আদিবাসীদের দিনকাল
গাইবান্ধার আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও বুনো সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর দিনকাল এখন আর ভাল নেই। অশিক্ষা, কুসংস্কার, সীমাহীন দারিদ্র্য এবং কর্মসংস্থানের অভাবে ভূমিহীন এই আদিবাসীদের অস্তিত্ব এখন বিলুপ্তির পথে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে শুধু গাইবান্ধা জেলাতেই নয়; উত্তরাঞ্চলের রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলার
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে শুধু গাইবান্ধা জেলাতেই নয়; উত্তরাঞ্চলের রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলার
লালমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজীবী ওঁরাও পরিবারের বসতি ছিল অনেক। নানা দেবদেবী এবং প্রকৃতির বড় প্রাচীন গাছ, নদী, সূর্য পুজোর প্রতি এদের ধর্ম বিশ্বাস থাকলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার অধিকাংশ সাঁওতাল, ওঁরাও বুনো পরিবার ভারতে চলে গিয়ে নিজ আবাসভূমিতে আর ফিরে আসেনি। এরপরও যারা ছিল তারাও সংখ্যা স্বল্পতায় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনাচরণে নানা বিঘœ সৃষ্টি হয় বলে ধীরে ধীরে পাড়ি দিয়েছে ভারতের নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, আসামসহ অন্যান্য এলাকায়। কেননা ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলে ওঁরাও পরিবার ছিল প্রায় ৬ হাজার। আর এখন তাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এখনও গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও টিকে আছে ২শ’ ৫০ ওঁরাও পরিবার। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বরেন্দ্র এলাকা কামদিয়া, রাজাহার, সাখাহার, সাপমারা, গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নে ২শ’ ২০টি ওঁরাও পরিবার, সাড়ে ৫ হাজার সাঁওতাল এবং ২ হাজার ৩শ’ বুনো পরিবার তাদের আদি সংস্কৃতি আঁকড়ে বসবাস করছে।
‘ওঁরাও’ এই নামের আদিবাসীরা আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ। এদের গায়ের রং কালো, নাক চ্যাপটা, চুল কালো ও কুঞ্চিত, উচ্চতা মাঝারি। উপমহাদেশে ওঁরাওদের প্রধান বসতি উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর, রাজমহল ও বিহার সন্নিহিত অঞ্চলে। নৃতত্ত্ববিদগণের মতে একই অঞ্চলের মু-া, মালপাহাড়ি ও সাঁওতালদের সঙ্গে ওঁরাওদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভাষার দিক থেকেও এরা সবাই একই অস্ট্রিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কারো কারো মতে কুরুথ ভাষার বিভাজিত একটি অংশের টোটেমরূপে ওঁরাও কথাটা এসেছে। এরা ঠিক কবে-কি কারণে বাংলাদেশে এসে বসবাস শুরু করে সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা যায়নি।
এ জেলার ওঁরাও, সাঁওতাল এবং বুনো পরিবারগুলো মূলত কৃষিজীবী। এরা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। এছাড়া কৃষি শ্রমিক এবং দিনমজুরী তাদের পেশা। পরিবারের নারী- পুরুষ দু’জনই কর্মঠ এবং উভয়েই শ্রমজীবী পেশাকে আঁকড়ে জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ওঁরাওরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো পুজো-পার্বণে বিশ্বাসী হলেও এদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ভিন্নতা রয়েছে। বৈশাখ মাসে এরা বসুন্ধরা ব্রত ও উৎসব, ভাদ্র মাসে ভাদু উৎসব, অঘ্রানে সেঁজুতি, ফাল্গুনে ইতু এবং চৈত্র মাসে ওঁরাওরা বসন্ত উৎসব পালন করে থাকে। বর্ষাকালে কদম ফুল ফোটার মৌসুমে এরা কদম গাছ এবং পাতা, ডাল ও ফুল নিয়েও পুজো অর্চনা করে থাকে। এই পুজো-পার্বণের মূল উদ্দেশ্য হলোÑজমি ও ফসলের উর্বরতা শক্তি ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা।
এদিকে সাঁওতালদের মধ্যে অধিকাংশই খ্রীস্টান ধর্মের হলেও কিছু কিছু হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী সাঁওতাল পরিবার তাদের আদি সংস্কৃতি এবং ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে। এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবন ও ধর্ম চর্চায় উজ্জ্বল রঙ্গিন ফুলের কদর অনেক বেশি। বিশেষ করে লাল জবা ফুল তাদের পুজো- পার্বণে এবং উৎসব পরবে বেশিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়। এদের মেয়েরা রঙ্গিন শাড়ি পরে, চুলে রঙ্গিন ফুল গুঁজে নাচে-গানে উৎসব পালন করে থাকে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই সামাজিক রীতি হিসেবে শরীরে উল্কি আঁকে। এদের বিয়ে হয় ধুমধামে অনেকটা সাঁওতালদের বিয়ের অনুকরণে। বিয়েতে নাচ-গান এবং ভাত পচানো ওদের বাড়িতেই তৈরি করা চোলাই মদ থাকতেই হবে। এই মদ আর পাঁঠা বা শূকরের মাংসের সঙ্গে মোটা চালের ভাতের ভোজ দিয়েই চলে বিয়ের বাড়ির আহার পর্ব। আদিবাসীদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের একসঙ্গে দুই স্ত্রী বা স্বামী রাখার বিধান এদের নেই। এখনও এদের সমাজে প্রাচীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এদের মধ্যে বিধবা বিয়ে এবং ঘরভাঙ্গা বিয়ে প্রচলিত আছে, তবে শিশু বিয়ের প্রচলন কম।
আগে গারোদের মতো দেকাচোঙ ঘর এবং সাঁওতালদের আখ্রা ঘরের মতো বিবাহযোগ্য তরুণ-তরুণীরা বিয়ের আগে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেত। বড় গোলাঘর, যাকে বলা হয় ধুমকুরিয়া। এই গোলোঘরে নির্দিষ্ট পরবের দিনে একসঙ্গে একাধিক বিবাহযোগ্য নারী-পুরুষ একত্রে বসে তাদের পছন্দমতো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করত। পরে পরিবারের লোকজনের সম্মতিতে বিয়ে হতো। এখন আর সে প্রথার প্রচলন বা সুযোগ নেই। তবে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বেশি পরিশ্রম করে এবং কৃষিকাজেও তারা অত্যন্ত দক্ষ। বেশি কাজ করেও নারী শ্রমিকরা পুরুষের চেয় কম মজুরী পায়। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে এবং নারী বলে বিচার পায় না। ওঁরাও জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সরকারী ত্রাণ সহায়তা থেকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত। অথচ দেখার কেউ নেই। নানা প্রতিকূলতা, দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার শিকার হয়েও আদিবাসীরা এখনও যে আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও এবং বুনোরা এ জেলায় আদি সংস্কৃতি এবং একান্ত নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতিকে উপজীব্য করেই স্বকীয় বৈশিষ্টে অস্তিত্বকে ধারণ করে রেখেছে এটাও কম কথা নয়।
Ñআবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা
‘ওঁরাও’ এই নামের আদিবাসীরা আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ। এদের গায়ের রং কালো, নাক চ্যাপটা, চুল কালো ও কুঞ্চিত, উচ্চতা মাঝারি। উপমহাদেশে ওঁরাওদের প্রধান বসতি উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর, রাজমহল ও বিহার সন্নিহিত অঞ্চলে। নৃতত্ত্ববিদগণের মতে একই অঞ্চলের মু-া, মালপাহাড়ি ও সাঁওতালদের সঙ্গে ওঁরাওদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভাষার দিক থেকেও এরা সবাই একই অস্ট্রিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কারো কারো মতে কুরুথ ভাষার বিভাজিত একটি অংশের টোটেমরূপে ওঁরাও কথাটা এসেছে। এরা ঠিক কবে-কি কারণে বাংলাদেশে এসে বসবাস শুরু করে সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা যায়নি।
এ জেলার ওঁরাও, সাঁওতাল এবং বুনো পরিবারগুলো মূলত কৃষিজীবী। এরা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। এছাড়া কৃষি শ্রমিক এবং দিনমজুরী তাদের পেশা। পরিবারের নারী- পুরুষ দু’জনই কর্মঠ এবং উভয়েই শ্রমজীবী পেশাকে আঁকড়ে জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ওঁরাওরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো পুজো-পার্বণে বিশ্বাসী হলেও এদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ভিন্নতা রয়েছে। বৈশাখ মাসে এরা বসুন্ধরা ব্রত ও উৎসব, ভাদ্র মাসে ভাদু উৎসব, অঘ্রানে সেঁজুতি, ফাল্গুনে ইতু এবং চৈত্র মাসে ওঁরাওরা বসন্ত উৎসব পালন করে থাকে। বর্ষাকালে কদম ফুল ফোটার মৌসুমে এরা কদম গাছ এবং পাতা, ডাল ও ফুল নিয়েও পুজো অর্চনা করে থাকে। এই পুজো-পার্বণের মূল উদ্দেশ্য হলোÑজমি ও ফসলের উর্বরতা শক্তি ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা।
এদিকে সাঁওতালদের মধ্যে অধিকাংশই খ্রীস্টান ধর্মের হলেও কিছু কিছু হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী সাঁওতাল পরিবার তাদের আদি সংস্কৃতি এবং ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে। এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবন ও ধর্ম চর্চায় উজ্জ্বল রঙ্গিন ফুলের কদর অনেক বেশি। বিশেষ করে লাল জবা ফুল তাদের পুজো- পার্বণে এবং উৎসব পরবে বেশিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়। এদের মেয়েরা রঙ্গিন শাড়ি পরে, চুলে রঙ্গিন ফুল গুঁজে নাচে-গানে উৎসব পালন করে থাকে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই সামাজিক রীতি হিসেবে শরীরে উল্কি আঁকে। এদের বিয়ে হয় ধুমধামে অনেকটা সাঁওতালদের বিয়ের অনুকরণে। বিয়েতে নাচ-গান এবং ভাত পচানো ওদের বাড়িতেই তৈরি করা চোলাই মদ থাকতেই হবে। এই মদ আর পাঁঠা বা শূকরের মাংসের সঙ্গে মোটা চালের ভাতের ভোজ দিয়েই চলে বিয়ের বাড়ির আহার পর্ব। আদিবাসীদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের একসঙ্গে দুই স্ত্রী বা স্বামী রাখার বিধান এদের নেই। এখনও এদের সমাজে প্রাচীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এদের মধ্যে বিধবা বিয়ে এবং ঘরভাঙ্গা বিয়ে প্রচলিত আছে, তবে শিশু বিয়ের প্রচলন কম।
আগে গারোদের মতো দেকাচোঙ ঘর এবং সাঁওতালদের আখ্রা ঘরের মতো বিবাহযোগ্য তরুণ-তরুণীরা বিয়ের আগে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেত। বড় গোলাঘর, যাকে বলা হয় ধুমকুরিয়া। এই গোলোঘরে নির্দিষ্ট পরবের দিনে একসঙ্গে একাধিক বিবাহযোগ্য নারী-পুরুষ একত্রে বসে তাদের পছন্দমতো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করত। পরে পরিবারের লোকজনের সম্মতিতে বিয়ে হতো। এখন আর সে প্রথার প্রচলন বা সুযোগ নেই। তবে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বেশি পরিশ্রম করে এবং কৃষিকাজেও তারা অত্যন্ত দক্ষ। বেশি কাজ করেও নারী শ্রমিকরা পুরুষের চেয় কম মজুরী পায়। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে এবং নারী বলে বিচার পায় না। ওঁরাও জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সরকারী ত্রাণ সহায়তা থেকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত। অথচ দেখার কেউ নেই। নানা প্রতিকূলতা, দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার শিকার হয়েও আদিবাসীরা এখনও যে আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও এবং বুনোরা এ জেলায় আদি সংস্কৃতি এবং একান্ত নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতিকে উপজীব্য করেই স্বকীয় বৈশিষ্টে অস্তিত্বকে ধারণ করে রেখেছে এটাও কম কথা নয়।
Ñআবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা
No comments