধুনিক কৌশল আমরা পেয়ে গেলাম তা হলো :
ক্রিয়াপদ ব্যবহারের স্বাভাবিকতা অর্থাৎ নামধাতুজ শব্দ 'টঙ্কারিছে', 'বিচরিয়া', 'গুঞ্জরিলো' ইত্যাদি থেকে মুক্তি লাভ।
বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন স্থানে স্বাভাবিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা, যা ছন্দ-প্রকরণকে অক্ষুণ্ন রেখেও বাক্যকে গদ্যসুলভ ধ্বনিব্যঞ্জনা দান করে।
সমমাত্রিক পঙ্ক্তিবিন্যাসের চেয়ে অসমমাত্রিক পঙ্ক্তিবিন্যাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া_ অর্থাৎ দীর্ঘ পঙ্ক্তির সঙ্গে নিদ্বর্িধায় যে কোনো দৈর্ঘ্যের ছোট পঙ্ক্তি ব্যবহার করা_ যাকে 'মুক্তক' আঙ্গিক বলা হয়। অনেকে 'মুক্তক' বলতে ছন্দ-প্রকরণে শৈথিল্যকে বুঝে থাকেন। প্রকৃত অর্থে মুক্তক আঙ্গিকে বিন্যস্ত ছন্দের কবিতায় মাত্রা-বিচ্যুতির কোনো সুযোগ নেই, কেবল পঙ্ক্তির সংকোচন-প্রসারণই এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কার নির্মাণে যতটা সম্ভব বিসদৃশ উপমান-উপমেয়র সঙ্গম ঘটানো। প্রচলিত পন্থার উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপকের চেয়ে সমান্তরাল রূপক ও প্রতীক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ। সমাসোক্তি ও অন্যাসক্তকে তাদের প্রচলিত রূপ থেকে উন্নীত করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে বাড়তি শক্তি দান।
উপমান আহরণে বস্তুবিশ্বের চেনা পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে প্রায়শ অবচেতনায় পরিভ্রমণ_ অর্থাৎ চিত্রকল্প নির্মাণে পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টির প্রয়াস।
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতার এসব নির্মাণ-কৌশল পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করলেও আহসান হাবীব ছিলেন বিষয়বস্তু চয়নের বিবেচনায় তিরিশি কাব্যতত্ত্বের প্রথম বিদ্রোহী। অন্তত এ বিষয়ে তিরিশি কাব্যতত্ত্বে নিজেকে বিসর্জন দিতে আহসান হাবীবের কবিসত্তা ছিল দ্বন্দ্ব-জর্জরিত। তাই প্রবেশলগ্নেই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল তিরিশি কাব্যতত্ত্বের সেই বিশেষ সুচিবায়ুগ্রস্ততার প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস। বুদ্ধদেব বসুর 'প্রান্তরে কিছু নেই, জানালায় পর্দা টেনে দে' কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'সহে না সহে না এ জনতার জঘন্য মিতালি'_ এসব উক্তি ছাড়াও বিভিন্ন নিবন্ধে কবিতাকে জনজীবন থেকে দূরে রেখে অন্তর্মুখিনতায় ডুব দিয়ে যে কলাকৈবল্যবাদী কাব্যচর্চার ঘোষণা ছিল রবীন্দ্রোত্তর তিরিশি আন্দোলনে তাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি কবি আহসান হাবীব। 'ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়/তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়' এই দুটিমাত্র পঙ্ক্তি থেকেই জানা যায় আহসান হাবীবের দ্বন্দ্ব-মুখর মানসলোকের পরিচয়। আমরা এই রূপকধর্মী চিত্রকল্পটিতে দেখি : ঝরাপালক-আচ্ছাদিত নীড়ে বসে এক পাখি [রূপকার্থে কবি] সবুজ পাতার স্বপ্ন দেখছে। প্রকাশিত ভাবনা ছাড়াও পরপর দুটি 'তবু' শব্দের ব্যবহার উলি্লখিত দ্বন্দ্বকে আরও পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। উল্লেখ্য, আহসান হাবীবের এই 'ঝরাপালক' শব্দবন্ধটি তিরিশি কাব্যধারার মৌল ভাবনা জীবনানন্দের 'ঝরাপালক' কাব্যে প্রকাশিত বিনষ্টি-চেতনা, নৈরাশ্য ও বিমানবিকতার ইঙ্গিতবহ। পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান তাঁর প্রবেশলগ্নে তিরিশিদের কাব্য-ভাবনায় আমূল জারিত হয়ে কবিতায় জনজীবন বিচ্ছিন্নতার আত্মঘোষণা দিয়েছিলেন এভাবে : 'আমার খামার নেই, শস্যকণা নেই কোন/আছে শুধু একটি নিবিড় আকাশ' কিংবা তাঁর প্রবেশলগ্নে রচিত বিখ্যাত কবিতা 'রুপালি স্নান'-এর 'শুধু দুই টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ/অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ/শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের কাছে এসে রোজ/চাই নি তো আমি... হাজার যুগের তারার উৎস ওই যে আকাশ/তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে... শান্ত রূপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।' সেই অন্তর্মুখী শামসুর রাহমানও তাঁর মধ্য-পর্যায়ে এসে কেবল 'স্বর্গ-শিশিরে' স্নান করার বাসনা ছেড়ে সমকালীন মনুষ্য-জীবন ও রাজনীতিকে তাঁর কবিতার বিষয় করে তুললেন এবং হয়ে উঠলেন এতটাই বহির্মুখী যেন কবিতায় আমাদের জনপ্রতিনিধি। তিরিশের জীবনানন্দ দাশও তাঁর 'রূপসী বাংলা'য় এসে স্বদেশের রূপ-সৌন্দর্য দিয়ে তাঁর মানসলোক রাঙিয়েছিলেন। তবে জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় প্রত্যক্ষভাবে জনজীবনের চিত্র নেই; আছে লক্ষ্মীপেঁচা, শঙ্খচিল, ইঁদুর, শালিক পাখি, মৎস্যকন্যা আর গঙ্গা-ফড়িংদের প্রাধান্য; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য একান্তই ব্যক্তিমানুষের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এসব পাখি। প্রত্যক্ষ মানুষ যে ক'জন আছে তারাও স্বপ্নের রাজকন্যা বা বেহুলার মতো পৌরাণিক মানুষ।
পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তাঁর মধ্য-পর্যায়ের বিচ্যুতির আগে পর্যন্ত স্বাদেশিকতা ও জীবন-ঘনিষ্ঠতার প্রতি আহসান হাবীবের মতো প্রবলভাবেই নিবিষ্ট থেকেছেন। কোনো কোনো [ফেরার পিপাসা, প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি] কবিতায় তিরিশি ধারার প্রতি দারুণ বিবমিষাও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর 'কালের কলস' কাব্যে 'ভেদাভেদ' শিরোনামের একটি কবিতায় এই বিবমিষায় যুক্ত হয়েছে তিরিশি আধুনিকতা নিয়ে প্রবল শেষোক্তিও : 'যারা মেতেছিলো আধুনিকতার দ্বন্দ্বে/আজো বেঁচে আছে তাদেরই কতেক ভক্ত/কেবল কয়টি পদ্যের দুর্গন্ধে/অর্ধশতক করে যাবে উত্ত্যক্ত।' পঞ্চাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ শামসুল হকের রচনাকর্মও এ দেশের মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। কেবল শহীদ কাদরী বাদে পঞ্চাশ ও ষাটোত্তর প্রজন্মের কোনো কবিই জনজীবন বিচ্ছিন্নতার ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেননি বরং একে আরও নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে ব্রতী হয়েছেন ও হচ্ছেন। সঙ্গতকারণে আহসান হাবীবকেই যদি এই তিরিশোত্তর কাব্যধারার আদি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় তবে নিদ্বর্িধায় বলা চলে : আধেয় বা বিষয়বস্তুর বিবেচনায় বাংলাদেশের কবিতার মূলধারা কোনোকালেই তিরিশি কাব্যতত্ত্বে নিবিষ্ট ছিল না।
তিরিশি কবিরা তাঁদের কাব্যতত্ত্বে ও রচনাকর্মে নৈরাশ্যবাদ, স্বকালের বন্ধ্যত্ব তথা বিশ-শতকীয় বিনষ্টি, বিমানবিকীকরণ ও জনজীবন বিচ্ছিন্নতার নানা দেয়াল তুলে দিয়ে এক রুদ্ধতার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন আধুনিক কবিতাকে। আহসান হাবীব তাঁর রচনাকর্মে আশাবাদ, স্বদেশলগ্নতা ও পুনমানবিকীকরণের উদ্বোধন ঘটিয়ে আধুনিকতার সংজ্ঞাকে মুক্ত ও সম্প্রসারিত করেছেন। আহসান হাবীবোত্তর আমাদের কবিতা তাই এসব তিরিশি ইজমের দাসত্ব করেনি; কৈবল্যবাদী, আত্মজৈবনিক, হতাশাব্যঞ্জক কাতরোক্তিই আধুনিকতার সূচক... এ কথা আর সত্য নয় এবং এ সত্য প্রথম উপলব্ধি করেছেন কবি আহসান হাবীব। আহসান হাবীব কবি হিসেবে আমাদের কাছে বরেণ্য কেবল এই ঐতিহাসিক কারণেই নয়... তিরিশোত্তরকালে আবির্ভূত আমাদের শ্রেষ্ঠতম কবিদেরও একজন তিনি, যার উপাত্তনির্ভর বিচার-বিশ্লেষণ রয়েছে আমার অন্য লেখাগুলোতে।
তিরিশি কাব্যাদর্শ নিয়ে আহসান হাবীব তাঁর অজস্র কবিতায় প্রশ্ন রেখেছেন :খালেক নিকিরি, কদম আলী, কিংবা জমিলার মায়ের নিকট-আত্মীয়টি যিনি বিদ্যালাভের কৃপায় এইমাত্র পুরনো কাঁথার ওম থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম রোদ পোহাচ্ছেন নাগরিক আবহাওয়ায়, যিনি সম্প্রতি বোদলেয়ার-কামু-কাফকা-সার্ত্রে-রিলকে-এলিয়ট-ইয়েটস-এর দারুণ ভক্ত হয়ে পড়েছেন, যার গায়ে লেগে আছে পচা পাট, কচুরিপানা আর ডানকিনা মাছের আঁশটে গন্ধ, পায়ের পাতায় লেপ্টে আছে শিশিরসম্পৃক্ত কাদা... অথচ স্মৃতিহননের এক উন্মত্ত খেলায় মেতে যিনি স্বপ্ন বেচে দিয়ে কেবলই দুঃস্বপ্ন কিনছেন, আর এক অলীক নাগরিক যন্ত্রণাবোধের শিকার হয়ে ছটফট করছেন নিজের বিবরে_ যিনি এই ক'দিন আগেও ঈশ্বর গায়েনের সুপারি বাগানে রানীবালার হাত ধরে ফেলেছিলেন... অথচ এখন কেবল 'নিঃসঙ্গ নিঃসঙ্গ' বলে হাহাকার করছেন, তার এই আধুনিকতাবোধ কি স্বদেশের শিকড়সম্পৃক্ত নাকি ধার করা? এই প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে আহসান হাবীব নির্মাণ করেছেন স্বদেশলগ্ন ও জীবনঘনিষ্ঠ অজস্র কবিতা এবং প্রভাবিত করেছেন তাঁর উত্তর-প্রজন্মের কবিদের রচনাকর্মকেও।
তিরিশি আন্দোলনের অব্যবহিত পর আহসান হাবীবের এ রকম উপলব্ধি সাক্ষ্য দেয় : বিষয় চয়নের বিবেচনায় তিনি ছিলেন তিরিশ কাব্যতত্ত্বের প্রথম দ্রোহী এবং তাঁর সেই কাব্যচিন্তন ছিল সুদূরপ্রসারী। হ
No comments