শান্তিদূতের পদ থেকে ইস্তফার ঘোষণা আনানের-* সিরিয়ায় সংঘাত বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বিরোধের কারণেই এ সিদ্ধান্ত -* পদত্যাগ কার্যকর হবে ৩১ আগস্ট থেকে

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে সিরিয়াবিষয়ক শান্তিদূতের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কফি আনান। গত বৃহস্পতিবার রাতে আনান তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এপ্রিলে তিনি যে ছয় দফা শান্তি প্রস্তাব দেন, বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো পক্ষ থেকে কখনই তা যথাযথ সমর্থন পায়নি এবং সিরিয়ার সংঘাত আরো রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।


গত ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত নিযুক্ত হন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। ২০১১ সালের মার্চে শুরু হওয়া সংঘাত নিরসনে সিরিয়ার বিবদমান দলগুলোর প্রতি ছয় দফা শান্তি প্রস্তাব দেন তিনি। গত ১২ এপ্রিল থেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ছিল তাতে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পরিবর্তে সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পায়। সিরিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর আলেপ্পোতে সরকারি বাহিনী নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও দেশটিতে প্রায় ১৭০ জন মারা গেছে। ১৭ মাসের সহিংসতায় সিরিয়ায় ২০ হাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে। সিরিয়ায় চলমান সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনবার প্রস্তাব তোলা হলেও রাশিয়া ও চীনের ভেটোর কারণে ভেস্তে যায়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সিরিয়াবিষয়ক একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার আগের দিন আচমকা আনান নিজের পদত্যাগের খবর জানালেন। গতকাল শুক্রবার উত্থাপিত হওয়ার কথা ছিল প্রস্তাবটি। প্রথমে আরব দেশগুলো প্রেসিডেন্ট আসাদের পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলেছিল এই প্রস্তাবে। কিন্তু পরে আরব ও লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সমালোচনার মুখে তারা আসাদের পদত্যাগের দাবি সরিয়ে নেয়। প্রস্তাবে সিরিয়ার সংঘাত বন্ধের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সমালোচনাও করা হয়েছে।
আগামী ৩১ আগস্ট শান্তিদূত হিসেবে আনানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর মেয়াদ নবায়ন না করার কথা জানিয়েছেন তিনি। জেনেভায় তড়িঘড়ি করে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'সিরিয়া ইস্যু নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা অনবরত পরস্পরের দিকে আঙ্গুল তাক করে যাচ্ছেন এবং গালিগালাজ করছেন। রক্তপাত বন্ধে তাঁরা কখনই সম্মিলিত চেষ্টা চালাননি। যতটুকু প্রয়োজন ছিল ততটুকু সমর্থন আমি কখনোই পাইনি। আপনাদের বুঝতে হবে যে একজন দূত হিসেবে আমি শান্তির চেয়ে সংঘাতের মূল নায়কদের, নিরাপত্তা পরিষদ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বেশি গুরুত্ব দিতে পারি না। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমশ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা পরিষদে ঐকমত্যের অভাবের কারণে আমি সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' তবে আজ হোক বা কাল, প্রেসিডেন্ট আসাদকে সরে যেতে হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় লেখা এক মন্তব্য প্রতিবেদনে আনান যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতি সিরিয়াকে মারাত্মক গৃহযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব সিরিয়াবিষয়ক নতুন দূত নিয়োগের ব্যাপারে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন আনান।
আনানের পদত্যাগের ঘোষণা আসার পর নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পসরা শুরু হয়েছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কারনি বলেন, 'আনানের পদত্যাগের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতাই প্রতীয়মান হয়েছে। আসাদের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের কারণেই এটা ঘটেছে।' জার্মানিও আনানের পদত্যাগের বিষয়ে রাশিয়া ও চীনকে দায়ী করেছে।
তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আনানের পদত্যাগের বিষয়টিকে 'চরম লজ্জাকর' কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 'কফি আনান অত্যন্ত মেধাবী মানুষ, অত্যন্ত দক্ষ কূটনৈতিক এবং খুবই সৎ মানুষ। তাই তাঁর পদত্যাগের ঘটনাও চরম লজ্জার।' রাশিয়া জোরালোভাবে আনানকে সমর্থন করেছে বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত ভিতালি চুরকিন। এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হং লেই বলেন, 'আনানের পদত্যাগের খবরে চীন দুঃখ প্রকাশ করছে। তাঁর মধ্যস্থতামূলক কাজের জটিলতা আমরা বুঝতে পারছি এবং তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।' এদিকে আগামী ১৯ আগস্ট মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ায় পর্যবেক্ষণ মিশনের সময় আর না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। পর্যবেক্ষকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
ইরান অভিযোগ করেছে, 'হস্তক্ষেপকারী দেশগুলোর' কারণেই কফি আনানের শান্তি মিশন ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রামিন মেহমানপারাস্ত বলেন, 'হস্তক্ষেপকারী দেশগুলো সিরিয়ায় অস্ত্রের চালান বন্ধে কফি আনানের চেষ্টায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। তারা আনানের ছয় দফা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত হওয়ার পথেই কেবল বাধা তৈরি করেনি, বরং তাঁর মিশনকেই ব্যর্থ করে দিয়েছে।' ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি সৌদি আরব, কাতার, তুরস্কের বিরুদ্ধে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাহায্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। সূত্র : এএফপি।

No comments

Powered by Blogger.