দিল্লির চিঠি ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্র ও সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায় by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠিক ছয় দিনের ব্যবধানে ভারতের সুপ্রিম
কোর্ট নির্বাচনসংক্রান্ত এমন দুটি রায় দিয়েছেন, যার প্রতিক্রিয়া শুধু যে
সুদূরপ্রসারীই হবে তা নয়, ইতিমধ্যেই ‘ইলেকশন মোড’-এ চলে যাওয়া এই দেশের
রাজনীতিক ও রাজনীতি-সচেতন আম-আদমিকে চঞ্চল ও চনমনে করে তুলেছে।
এই
উপমহাদেশের অন্যত্র, গণতন্ত্র যেখানে হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে ক্রমশ
থিতু হওয়ার পথে এগোচ্ছে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোচ্চ
আদালতের এই যুগল রায় সেই সব দেশের গণতান্ত্রিক আবহকে আদৌ আন্দোলিত করতে
পারে কি না, তা অবশ্য দ্রষ্টব্য হয়ে থাকবে।
প্রথম রায় দানের তারিখ ৫ জুলাই, শুক্রবার। সুপ্রিম কোর্টের ভাবী প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবম ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈ একটি মামলা খারিজ করার পাশাপাশি দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনী ইশতেহারে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করার বিষয়ে যেন নির্বাচন আচরণবিধিতে পরিবর্তন আনা হয়। এ কথা ঠিক যে, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া রাজনীতি অচল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি যেখানে ঘুষেরই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায় এবং বড় বা ক্ষমতাসীন দলগুলো যখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয়ের প্রতিযোগিতায় নামে, তখন তা বন্ধ করে ছোট-মাঝারি-বড় সব দলের জন্য একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা জরুরি বলে এই দুই বিচারপতি মনে করেছেন। সেই অনুযায়ীই দেশের নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ।
তামিলনাড়ুর এস সুব্রক্ষ্মন্যম বালাজি এই মামলাটি করেছিলেন তাঁর রাজ্য ও অন্যদের বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান রাজনৈতিক দল ডিএমকে প্রতিশ্রুতি দেয়, ভোটে জিতলে তারা সব টিভিহীন পরিবারকে রঙিন টিভি সেট উপহার দেবে। করুণানিধির দলের যুক্তি ছিল, গ্রামীণ মহিলাদের বিনোদন বলতে সেই অর্থে কিছুই প্রায় নেই। টিভি দিলে তাদের বিনোদন যেমন হবে, সাধারণভাবে জ্ঞানের বহরও বাড়বে। সুব্রক্ষ্মন্যম বালাজি মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চে মামলা ঠোকেন। তাঁর দাবি, এই প্রতিশ্রুতি ঘুষেরই নামান্তর এবং ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিপন্থী। মামলা দায়ের করার পরপরই রাজ্যে নির্বাচন হয়ে যায় এবং ডিএমকে ক্ষমতায় আসে। প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রথম বছরে ৩০ হাজার পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়। বাজেটে এ জন্য আলাদা বরাদ্দ হয় ৭৫০ কোটি রুপি। মামলাটি হাইকোর্ট খারিজ করে দেন এই যুক্তিতে যে গরিব মানুষকে রঙিন টিভি দেওয়াটা রাজকোষের অপচয় নয়।
মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে আসে ২০১১ সালে। রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএমকের পাশাপাশি এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতাও ‘প্রতিশ্রুতির’ বন্যা বইয়ে দেন। গ্রাইন্ডার, মিক্সার, বিজলি পাখা, ল্যাপটপ, চার গ্রাম সোনা, বিবাহযোগ্য মেয়ের জন্য ৫০ হাজার রুপি, রেশনে ২০ কেজি করে চাল, গরু, ভেড়া, এমনকি গ্রিন হাউস তৈরি করে দেওয়ারও কথা বলা হয়। বালাজি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে বলেন, এসব প্রতিশ্রুতি ঘুষ দিয়ে ভোট কেনারই নামান্তর শুধু নয়, এ হলো সরকারি কোষাগারের অযথা অপচয়। ‘কনসোলিডেটেড ফান্ড’-এর অর্থ এভাবে খরচ করা সংবিধানবিরোধী।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে ‘দুর্নীতিমূলক কাজ’ বলতে বিচারপতিরা অসম্মত হলেও তাঁরা রায় দানের সময় স্বীকার করেন, এ ধরনের দান-খয়রাত নিঃসন্দেহে মানুষকে প্রভাবিত করে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধা দেয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সমানভাবে বিচার্য হতে দেয় না। অর্থাৎ, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ অসমান হয়ে দাঁড়ায়। এ কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ আদালত বলেন, এই বিষয়ে আইনসভাকে আইন প্রণয়ন করার নির্দেশ তাঁরা দিতে পারেন না, যদিও নির্বাচন কমিশনকে বলতে পারেন বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে যথাশিগগির সম্ভব বিষয়টিকে নির্বাচনী আচরণবিধির আওতায় নিয়ে আসতে।
