ধর্ম-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা রোজাদারের কর্তব্য by আবদুস সবুর খান
রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও দোজখের আগুন থেকে মুক্তির মাস মাহে রমজান। এ মাসের এত ফজিলত ও মর্যাদা যে দীর্ঘ ১১ মাস মোমিন মুসলমানগণ এই মাসটির আগমনের অপেক্ষা করেন। তবে বাংলাদেশের জীবনবাস্তবতায় অসচ্ছল ও নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ রমজানের আগমনের বার্তা শুনে খুশি হওয়ার পরিবর্তে আতঙ্কিত হয়।
কারণ, রোজা এলেই অবধারিতভাবে ভোজ্যতেল, ডাল, ছোলা, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পায়। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়, অথচ তাদের কোনো আয় বাড়ে না। রহমতের মাস তাদের জন্য আনন্দদায়ক না হয়ে, হয়ে ওঠে কষ্টের, বিরক্তির। ১০-১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের এটিই হয়ে উঠেছে নির্মম বাস্তবতা।
ত্যাগ, সংযম আর কৃচ্ছ্রসাধনের এই মাসে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ কী?
কিছু কারণ আমরা সবাই জানি। এর জন্য সবার আগে আমরা ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করি। কারণ, দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে অধিক মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশই মুসলমান এবং রোজাদার। তাঁরাও সাধারণ রোজাদারদের মতো রোজা রাখেন, ইফতার করেন, মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করেন। তাঁদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য আমদানি করে বাজার দামে বিক্রয় করে, তার উপার্জনে আল্লাহর রহমত রয়েছে। আর যে ব্যক্তি আমদানি করে চড়া দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করে রাখে, তাদের প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের প্রতি জুলুম করে আর কূটকৌশলে বা অবৈধ পন্থায় অর্থ আয় করে, তাদের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম।’ অথচ রাসুল (সা.)-এর এই বাণীর প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি অন্যতম কারণ চাহিদা বৃদ্ধি। এটি অর্থনীতির একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম—চাহিদা বৃদ্ধি পেলে দাম বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের এই মাসে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণ কী? রমজান মাস হচ্ছে ভোজনলিপ্সা বা রসনা নিয়ন্ত্রণের মাস। কিন্তু বাস্তবে এ মাসে আমরা রোজাদারেরা কী করছি—সংযম না রসনাবিলাস, কৃচ্ছ্রসাধন নাকি কেনাকাটার নিমিত্তে কাড়াকাড়ি? উত্তর আমাদের জানা। এ মাসে আমরা সামর্থ্যবান রোজাদারেরা অন্য সব মাসের তুলনায় বহুগুণ বেশি ভোগ্যসামগ্রী ক্রয় করছি। দিনের বেলায় কোনোমতে না খেয়ে থেকে ইফতার থেকে সেহির পর্যন্ত সময়ের রসনাতৃপ্তির জন্য নানা রকম দ্রব্য জোগাড়ের অসুস্থ প্রয়াস আমাদের রোজার মূল লক্ষ্য ত্যাগ ও সংযম থেকে বিচ্যুত করে ভোগলিপ্সা ও রসনাবিলাসে লিপ্ত করছে। ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাভাবিক কারণেই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিপাকে পড়ছে স্বল্প আয় ও নিম্নবিত্তের সাধারণ রোজাদারগণ। রমজান তাঁদের জন্য রহমতের মাস না হয়ে হয়ে উঠছে কষ্টের মাস, ভোগান্তির মাস।
আমরা যে শুধু ভোগ করছি তা-ই নয়, বরং আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের দান না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইফতারের আয়োজনে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে অপব্যয়ও করছি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অপব্যয়কারীকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য দেবে, আর অভাবগ্রস্ত ও পথচারীকেও, আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা অবশ্যই শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭)
আমাদের প্রাত্যহিক ইফতারির তালিকায় যেসব খাদ্যদ্রব্য থাকে, সেগুলোও কিন্তু রসনাবিলাসসামগ্রী। ভাজাপোড়া, মাংস-কাবাব ইত্যাকার বাহারি খাদ্যসামগ্রীতে (বাংলাদেশে যেগুলো ইফতারসামগ্রী হিসেবে পরিচিত) বিকেল থেকেই অলিগলি সরগরম হয়ে ওঠে। আর রোজাদারেরাও এসব সামগ্রী দিয়ে ইফতার করার জন্য লাইন ধরে কিনতে থাকেন। অথচ রাসুল (সা.) এসব ভাজাপোড়া সামগ্রী দিয়ে ইফতার করাকে অপছন্দ করেছেন। তিনি ফলজাতীয় সামগ্রী দিয়ে ইফতার করাকে পছন্দ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোজা থেকে ইফতার করে, তখন তার খুরমা-খেজুর দিয়ে ইফতার করা উচিত। যদি তা না পায়, তবে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কারণ পানি হচ্ছে পাক-পবিত্র।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসুল (সা.) এবং সাহাবি ও তাবেয়ীগণের যুগে রমজান মাসে বাজারদর সবচেয়ে মন্দা যেত। পণ্যসামগ্রীর চাহিদা থাকত সবচেয়ে কম। তাঁরা কেনাকাটা না করে ঘুরে ঘুরে গরিব-দুঃখীদের দান-সদকা করতেন। এখনো আরব দেশগুলোতে রোজার মাসে বাজারে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা থাকে স্বাভাবিক, দ্রব্যমূল্যও বাড়ে না। আমাদেরও রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা ও জোগানদাতানির্বিশেষে সব রোজাদারেরই সমান ভূমিকা রাখা উচিত। ব্যবসায়ী রোজাদারদের যেমন অধিক মুনাফার লোভ না করে অধিক সওয়াবের আশায় এই মাসে কম লাভে পণ্য বিক্রি করায় উৎসাহিত হওয়া উচিত, ভোক্তা রোজাদারদেরও তেমনি রসনাবিলাসের নিমিত্তে অধিক কেনাকাটা না করে বরং সওয়াব লাভের আশায় সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধন করে অধিক পরিমাণে দান-সদকায় উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। তাহলে রমজান মাসে একদিকে দ্রব্যমূল্য যেমন নিয়ন্ত্রিত থাকবে, অন্যদিকে গরিব-দুঃখীরাও মাহে রমজানের প্রকৃত কল্যাণ লাভ করবে।
আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
ত্যাগ, সংযম আর কৃচ্ছ্রসাধনের এই মাসে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ কী?
কিছু কারণ আমরা সবাই জানি। এর জন্য সবার আগে আমরা ব্যবসায়ীদেরই দায়ী করি। কারণ, দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে অধিক মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশই মুসলমান এবং রোজাদার। তাঁরাও সাধারণ রোজাদারদের মতো রোজা রাখেন, ইফতার করেন, মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করেন। তাঁদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য আমদানি করে বাজার দামে বিক্রয় করে, তার উপার্জনে আল্লাহর রহমত রয়েছে। আর যে ব্যক্তি আমদানি করে চড়া দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করে রাখে, তাদের প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের প্রতি জুলুম করে আর কূটকৌশলে বা অবৈধ পন্থায় অর্থ আয় করে, তাদের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম।’ অথচ রাসুল (সা.)-এর এই বাণীর প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি অন্যতম কারণ চাহিদা বৃদ্ধি। এটি অর্থনীতির একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম—চাহিদা বৃদ্ধি পেলে দাম বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের এই মাসে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণ কী? রমজান মাস হচ্ছে ভোজনলিপ্সা বা রসনা নিয়ন্ত্রণের মাস। কিন্তু বাস্তবে এ মাসে আমরা রোজাদারেরা কী করছি—সংযম না রসনাবিলাস, কৃচ্ছ্রসাধন নাকি কেনাকাটার নিমিত্তে কাড়াকাড়ি? উত্তর আমাদের জানা। এ মাসে আমরা সামর্থ্যবান রোজাদারেরা অন্য সব মাসের তুলনায় বহুগুণ বেশি ভোগ্যসামগ্রী ক্রয় করছি। দিনের বেলায় কোনোমতে না খেয়ে থেকে ইফতার থেকে সেহির পর্যন্ত সময়ের রসনাতৃপ্তির জন্য নানা রকম দ্রব্য জোগাড়ের অসুস্থ প্রয়াস আমাদের রোজার মূল লক্ষ্য ত্যাগ ও সংযম থেকে বিচ্যুত করে ভোগলিপ্সা ও রসনাবিলাসে লিপ্ত করছে। ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাভাবিক কারণেই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিপাকে পড়ছে স্বল্প আয় ও নিম্নবিত্তের সাধারণ রোজাদারগণ। রমজান তাঁদের জন্য রহমতের মাস না হয়ে হয়ে উঠছে কষ্টের মাস, ভোগান্তির মাস।
আমরা যে শুধু ভোগ করছি তা-ই নয়, বরং আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের দান না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইফতারের আয়োজনে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে অপব্যয়ও করছি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অপব্যয়কারীকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য দেবে, আর অভাবগ্রস্ত ও পথচারীকেও, আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা অবশ্যই শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭)
আমাদের প্রাত্যহিক ইফতারির তালিকায় যেসব খাদ্যদ্রব্য থাকে, সেগুলোও কিন্তু রসনাবিলাসসামগ্রী। ভাজাপোড়া, মাংস-কাবাব ইত্যাকার বাহারি খাদ্যসামগ্রীতে (বাংলাদেশে যেগুলো ইফতারসামগ্রী হিসেবে পরিচিত) বিকেল থেকেই অলিগলি সরগরম হয়ে ওঠে। আর রোজাদারেরাও এসব সামগ্রী দিয়ে ইফতার করার জন্য লাইন ধরে কিনতে থাকেন। অথচ রাসুল (সা.) এসব ভাজাপোড়া সামগ্রী দিয়ে ইফতার করাকে অপছন্দ করেছেন। তিনি ফলজাতীয় সামগ্রী দিয়ে ইফতার করাকে পছন্দ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোজা থেকে ইফতার করে, তখন তার খুরমা-খেজুর দিয়ে ইফতার করা উচিত। যদি তা না পায়, তবে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কারণ পানি হচ্ছে পাক-পবিত্র।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসুল (সা.) এবং সাহাবি ও তাবেয়ীগণের যুগে রমজান মাসে বাজারদর সবচেয়ে মন্দা যেত। পণ্যসামগ্রীর চাহিদা থাকত সবচেয়ে কম। তাঁরা কেনাকাটা না করে ঘুরে ঘুরে গরিব-দুঃখীদের দান-সদকা করতেন। এখনো আরব দেশগুলোতে রোজার মাসে বাজারে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা থাকে স্বাভাবিক, দ্রব্যমূল্যও বাড়ে না। আমাদেরও রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা ও জোগানদাতানির্বিশেষে সব রোজাদারেরই সমান ভূমিকা রাখা উচিত। ব্যবসায়ী রোজাদারদের যেমন অধিক মুনাফার লোভ না করে অধিক সওয়াবের আশায় এই মাসে কম লাভে পণ্য বিক্রি করায় উৎসাহিত হওয়া উচিত, ভোক্তা রোজাদারদেরও তেমনি রসনাবিলাসের নিমিত্তে অধিক কেনাকাটা না করে বরং সওয়াব লাভের আশায় সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধন করে অধিক পরিমাণে দান-সদকায় উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। তাহলে রমজান মাসে একদিকে দ্রব্যমূল্য যেমন নিয়ন্ত্রিত থাকবে, অন্যদিকে গরিব-দুঃখীরাও মাহে রমজানের প্রকৃত কল্যাণ লাভ করবে।
আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
No comments