'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' নামটি তামাশার বিষয় নয়
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা এক. বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠী, কিছু এনজিও ও কয়েকটি রাজনৈতিক দল সব সময় যে কথাটি বলে থাকে, তা হলো- 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে।'
সবাই জানেন, এ দেশের স্থানীয় সরকারগুলো স্বাধীন ও স্বশাসিত নয়; গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়; এগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় এজেন্ট হয়ে কাজ করে। এ ব্যবস্থা বহাল রেখে 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী' করা মানে এই এজেন্ট প্রথাকেই আরো শক্তিশালী করা। এই ধারায় কতিপয় এনজিও প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ হজম করার স্বার্থে সভা-সেমিনারও করে আসছে। এতে স্থানীয় সরকারের কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং এনজিওগুলোর নিজস্ব উন্নয়ন হয়েছে এবং কিছু সুবিধাভোগী স্থানীয় প্রতিনিধি তৈরি হয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকারের ওপর প্রকৃত আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে। এ ধরনের একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' নিয়ে সিডিএলজি দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পেইন করে আসছে। তাতে করে এই রূপরেখার ওপর ব্যাপক সচেতনতা ও এর পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এর দরুন জনমনে 'স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে হবে'- পদবাচ্যটির অসারত্ব ধরা পড়েছে।
দুই. আমাদের ধারণা, উপরিউক্ত বিষয়টি বুঝতে পেরে দাতা সংস্থায় কর্মরত কিছু বাঙালি কর্মকর্তার যোগসাজশে কিছু এনজিও সিডিএলজির আন্দোলনটি ক্ষতিগ্রস্ত করার হীনউদ্দেশ্যে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ' নামে প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। অথচ সিডিএলজি প্রস্তাবিত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'র কোনো উপাদান এদের এই তথাকথিত প্রকল্পে নেই। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ইউএসএআইডির সহায়তায় 'পপি' নামের একটি এনজিও শেরপুর জেলায় 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ' শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে জানা গেছে। গত ১৯ জুলাই শেরপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন, এসডিএলজি প্রকল্পের ডেপুটি চিফ অব পার্টি ড. জেরিন রহমান খানসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ জুলাই ২০১২)। এ ধরনের প্রকল্পে অতীতেও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি, এখনো যে হবে না তা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়। তবে ব্যক্তিবিশেষ ও কিছু এনজিওর লাভ হতেই পারে। প্রশ্ন হলো, তাতে দেশের কী লাভ, স্থানীয় সরকারের কী লাভ? তা ছাড়া 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' শব্দবন্ধটি তো কোনো তামাশার বিষয় নয়; এর একটা নির্দিষ্ট রূপ আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। তা নিয়ে জোরদার ক্যাম্পেইন চলছে, চলতে থাকবে। অপচেষ্টা, অপকৌশল অবশ্যই একদিন না একদিন তলিয়ে যাবে- এই বিশ্বাসও আমাদের রয়েছে।
তিন. বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় গড়ে ওঠেনি। এগুলো ব্রিটিশদের দয়ায় তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশরা তাদের শাসনকে নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে স্থানীয় পর্যায়ে এজেন্ট প্রথা চালু করে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল চলে গেলেও বাংলাদেশের শাসকরা একই উদ্দেশ্যে সেই এজেন্ট প্রথা বহাল রাখেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সামরিক সরকার ও অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেই তাদের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে বাক্যটি বারবার ব্যবহার করেছে, তা হলো- 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী' করতে হবে। এর সঙ্গে এনজিওগুলো দাতাদের টাকা হজম করার জন্য 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী' করার নামে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে মাঠে থেকেছে। কিন্তু দাতা সংস্থার টাকায় তাদের গৃহীত প্রকল্প দ্বারা এ দেশে স্বরাজ, স্ব-শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একটুও অগ্রসর হয়নি, বরং একদল চাটুকার ও সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ণবিষয়ক গবেষক আবু তালেব সর্বপ্রথম এ বিষয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত একটি জাতীয় সেমিনারে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' তুলে ধরেন; এতে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসকরণ, প্রকারভেদকরণ, নামকরণ, প্রতিটি ইউনিটের সরকার কাঠামো, দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, নগরায়ণ, নগরীয় কৃষি, ২০২০ ও ২০৫০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য রূপ কি হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা হাজির করেন। মূলত সেই থেকে বাংলাদেশে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' শব্দবন্ধটি ও তা বাস্তবায়নের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষকদের সমন্বয়ে 'সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্ন্যান্স (সিডিএলজি)' গঠন করা হয়। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'কেন্দ্রিক আন্দোলনটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে আসছে; তাতে প্রবল জনমত সৃষ্টি হচ্ছে; জনমতের চাপে একদিন না একদিন এই রূপরেখাটি বাস্তবায়িত যে হবে, সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
চার. অনেকের মতে, এ দেশে ব্রিটিশ সরকার বিপুল রাজস্ব আদায় ও ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় প্রশাসন সৃষ্টি করে। স্বাধীন দেশে স্থানীয় সরকার থাকতে পারে, প্রয়োজনের নিরিখে উন্নয়ন ও জনসেবার স্বার্থে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি স্তরবিশিষ্ট এজেন্টধর্মী স্থানীয় সরকার থাকায় জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা উন্নয়ন কস্টের পেছনে নয়, মূলত সিস্টেম কস্টের পেছনে ব্যয় হয়ে থাকে। এখানে কাজের জন্য চাকরি নয়, অন্য সব উদ্দেশ্যে চাকরি দেওয়া হয়। দেখা গেছে, নগরীয় কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে এক স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় ইউনিট (পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) রয়েছে বলে মনে হয়। গ্রামীণ কাজগুলো করার জন্য বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় ইউনিট (ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগ) রয়েছে। আবার গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো করার জন্য একাধিক স্তর (উপজেলা, জেলা ও বিভাগ) রয়েছে। সে জন্য গ্রামীণ কাজ, নগরীয় কাজ ও গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য, স্থানীয় সরকারের যথাযথ প্রকারভেদ করার জন্য, গ্রাম ও নগরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য, স্তরে স্তরে প্রয়োজন মাফিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস গ্রহণ করা জরুরি। আমরা দেখতে পাই, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে উপজেলা ও জেলার তেমন কোনো কাজ নেই। অথচ উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা ও জেলার আয়তনের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনগুলোকে রেখে দেওয়া হয়েছে। পৌরবাসীর ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে। সে জন্য গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একটি মাত্র স্তর থাকতে পারে, তা হলো- বিভাগ অথবা জেলা। সিডিএলজি দুটি বিকল্প স্তরবিন্যাসকরণের প্রস্তাব নিয়ে ক্যাম্পেইন করে আসছে। ১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী বিভাগ যদি স্থানীয় ইউনিটগুলোর সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট হয়, তাহলে উপজেলা ও জেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগর (পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও সিটি করপোরেশন) থাকবে না। তখন একদিকে নগরীয় ইউনিটের সর্বনিম্ন ইউনিট হবে নগরগুলো এবং অপরদিকে গ্রামীণ ইউনিটের সর্বনিম্ন ইউনিট হবে ইউনিয়ন। এই স্তরবিন্যাসে উপজেলা ও জেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী ইউনিট হবে। আর ২ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী বিভাগ যদি অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য স্তর হয়, তাহলে সেটিকে বাদ দিয়ে তার স্থানে জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট নির্ধারণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ জেলার আয়তনের মধ্যে নগরীয় ও গ্রামীণ ইউনিটগুলো থাকবে। তবে উপজেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগর থাকবে না। তখনো উপজেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে তার প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতে থাকবে কি না মূল্যায়ন করে দেখতে হবে।
পাঁচ. এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু চায় না। এটি বিভিন্ন ঘটনা-পরিক্রমায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, একুশ শতক হবে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ণের শতাব্দী। তবে এটি শুধু প্রচারের বিষয় নয়, বাস্তবায়নের বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও সংস্কৃতি অনুযায়ী একেক দেশের গণতন্ত্রায়ণের ডিজাইন একেক রকম হয়, হতে পারে। বাংলাদেশের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুযায়ী দুই ধরনের সরকার (কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়) ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য বলে সিডিএলজি মনে করে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো করবে। আর অবশিষ্ট কাজগুলো স্থানীয় সরকারগুলো সম্পন্ন করবে। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশকে গ্রামকেন্দ্রিক দেশ বলা হতো। এখন সে অবস্থা আর নেই। বর্তমানে গ্রামের পাশাপাশি নগরে প্রায় পাঁচ কোটি লোক বসবাস করছে। ২০২০ সাল নাগাদ অর্ধেক ও ২০৫০ সাল নাগাদ গোটা জনগোষ্ঠী নগরীয় এলাকায় বসবাস করবে। তাই বর্তমানের বাংলাদেশ হচ্ছে গ্রামীণ-নগরীয় বাংলাদেশ, আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ মানে পরিপূর্ণ নগরীয় বাংলাদেশ।
ছয়. গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানে নগরে রূপান্তরিত হওয়া। সে জন্য গ্রামকে অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল প্রতিষ্ঠান ধরে সিডিএলজি 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'য় স্থানীয় সরকারের দুটি বিকল্প স্তরবিন্যাসের প্রস্তাব করেছে। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই এবং সেই গণতন্ত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই, তাহলে স্থানীয় পর্যায় থেকে প্রতিটি ইউনিটে যথাযথ 'সরকার কাঠামো' স্থাপন করে (যেমন ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন সরকার' ও নগরে 'নগর সরকার' ইত্যাদি), সেগুলো পরিচালনার ভার স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে। নগর সংসদ, নগর প্রশাসন ও নগর আদালত মিলে 'নগর সরকার' গঠিত হবে। সেই সঙ্গে নগর ন্যায়পাল ও নগর নির্বাচনী বোর্ড থাকবে। বাংলাদেশ যদি উপরিউক্ত প্রস্তাবটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এটি হবে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের মডেল কান্ট্রি। আর যদি কোনো এনজিও ও গবেষক উপরিউক্ত প্রস্তাব মতে, স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করে, তাহলে তাদেরও গণতন্ত্রের পতাকাবাহী হিসেবে অভিহিত করা যাবে। সে জন্য বলব, 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' নামটি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করাই সততার পরিচায়ক।
লেখকবৃন্দ : নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
দুই. আমাদের ধারণা, উপরিউক্ত বিষয়টি বুঝতে পেরে দাতা সংস্থায় কর্মরত কিছু বাঙালি কর্মকর্তার যোগসাজশে কিছু এনজিও সিডিএলজির আন্দোলনটি ক্ষতিগ্রস্ত করার হীনউদ্দেশ্যে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ' নামে প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। অথচ সিডিএলজি প্রস্তাবিত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'র কোনো উপাদান এদের এই তথাকথিত প্রকল্পে নেই। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ইউএসএআইডির সহায়তায় 'পপি' নামের একটি এনজিও শেরপুর জেলায় 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ' শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে জানা গেছে। গত ১৯ জুলাই শেরপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন, এসডিএলজি প্রকল্পের ডেপুটি চিফ অব পার্টি ড. জেরিন রহমান খানসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ জুলাই ২০১২)। এ ধরনের প্রকল্পে অতীতেও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি, এখনো যে হবে না তা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়। তবে ব্যক্তিবিশেষ ও কিছু এনজিওর লাভ হতেই পারে। প্রশ্ন হলো, তাতে দেশের কী লাভ, স্থানীয় সরকারের কী লাভ? তা ছাড়া 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' শব্দবন্ধটি তো কোনো তামাশার বিষয় নয়; এর একটা নির্দিষ্ট রূপ আছে, বৈশিষ্ট্য আছে। তা নিয়ে জোরদার ক্যাম্পেইন চলছে, চলতে থাকবে। অপচেষ্টা, অপকৌশল অবশ্যই একদিন না একদিন তলিয়ে যাবে- এই বিশ্বাসও আমাদের রয়েছে।