মামলাটি খারিজ হওয়ার দুঃখ বালাজির ঘুচে গেছে নিশ্চয়, কেননা, রায় দানের চার দিন পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়ে এই বিষয়ে তাদের অভিমত জানতে চেয়েছে। ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি করেছিলেন আইনজীবী লিলি টমাস ও ‘লোক প্রহরী’ নামে এক বেসরকারি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এন শুক্ল। দেশের রাজনীতিকে অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করার তাগিদে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে তাঁরা ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) ধারা বাতিলের আবেদন জানান। তাঁদের নিবেদন, ভারতীয় সংবিধানের ১০১(৩)(ক) এবং ১৯০(৩)(ক) ধারায় নির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সদস্যপদ খারিজ হবে। কিন্তু সংসদে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) সংশোধনী এনে যা বলা হয়েছে, তা সংবিধান পরিপন্থী। ওই ধারায় এ কথা বলা হয় যে সাজাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধির উচ্চতর আদালতে আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদ খারিজ হবে না। সুপ্রিম কোর্ট ১০ জুলাই বুধবার সেই সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী বলে খারিজ করে জানান, ওই দিন থেকেই তাঁদের রায় কার্যকর হবে। দেশের যেকোনো আদালতে যেসব জনপ্রতিনিধির অতঃপর দুই বছরের সাজা হবে, তাঁদের কেউই ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। অবশ্য যাঁরা ইতিমধ্যেই সাজা পেয়েছেন অথচ আবেদন উচ্চতর বা উচ্চতম আদালতে বিবেচনাধীন, তাঁদের সদস্যপদ এই রায়ের সঙ্গে সঙ্গে খারিজ হচ্ছে না।
এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত শীর্ষ আদালতের দু-দুটি রায়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে হেলদোল শুরু হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। ঘুষ দিয়ে ভোট কেনার নানা ফন্দিফিকির যেমন একদিকে চুরির বহর বাড়িয়েছে এবং কোষাগার ফাঁকা করে রাজ্যে রাজ্যে উন্নয়নের বারোটা বাজাচ্ছে, নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিকদের হতোদ্যম করে তুলেছে, তেমনই রাজনীতির অপরাধীকরণে জেরবার হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) ও ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচের (এনইডব্লিউ) হিসাব অনুযায়ী বর্তমান লোকসভার ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে ১৬২ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দেশের রাজ্য বিধানসভাগুলোর মোট চার হাজার ৩২ সদস্যের মধ্যে ফৌজদারি মামলা রয়েছে এক হাজার ২৫৮ জনের বিরুদ্ধে, যেগুলোর প্রায় অর্ধেক গুরুতর অভিযোগ। এই দুই সংস্থা অনুযায়ী দলগত হিসাবও মারাত্মক। ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার ৮২ শতাংশ, লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ৬৪ শতাংশ, মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টির ৪৮ শতাংশ, বিজেপির ৩১ এবং কংগ্রেসের ২১ শতাংশ সদস্যই অপরাধী।
এত বছর ধরে একদিকে নির্বাচনী সংস্কার ও রাজনীতিকে অপরাধীমুক্ত করার যে প্রচেষ্টা চলছিল, নানা বাধা-বিপত্তিজনিত কারণে তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অন্তত অপরাধীদের টিকিট দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ভাবনাচিন্তা করতে রাজনীতির কারবারিরা বাধ্য হবেন। কিন্তু অন্য একটি বিষয়ও ভাবা প্রয়োজন। রাজনীতিতে যাঁরাই আছেন, কোনো না কোনো কারণে তাঁদের মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখি হতেই হয়। রাজনৈতিক হিংসা যেখানে প্রবল, প্রতিহিংসার রাজনীতি যে রাজ্যে দস্তুর, সেখানে ফৌজদারি মিথ্যে মামলায় প্রতিপক্ষকে সাজা দেওয়াটাও অসম্ভব নয়। এই রায় সেই নিরিখে রাজনৈতিক নেতাদের সাবধানী হতে যেমন বাধ্য করবে, তেমনি প্রকৃত অপরাধীদের জন্য রাজনীতির দরজা কিছুটা হলেও বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
