জাবিতে টানা ২৪ ঘণ্টা তা-ব চালাল কারা- নানা প্রশ্ন- সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিন মামলা, গ্রেফতার নেই by বিভাষ বাড়ৈ ও আহমেদ রিয়াদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের নেতা লিখনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, ভাংচুর এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধাদানের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে সাভার ও আশুলিয়া থানায় দুটি এবং আহত লিখনের মা সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ে আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে বুধবার মধ্যরাতেই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ থেমে গেলেও বৃহস্পতিবার টানা ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ক্যাম্পাসে কারা তা-ব চালিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, উপাচার্যসহ কর্তৃপক্ষকে ব্যর্থ করে দিতে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সেই শিক্ষক নেতারাই কলকাঠি নেড়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষের সময় বের হতে না পারলেও সেই শিক্ষকরা কিভাবে নির্বিঘেœ দিনভর তৎপর ছিলেন? রামদা, চাপাতিসহকারে ছাত্রদলের নবাগত কিছু সদস্যকে চেনা গেলেও অধিকাংশই অপরিচিত। সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে প্রতিক্রিয়াশীলরা সক্রিয় ছিল বলেই উপাচার্যসহ প্রগতিশীল শিক্ষকরা আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিকে জাবিতে প্রবেশ করেই উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে যে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন পুরো ঘটনাকে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখছেন অনেকে। উপাচার্য নিজেও ঘটনায় হতবাক। তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বললেন, বুধবার শুরুতে যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন তাদের হাতে বৃহস্পতিবার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘটনাকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অপতৎরতা হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। তিনি বলেন, পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়টি অবশ্যই দেখা হবে। জাবির হঠাৎ এই সংঘর্ষের ঘটনাকে একটি বিশেষ মহলের পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, পুরা ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের অবশ্যই চিহ্নিত করা হবে। ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, তাহমিদুল ইসলাম লিখনের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ আনেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী। রাতেই লিখন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রীর সহপাঠী মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী নাহিদের বিরুদ্ধে। এ কারণে নাহিদকে রাতেই পুলিশ আটক করতে আসে। কিন্তু আটক করে আনতে গেলেই পুলিশের ওপর আক্রমণ। এক পর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়লে আহত হয় ৫ জন। জানা গেছে, আহত লিখন ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন গ্রুপের কর্মী। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান ছিল তার। সম্প্রতি ভিসি ছাত্রলীগের সকল গ্রুপের সহাবস্থানের ঘোষণা দেয়ার পর সে বঙ্গবন্ধু হলে ওঠে। জানুয়ারি মাসে নিহত জুবায়েরও একই গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। বুধবার সকালে লিখন তার অনুসারী কর্মীদের নিয়ে ভিসি অফিসের সামনে জুবায়ের হত্যাকারীদের আটকের দাবিতে মানববন্ধন করে। বঙ্গবন্ধু হলের একই ব্যাচের (৩৬ ব্যাচ) অপর ছাত্রলীগের নেতা রিয়াজের সঙ্গে রয়েছে লিখনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। রিয়াজ তাকে বিভিন্ন সময় দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে। মীর মশাররফ হোসেন হলের অপর নেতা আশরাফুজ্জামান লিটনের সঙ্গেও রয়েছে তার দ্বন্দ্ব। লিটন, রিয়াজ ও লিখন তিনজনই ছাত্রলীগের সম্ভাব্য কমিটির সভাপতি প্রার্থী। এ কারণে তাকে মেরে পথ পরিষ্কার করাই উদ্দেশ্য ছিল বলে অভিযোগ করেছে আহত লিখন। ঘটনা বুধবার এ পর্যন্তই। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে শুরু তা-ব। বুধবার মধ্যরাতের ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে জখমের হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করার জেরে ছাত্র-পুলিশ বিক্ষোভে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য প্রবেশ করা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মীর মশাররফ হোসেন হলের একাংশের উপস্থিতি ছিল।
বুধবার মধ্যরাতে আশুলিয়া থানা পুলিশ ঐ ছাত্রকে আটক ঘটনার জেরে ছাত্র অসন্তোষ ও পরবর্তীতে পুলিশের ওপর হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নজিরবিহীন তা-ব চালায়। ঘটনার পর সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জহির রায়হান মিলনায়তন, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, নতুন ও পুরান প্রশাসনিক ভবন, প্রক্টর অফিস, নতুন কলাভবন, মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসা ভাংচুর করে। হামলা চালানো হয় সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুলক কবীর ও অধ্যাপক আবদুল বায়েসের বাসভবনে। এক পর্যায়ে সেই ছাত্ররাই তারা মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্টকে তার বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখেন। প্রক্টরের বাসা এবং সাবেক উপাচার্যের বাসাও ভাংচুর করে এরাই। এতে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বিঘিœত এবং ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে। অন্যদিকে বুধবার দিনভর উপাচার্যসহ প্রশাসনের সকলকে এড়িয়ে গেছেন ক্যাম্পাস দখল করে তা-ব চালানো গ্রুপটিই। যে ছাত্রকে আহত করা হয়েছে সেই ছাত্রের হল বঙ্গবন্ধৃু হলের সকল ছাত্র এমনকি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও বৃহস্পতিবার হল থেকে বের হয়নি। বের হয়নি অন্য হলের ছাত্ররাও। কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি গ্রুপ ও অচেনা লোককে ক্যাম্পাস রীতিমতো অবরুদ্ধ করে ভাংচুর চালাতে দেখা গেছে।
এদিকে একজন অভিযুক্ত আসামিকে ধরতে আসার পর এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন ভাংচুর ও তা-বলীলা চালানো হলো? এ বিষয়টিই এখন সবার কৌতূহলের বিষয়। জানা গেছে, অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের বিদায়ের পর অনেকেই ভিসি হওয়ার আশায় ছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে নিয়োগ দেয়ার পর তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এরপর উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করলেও তারা ব্যর্থ হয়। উপাচার্য হন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় যারা খুশি হতে পারেননি, তারা এই ছাত্র আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে। সেই আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকেই বৃহস্পতিবার তৎপর থাকতে দেখা গেছে। অথচ তা-বে তখন উপাচার্যসহ অধিকাংশ প্রগতিশীল শিক্ষকই অবরুদ্ধ। তাহলে তারা কিভাবে চলাফেরা করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে এ প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। সাধারণ ছাত্ররা বলছে, ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দালনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা ছিল প্রায় অপরিচিত। অনেকেই মনে করছেন, জামায়াত-শিবির চক্র এ আন্দোলনে মদদ যোগানোর পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র-শিক্ষকদের একটি গোষ্ঠী এই আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই অংশের মধ্যে সংঘর্ষ হলেও পুরো সহিংস ঘটার সুযোগ নিয়েছে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে তৃতীয় কোন পক্ষ। ভিডিও ফুটেজ দেখে যাদের চিহ্নিত করা গেছে তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্র। আর যারা নেতৃত্বে ছিল তারা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত। এরাই এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল। মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ নেতা লিটন বলেছেন, আমরা আসলে আন্দোলনের কোন পরিকল্পনায় ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে এরকম ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার সকালে ছাত্রলীগের একাংশের নেতা লিখনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, ভাংচুর এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধাদানের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে সাভার ও আশুলিয়া থানায় দুটি এবং আহত লিখনের মা সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিন মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৭৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। সাভার মডেল থানার ওসি মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, ছাত্রলীগের একাংশের নেতা তাহমিদুল ইসলাম লিখনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় তার মা কাজী জোহরা বেগম যে মামলাটি করেছেন তাতে নামসহ ৯ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় সাভার থানার এসআই সাজ্জাদ রোমন বাদী হয়ে ১০ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোস্তফা কামাল বলেন, দারোগা বিল্লাল হোসেনকে পিটিয়ে আহত করাসহ পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় এসআই বদরুল আলম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এতে আসামি হিসেবে ৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক-কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের ভাংচুর হামলার ঘটনা জাবির ইতিহাসে সেই। যেখানে কয়েক কোটি টাকার স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জানা গেছে, উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার হোসেন আজ শনিবার দুপুর ১২টায় সিনেট হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ ও শিক্ষক আন্দোলনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অস্থিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি হলেও এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। সঙ্কট নিরসনে ইউজিসি ছাত্র-শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে। অস্থিরতা নিরসন ও শিক্ষা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে শিক্ষক সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের স্ব-স্ব দায়িত্বের কথা স্মরণে রেখে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে কমিশন প্রত্যাশা করে। মঞ্জুরি কমিশন আরও বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রয়োজন মনে করলে ইউজিসি সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানে বদ্ধপরিকর। যে সময় দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২২ লাখের সীমা অতিক্রম করেছে যা চীন ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পরের স্থান অর্জন করে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সে সময় এ অচলাবস্থা মোটেও কাম্য নয়।
এদিকে জাবিতে প্রবেশ করেই উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে যে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন পুরো ঘটনাকে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখছেন অনেকে। উপাচার্য নিজেও ঘটনায় হতবাক। তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বললেন, বুধবার শুরুতে যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন তাদের হাতে বৃহস্পতিবার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘটনাকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অপতৎরতা হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। তিনি বলেন, পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়টি অবশ্যই দেখা হবে। জাবির হঠাৎ এই সংঘর্ষের ঘটনাকে একটি বিশেষ মহলের পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, পুরা ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের অবশ্যই চিহ্নিত করা হবে। ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, তাহমিদুল ইসলাম লিখনের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ আনেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী। রাতেই লিখন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রীর সহপাঠী মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী নাহিদের বিরুদ্ধে। এ কারণে নাহিদকে রাতেই পুলিশ আটক করতে আসে। কিন্তু আটক করে আনতে গেলেই পুলিশের ওপর আক্রমণ। এক পর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়লে আহত হয় ৫ জন। জানা গেছে, আহত লিখন ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন গ্রুপের কর্মী। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান ছিল তার। সম্প্রতি ভিসি ছাত্রলীগের সকল গ্রুপের সহাবস্থানের ঘোষণা দেয়ার পর সে বঙ্গবন্ধু হলে ওঠে। জানুয়ারি মাসে নিহত জুবায়েরও একই গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। বুধবার সকালে লিখন তার অনুসারী কর্মীদের নিয়ে ভিসি অফিসের সামনে জুবায়ের হত্যাকারীদের আটকের দাবিতে মানববন্ধন করে। বঙ্গবন্ধু হলের একই ব্যাচের (৩৬ ব্যাচ) অপর ছাত্রলীগের নেতা রিয়াজের সঙ্গে রয়েছে লিখনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। রিয়াজ তাকে বিভিন্ন সময় দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে বলে জানা গেছে। মীর মশাররফ হোসেন হলের অপর নেতা আশরাফুজ্জামান লিটনের সঙ্গেও রয়েছে তার দ্বন্দ্ব। লিটন, রিয়াজ ও লিখন তিনজনই ছাত্রলীগের সম্ভাব্য কমিটির সভাপতি প্রার্থী। এ কারণে তাকে মেরে পথ পরিষ্কার করাই উদ্দেশ্য ছিল বলে অভিযোগ করেছে আহত লিখন। ঘটনা বুধবার এ পর্যন্তই। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে শুরু তা-ব। বুধবার মধ্যরাতের ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে জখমের হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করার জেরে ছাত্র-পুলিশ বিক্ষোভে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য প্রবেশ করা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মীর মশাররফ হোসেন হলের একাংশের উপস্থিতি ছিল।
বুধবার মধ্যরাতে আশুলিয়া থানা পুলিশ ঐ ছাত্রকে আটক ঘটনার জেরে ছাত্র অসন্তোষ ও পরবর্তীতে পুলিশের ওপর হামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নজিরবিহীন তা-ব চালায়। ঘটনার পর সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জহির রায়হান মিলনায়তন, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, নতুন ও পুরান প্রশাসনিক ভবন, প্রক্টর অফিস, নতুন কলাভবন, মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসা ভাংচুর করে। হামলা চালানো হয় সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুলক কবীর ও অধ্যাপক আবদুল বায়েসের বাসভবনে। এক পর্যায়ে সেই ছাত্ররাই তারা মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্টকে তার বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখেন। প্রক্টরের বাসা এবং সাবেক উপাচার্যের বাসাও ভাংচুর করে এরাই। এতে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বিঘিœত এবং ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে। অন্যদিকে বুধবার দিনভর উপাচার্যসহ প্রশাসনের সকলকে এড়িয়ে গেছেন ক্যাম্পাস দখল করে তা-ব চালানো গ্রুপটিই। যে ছাত্রকে আহত করা হয়েছে সেই ছাত্রের হল বঙ্গবন্ধৃু হলের সকল ছাত্র এমনকি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও বৃহস্পতিবার হল থেকে বের হয়নি। বের হয়নি অন্য হলের ছাত্ররাও। কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি গ্রুপ ও অচেনা লোককে ক্যাম্পাস রীতিমতো অবরুদ্ধ করে ভাংচুর চালাতে দেখা গেছে।
এদিকে একজন অভিযুক্ত আসামিকে ধরতে আসার পর এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন ভাংচুর ও তা-বলীলা চালানো হলো? এ বিষয়টিই এখন সবার কৌতূহলের বিষয়। জানা গেছে, অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের বিদায়ের পর অনেকেই ভিসি হওয়ার আশায় ছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে নিয়োগ দেয়ার পর তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এরপর উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করলেও তারা ব্যর্থ হয়। উপাচার্য হন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় যারা খুশি হতে পারেননি, তারা এই ছাত্র আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে। সেই আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকেই বৃহস্পতিবার তৎপর থাকতে দেখা গেছে। অথচ তা-বে তখন উপাচার্যসহ অধিকাংশ প্রগতিশীল শিক্ষকই অবরুদ্ধ। তাহলে তারা কিভাবে চলাফেরা করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে এ প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। সাধারণ ছাত্ররা বলছে, ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দালনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা ছিল প্রায় অপরিচিত। অনেকেই মনে করছেন, জামায়াত-শিবির চক্র এ আন্দোলনে মদদ যোগানোর পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র-শিক্ষকদের একটি গোষ্ঠী এই আন্দোলনে উৎসাহ যুগিয়েছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই অংশের মধ্যে সংঘর্ষ হলেও পুরো সহিংস ঘটার সুযোগ নিয়েছে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে তৃতীয় কোন পক্ষ। ভিডিও ফুটেজ দেখে যাদের চিহ্নিত করা গেছে তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্র। আর যারা নেতৃত্বে ছিল তারা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত। এরাই এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল। মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ নেতা লিটন বলেছেন, আমরা আসলে আন্দোলনের কোন পরিকল্পনায় ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে এরকম ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার সকালে ছাত্রলীগের একাংশের নেতা লিখনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা, ভাংচুর এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধাদানের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে সাভার ও আশুলিয়া থানায় দুটি এবং আহত লিখনের মা সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিন মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৭৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। সাভার মডেল থানার ওসি মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, ছাত্রলীগের একাংশের নেতা তাহমিদুল ইসলাম লিখনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় তার মা কাজী জোহরা বেগম যে মামলাটি করেছেন তাতে নামসহ ৯ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় সাভার থানার এসআই সাজ্জাদ রোমন বাদী হয়ে ১০ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোস্তফা কামাল বলেন, দারোগা বিল্লাল হোসেনকে পিটিয়ে আহত করাসহ পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় এসআই বদরুল আলম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এতে আসামি হিসেবে ৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক-কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের ভাংচুর হামলার ঘটনা জাবির ইতিহাসে সেই। যেখানে কয়েক কোটি টাকার স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জানা গেছে, উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার হোসেন আজ শনিবার দুপুর ১২টায় সিনেট হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ ও শিক্ষক আন্দোলনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অস্থিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি হলেও এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। সঙ্কট নিরসনে ইউজিসি ছাত্র-শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে। অস্থিরতা নিরসন ও শিক্ষা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে শিক্ষক সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের স্ব-স্ব দায়িত্বের কথা স্মরণে রেখে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে কমিশন প্রত্যাশা করে। মঞ্জুরি কমিশন আরও বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রয়োজন মনে করলে ইউজিসি সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানে বদ্ধপরিকর। যে সময় দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২২ লাখের সীমা অতিক্রম করেছে যা চীন ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পরের স্থান অর্জন করে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সে সময় এ অচলাবস্থা মোটেও কাম্য নয়।
No comments