তিন. বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় গড়ে ওঠেনি। এগুলো ব্রিটিশদের দয়ায় তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশরা তাদের শাসনকে নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে স্থানীয় পর্যায়ে এজেন্ট প্রথা চালু করে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল চলে গেলেও বাংলাদেশের শাসকরা একই উদ্দেশ্যে সেই এজেন্ট প্রথা বহাল রাখেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সামরিক সরকার ও অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেই তাদের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে বাক্যটি বারবার ব্যবহার করেছে, তা হলো- 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী' করতে হবে। এর সঙ্গে এনজিওগুলো দাতাদের টাকা হজম করার জন্য 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী' করার নামে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে মাঠে থেকেছে। কিন্তু দাতা সংস্থার টাকায় তাদের গৃহীত প্রকল্প দ্বারা এ দেশে স্বরাজ, স্ব-শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একটুও অগ্রসর হয়নি, বরং একদল চাটুকার ও সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ণবিষয়ক গবেষক আবু তালেব সর্বপ্রথম এ বিষয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত একটি জাতীয় সেমিনারে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' তুলে ধরেন; এতে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসকরণ, প্রকারভেদকরণ, নামকরণ, প্রতিটি ইউনিটের সরকার কাঠামো, দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, নগরায়ণ, নগরীয় কৃষি, ২০২০ ও ২০৫০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য রূপ কি হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা হাজির করেন। মূলত সেই থেকে বাংলাদেশে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' শব্দবন্ধটি ও তা বাস্তবায়নের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিক্ষকদের সমন্বয়ে 'সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্ন্যান্স (সিডিএলজি)' গঠন করা হয়। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'কেন্দ্রিক আন্দোলনটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে আসছে; তাতে প্রবল জনমত সৃষ্টি হচ্ছে; জনমতের চাপে একদিন না একদিন এই রূপরেখাটি বাস্তবায়িত যে হবে, সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
চার. অনেকের মতে, এ দেশে ব্রিটিশ সরকার বিপুল রাজস্ব আদায় ও ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় প্রশাসন সৃষ্টি করে। স্বাধীন দেশে স্থানীয় সরকার থাকতে পারে, প্রয়োজনের নিরিখে উন্নয়ন ও জনসেবার স্বার্থে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি স্তরবিশিষ্ট এজেন্টধর্মী স্থানীয় সরকার থাকায় জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা উন্নয়ন কস্টের পেছনে নয়, মূলত সিস্টেম কস্টের পেছনে ব্যয় হয়ে থাকে। এখানে কাজের জন্য চাকরি নয়, অন্য সব উদ্দেশ্যে চাকরি দেওয়া হয়। দেখা গেছে, নগরীয় কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে এক স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় ইউনিট (পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) রয়েছে বলে মনে হয়। গ্রামীণ কাজগুলো করার জন্য বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় ইউনিট (ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগ) রয়েছে। আবার গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো করার জন্য একাধিক স্তর (উপজেলা, জেলা ও বিভাগ) রয়েছে। সে জন্য গ্রামীণ কাজ, নগরীয় কাজ ও গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য, স্থানীয় সরকারের যথাযথ প্রকারভেদ করার জন্য, গ্রাম ও নগরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য, স্তরে স্তরে প্রয়োজন মাফিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস গ্রহণ করা জরুরি। আমরা দেখতে পাই, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে উপজেলা ও জেলার তেমন কোনো কাজ নেই। অথচ উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা ও জেলার আয়তনের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনগুলোকে রেখে দেওয়া