চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ-সন্ধান by যতীন সরকার
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞান যে গণতন্ত্রের
মহিমা কীর্তনে পঞ্চমুখ, প্রকৃত অর্থে সেটি যে ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে
ধনিকদের দ্বারা প্রবর্তিত ও পরিচালিত ধনিক গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়, কোনো
মতেই এ সত্যকে আড়াল করে রাখা যায় না।
তবু মানতেই হবে যে
ধনিক ভিন্ন অন্যতর ও নিম্নতর শ্রেণীতে যাদের অবস্থান, তারাও এই ধনিক
গণতন্ত্রজাত নানা সুবিধা-সুযোগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয় না। বিশেষ করে
পাশ্চাত্যের উন্নত ধনতন্ত্রী দেশগুলোতে। ওই সব দেশের কিছুসংখ্যক সাধারণ
শ্রমজীবী মানুষের জন্যও যে ধরনের আর্থিক নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা
রয়েছে, সে ধরনের নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েশ অনেক দেশের উঁচু মহলের মানুষের
ভাগ্যেও জোটে না। এর হেতুটির খোঁজ করলে দেখা যাবে যে গুটিকয়েক দেশের
কিছুসংখ্যক মানুষ ভাগ্যধর হয়েছে, দেশের অন্যান্য সবাইকে ভাগ্যহীন বানিয়েই।
বিপুলসংখ্যক দেশের বিপুল সম্পদ অপহরণই স্বল্পসংখ্যক দেশের উন্নত দেশে
উন্নীত হওয়ার ও অন্যগুলোর অবনীত হওয়ার হেতু।
এই প্রক্রিয়াটিরই নাম সাম্রাজ্যবাদ। ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তরকেই বলে সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদে পরিণত ধনতন্ত্রী দেশগুলোই সারা দুনিয়াকে শোষণ করে করে নিজেদের চিকনাই বাড়িয়েছে এবং সেইসঙ্গে ধনতন্ত্রের শোষক রূপটিকে আড়ালে রাখতে ও উদার গণতন্ত্রের বিভ্রম বিস্তারে প্রয়াসী হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে শোষণ চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা যে 'সুপার প্রফিট' বা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে, সেই মুনাফা থেকেই কিছু অংশ তাদের নিজেদের দেশের শ্রমজীবীদের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় এবং এতে তাদের মূল ধনভাণ্ডারে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। এর ফলে অন্য দেশগুলো ক্রমে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। অন্যদিকে এই প্রক্রিয়াতেই উন্নত দেশের ধনিকরা নিজেদের দেশের শ্রমিকদের দিয়েই এমন একটা 'শ্রমিক অভিজাত গোষ্ঠী' সৃষ্টি করে নেয়, যে গোষ্ঠীটি সারা দুনিয়ার শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থসাধনে ব্যাপৃত থাকে।
এই সূত্রেই পত্তন ঘটে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া সংঘগুলোর এবং সাম্রাজ্যবাদীরা দুনিয়াটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার প্রয়াসে প্রবৃত্ত হয়। এ রকম ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে গিয়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের ভেতরে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তেমন একটি যুদ্ধই পরিণতি পায় বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রূপে যার পরিচিতি।
ওই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে, ১৯১৭ সালে, অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের। নবোদ্ভূত এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্বধনতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কেবলই জেরবার ও নাজেহাল হতে থাকে। শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের অন্তঃসারশূন্যতা পুরোপুরি প্রকট হয়ে ওঠে। যুদ্ধের শেষে শক্তিশালী বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের পত্তন, দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার ব্যাপক বিস্তৃতি এবং একপর্যায়ে প্রায় সব দেশ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হওয়া।
শুধু তাই নয়, মানুষ বুঝে ফেলে যে ধনতন্ত্রীরা 'গণতন্ত্র' নাম দিয়ে এতকাল ধরে যা চালাতে চেয়েছে, তা আসলে ধনিকদেরই গণতন্ত্র, ধনিকরাই এখানে সর্বেসর্বা, সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষ এই তথাকথিত গণতন্ত্রে সর্বদাই শোষিত-বঞ্চিত হয়ে এসেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সব মানবিক অধিকারই গণমানুষের নাগালের বাইরে থেকে গেছে। ধনতন্ত্রের- অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ না ঘটিয়ে এই মেকি গণতন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্তি ও প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
কিন্তু সেই বাঞ্ছিত অবস্থা ও ব্যবস্থা তো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। বরং ঘটছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত সব ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ রূপ এখন আর দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় বটে। কিন্তু ছদ্মবেশ ধরে সেই সাম্রাজ্যবাদই আজ দুনিয়াজুড়ে খুঁটি গেড়ে বসছে। ধনতন্ত্রের বিকল্প রূপে একসময় যে সমাজতন্ত্র শোষিত মানুষের বুকে অসীম প্রত্যাশার বজ্রানল জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই সমাজতন্ত্র যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিগত শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙন ও পতনের ফলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমাজতন্ত্র সমর্থক বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীগুলোতে লাগে উল্টো রথের টান। আর এসব ঘটনা ও দুর্ঘটনাই ধনতন্ত্রের তাত্তি্বকদের নতুনভাবে চাঙ্গা করে তোলে। আত্মপ্রসন্নচিত্তে তাঁরা বলতে শুরু করেন যে সমাজতন্ত্র টন্ত্র সব ভুয়া, ধনতন্ত্রেই সমাজের অগ্রযাত্রা শেষ, পশ্চিমি সভ্যতাই সেরা সভ্যতা, সেই সভ্যতার কোলেই আত্মসমর্পণ করতে হবে সব দেশ ও জাতিকে।
এই পর্যায়েই বিশ্বজুড়ে বিস্তার ঘটানো হয় 'বিশ্বায়ন' নামক একটি ধারণার। বিশ্বায়ন আসলে সাম্রাজ্যবাদেরই ছদ্মনাম। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিপর্যয়, বিশ্ব পরিসরে সমাজতন্ত্র-সমর্থক অনেক নেতা-কর্মীর চিত্তবৈকল্য এবং কোনো কোনো সাবেক সমাজতন্ত্রীর একেবারে বিপরীতধর্মী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে চলে যাওয়া- এ সবই দেশে দেশে নয়া সাম্রাজ্যবাদের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। বিশ্বায়নের ছদ্মবেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই বিশ্বেশ্বর হয়ে উঠতে চাইছে। অনেকটা সে রকমই হয়েও উঠেছে। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের অভ্যন্তরে যদিও জনগণের মধ্যে বিশ্বায়নবিরোধী ভাবনা-চিন্তার বিস্তার ঘটে চলছে, তবু ওই সব অধিকাংশ দেশেরই শাসকগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে মার্কিন আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছে।
এই পরিস্থিতিতে সাবেক উপনিবেশ তথা অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলো হয়েছে চূড়ান্ত দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যের শিকার। ওই সব দেশেরই অন্তর্গত আমাদের এই বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের যে ভূখণ্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশটি গঠিত, সেটিকে সাম্রাজ্যবাদী ও তার সহযোগীরা কেবল শোষণের ক্ষেত্ররূপেই ব্যবহার করেছে, এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতেও দেয়নি। উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক একটি অদ্ভুত ও কৃত্রিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এ অঞ্চলটি আরো বেশি পরিমাণে শোষিত হতে থাকে।
পাকিস্তানি শোষণ-শাসনে ও সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠলগ্ন হয়ে থেকে এখানে কোনো স্বাধীন-ধনিক গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। কাজেই ধনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই এখানে ছিল না। জনগণের চৈতন্যে যখনই গণতন্ত্রের অভিলাষ জেগে উঠেছে তখনই জঙ্গিতন্ত্র সে অভিলাষের মূলোচ্ছেদে প্রবৃত্ত হয়েছে। জঙ্গিতন্ত্রই এখানে প্রবল প্রতাপে গণতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থেকেছে। আবার এই জঙ্গিতন্ত্রই নানা কায়দায় গণতন্ত্রের বিভ্রম ছড়িয়েছে, এ দেশের মানুষের মেধার উপযোগী নয় পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র- এমন কথা সোচ্চারে প্রচার করেছে, আর অভিনব ও আজব ধরনের গণতন্ত্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের এক জঙ্গবাহাদুর ইসকান্দর মির্জা প্রচারিত 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র'কেই আরেক জঙ্গবাহাদুর আইয়ুব খান 'মৌলিক গণতন্ত্র' নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে।
এসব আজব গণতন্ত্রকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। তাই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবলমুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানে থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেই যাত্রা শুরু করেছিল। ধনতন্ত্র ও ধনিক গণতন্ত্র নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার রক্ষিত হয় যে গণতন্ত্রে, সে রকম প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে রেখেছিল তার লক্ষ্যবিন্দুতে।
কিন্তু ভেতর ও বাইরের মতলববাজদের ষড়যন্ত্র দেশটিকে তার লক্ষ্যবিন্দুতে স্থির থাকতে দেয়নি। এরা সবাই মিলেই দেশটির যাত্রাপথকে বিপরীতমুখী করে ফেলে। অথচ বিপরীত মুখে গিয়েই বোধগম্য কারণেই এখানে কোনো স্বাধীন ও জাতীয় ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটতে পারেনি। তার বদলে এ ধরনের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠলগ্ন একটি লুটপাটতন্ত্রী শাসকশ্রেণী। সেই শ্রেণীই বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে শাসনক্ষমতার দখল নেয়। যে গোষ্ঠী ক্ষমতার গদিটিকে দখল করতে পারে, সে গোষ্ঠী গদিটিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকার জন্য নানা পথের সন্ধান করে। আর ক্ষমতাচ্যুত গোষ্ঠীটি ক্ষমতা দখলের জন্যও একই রকম তৎপরতা চালায়। সব গোষ্ঠীরই মুখে গণতন্ত্রের ললিতবাণী, কিন্তু অন্তরে স্বৈরতন্ত্রী ভাবনার লকলকানি। গণতন্ত্রের বেনামিতে গণপ্রতারণাই ক্ষমতারোহী ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব গোষ্ঠীর ধ্যান-জ্ঞান ও বীজমন্ত্র। সব গোষ্ঠীর সঙ্গেই সংযুক্ত হয়ে আছে লুটপাটপ্রত্যাশী তথাকথিত শিল্প-উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ফটকাবাজ এবং মতলববাজ আমলাকুল। এদের সমবায়েই তৈরি হয়েছে অন্নদাশঙ্কর-কথিত টুইডেলগাম আর টুইডেলগীদের। এরাই আজ বাংলাদেশের গণ-অধিকার অপহারক ও প্রতারক গণতন্ত্রের ধারকবাহক।
এই টুইডেলগাম আর টুইডেলগীদের প্রতাপান্বিত অবস্থান বজায় থাকবে, সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদভোজীরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করবে, লুটপাটতন্ত্রীরা বহাল তবিয়তে লুটপাট চালিয়ে যাবে অথচ দেশটিতে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রেরও প্রতিষ্ঠা ঘটবে- এমন ভাবনার ভাবুকদের প্রভাব-বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমস্যা-সংকটের এবং সমস্যা-নিরসনের ও সংকটত্রাণের কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে পথের খোঁজ পাওয়ার জন্য প্রথমেই বেরিয়ে আসতে হবে একালের নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্ভাবিত ও প্রচারিত সব অপতত্ত্বের অরণ্য থেকে। সেই অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই প্রয়োজন জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্রের তত্ত্বটিকে চৈতন্যে ধারণা করা। সেই প্রয়োজন সাধনের জন্যই আমাদের আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
এই প্রক্রিয়াটিরই নাম সাম্রাজ্যবাদ। ধনতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তরকেই বলে সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদে পরিণত ধনতন্ত্রী দেশগুলোই সারা দুনিয়াকে শোষণ করে করে নিজেদের চিকনাই বাড়িয়েছে এবং সেইসঙ্গে ধনতন্ত্রের শোষক রূপটিকে আড়ালে রাখতে ও উদার গণতন্ত্রের বিভ্রম বিস্তারে প্রয়াসী হয়েছে।
বিভিন্ন দেশে শোষণ চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা যে 'সুপার প্রফিট' বা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে, সেই মুনাফা থেকেই কিছু অংশ তাদের নিজেদের দেশের শ্রমজীবীদের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয় এবং এতে তাদের মূল ধনভাণ্ডারে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। এর ফলে অন্য দেশগুলো ক্রমে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। অন্যদিকে এই প্রক্রিয়াতেই উন্নত দেশের ধনিকরা নিজেদের দেশের শ্রমিকদের দিয়েই এমন একটা 'শ্রমিক অভিজাত গোষ্ঠী' সৃষ্টি করে নেয়, যে গোষ্ঠীটি সারা দুনিয়ার শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থসাধনে ব্যাপৃত থাকে।
এই সূত্রেই পত্তন ঘটে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া সংঘগুলোর এবং সাম্রাজ্যবাদীরা দুনিয়াটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার প্রয়াসে প্রবৃত্ত হয়। এ রকম ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে গিয়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের ভেতরে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ লেগে থাকে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তেমন একটি যুদ্ধই পরিণতি পায় বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রূপে যার পরিচিতি।
ওই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে, ১৯১৭ সালে, অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের। নবোদ্ভূত এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্বধনতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কেবলই জেরবার ও নাজেহাল হতে থাকে। শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের অন্তঃসারশূন্যতা পুরোপুরি প্রকট হয়ে ওঠে। যুদ্ধের শেষে শক্তিশালী বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের পত্তন, দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার ব্যাপক বিস্তৃতি এবং একপর্যায়ে প্রায় সব দেশ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হওয়া।
শুধু তাই নয়, মানুষ বুঝে ফেলে যে ধনতন্ত্রীরা 'গণতন্ত্র' নাম দিয়ে এতকাল ধরে যা চালাতে চেয়েছে, তা আসলে ধনিকদেরই গণতন্ত্র, ধনিকরাই এখানে সর্বেসর্বা, সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষ এই তথাকথিত গণতন্ত্রে সর্বদাই শোষিত-বঞ্চিত হয়ে এসেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সব মানবিক অধিকারই গণমানুষের নাগালের বাইরে থেকে গেছে। ধনতন্ত্রের- অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ না ঘটিয়ে এই মেকি গণতন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্তি ও প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
কিন্তু সেই বাঞ্ছিত অবস্থা ও ব্যবস্থা তো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। বরং ঘটছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত সব ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ রূপ এখন আর দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় বটে। কিন্তু ছদ্মবেশ ধরে সেই সাম্রাজ্যবাদই আজ দুনিয়াজুড়ে খুঁটি গেড়ে বসছে। ধনতন্ত্রের বিকল্প রূপে একসময় যে সমাজতন্ত্র শোষিত মানুষের বুকে অসীম প্রত্যাশার বজ্রানল জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই সমাজতন্ত্র যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিগত শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙন ও পতনের ফলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমাজতন্ত্র সমর্থক বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীগুলোতে লাগে উল্টো রথের টান। আর এসব ঘটনা ও দুর্ঘটনাই ধনতন্ত্রের তাত্তি্বকদের নতুনভাবে চাঙ্গা করে তোলে। আত্মপ্রসন্নচিত্তে তাঁরা বলতে শুরু করেন যে সমাজতন্ত্র টন্ত্র সব ভুয়া, ধনতন্ত্রেই সমাজের অগ্রযাত্রা শেষ, পশ্চিমি সভ্যতাই সেরা সভ্যতা, সেই সভ্যতার কোলেই আত্মসমর্পণ করতে হবে সব দেশ ও জাতিকে।
এই পর্যায়েই বিশ্বজুড়ে বিস্তার ঘটানো হয় 'বিশ্বায়ন' নামক একটি ধারণার। বিশ্বায়ন আসলে সাম্রাজ্যবাদেরই ছদ্মনাম। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিপর্যয়, বিশ্ব পরিসরে সমাজতন্ত্র-সমর্থক অনেক নেতা-কর্মীর চিত্তবৈকল্য এবং কোনো কোনো সাবেক সমাজতন্ত্রীর একেবারে বিপরীতধর্মী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে চলে যাওয়া- এ সবই দেশে দেশে নয়া সাম্রাজ্যবাদের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। বিশ্বায়নের ছদ্মবেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই বিশ্বেশ্বর হয়ে উঠতে চাইছে। অনেকটা সে রকমই হয়েও উঠেছে। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের অভ্যন্তরে যদিও জনগণের মধ্যে বিশ্বায়নবিরোধী ভাবনা-চিন্তার বিস্তার ঘটে চলছে, তবু ওই সব অধিকাংশ দেশেরই শাসকগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে মার্কিন আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছে।
এই পরিস্থিতিতে সাবেক উপনিবেশ তথা অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলো হয়েছে চূড়ান্ত দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যের শিকার। ওই সব দেশেরই অন্তর্গত আমাদের এই বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের যে ভূখণ্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশটি গঠিত, সেটিকে সাম্রাজ্যবাদী ও তার সহযোগীরা কেবল শোষণের ক্ষেত্ররূপেই ব্যবহার করেছে, এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতেও দেয়নি। উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক একটি অদ্ভুত ও কৃত্রিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এ অঞ্চলটি আরো বেশি পরিমাণে শোষিত হতে থাকে।