এ কথা ভাবতেও লজ্জা লাগে যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাজনীতি ইদানীং আক্ষরিক অর্থেই ‘টাকার বশে’ পরিণত হয়েছে। যার অর্থ আছে, রাজনীতিতে ঝোঁক থাকলে তাকে রোখা প্রায় অসম্ভব। অর্থবল জন্ম দেয় বাহুবলের। এই দুই বলের সংমিশ্রণে রাজনীতি পেয়ে যায় এক বাড়তি গুরুত্ব। ধনকুবের না হলে রাজনীতিতে সফল হওয়া আজকের দিনে প্রায় অসম্ভব। নির্বাচন কমিশন গত আড়াই দশকে সংস্কারের যেসব পদক্ষেপ করেছে, তাতে ভোট অনেকটাই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়তো হয়েছে কিন্তু অর্থের ঝনঝনানি বন্ধ করতে পারেনি। লোকসভা ও বিধানসভার ক্ষেত্রে প্রচারের খরচ বেঁধে দিলেও চোরাগোপ্তা খরচ আটকাতে পারেনি। এই তো দিন কয়েক আগে বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা কবুলই করে ফেলেছেন, ভোট-প্রচারে তাঁর খরচ হয়েছে আট কোটি রুপি। কমিশনের বেঁধে দেওয়া খরচ যেখানে মাত্রই ৪০ লাখ! ভোটে দাঁড়াতে গেলে প্রার্থীদের সম্পত্তির ঘোষণা এ দেশে বাধ্যতামূলক। দেখা যাচ্ছে, জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়ার পর বহু মানুষের সম্পত্তি কয়েক শ গুণ বেড়ে গেছে! কী করে তা হলো, তা জানানোর দায় যেমন প্রার্থীর থাকে না, জানার আগ্রহও তেমন নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করে না। অথচ খুব সহজেই এখানেও রাশ টানা যায়। প্রার্থীদের সম্পত্তির ঘোষণা খতিয়ে দেখার জন্য একটি সেল নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা যেতে পারে, যারা দেখবে অর্জিত সম্পত্তির সঙ্গে ঘোষণা সংগতিপূর্ণ কি না। অসংগতি প্রার্থী-পদে বাধা সৃষ্টি করতেই পারে।
রাজনীতিকে স্বচ্ছ করতে এখনো অনেক পথ হাঁটা বাকি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টি এন সেশনের উদ্যোগের পর থেকে এত দিনে অবস্থার কিছুটা উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। আরও খানিকটা সুপ্রিম কোর্টের এই দুই রায়ে নিশ্চিতই হবে। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতির অসুখ সারাতে আরও অনেক দাওয়াই প্রয়োজন। রাজনীতিকেরা চঞ্চল হবেন। না হয়ে উপায়ও নেই। আম-আদমি কিন্তু চনমনে। নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের যুগলবন্দী রাজনীতির রং বদলে দিতে পারে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
প্রথম রায় দানের তারিখ ৫ জুলাই, শুক্রবার। সুপ্রিম কোর্টের ভাবী প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবম ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈ একটি মামলা খারিজ করার পাশাপাশি দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনী ইশতেহারে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করার বিষয়ে যেন নির্বাচন আচরণবিধিতে পরিবর্তন আনা হয়। এ কথা ঠিক যে, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া রাজনীতি অচল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি যেখানে ঘুষেরই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায় এবং বড় বা ক্ষমতাসীন দলগুলো যখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অপচয়ের প্রতিযোগিতায় নামে, তখন তা বন্ধ করে ছোট-মাঝারি-বড় সব দলের জন্য একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা জরুরি বলে এই দুই বিচারপতি মনে করেছেন। সেই অনুযায়ীই দেশের নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ।
তামিলনাড়ুর এস সুব্রক্ষ্মন্যম বালাজি এই মামলাটি করেছিলেন তাঁর রাজ্য ও অন্যদের বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান রাজনৈতিক দল ডিএমকে প্রতিশ্রুতি দেয়, ভোটে জিতলে তারা সব টিভিহীন পরিবারকে রঙিন টিভি সেট উপহার দেবে। করুণানিধির দলের যুক্তি ছিল, গ্রামীণ মহিলাদের বিনোদন বলতে সেই অর্থে কিছুই প্রায় নেই। টিভি দিলে তাদের বিনোদন যেমন হবে, সাধারণভাবে জ্ঞানের বহরও বাড়বে। সুব্রক্ষ্মন্যম বালাজি মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চে মামলা ঠোকেন। তাঁর দাবি, এই প্রতিশ্রুতি ঘুষেরই নামান্তর এবং ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিপন্থী। মামলা দায়ের করার পরপরই রাজ্যে নির্বাচন হয়ে যায় এবং ডিএমকে ক্ষমতায় আসে। প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রথম বছরে ৩০ হাজার পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়। বাজেটে এ জন্য আলাদা বরাদ্দ হয় ৭৫০ কোটি রুপি। মামলাটি হাইকোর্ট খারিজ করে দেন এই যুক্তিতে যে গরিব মানুষকে রঙিন টিভি দেওয়াটা রাজকোষের অপচয় নয়।
মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে আসে ২০১১ সালে। রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএমকের পাশাপাশি এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতাও ‘প্রতিশ্রুতির’ বন্যা বইয়ে দেন। গ্রাইন্ডার, মিক্সার, বিজলি পাখা, ল্যাপটপ, চার গ্রাম সোনা, বিবাহযোগ্য মেয়ের জন্য ৫০ হাজার রুপি, রেশনে ২০ কেজি করে চাল, গরু, ভেড়া, এমনকি গ্রিন হাউস তৈরি করে দেওয়ারও কথা বলা হয়। বালাজি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে বলেন, এসব প্রতিশ্রুতি ঘুষ দিয়ে ভোট কেনারই নামান্তর শুধু নয়, এ হলো সরকারি কোষাগারের অযথা অপচয়। ‘কনসোলিডেটেড ফান্ড’-এর অর্থ এভাবে খরচ করা সংবিধানবিরোধী।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে ‘দুর্নীতিমূলক কাজ’ বলতে বিচারপতিরা অসম্মত হলেও তাঁরা রায় দানের সময় স্বীকার করেন, এ ধরনের দান-খয়রাত নিঃসন্দেহে মানুষকে প্রভাবিত করে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধা দেয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সমানভাবে বিচার্য হতে দেয় না। অর্থাৎ, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ অসমান হয়ে দাঁড়ায়। এ কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ আদালত বলেন, এই বিষয়ে আইনসভাকে আইন প্রণয়ন করার নির্দেশ তাঁরা দিতে পারেন না, যদিও নির্বাচন কমিশনকে বলতে পারেন বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে যথাশিগগির সম্ভব বিষয়টিকে নির্বাচনী আচরণবিধির আওতায় নিয়ে আসতে।
মামলাটি খারিজ হওয়ার দুঃখ বালাজির ঘুচে গেছে নিশ্চয়, কেননা, রায় দানের চার দিন পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়ে এই বিষয়ে তাদের অভিমত জানতে চেয়েছে। ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি করেছিলেন আইনজীবী লিলি টমাস ও ‘লোক প্রহরী’ নামে এক বেসরকারি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এন শুক্ল। দেশের রাজনীতিকে অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করার তাগিদে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে তাঁরা ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) ধারা বাতিলের আবেদন জানান। তাঁদের নিবেদন, ভারতীয় সংবিধানের ১০১(৩)(ক) এবং ১৯০(৩)(ক) ধারায় নির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সদস্যপদ খারিজ হবে। কিন্তু সংসদে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৪) সংশোধনী এনে যা বলা হয়েছে, তা সংবিধান পরিপন্থী। ওই ধারায় এ কথা বলা হয় যে সাজাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধির উচ্চতর আদালতে আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদ খারিজ হবে না। সুপ্রিম কোর্ট ১০ জুলাই বুধবার সেই সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী বলে খারিজ করে জানান, ওই দিন থেকেই তাঁদের রায় কার্যকর হবে। দেশের যেকোনো আদালতে যেসব জনপ্রতিনিধির অতঃপর দুই বছরের সাজা হবে, তাঁদের কেউই ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। অবশ্য যাঁরা ইতিমধ্যেই সাজা পেয়েছেন অথচ আবেদন উচ্চতর বা উচ্চতম আদালতে বিবেচনাধীন, তাঁদের সদস্যপদ এই রায়ের সঙ্গে সঙ্গে খারিজ হচ্ছে না।
এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত শীর্ষ আদালতের দু-দুটি রায়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে হেলদোল শুরু হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। ঘুষ দিয়ে ভোট কেনার নানা ফন্দিফিকির যেমন একদিকে চুরির বহর বাড়িয়েছে এবং কোষাগার ফাঁকা করে রাজ্যে রাজ্যে উন্নয়নের বারোটা বাজাচ্ছে, নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিকদের হতোদ্যম করে তুলেছে, তেমনই রাজনীতির অপরাধীকরণে জেরবার হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) ও ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচের (এনইডব্লিউ) হিসাব অনুযায়ী বর্তমান লোকসভার ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে ১৬২ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। দেশের রাজ্য বিধানসভাগুলোর মোট চার হাজার ৩২ সদস্যের মধ্যে ফৌজদারি মামলা রয়েছে এক হাজার ২৫৮ জনের বিরুদ্ধে, যেগুলোর প্রায় অর্ধেক গুরুতর অভিযোগ। এই দুই সংস্থা অনুযায়ী দলগত হিসাবও মারাত্মক। ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার ৮২ শতাংশ, লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ৬৪ শতাংশ, মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টির ৪৮ শতাংশ, বিজেপির ৩১ এবং কংগ্রেসের ২১ শতাংশ সদস্যই অপরাধী।
এত বছর ধরে একদিকে নির্বাচনী সংস্কার ও রাজনীতিকে অপরাধীমুক্ত করার যে প্রচেষ্টা চলছিল, নানা বাধা-বিপত্তিজনিত কারণে তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অন্তত অপরাধীদের টিকিট দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো ভাবনাচিন্তা করতে রাজনীতির কারবারিরা বাধ্য হবেন। কিন্তু অন্য একটি বিষয়ও ভাবা প্রয়োজন। রাজনীতিতে যাঁরাই আছেন, কোনো না কোনো কারণে তাঁদের মামলা-মোকদ্দমার মুখোমুখি হতেই হয়। রাজনৈতিক হিংসা যেখানে প্রবল, প্রতিহিংসার রাজনীতি যে রাজ্যে দস্তুর, সেখানে ফৌজদারি মিথ্যে মামলায় প্রতিপক্ষকে সাজা দেওয়াটাও অসম্ভব নয়। এই রায় সেই নিরিখে রাজনৈতিক নেতাদের সাবধানী হতে যেমন বাধ্য করবে, তেমনি প্রকৃত অপরাধীদের জন্য রাজনীতির দরজা কিছুটা হলেও বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
এ কথা ভাবতেও লজ্জা লাগে যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাজনীতি ইদানীং আক্ষরিক অর্থেই ‘টাকার বশে’ পরিণত হয়েছে। যার অর্থ আছে, রাজনীতিতে ঝোঁক থাকলে তাকে রোখা প্রায় অসম্ভব। অর্থবল জন্ম দেয় বাহুবলের। এই দুই বলের সংমিশ্রণে রাজনীতি পেয়ে যায় এক বাড়তি গুরুত্ব। ধনকুবের না হলে রাজনীতিতে সফল হওয়া আজকের দিনে প্রায় অসম্ভব। নির্বাচন কমিশন গত আড়াই দশকে সংস্কারের যেসব পদক্ষেপ করেছে, তাতে ভোট অনেকটাই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়তো হয়েছে কিন্তু অর্থের ঝনঝনানি বন্ধ করতে পারেনি। লোকসভা ও বিধানসভার ক্ষেত্রে প্রচারের খরচ বেঁধে দিলেও চোরাগোপ্তা খরচ আটকাতে পারেনি। এই তো দিন কয়েক আগে বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা কবুলই করে ফেলেছেন, ভোট-প্রচারে তাঁর খরচ হয়েছে আট কোটি রুপি। কমিশনের বেঁধে দেওয়া খরচ যেখানে মাত্রই ৪০ লাখ! ভোটে দাঁড়াতে গেলে প্রার্থীদের সম্পত্তির ঘোষণা এ দেশে বাধ্যতামূলক। দেখা যাচ্ছে, জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়ার পর বহু মানুষের সম্পত্তি কয়েক শ গুণ বেড়ে গেছে! কী করে তা হলো, তা জানানোর দায় যেমন প্রার্থীর থাকে না, জানার আগ্রহও তেমন নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করে না। অথচ খুব সহজেই এখানেও রাশ টানা যায়। প্রার্থীদের সম্পত্তির ঘোষণা খতিয়ে দেখার জন্য একটি সেল নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা যেতে পারে, যারা দেখবে অর্জিত সম্পত্তির সঙ্গে ঘোষণা সংগতিপূর্ণ কি না। অসংগতি প্রার্থী-পদে বাধা সৃষ্টি করতেই পারে।
রাজনীতিকে স্বচ্ছ করতে এখনো অনেক পথ হাঁটা বাকি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টি এন সেশনের উদ্যোগের পর থেকে এত দিনে অবস্থার কিছুটা উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। আরও খানিকটা সুপ্রিম কোর্টের এই দুই রায়ে নিশ্চিতই হবে। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতির অসুখ সারাতে আরও অনেক দাওয়াই প্রয়োজন। রাজনীতিকেরা চঞ্চল হবেন। না হয়ে উপায়ও নেই। আম-আদমি কিন্তু চনমনে। নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের যুগলবন্দী রাজনীতির রং বদলে দিতে পারে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments