বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৭৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. আবু তাহের, বীর প্রতীক সাহসী যোদ্ধা বীর যোদ্ধা দুপুর থেকে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। মো. আবু তাহেররা আক্রমণ করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছাতকের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। তাঁরা মূল আক্রমণকারী দল (ব্রাভো)।
তাঁদের সঙ্গে আছে আরেকটি দল (আলফা)। আগের দিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে রাতে এসে তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির চারদিকের দেওয়ালসংলগ্ন টিলার উঁচু স্থানগুলোতে।
সুরমা নদীর তীরে ছাতক। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১১-১২ মাইল দূরে। তখনকার একমাত্র এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির অবস্থান নদীর পশ্চিম তীরে। ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখানে ঘাঁটি করে। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ইপিসিএএফ ও রাজাকার। সব মিলিয়ে তিন কোম্পানির অনেক জনবল, প্রায় এক ব্যাটালিয়ন শক্তি।
প্রথমে মুক্তিবাহিনীর আলফা দল ১৪ অক্টোবর দুপুরের আগেই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির এক-দেড় শ গজের মধ্যে পৌঁছে। তাঁদের রিকোয়েললেস রাইফেলের গোলায় পাকিস্তানিদের কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই এই দল ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
মো. আবু তাহেরদের দল ছিল একটু পেছনে। এ সময় তাঁরা এগিয়ে আলফা দলের কাছাকাছি অবস্থান নেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। পরদিন (১৫ অক্টোবর) পাকিস্তানি তিনটি হেলিকপ্টার তাঁদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। এতে তাঁরা বিচলিত বা মনোবল হারাননি। আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
১৫ অক্টোবর সারা দিন যুদ্ধ চলে। ১৬ অক্টোবর সকাল থেকেই আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আলফা দল সামনে থাকে। আবু তাহেরদের দল পেছন থেকে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। সন্ধ্যার মধ্যেই গোটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্তের বাইরে যেতে থাকে। কারণ সিলেট থেকে ছাতকে আক্রান্ত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সাহায্য (রিইনফোর্সমেন্ট) চলে আসে। তারা দোয়ারাবাজার বেড়িবাঁধ দিয়ে ছাতকে অগ্রসর হয়। নতুন এই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের পেছনের উঁচু টিলাগুলোতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়।
ফলে মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। নতুন এই পাকিস্তানি সেনাদের আগমন ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ পেছনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কাটঅফ পার্টি। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য আসা সাহায্য প্রতিহত করা। তিন দিন স্থায়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছাতকে প্রায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ছাতক থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়।
মো. আবু তাহের ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। শেরপুর জেলার নকশি বিওপির যুদ্ধ, বৃহত্তর সিলেট জেলার টেংরাটিলা, সালুটিকরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো আবু তাহেরকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৯২।
মো. আবু তাহের স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে হাবিলদার হিসেবেই ১৯৭৮ সালে অবসর নেন। ১৯৭৯ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার পিরকাসিমপুর গ্রামে। বাবার নাম আশরাফ আলী ভূঁইয়া, মা জোবেদা খাতুন, স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। তাঁদের পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: লুৎফর রহমান (মো. আবু তাহের বীর প্রতীকের ছেলে) ও মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান (সহযোদ্ধা) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
সুরমা নদীর তীরে ছাতক। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১১-১২ মাইল দূরে। তখনকার একমাত্র এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির অবস্থান নদীর পশ্চিম তীরে। ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখানে ঘাঁটি করে। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ইপিসিএএফ ও রাজাকার। সব মিলিয়ে তিন কোম্পানির অনেক জনবল, প্রায় এক ব্যাটালিয়ন শক্তি।
প্রথমে মুক্তিবাহিনীর আলফা দল ১৪ অক্টোবর দুপুরের আগেই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির এক-দেড় শ গজের মধ্যে পৌঁছে। তাঁদের রিকোয়েললেস রাইফেলের গোলায় পাকিস্তানিদের কয়েকটি বাংকার ধ্বংস হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই এই দল ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে।
মো. আবু তাহেরদের দল ছিল একটু পেছনে। এ সময় তাঁরা এগিয়ে আলফা দলের কাছাকাছি অবস্থান নেন। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। পরদিন (১৫ অক্টোবর) পাকিস্তানি তিনটি হেলিকপ্টার তাঁদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। এতে তাঁরা বিচলিত বা মনোবল হারাননি। আবু তাহের ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
১৫ অক্টোবর সারা দিন যুদ্ধ চলে। ১৬ অক্টোবর সকাল থেকেই আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আলফা দল সামনে থাকে। আবু তাহেরদের দল পেছন থেকে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। সন্ধ্যার মধ্যেই গোটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্তের বাইরে যেতে থাকে। কারণ সিলেট থেকে ছাতকে আক্রান্ত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সাহায্য (রিইনফোর্সমেন্ট) চলে আসে। তারা দোয়ারাবাজার বেড়িবাঁধ দিয়ে ছাতকে অগ্রসর হয়। নতুন এই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের পেছনের উঁচু টিলাগুলোতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়।
ফলে মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। নতুন এই পাকিস্তানি সেনাদের আগমন ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ পেছনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কাটঅফ পার্টি। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য আসা সাহায্য প্রতিহত করা। তিন দিন স্থায়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছাতকে প্রায় বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের ছাতক থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়।
মো. আবু তাহের ইপিআরে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হন। শেরপুর জেলার নকশি বিওপির যুদ্ধ, বৃহত্তর সিলেট জেলার টেংরাটিলা, সালুটিকরসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো আবু তাহেরকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৯২।
মো. আবু তাহের স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে হাবিলদার হিসেবেই ১৯৭৮ সালে অবসর নেন। ১৯৭৯ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার পিরকাসিমপুর গ্রামে। বাবার নাম আশরাফ আলী ভূঁইয়া, মা জোবেদা খাতুন, স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। তাঁদের পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: লুৎফর রহমান (মো. আবু তাহের বীর প্রতীকের ছেলে) ও মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান (সহযোদ্ধা) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments