৫শ বছরের পুরনো বাবা আদম মসজিদ

৫শ বছরের ইতিহাসখ্যাত বাবা আদম মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে ৪ কিলোমিটার দূরে এ মসজিদটির অবস্থান। বাবা আদম মসজিদের অবস্থান মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার দরগাবাড়ি গ্রামে। বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে এ মসজিদটি জৌলসহীন হয়ে পড়েছে।


জেলা শহরের এ প্রাচীন স্থাপনাটি এক নজর দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এখানে ছুটে আসে। অনেকে আবার বিভিন্ন মানত নিয়ে আসে। এ মসজিদে প্রবেশের রাস্তার পাশে রয়েছে ইসলাম প্রচারক বাবা আদমের কবর। কবরটি এখন মাজারে পরিণত হয়েছে। এ মাজারকে কেন্দ্র করেই এ মহল্লার নামকরণ করা হয় দরগাবাড়ি। বর্তমানে মাজারটির সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, বাবা আদমের এই মসজিদটি আমাদের দেশের প্রথম মসজিদ। হিজরি ৮৮৮ অনুযায়ী ১৪৮৩ সালে মসজিদটি তৈরি করা হয়। ৬ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। ভবনটির দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট, প্রস্থ ৩৬ ফুট। দেয়ালগুলো প্রায় ৪ ফুট চওড়া। ভিতের ওপরের অংশ গাঁথা হয়েছে সুরকি ও পাতলা ইট দিয়ে। স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী ইমারতটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। সামনে খিলান আকৃতির একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। আর এর দু’পাশে রয়েছে সমান আকারের দু’টি জানালা। এছাড়া এ মসজিদে আর কোন দরজা-জানালা নেই। প্রবেশপথের ওপরে ফরাসী অক্ষর খোদাই করে কালো পাথরের ফলক লাগানো হয়েছে। মূল দেয়াল থেকে সামনের দিকে খানিকটা করে এগিয়ে এসে চার কোনায় ৪টি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো ষড়ভুজবিশিষ্ট। খিলান দরজা স্তম্ভের পাদদেশে, মাঝে এবং পুরো ইমারতের ছাদের কার্নিশের তলা দিয়ে পাতলা ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার ঐতিহ্যবাহী নক্সা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া প্রবেশপথের দু’পাশে সামনের দেয়ালে ইটের ফলকের সুদৃশ্য কারু কাজ করা। এরকম কারুকাজ রয়েছে উত্তর-দক্ষিণ দিকের দেয়ালেও।
শুধু সামনের দিকে দরজা জানালা ছাড়া দু’পাশে জানালা না থাকায় মসজিদটির ভিতরের পরিবেশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনেও বেশ আবছাময়। সামনের দরজা-জানালাগুলোতে চওড়া কাঠের ফ্রেমের পাল্লা লাগানো। সব মিলিয়ে সুরক্ষিত দুর্গের মতো মনে হয় স্থাপনাটিকে। তার কারণ সম্ভবত এই যে, ইবাদতে মগ্ন থাকার সময় মুসল্লিরা যাতে কারও হামলা বা আক্রমণের কবলে না পড়েন সে জন্যই এমন সুরম্য দুর্গের মতো করে নির্মাণ করা হয় ইমারতটি।
বাবা আদম যাঁর নামানুসারে এই মসজিদটি তিনি সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৫৬৯ হিজরি অনুযায়ী ১১৭৩ সালে তৎকালীন বিক্রমপুর পরগনার রামপালে এসেছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। রামপালের দরগাবাড়ি এলাকায় তিনি অবস্থান করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তখন এ জনপদে সেন রাজাদের রাজত্বকাল চলছিল। বিক্রমপুরের মহাপরাক্রমশালী রাজা বল্লাল সেনের নেতৃত্বে হিন্দু সমাজে ইসলাম ধর্ম প্রচারকে কেন্দ্র করে সুসংহত বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের যুদ্ধ বাধে। ওই ধর্মযুদ্ধে বাবা আদম শহীদ হন। এ যুদ্ধের বিষয়ে এলাকার লোকমুখে এখনও অনেক কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। একটি কাহিনী এরকমÑবল্লাল সেন যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার পোষা কবুতর সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়েছিলেন এবং বাড়ির স্ত্রী-কন্যাদের বলে আসেন, যদি কবুতর ফেরত চলে আসে তাহলে বুঝতে হবে যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটেছে এবং মহিলারা সবাই যেন তখন আগুনে আত্মাহুতি দেয়। কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম। যুদ্ধে রাজার জয় হলো। ফিরতি পথে একটি পুকুরে রাজা যখন শরীরে লেগে থাকা রক্ত, ধুলা, ময়লা ধুয়ে নিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে কবুতরটি উড়ে যায় রাজ প্রাসাদের দিকে। রাজা সমূহ সর্বনাশ ঠেকাতে উর্ধশ্বাসে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি তাঁর পরিবারকে। তাঁর পৌঁছানোর আগেই কবুতরটি চলে আসায় অন্তঃপুরবাসিনী সবাই যুদ্ধে রাজার পরাজয় হয়েছে ভেবে আত্মাহুতি দেন। তবে এটি নিছকই জনশ্রুতি। বাবা আদমের শহীদের ৩১৯ বছর পর ১৪৮৩ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়। সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের শাসনামলে মালিক কাফুর মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের ভেতরের মেহেরাবটির দু’পাশে আরও দুু’টি দেয়ালে খোদাই করা র‌্যাকের মতো রয়েছে। ইট বিছানো মেঝে। মোট ছ’টি কাতারের ব্যবস্থা। মাঝখানে কালো পাথরের বিশাল আকৃতির দু’টি স্তম্ভ উঠে গেছে ছাদ পর্যন্ত। মূলত এই পাথরের স্তম্ভ দু’টিই ছাদের গম্বুজগুলোর অধিকাংশ ভার বহন করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। মসজিদে এখনও নিয়মিত নামাজের জামায়াত হয়ে থাকে। ভিতরে স্থানের স্বল্পতার কারণে সামনের প্রাঙ্গণে কংক্রিট ঢালাই করে আরও সাতটি কাতারের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান করা হয়েছে এবং প্রাঙ্গণসহ মসজিদ ভবনটি নিচু লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। প্রতœতত্ত্ব বিভাগ পুরাকীর্তি হিসেবে বাবা আদমের মসজিদটিকে অধিভুক্ত করেছে, তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এর আর কোন সংস্কার কাজ হয়নি। সংস্কারের অভাবে প্রাচীন এই মসজিদটি রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। মসজিদে ঢোকার রাস্তাটিও সরু। মূল রাস্তাটি আরও প্রশস্তসহ পর্যটকদের যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বল্লাল সেনের বাড়ির কাছকাছি এই মসজিদটি নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল। তাই ক্রমশ পর্যটক বাড়ছে। তবে সঠিক ইতিহাস জানার জন্য নেই কোন সুযোগ। মিরাকাদিম পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন জানান, মসজিদটি আমাদের গর্ব। আমরা চাই প্রতœতত্ত্ব বিভাগ এটি রক্ষায় খুব দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ আজিজুল আলম বলেন, বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে এমন বহু পুরাকীর্তি রয়েছে, যা নতুন প্রজন্মকে জানাতে স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষা সফরে বিক্রমপুর ঘুরে দেখতে পারে। এতে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে। জ্ঞানের পরিধিবি বাড়বে। ইতোমধ্যে শহরের ড. ইয়াজউদ্দিন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ‘বিক্রমপুর ঘুরে দেখা’র অংশ হিসেবে প্রাচীন এই মসজিদে ঘুরে দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছে। তিনি মনে করেন প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি যথাযথ সংস্কারের পাশাপাশি এর সঠিক ইতিহাস নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ করলে পর্যটক আরও বৃদ্ধি পাবে।
Ñমীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সিগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.