হয়েছে। পৌরবাসীর ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচনের বিধান করা হয়েছে। সে জন্য গ্রামীণ-নগরীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একটি মাত্র স্তর থাকতে পারে, তা হলো- বিভাগ অথবা জেলা। সিডিএলজি দুটি বিকল্প স্তরবিন্যাসকরণের প্রস্তাব নিয়ে ক্যাম্পেইন করে আসছে। ১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী বিভাগ যদি স্থানীয় ইউনিটগুলোর সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট হয়, তাহলে উপজেলা ও জেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগর (পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও সিটি করপোরেশন) থাকবে না। তখন একদিকে নগরীয় ইউনিটের সর্বনিম্ন ইউনিট হবে নগরগুলো এবং অপরদিকে গ্রামীণ ইউনিটের সর্বনিম্ন ইউনিট হবে ইউনিয়ন। এই স্তরবিন্যাসে উপজেলা ও জেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী ইউনিট হবে। আর ২ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী বিভাগ যদি অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য স্তর হয়, তাহলে সেটিকে বাদ দিয়ে তার স্থানে জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট নির্ধারণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ জেলার আয়তনের মধ্যে নগরীয় ও গ্রামীণ ইউনিটগুলো থাকবে। তবে উপজেলার আয়তনের মধ্যে কোনো নগর থাকবে না। তখনো উপজেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে তার প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতে থাকবে কি না মূল্যায়ন করে দেখতে হবে।
পাঁচ. এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু চায় না। এটি বিভিন্ন ঘটনা-পরিক্রমায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, একুশ শতক হবে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ণের শতাব্দী। তবে এটি শুধু প্রচারের বিষয় নয়, বাস্তবায়নের বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও সংস্কৃতি অনুযায়ী একেক দেশের গণতন্ত্রায়ণের ডিজাইন একেক রকম হয়, হতে পারে। বাংলাদেশের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুযায়ী দুই ধরনের সরকার (কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়) ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য বলে সিডিএলজি মনে করে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো করবে। আর অবশিষ্ট কাজগুলো স্থানীয় সরকারগুলো সম্পন্ন করবে। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশকে গ্রামকেন্দ্রিক দেশ বলা হতো। এখন সে অবস্থা আর নেই। বর্তমানে গ্রামের পাশাপাশি নগরে প্রায় পাঁচ কোটি লোক বসবাস করছে। ২০২০ সাল নাগাদ অর্ধেক ও ২০৫০ সাল নাগাদ গোটা জনগোষ্ঠী নগরীয় এলাকায় বসবাস করবে। তাই বর্তমানের বাংলাদেশ হচ্ছে গ্রামীণ-নগরীয় বাংলাদেশ, আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ মানে পরিপূর্ণ নগরীয় বাংলাদেশ।
ছয়. গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানে নগরে রূপান্তরিত হওয়া। সে জন্য গ্রামকে অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল প্রতিষ্ঠান ধরে সিডিএলজি 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'য় স্থানীয় সরকারের দুটি বিকল্প স্তরবিন্যাসের প্রস্তাব করেছে। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই এবং সেই গণতন্ত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই, তাহলে স্থানীয় পর্যায় থেকে প্রতিটি ইউনিটে যথাযথ 'সরকার কাঠামো' স্থাপন করে (যেমন ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন সরকার' ও নগরে 'নগর সরকার' ইত্যাদি), সেগুলো পরিচালনার ভার স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে। নগর সংসদ, নগর প্রশাসন ও নগর আদালত মিলে 'নগর সরকার' গঠিত হবে। সেই সঙ্গে নগর ন্যায়পাল ও নগর নির্বাচনী বোর্ড থাকবে। বাংলাদেশ যদি উপরিউক্ত প্রস্তাবটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, তাহলে এটি হবে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের মডেল কান্ট্রি। আর যদি কোনো এনজিও ও গবেষক উপরিউক্ত প্রস্তাব মতে, স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করে, তাহলে তাদেরও গণতন্ত্রের পতাকাবাহী হিসেবে অভিহিত করা যাবে। সে জন্য বলব, 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' নামটি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করাই সততার পরিচায়ক।
লেখকবৃন্দ : নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
No comments