আধুনিক রাষ্ট্রে দায়মুক্তি কেউ পেতে পারে না by মুনতাসীর মামুন

সেই চিৎকারের কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না। এক দশক আগের কথা। খালেদা জিয়া-নিজামীর সরকার তখন আমাদের অনেককে জেলে ঢুকিয়েছে। রাত নামছে। জেলের গরাদে একা। বাইরে রক্ষী বা সুবিধাভোগী কোন কয়েদী বিবিসি শুনছে। ভাষ্যকার তখন বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করছেন।


দেশে তখন ক্লিনহার্ট অপারেশন চলছে। প্রতিদিন সেনাবাহিনী লোক হাপিস করে দিচ্ছে আর বলছে হৃদরোগে মারা গেছে। এই রকম হারিয়ে যাওয়া এক ব্যবসায়ীর তরুণী স্ত্রীর সাক্ষাতকার নেয়া হচ্ছে। তার আর্তচিৎকারÑআমার স্বামী ব্যবসায়ী, কোন কিছুতেই নেই। তরতাজা মানুষটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এখন বলছে হার্টএ্যাটাকে মারা গেছে। তখন মনে হচ্ছিল যে অফিসারটি এ কাজটি করেছে তার প্রতি এ ব্যবহার করলে তার স্ত্রী কী করতেন? ক্লিনহার্ট অপারেশনের সময় বাইরে ছিলাম। লেখালেখি করেছি তখন এর বিরুদ্ধে। তারপর তো জেলে। জেল থেকে বেরিয়ে তারপরও ভেবেছি দেশ পাকিস্তানীমনা বাঙালীরা শাসন করছে দেখে আজ এই ভোগান্তি।
এক দশক আগের কথা। নিশ্চয় অনেকের মনে নেই ক্লিনহার্ট অপারেশনের কথা। এর নায়কের কথা মনে নেই নিশ্চয়। তিনি ছিলেন সেই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী। নিষ্ঠুরতায় তার জুড়ি মেলাভার। এই খুনের পুরস্কার স্বরূপ পরবর্তী সেনাপ্রধান সামরিক তত্ত্বাবধায়ক আমলে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান করা হয়। তখন আবার দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি আওয়ামী ও বিএনপি [তাদের অনেকেই দুর্নীতিবাজ তা মিথ্যা নয়] রাজনীতিবিদদের মধ্যেই শুধু দুর্নীতিবাজ খুঁজে পেয়েছিলেন। জামায়াত আর সেনাবাহিনীর মধ্যে নয়। যা হোক, পত্রিকার এক সংবাদ দেখে তাগিদ অনুভব করলাম এ লেখাটি লেখার জন্য।
গত ১০ বছর অপেক্ষা করছিলাম এ সংবাদটির জন্য। ইদানীং, যখনই মৃদু হেসে মওদুদ সংবিধানের কথা বলতেন তখনই মনে পড়ত সংবিধানে সেই দায়মুক্তির ধারাটির কথা। মনে হতো, কীভাবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বা যারা মানবাধিকারের কথা বলেন, তারা এই কুৎসিত আইনটির বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেননি। আমি ২০০৩ সালের দায়মুক্তি আইনের কথা বলছি। সম্প্রতি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও শাহদীন মালিক একটি রিট করেছেন এর অবসান চেয়ে। হাইকোর্ট ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যৌথবাহিনী পরিচালিত অপারেশন ক্লিনহার্টে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে প্রণীত আইন কেন অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে।’ [ভোরের কাগজ, ৩০.৭.১২] শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে ঐ অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে একশ’ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ চেয়েও আবেদন করেছেন। অভিনন্দন দুই আইনজীবীকে।
যাদের বয়স এখন ২০-এর উর্ধে তারা অনেকেই বিষয়টি জানেন না। আমাদের বয়সী অনেকেও তা ভুলে গেছেন। সেই সময় আমি/আমরা এ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। কাজ হয়নি জেলখাটা ছাড়া। সে সব লেখা থেকে খানিকটা পুনরাবৃত্তি করছি পটভূমিটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।
জোট আমলে সন্ত্রাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পুলিশ অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিদের সহযোগী চখা মিয়ার পুত্র মির্জা ফখরুল ওরফে গর্জন সিং-কে কোন সাংবাদিকের মুরোদ হলো না জিজ্ঞেস করতে, আপনি যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন কেন ক্লিনহার্ট অপারেশন করেছিলেন? যাক, সন্ত্রাস এমন ভয়াবহ পর্যায়ে যে অনেকে হিজরতের কথা ভাবছিল। তখন খালেদা সেনাবাহিনী নামালেন সন্ত্রাস দমনে এবং তারা গড়ে প্রতিদিন একজন করে হত্যা করেছিল গ্রেফতার করে।
তখন আমাদের এক কবি বন্ধু বলছিলেন, আফ্রো-আমেরিকানরা প্রায় ক্ষেত্রে ‘জি’ শব্দটি ব্যবহার করে না। যেমন, কিলিংকে বলে কিলিন। আমাদের গ্রামের মানুষজনের অবস্থাও যে এ রকম। অপারেশন ক্লিনহার্টকে তারা বলে কিলিন হার্ট। আক্ষরিক অর্থে অবশ্য তা তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, এটি হচ্ছে অপারেশন ডার্টি হার্ট। যদি ক্লিনহার্ট নিয়ে অপারেশন ক্লিনহার্ট চালানো হতো, তাহলে এসব কথা উঠত না।
সিভিল সমাজ থেকে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছিল। মিডিয়াতেও তা প্রতিফলিত হয়েছিল। বিষয়গুলো হলো বা যে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হচ্ছিল তা হলোÑ
প্রথমত, আইনীভাবে সেনাবাহিনী নামানো হয়নি। সুতরাং তারা বেআইনী কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, একটি যৌথ অভিযান বলে সরকার যা প্রচার করছে, তা সত্য নয়। সেনা অভিযানে কখনও পুলিশ-আনসারকে দেখা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, সন্ত্রাসী ধরলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু তালিকাবহির্ভূতদের ধরা হচ্ছে কেন? চতুর্থত, বৈধ অস্ত্রকে অবৈধ অস্ত্র বলে উল্লেখ করা হচ্ছে কেন? এটি কি অভিযানের সাফল্য দেখানোর জন্য? পঞ্চমত, মানুষের ওপর অত্যাচার, অভদ্র আচরণ তো কোন সুশৃঙ্খল সভ্য বাহিনী করে না। ষষ্ঠত, বাংলাদেশে কি বিএনপি-আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দল নেই? গ্রেফতার করা হচ্ছে এ দলের কর্মী ও সন্ত্রাসীদের। কিন্তু দেশের শ্রেষ্ঠ টেরোরিস্ট গ্রুপ জামায়াতে ইসলামী বাদ। সপ্তমত, ফলে ধারণা তৈরি হতে পারে, নির্বাচনের সময় যে পার্টনারশিপ পড়ে উঠেছিল, তা থেকে একটি দল বাদ যাচ্ছে অর্থাৎ এ অভিযান মোটেই নিরপেক্ষ নয়। অষ্টমত, সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সেনা হেফাজতে গড়ে একজন মারা গেছে প্রতিদিন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনা দফতর থেকেও তা-ই বলা হচ্ছিল। রাশেদ খান মেনন অবশ্য বলেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের হার্ট এত দুর্বল নয় যে, সেনা দেখলেই ফেল করবে। কিন্তু করেছে। গিনেস বুকে এটি স্থান পেতে পারে রেকর্ড হিসেবে। তবে আমি মনে করি চিলির সেনাবাহিনী থেকে আমাদের সেনাবাহিনী মন্দ নয়। চিলির সেনাবাহিনী লোক তুলে নিতো আর ফেরত দিত না। আমাদের বাহিনী লোক তুলে নিলেও ফেরত দেয় জীবিত বা মৃত।
সেনাবাহিনী নিয়ে রাজনীতি দু’ভাগ হয়ে গেছে। সরকারী দল ও এর সহযোগীরা তা সমর্থন করেছে। বিরোধী দল মৃদুকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছে। জোরালোভাবে তা করতে না পারার কারণ, প্রতিটি দল বা রাজনীতিবিদরা সেনাদের তোয়াজ করেছেন কোন না কোনভাবে। সব সময়ের মতো সোচ্চার ছিল বুদ্ধিজীবী, সংবাদপত্র ও দু’একটি মানবাধিকার সংস্থা, যার মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থা এখন যে তখনও ছিল সরকারী মানবাধিকার সংস্থা মাত্র।
সরকারী দল ও সেনা কর্মকর্তারা স্বাভাবিকভাবেই তা পছন্দ করেনি। আমার এক কনিষ্ঠ সহকর্মী চট্টগ্রামে জানালেন, তাদের পরিচিত এক মেজর বলেছিলেন, ঢাকায় থাকলে তারা আমাদের দেখে নিত। এসব হুঙ্কার আমরা চার দশক ধরে শুনছি। তারা যদি জানতো সিভিল সমাজ তাদের কী চোখে দেখে, তাহলে এ ধরনের মন্তব্য করার আগে দু’বার ভাবত। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্যে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
সাবেক জেনারেল ও বিএনপির নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ বুদ্ধিজীবী সমাজকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করবেন না। সেনাবাহিনী সম্পর্কে কটূক্তি করাটা একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শেষ রক্ষাকবজ সেনাবাহিনী ছিল বলেই দেশে শান্তি ফিরে এসেছে’ (জনকণ্ঠ, ১.১১.২০০২)। এই লোকটি এখনও রাজনীতি করতে পারছে এবং এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের মানুষের সহিষ্ণুতা। এই লোকটির আমলে সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশের প্রথম কাতারের সব রাজনীতিবিদকে হেনস্তা হতে হয়েছে। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নেয়া হয়েছিল। এ লোকটি নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে এ কারণ দেখিয়ে যে, বিএনপি সন্ত্রাস ও দুর্নীতি করছে এবং তার কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিনের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আজম খানকে জনসভায় পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘আমার ছোট ভাই’ বলে। এই মতলববাজ যখন আবার মাঠে নেমেছে, তখন সবার সাবধান থাকাই ভাল।
সেনা অভিযানে লক্ষণীয়, বিএনপির মাঠপর্যায়ে কিছু কর্মী-সন্ত্রাসী ও আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী-সন্ত্রাসী ধরা পড়েছিল। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের এমপি ও নীতিনির্ধারকদের বিনা কারণে ধরা হয়েছে। বিএনপির কোন মন্ত্রী বা এমপিকে নয়, এমনকি সন্ত্রাসী হিসেবে যাদের খ্যাতি আছে, তাদেরও নয়। ভুলক্রমে বিএনপির প্রভাবশালী কোন সন্ত্রাসী নেতা ধরা পড়ছে, আবার মাফ চেয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন খাজা হাবিব। পটুয়াখালীর বিএনপি নেতা কুট্টি সরকার অস্ত্রসহ ধরা পড়েও ছাড়া পেলেন (জনকণ্ঠ, ২.১১.২০০২)। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জনসভায় বেগম জিয়া বললেন, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস করছে। তার পরদিন খুলনায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তালুকদার খালেককে ধরা হলো। আরেক পত্রিকার খবরে দেখা গেল, সেনাবাহিনীর সামনে মহাখালী বাস টার্মিনাল দখল করা হয়েছে। টিভিতে দেখেছি খাজা হাবিবের বাসা থেকে বাক্স বাক্স মদ সেনারা বাজেয়াপ্ত করছে। তার কিছু হলো না। আর আওয়ামী লীগের ডা. ইকবালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তার বাসায় কয়েক বোতল মদ নাকি পাওয়া গেছে সে জন্য। সুতরাং সেনাবাহিনী কার জন্য কাজ করছে তা অনুমেয়। ক্লিন হার্টের অপারেশন হলে, তারা র‌্যাংক ও নামের ব্যাজ খুলে অপারেশনে যেত না। পাকি বা আলবদরদের মতো কাউকে ধরলেই কালো কাপড়ে চোখ বাঁধত না।
শুধু তাই-ই নয়, এ কারণে বিএনপির প্রধান বুদ্ধিজীবী-সমর্থক বলে পরিচিত অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান পর্যন্ত এক সাক্ষাৎকারে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সেনা হেফাজতে নির্যাতন বা নির্যাতনের ফলে মানুষ মারা যাওয়া কোনভাবেই আইনসম্মত নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। যেহেতু এ অভিযানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট যাচ্ছেন না,
তাই এটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বিনাবিচারে কাউকে মারা বা নির্যাতন করা যায় না। যেহেতু সেনা হেফাজতে নির্যাতন ও নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু এ বিষয়গুলো তদন্ত হওয়া উচিত (ভোরের কাগজ, ১.১১.২০০২)। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, প্রতিটি মৃত্যুর জন্য তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। যাদের হাতে মৃত্যু, তাদের দ্বারাই তদন্ত কমিটির ফলাফল কী হবে, সে বিষয়ে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।
সেনা অভিযানে কি ধর্ষণ ও খুন বন্ধ হয়েছিল? মোটেই না। সরকারপন্থী বলে পরিচিত এনজিও ডেমোক্রেসিওয়াচ জানিয়েছিল, অক্টোবর মাসে দেশে ১৪২ খুন হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭। এর মধ্যে ৩০ শিশু ও ২৭ জন নারী (জনকণ্ঠ, ২.১১.২০০২)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এ পরিপ্রেক্ষিতেই লিখেছিলেন। ‘সেনাবাহিনী নামালেই যদি সন্ত্রাস দমন হতো, তাহলে দীর্ঘ পনেরো বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনাশাসনে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসের চারা কেন উৎপাটিত হয়নি, বরং দিনে দিনে বেড়েছে! জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে তো দীর্ঘ আড়াই-তিন বছর প্রতিদিন ঢাকা শহরে সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি ‘সান্ধ্য আই’ জারি রেখে শাসন চালাতে হয়েছে। তাতে খুনোখুনির রাজনীতি ও সামাজিক সন্ত্রাস কোনটাই কি বন্ধ হয়েছিল? এরশাদও ক্ষমতা দখল করে কেবল সামরিক আইন জারি করা নয়, সেনা তলবও করেছিলেন। বলেছিলেন, দুর্নীতি দমন ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দূর করার লক্ষ্যে এই সেনা তলব। কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়ে গিয়েছিল সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতি দমন করা নয়Ñ গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূলোচ্ছেদের জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন এবং বাহিনীর সুনাম নষ্ট করেছিলেন (প্রথম আলো, ১.১১.২০০২)। এরপর আন্তর্জাতিক মহলও প্রশ্ন তোলে। এখন যেমন র‌্যাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে র‌্যাব ভেঙ্গে দিতে বলা হচ্ছে, তখন অবশ্য সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দিতে বলা হয়নি। কিন্তু দেশে বিদেশে সেনা অত্যাচারের বিরুদ্ধে মতামত এমন হলো যে, জাতিসংঘ মিশনও সেনাদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। তখন সরকার এই অপারেশন স্থগিত করে। ঐ সময় কথাবার্তা উঠতে থাকে মামলা-মোকদ্দমার। কিন্তু গর্জন সিংরা ক্ষমতায় থাকায় অনেকে সাহস করেনি। তবে সরকার আর ফাঁক রাখতে চায়নি। তারা সেনাবাহিনীকে ইনডেমনেটি দিয়ে বিল পাস করে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও সেনাসদস্যদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছিল। এটি কি আশ্চর্য না, বিএনপি এলেই সেনারা খুন-খারাবি করে আর বিএনপি তাদের দায়মুক্তি দেয়।
বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই নরহত্যা হয়েছে। কোনটির বিচার হয়েছে, কোনটির হয়নি। সব সরকারের আমলেই মৌলিক অধিকার-বিরোধী আইন হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনটি কখনও হয়নি যে, বিচার পাওয়ার অধিকারটি হরণ করা হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায়, ‘অপরাধের বিচারের পর রফা বা ক্ষমার রেওয়াজ অতি পুরাতন। সামাজিক অস্থিরতা ও সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে দুর্বল ও দুঃস্থ রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও আপোস করতে হয়। এই রীতি-রেওয়াজ স্মরণ রেখেও আমাদের বলতে হবে, বিচারের আগেই অভিযুক্তের দায়মুক্তির বিধান বিচারাদর্শের বড় পরিপন্থী।’
মওদুদ আহমেদ যিনি শার্ট বদলানোর মতো দল ও মত বদলান, তিনি দায়মুক্তি অধ্যাদেশ পাস করিয়েছিলেন। এই আইন অনুযায়ী “১৪ অক্টোবর ২০০২ হইতে ৯ জানুয়ারি ২০০৩ তারিখ কার্যদিবস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার কর্তৃক ১৬ অক্টোবর, ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ এবং তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত সকল আদেশ, উক্ত আদেশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য কৃত যাবতীয় কার্য এবং উক্ত আদেশসমূহ বলে ও অনুসারে যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য বা যৌথ অভিযানে অন্য কোন সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত সময়ের মধ্যে তাহার দায়িত্ব বিবেচনায় প্রদত্ত আদেশকৃত আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদসহ সকল প্রকার কার্য ও গৃহীত ব্যবস্থা, প্রচলিত আইনে ও আদেশসমূহে যাহাই থাকুক না কেন, ১৬ অক্টোবর, ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ প্রদানকারী এবং উক্ত আদেশবলে ও অনুসারে আদেশ প্রদানকারী এবং কার্য সম্পাদনকারী এবং যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণকে তজ্জন্য সর্বপ্রকার দায়মুক্ত করা হইল।’ এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ কেন করা হলো। এর সরল উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে। যেমনÑকলোনি সরকারের মতাদর্শ অনুসারে, আইন সরকারের ইচ্ছা সুতরাং এ সরকারও তা-ই করেছে। পাকি আদর্শে বিশ্বাসী ক্ষমতাসীনদের সেনাবাহিনীর ব্যবহার দরকার, ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য, সে জন্য করেছে। কিন্তু মূল কথাটি অনেকে জানলেও বা অনুধাবন করলেও বলছেন না। মূল বিষয়টি হলো-সেনা ভজনা।
বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং তার নেতা- নেত্রী, এস্টাবলিশমেন্ট, পত্রপত্রিকার মালিকÑ সব সেনা ভজনায় অভ্যস্ত এবং সানন্দে তারা তা করেন। বিএনপির জন্ম তো ক্যান্টনমেন্টেই; অনেকেই মনে করেন, এটি তাদেরই সেকেন্ড ফ্রন্ট। সুতরাং সেনা ভজনা নয়, তারা সেনাদেরই অন্তর্ভুক্ত। বিএনপির নেত্রী ক্যান্টনমেন্টে থাকেন এবং লোকালয়ে কখনও বসবাস করতে ইচ্ছুক নন। এটি একদিক। অন্যদিকে, যারা দায়মুক্তির বিরোধিতা করছেন, তারা সেনাবাহিনীকে দোষী করছেন না, যতটা করছেন বেগম জিয়াকে। এটিও লক্ষণীয়। প্রতিটি আইন প্রণয়নের পেছনে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিকা থাকে। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের পেছনেও কাজ করছে সে পটভূমিকা। রাজনৈতিক দিকটি হলো জামায়াত ১৯৭১ সালে খুন- খারাবি করেছে, বিএনপির প্রতিটি আমলেই খুুন-খারাবি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীও একইভাবে দু’জন প্রেসিডেন্ট হত্যা, চার রাজনৈতিক নেতা এবং বিশেষ করে, জিয়ার আমলে অনেক খুন-খারাবির সঙ্গে যুক্ত। এর কোনটির বিচার সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মানুষজন এখন নিরস্ত্র হলেও সচেতন হয়ে উঠছে। সুযোগ পেলে এর বদলা নিতে পারে। সুতরাং সেনাবাহিনীর পলিটিক্যাল ফ্রন্টের লক্ষ্য হবে তাদের রক্ষা করা।
অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা জানেন, সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রকৃত ক্ষমতার উৎসÑ জনগণ নয়। প্রতিটি সরকারের আমলে মানুষকে নিরন্ন রেখে কতিপয় ব্যক্তির জন্য বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই একটি মাপকাঠিই সেনা প্রভাব মাপার জন্য যথেষ্ট। সেনারা এখন ‘শান্তি মিশন’-এ গিয়ে ডলারে ভাল রোজগারপাতি করছে। এখন এসব মৃত্যু, বিচার-টিচার শুরু হলে ডলার রোজগার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং এসব বিরূপ প্রপাগান্ডা বন্ধের উপায় দায়মুক্তি। সেনাদের ইচ্ছাই বাংলাদেশে প্রধান ইচ্ছা।
এছাড়া বেগম জিয়া থেকে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ ধারণাও সৃষ্টি হয়েছিল, যা অর্জিত হয়েছে তা ভোগের জন্য স্পেস দরকার এবং হত্যার জন্য তাদের হুকুমের আসামি করলে ভোগ করার স্পেসটি পাওয়া যাবে না। সুতরাং দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। সেনা নামানোটা যে শুধু সন্ত্রাস দমন ছিল না, ছিল এক ধরনের মতলবাজি, তার প্রমাণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ সত্ত্বেও সন্ত্রাস থেকে ভোট রক্ষায় সেনাবাহিনী না নামানো (অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত, তাতে অবস্থার খুব একটা হেরফর হতো না)।
পবিত্র কোরান শরিফের সুরা মায়িদার ৩২ আয়াতে আছে : ‘এ কারণেই আমি বনি ইসরায়েলদের ওপর এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্য করা ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করলো, আর কেউ কারো প্রাণরক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণরক্ষা করলো।’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতেও এ আইন ধর্মবিরোধী। অবশ্য অধিকাংশ ধর্মবিরোধী কাজ এ সরকারের সময়েই হয়েছে।
এবার দায়মুক্তি আইনের মারপ্যাঁচটি দেখুন। সেনাসদস্যদের বিচার করা যাবে সামরিক আইন দ্বারা। অভিযোগ ছাড়া বিচার হবে? অভিযোগ করতে হলে সিভিলিয়ানদের করতে হবে? ‘ব্লাডি সিভিলিয়ানরা’ কি অভিযোগ আনতে পারবে আর্য সেনাদের বিরুদ্ধে? কখনই না। এবং সে আইনে তা গ্রাহ্যও হবে না। আর সেনারা বিচার করবে নিজেদের কৃতকর্ম কিসের ভিত্তিতে? পুরোটা ছিল একটা ফার্স, মওদুদী ফার্স। অনেকে হাসাহাসি করবেন এই বলে যে, বঙ্গবাজারে চাঁদাবাজির জন্য এক কাপ্তানের কোর্ট মার্শাল হচ্ছে। যেখানে খুনের বিচার হবে না, সেখানে চাঁদাবাজির বিচার করে কী লাভ? একই কথা পুশিল বাহিনী, সংশ্লিষ্ট সিভিলিয়ান কর্মকর্তা এবং মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কলোনি আইনে যা-ই থাকুক, আইনে থাকুক না থাকুক, বর্তমান বিশ্বে একটি ডিকটাট সবাই মেনে চলেন তা হচ্ছে, সমস্ত কর্মকা- এমনকি আইনের উৎসও হবে মানবিকতা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্ষুব্ধ ছিল বাংলাদেশের ওপর, তার প্রধান কারণ দায়মুক্তি। খুন করলে বিচার হবে না। সভ্য সমাজ তা ভাবতে পারে না। যে কারণে সভ্য দেশে বাংলাদেশ পরিচিত হচ্ছিল জংলী দেশ হিসেবে, যেখানে আইন করা হয় আইনবহির্ভূত কাজ করার জন্য। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি শুধু কালিমালিপ্তই নয়, ভূলুণ্ঠিত করার জন্যও বেগম জিয়ার সরকার দায়ী। পত্রপত্রিকায়, আইনজীবী-বুদ্ধিজীবী সবাই প্রায় ৫০ জনের মৃত্যুকে উল্লেখ করেছেন। হেফাজতে মৃত্যু বা কাস্টোডিয়াল ডেথ হিসেবে। হেফাজতে হৃদরোগে মৃতু্যু হতে পারে। সুতরাং এর জন্য বিচারের দরকার কী? এ ধরনের কথা বলেন সেনা ভজনকারীরা। আসলে প্রতিটি মৃত্যু ছিল হেফাজতে হত্যা, কাস্টোডিয়াল কিলিং। হত্যা না হলে বিচারের কথা কেন আসে বা কেন আসে দায়মুক্তির প্রশ্ন। সেনা হেফাজতে নিয়ে এদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে এবং তাতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সে জন্যই বিচারের প্রশ্ন আসছে। মনে রাখা দরকার, হত্যার বিচার চাওয়ার মৌলিক অধিকার এবং হত্যার বিষয়টি কখনও তামাদি হয় না। অনেকে প্রশ্ন করছেন, বেগম জিয়া কি অর্ডার দিয়েছিলেন হত্যা করার বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? সেটি আমরা জানি না। তবে মনে রাখা দরকার, পাকি বাহিনীর সঙ্গে আদর্শগত দিক থেকে এদের পার্থক্য কম। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনের পর সেনাবাহিনী প্রথমেই নাপিতের অর্থাৎ চুল কাটার দায়িত্ব নেয়, নারী-পুরুষকে একসঙ্গে ঘুরতে দেখলে বাধা দেয়, কান ধরে ওঠ-বস করায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও ২০০২ ও ২০০৭ সালে একই কাজ করেছে। পাকি বাহিনী পছন্দ করে নিরস্ত্রদের পেটাত। এরাও তাই করে। সেই সময় সেনা অভিযানে একজন নামী সন্ত্রাসীও ধরা পড়েনি, সন্ত্রাসী জামায়াতী বা উগ্রবাদীদের কাউকে ধরা হয়নি। কাস্টোডিতে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক ছিল না। কেন এমন হলো? পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে, উপরে আল্লাহ নিচে সেনা। এখানেও সে বিশ্বাস আছে, যেহেতু অধিকাংশ সময় তারাই শাসন করেছে। সুতরাং অভিযানে নেমে প্রবল আক্রোশে সিভিলিয়ানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
দায়মুক্তি আইন অল্প কয়েকজনকে হত্যার অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করেছিল। কিন্তু ১৪ কোটির ওপর একটি দায় চাপিয়ে দিয়েছিল। এই দায় থেকে মুক্তি না পেলে বর্তমানের ১৫ কোটি সভ্য সমাজে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
দুই আইনজীবীর আবেদন সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য। আদালত আগে দ্বিতীয় দায়মুক্তি আইন অবৈধ ঘোষণা করেছিল। এটি হচ্ছে তৃতীয় এবং এটিও বাতিল হওয়া উচিত বলে সিভিল সমাজ মনে করে। এ দেশে শুধু পুলিশ বা র‌্যাবই নয়, সবধরনের নিরাপত্তা বাহিনীই সাধারণের ওপর অত্যাচার করে পার পেয়ে যায় এবং ক্ষমতায় গেলে রাজনীতিবিদরা নির্লজ্জভাবে সাধারণের কথা ভুলে এদেরই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভজনা করে। আদালত আইন বাতিল করলেই যে হাসান মশহুদকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে বা যে ক্যাপ্টেন/মেজর ঐ বিধবার ব্যবসায়ী স্বামীকে হত্যা করেছিল তার বিচার হবেÑতা আমি মনে করি না। কারণ এস্টাবলিশমেন্টকে কেউ চটাতে চায় না। কিন্তু দায়মুক্তি না থাকলে কখনও না কখনও মানুষ সাহসী হয়ে এর বিচার চাইতে পারে। কে ভেবেছিল ৪০ বছর পর ক্ষমতাবান গোলাম আযম বা নিজামীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তবে সমাজে এ ধারণাটার প্রচলন হওয়া উচিত, এ সমাজে সবারই দায় আছে। দায়মুক্তি কেউ পেতে পারে না। দায়মুক্তি যে পায় তখন তো সে রাষ্ট্রের থেকেও বড় হয়ে ওঠে। আধুনিক রাষ্ট্রে তা তো হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.