পাকিস্তানি শোষণ-শাসনে ও সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠলগ্ন হয়ে থেকে এখানে কোনো স্বাধীন-ধনিক গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। কাজেই ধনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই এখানে ছিল না। জনগণের চৈতন্যে যখনই গণতন্ত্রের অভিলাষ জেগে উঠেছে তখনই জঙ্গিতন্ত্র সে অভিলাষের মূলোচ্ছেদে প্রবৃত্ত হয়েছে। জঙ্গিতন্ত্রই এখানে প্রবল প্রতাপে গণতন্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থেকেছে। আবার এই জঙ্গিতন্ত্রই নানা কায়দায় গণতন্ত্রের বিভ্রম ছড়িয়েছে, এ দেশের মানুষের মেধার উপযোগী নয় পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র- এমন কথা সোচ্চারে প্রচার করেছে, আর অভিনব ও আজব ধরনের গণতন্ত্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের এক জঙ্গবাহাদুর ইসকান্দর মির্জা প্রচারিত 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র'কেই আরেক জঙ্গবাহাদুর আইয়ুব খান 'মৌলিক গণতন্ত্র' নামে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে।
এসব আজব গণতন্ত্রকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। তাই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবলমুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানে থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেই যাত্রা শুরু করেছিল। ধনতন্ত্র ও ধনিক গণতন্ত্র নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার রক্ষিত হয় যে গণতন্ত্রে, সে রকম প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে রেখেছিল তার লক্ষ্যবিন্দুতে।
কিন্তু ভেতর ও বাইরের মতলববাজদের ষড়যন্ত্র দেশটিকে তার লক্ষ্যবিন্দুতে স্থির থাকতে দেয়নি। এরা সবাই মিলেই দেশটির যাত্রাপথকে বিপরীতমুখী করে ফেলে। অথচ বিপরীত মুখে গিয়েই বোধগম্য কারণেই এখানে কোনো স্বাধীন ও জাতীয় ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটতে পারেনি। তার বদলে এ ধরনের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠলগ্ন একটি লুটপাটতন্ত্রী শাসকশ্রেণী। সেই শ্রেণীই বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে শাসনক্ষমতার দখল নেয়। যে গোষ্ঠী ক্ষমতার গদিটিকে দখল করতে পারে, সে গোষ্ঠী গদিটিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকার জন্য নানা পথের সন্ধান করে। আর ক্ষমতাচ্যুত গোষ্ঠীটি ক্ষমতা দখলের জন্যও একই রকম তৎপরতা চালায়। সব গোষ্ঠীরই মুখে গণতন্ত্রের ললিতবাণী, কিন্তু অন্তরে স্বৈরতন্ত্রী ভাবনার লকলকানি। গণতন্ত্রের বেনামিতে গণপ্রতারণাই ক্ষমতারোহী ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব গোষ্ঠীর ধ্যান-জ্ঞান ও বীজমন্ত্র। সব গোষ্ঠীর সঙ্গেই সংযুক্ত হয়ে আছে লুটপাটপ্রত্যাশী তথাকথিত শিল্প-উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ফটকাবাজ এবং মতলববাজ আমলাকুল। এদের সমবায়েই তৈরি হয়েছে অন্নদাশঙ্কর-কথিত টুইডেলগাম আর টুইডেলগীদের। এরাই আজ বাংলাদেশের গণ-অধিকার অপহারক ও প্রতারক গণতন্ত্রের ধারকবাহক।
এই টুইডেলগাম আর টুইডেলগীদের প্রতাপান্বিত অবস্থান বজায় থাকবে, সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদভোজীরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করবে, লুটপাটতন্ত্রীরা বহাল তবিয়তে লুটপাট চালিয়ে যাবে অথচ দেশটিতে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রেরও প্রতিষ্ঠা ঘটবে- এমন ভাবনার ভাবুকদের প্রভাব-বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমস্যা-সংকটের এবং সমস্যা-নিরসনের ও সংকটত্রাণের কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে পথের খোঁজ পাওয়ার জন্য প্রথমেই বেরিয়ে আসতে হবে একালের নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্ভাবিত ও প্রচারিত সব অপতত্ত্বের অরণ্য থেকে। সেই অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই প্রয়োজন জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্রের তত্ত্বটিকে চৈতন্যে ধারণা করা। সেই প্রয়োজন সাধনের জন্যই আমাদের আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments