মহিলা ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা ও জনপ্রিয়তা by দিলরম্নবা কোহিনূর সুইটি

ঝিঁঝি পোকার' ইংরেজী নাম থেকে যে খেলার জন্ম, তার বয়স নিহায়ত কম নয়। ঝিঁঝি পোকার ইংরেজী নাম যদি জানা না থাকে তাহলে কষ্ট করে আর ডিকশনারি ঘাঁটার দরকার নেই। সেটি হচ্ছে ক্রিকেট। এই খেলার উৎপত্তিস্থল ঠিক কোথায়_ এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও বেশিরভাগ ক্রিকেট প-িতের মতে, ইংল্যান্ডই হচ্ছে ক্রিকেটের জন্মদাতা


(কারোর মতে ফ্রান্স)। যে দেশই হোক না কেন, ক্রিকেটের প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, সে বিষয়ে কোন বিতর্ক, মতানত্মর বা সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই জনপ্রিয়তার সিংহভাগই দাবিদার পুরম্নষ ক্রিকেট। পুরম্নষ ক্রিকেট নিয়ে মিডিয়া যতটা মাতামাতি, দাপাদাপি, লাফালাফি করে; তার সিকিভাগও মহিলা ক্রিকেটকে নিয়ে করে না। অথচ অবাক হলেও সত্য, আজকের ক্রিকেটকে জনপ্রিয়তার উচ্চশিখরে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি অবদান এই মহিলা ক্রিকেটেরই। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে জেনে নিন মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাস।
ইতিহাসের প্রথম মহিলা ক্রিকেট ম্যাচ
আজ থেকে ২৬৪ বছর আগের কথা। ইংরেজী পত্রিকা 'দ্য রিডিং মারকারি'তে প্রকাশিত হলো একটি ক্রিকেট ম্যাচের বিবরণ। তাতে জানা যায়, ১৭৪৫ সালের ২৬ জুলাই একটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ব্রেমলি বনাম হ্যামবেস্নডন গ্রামের মধ্যে। খেলাটি হয়েছিল সারেতে, গিলফোর্ডের কাছে। ম্যাচের বৈশিষ্ট্য হলো, এতে অংশ নেন মহিলারা এবং তাদের পরনে ছিল সাদা পোশাক। হ্যামবেস্নডন দলের ক্রিকেটাররা তাদের মাথায় লাল ও ব্রেমলি দলের ক্রিকেটাররা নীল ফিতা বেঁধে খেলেছিল। খেলার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। হ্যামবেস্নডনের ১২৭ রানের জবাবে ১১৯ রানে প্যাকেটবন্দী হয়ে যায় ব্রেমলি। এটিই ছিল তথ্য অনুযায়ী ইতিহাসের প্রথম মহিলা ক্রিকেট ম্যাচ।
কাগজ ঘেঁটে দ্বিতীয় ম্যাচটির কথাও জানা যায়। ১৩ জুলাই, ১৭৪৭ সাল। সাসেক্সের আর্টিলারি গ্রাউন্ডে মুখোমুখি হয় দু'টি দল। তাদের নাম উদ্ধার করা না গেলেও এটা জানা গেছে_ দলগুলোর একটি এসেছিল চার্লটন ও অপরটি এসেছিল ওয়েস্টডিন ও চিলগ্রোভ অঞ্চল থেকে। দুভার্গ্যজনকভাবে দলের নামের সঙ্গে খেলার রেজাল্টও জানা সম্ভব হয়নি। এরপর থেকে নিয়মিতই মহিলাদের ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছে সাসেক্স, হ্যাম্পশায়ার ও সারের আশপাশের গ্রামগুলোতে। বেশিরভাগ েেত্রই দল গ্রামভিত্তিক খেলা হলেও মাঝেমধ্যে দল গড়া হতো বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলাদের নিয়ে। পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী দলকে দেয়া হতো শীত নিবারণের জন্য হাতের দসত্মানা।
প্রথম কাউন্টি ম্যাচের ইতিহাস মহিলা ক্রিকেটের প্রথম কাউন্টি ম্যাচ হয় ১৮১১ সালে। অংশ নিয়েছিল সারে বনাম হ্যাম্পশায়ার। খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মিডলসেক্সের বল'স পন্ডে। মজার ব্যাপার, দ'ুদলে খেলেছিলেন ১৪ বছরের কিশোরী থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধারাও (ইউরোপে অবশ্য ৬০ বছরকে মোটেও বয়স্ক হিসেবে ধরা হয় না)!
ক্রিস্টিন উইলেস _ বোলিং ভঙ্গিমার আবিষ্কারক
আপনি কি জানেন, ক্রিকেট খেলা শুরম্ন হবার পর বোলারদের নির্দিষ্ট কোন বোলিং এ্যাকশন ছিল না? চাকিং ও আন্ডার আর্ম (মাটিতে গড়িয়ে দেয়া) ভঙ্গিতেই চলত গোলকবাজি। এটা কি জানেন, বর্তমানে নির্দিষ্ট মাত্রায় কনুই না ভেঙ্গে হাত ঘুরিয়ে যে বোলিং আমরা দেখি, সেই বোলিং এ্যাকশনের আবিষ্কারক ছিলেন একজন মহিলা? ১৮০০ সাল। ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার জন উইলেসের বোন ক্রিস্টিন উইলেস ছিলেন দারম্নণ ক্রিকেট অনুরাগী। বাড়ির উঠানে প্রায়ই ক্রিকেট খেলতেন ভাইয়ের সঙ্গে। লম্বা স্কার্ট আর লম্বা হাতার জন্য আন্ডার আর্ম বোলিং করতে ক্রিস্টিনার অসুবিধা হতো। এজন্য তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে হাত ঘুরিয়ে বল করলেন। আর তাতেই ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস ওঠে গেল। প্রতিটি বল খেলতে তার সমস্যা হচ্ছিল। ব্যস, সেই থেকে ব্যাপারটা চালু হয়ে গেল। হাত ঘুরিয়ে বোলিং।
প্রথম মহিলা ক্রিকেট কাব ১৮৮৭ সালে প্রথম মহিলা ক্রিকেট কাব প্রতিষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের নান এ্যাপেলটনে, নাম_ 'হোয়াইট হিদার কাব।' এই দলটির প্রতিটি ম্যাচেই প্রচুর পরিমাণে দর্শক হাজির থাকত। বিভিন্নস্থানে দলটি ম্যাচ খেলে অঢেল অর্থ উপার্জন করে। কাজেই সন্দেহাতীতভাবে এটাই ইতিহাসের প্রথম মহিলা পেশাদার ক্রিকেট কাব।
প্রথম মহিলা ক্রিকেট সংস্থা ইতিহাসের প্রথম মহিলা ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হয় ১৯২৬ সালে। ইংল্যান্ড দল এই সংস্থার অধীনে প্রথম মহিলা জাতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অস্ট্রেলিয়া তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৩১ সালে।
প্রথম মহিলা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ ও প্রথম শতক
ডিসেম্বর, ১৯৩৪। সিডনিতে পুরম্নষদের মতো ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরাও পরস্পরের মোকাবেলা করে প্রথম সরকারী টেস্ট ম্যাচে। ম্যাচগুলো ৪ দিনের ছিল। একটি ছিল ৩ দিনের। ২ ম্যাচে জয় ও ১টিতে ড্র করে শুভসূচনা করে ইংলিশ ললনারা। এরপর তারা জাহাজে চেপে পাড়ি জমায় অসিদের প্রতিবেশী দেশ নিউজিল্যান্ডে। সেখানে ক্রাইস্টচার্চে ইংলিশ 'ব্যাটসওম্যান' ব্যাটি বোল ১৮৯ রান করেন। এটিই ছিল মহিলাদের টেস্ট ম্যাচে ব্যক্তিগত প্রথম সেঞ্চুরি।
প্রথম আনত্মর্জাতিক মহিলা ক্রিকেট কাউন্সিল প্রথম আনত্মর্জাতিক মহিলা ক্রিকেট কাউন্সিল ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর অধীনে এখন পর্যনত্ম টেস্ট খেলুড়ে দেশের সংখ্যা ১০_ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, দণি আফ্রিকা, ভারত, পাকিসত্মান ও শ্রীলঙ্কা। এ পর্যনত্ম ১৩১টি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ২টি দেশই বেশি ম্যাচে অংশ নেয়। ১৯৮৫ সাল থেকে ৩ টেস্ট ম্যাচের দৈর্ঘ্য ৩ দিনের স্থলে বাড়িয়ে ৪ দিন করা হয়।
ব্যাটে-বলে-উইকেটকীপিংয়ে সেরারা টেস্টে এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সেরা ইনিংসটি ২৪২ রানের। এর 'মালিক' পাকিসত্মানের কিরণ বালুচ। ২০০৩ সালে উইন্ডিজের বিপ েকরাচীতে এই রান করেছিলেন তিনি। কিরণের মতো ডবল সেঞ্চুরিয়ান আরও ৫ জন আছেন। বল হাতে সেরা উদ্ভাসিত নৈপুণ্য ভারতের নীতু ডেভিডের। ইংল্যান্ডের বিপ ে৮ উইকেট পান তিনি। তাছাড়া তিনি এক ইনিংসে ৭টি করে উইকেট পান আরও ১০ বার! উভয় ইনিংস মিলিয়ে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড পাকিসত্মানের সাজিয়া খানের। ২০০৩ সালে উইন্ডিজের বিপ েকরাচীতে ২ ইনিংসে তাঁর বোলিং ফিগার ছিল : ২২৬ রানে ১৩ উইকেট। নারী-পুরম্নষ নির্বিশেষে অলরাউন্ডার হিসেবে ম্যাচে ১০ উইকেট ও শতক হাঁকিয়ে ইতিহাস গড়েন ১৯৫৮ সালে মেলবোর্নে। সবচেয়ে কম রানে বেশি উইকেট শিকারের (৭ রানে ৭ উইকেট) অস্ট্রেলিয়ার ইআর উইলসনের।
প্রথম মহিলা ওয়ানডে ও বিশ্বকাপ ক্রিকেট মজার ব্যাপার, মহিলাদের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচটিই ছিল প্রথম মহিলা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচ! এখানেও রেকর্ড। সেটা হলো পুরম্নষদের বিশ্বকাপের আগেই মহিলাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসর অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে। সেটা ১৯৭৩ সাল (পুরম্নষদের প্রথম বিশ্বকাপ হয় ১৯৭৫ সালে)। ব্যবসায়ী জ্যাক হাওয়ার্ড, রাজকুমারী এ্যানের উৎসাহে এই ঐতিহাসিক আসর বসে। ফাইনালে ৯২ রানে অসিদের হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় স্বাগতিক ইংলিশরা। যেখানে পুরম্নষদের ইংলিশ দল ৩ বার ফাইনাল খেলেও বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, সেখানে ইংলিশ মেয়েরা এই ৩ বারই চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাদের লজ্জায় ডোবানোর দায়িত্ব পালন করে (১৯৭৩, ৯৩, ২০০৯)। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ১৯৭৮, ৮২, ৮৮, ৯৭, ২০০৫ সালে ও নিউজিল্যান্ড ২০০০ সালে শিরোপা অর্জন করে। আইসিসির ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ (জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ এ্যান্ড টোবাগো, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, দণি আফ্রিকা, ভারত, পাকিসত্মান, স্কটল্যান্ড, জাপান, ডেনমার্ক, শ্রীলঙ্কা ও আনত্মর্জাতিক একাদশ। ২০০৯ সালের বিশ্বকাপ পর্যনত্ম মোট একদিনের ম্যাচ হয়েছে ৭০৭টি।
৩টি অনন্য বিশ্বরেকর্ড যদি প্রশ্ন করা হয় ওয়ানডেতে এক ইনিংসে ব্যক্তিগত, দলীয় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন রান কত, তাহলে সবাই বলবেন_ ১৯৪ রান (চার্লস কভেন্ট্রি ও সাঈদ আনোয়ার), ৯/৪৪৩ রান (শ্রীলঙ্কা বনাম হল্যান্ড, এ্যামিস্টিলেভেন, ২০০৫) ও ৩৫ রান (জিম্বাবুইয়ে, বনাম শ্রীলঙ্কা, হারারে, ২০০৪)। উত্তর সঠিক হলো কি? হয়নি। সঠিক উত্তরটি জেনে নিন। পুরম্নষদের একদিবসীয় ক্রিকেটে কোন্ উইলোবাজ প্রথম ডবল সেঞ্চুরি করে তুলকালাম কা- ঘটাবেন, এই জল্পনা-কল্পনা অনেকদিন ধরেই চলছে। কিন্তু এই মহাকীর্তি আজ থেকে এক যুগ আগেই ১৯৯৭ সালে গড়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটি খোদাই করে রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসওম্যান বেলিন্ডা কার্ক। ১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত বিশ্বকাপে তিনি ডেনমার্কের বোলারদের ধরে 'শিলপাটায় মরিচের মতো গুঁড়ো' করে সংগ্রহ করেন হার না মানা ২২৯ রান। ১৯৯৭ সালে ক্রাইস্টচার্চে পাকিসত্মানকে তুলোধুনো করে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের মেয়েরা ৫/৪৫৫ রান তুলে বিশ্বরেকর্ডের জন্ম দেয় (এছাড়া এ ম্যাচেই দলীয় সবচেয়ে বেশি রানের জয়টিও পায় কিউইরা, ৪০৮ রানের)। ডেভেন্টারে ২০০৮ সালে ক্যারিবীয়দের সঙ্গে হল্যান্ডের মেয়েরা মাত্র ২২ রানে অলআউট হয়ে লজ্জার সাগরে নিপতিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.