পদ্মা সেতু প্রকল্প: দেশীয় অর্থেই কাজ শুরু হবে। সরকারের আশা, দাতারা পরে সম্পৃক্ত হবে-পদ্মা সেতু নির্মাণে নতুন দরপত্র এ মাসেই by আনোয়ার হোসেন
দেশীয় অর্থেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া প্রাথমিক বাছাইয়ে যোগ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্যও চিঠি দেবে সরকার। আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই ঠিকাদারদের চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সেতু বিভাগ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার চুক্তির মেয়াদ ৩১ জুলাই থেকে এক মাস বাড়ানো হয়েছে। সেতু বিভাগ এই সময়ের মধ্যেই সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করতে চায়। সরকারের আশা, নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করার পর অন্য দাতাদেরও সম্পৃক্ত করা যাবে।
জানতে চাইলে যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে কাজ শুরু হয়ে গেছে। খুব শিগগির ঠিকাদারদের চিঠি দেওয়া হবে। চলতি অর্থবছরেই নির্মাণকাজ শুরু করার লক্ষ্য সরকারের। তিনি আরও বলেন, দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হবে। তবে এই কাজে প্রচুর ডলার দরকার হবে। সে ক্ষেত্রে অন্য উন্নয়ন সহযোগী কিংবা দেশকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টাও হচ্ছে।
আবার দরপত্র আহ্বান: সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শক নিয়োগসহ ছয়টি কাজের প্রাক্-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১০ ও ২০১১ সালে। সব দরপত্রের মূল্যায়ন শেষ করে সম্ভাব্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয় সে সময়। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকেই প্রতিটি কাজের জন্য একটি করে ঠিকাদার চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করার কথা ছিল। কিন্তু অনুমোদনের জন্য পাঠানোর পর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঋণচুক্তি স্থগিত করে দেয় বিশ্বব্যাংক। বাকি উন্নয়ন সহযোগীরাও বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করলে সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গত ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক।
এ পরিস্থিতিতে এখন দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাকেযাগ্য হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেই মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তবে প্রথমে মূল সেতু ও নদী শাসনের দরপত্রের কার্যক্রম শুরু হবে বলে সেতু বিভাগ জানিয়েছে।
সেতু বিভাগের সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য প্রকল্প কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বিদেশে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে কার্যক্রম আরও জোরদার হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ছয়টি কাজের মধ্যে মূল সেতুর জন্য পাঁচটি, নদী শাসনের জন্য ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। অন্য দরপত্রগুলোতেও পাঁচ থেকে সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হয়। তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্যও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছিল। দরপত্র মূল্যায়ন ও কারিগরি বিষয় দেখার জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
সূত্র জানায়, পুনরায় কার্যক্রম শুরুর অংশ হিসেবে জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে দরপত্র মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে সেতু ভবনে বৈঠক করেছেন। সব দরপত্রের দলিলই তৈরি করেছিল পদ্মা সেতুর নকশাপ্রণেতা প্রতিষ্ঠান মনসেল একম। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। পুনরায় দরপত্র কার্যক্রম চালুর প্রাক্কালে তাদের সঙ্গেও চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া চলছে বলে সূত্র জানায়।
কত টাকা লাগবে: দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে আগামী চার বছরে কী পরিমাণ টাকা লাগবে, তারও একটা হিসাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগ। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে। কিন্তু বরাদ্দ আছে ৮০০ কোটি টাকা। পরবর্তী দুই বছরে লাগবে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা করে। শেষ বছর প্রয়োজন হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর পরও কিছু সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বাকি থাকবে এবং সেটা সেতু উদ্বোধনের পর সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ঠিকাদারদের যে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে দেশীয় অর্থায়নের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে বলে পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা সবগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণকাজে আগ্রহী না হলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে।
দাতাদের সঙ্গে আলোচনা: এদিকে দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতারা সম্পৃক্ত হবে বলে সরকারের আশা। অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা নিরসনে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছে, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রসিকিউশন ও দক্ষ অনুসন্ধানী টিম গঠনে তারা সম্মত। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শর্ত পূরণ করায় বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বলে বিবৃতি দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, পুনর্বিবেচনার কথা বলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংককে সরাসরি কোনো চিঠি লেখেনি, আবেদনও করেনি। একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক এম নন্দন প্রসাদকে। বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি তারা পায়নি। তবে এম নন্দন প্রসাদ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে তাঁরা জেনেছেন। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক এলেন গোন্ডস্টেইন এখন ওয়াশিংটন আছেন। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে করণীয় কিছু নেই বলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন।
এদিকে শর্ত পূরণ নিয়েও কিছু বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা গ্রহণ করা হয়নি। গেজেট প্রকাশ হয়নি। আবার বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়নি বলেও সূত্রগুলো বলছে। বিশেষ করে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় একজনের নাম রয়েছে, যিনি এখনো বহাল আছেন। তা ছাড়া সরকারের মধ্য থেকেও বিশ্বব্যাংক নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য ও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। এতেও নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকাসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অতীতের দেওয়া নির্দেশনা মেনেই পুনরায় কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। যাতে বিশ্বব্যাংক ও অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা এগিয়ে এলে নতুন করে সংঘাত সৃষ্টি না হয় এবং নতুন দরপত্র আহ্বানের ঝামেলা এড়ানো যায়। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের মধ্যে আহ্বান করা দরপত্রের ওপর ভিত্তি করেই প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা সরকারের। সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন সহযোগীর নিজ নিজ নির্দেশনা (গাইড লাইন) আছে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই নতুন দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। যাতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা মিটে গেলে তাদের সঙ্গে কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থান সৃষ্টি না হয়।
তদারকি পরামর্শক নিয়োগ: মূল সেতু ও নদী শাসনের পাশাপাশি তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ-প্রক্রিয়াও নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে সেতু বিভাগ। কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে ওই দরপত্রের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডভিত্তিক হালক্রো গ্রুপকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। হালক্রো গ্রুপের যমুনা সেতু প্রকল্পেরও তদারিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
এর আগে সেতু বিভাগ গত বছর এসএনসি-লাভালিনকে তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। এসএনসি-লাভালিনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল। এরপরই বিশ্বব্যাংক এই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ আনে। কানাডায় এ নিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বব্যাংকও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভাও এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা হালক্রো গ্রুপকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
জানতে চাইলে যোগাযোগ ও রেলপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে কাজ শুরু হয়ে গেছে। খুব শিগগির ঠিকাদারদের চিঠি দেওয়া হবে। চলতি অর্থবছরেই নির্মাণকাজ শুরু করার লক্ষ্য সরকারের। তিনি আরও বলেন, দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হবে। তবে এই কাজে প্রচুর ডলার দরকার হবে। সে ক্ষেত্রে অন্য উন্নয়ন সহযোগী কিংবা দেশকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টাও হচ্ছে।
আবার দরপত্র আহ্বান: সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক নির্মাণ, সার্ভিস এলাকা নির্মাণ, নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শক নিয়োগসহ ছয়টি কাজের প্রাক্-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১০ ও ২০১১ সালে। সব দরপত্রের মূল্যায়ন শেষ করে সম্ভাব্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয় সে সময়। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকেই প্রতিটি কাজের জন্য একটি করে ঠিকাদার চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করার কথা ছিল। কিন্তু অনুমোদনের জন্য পাঠানোর পর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঋণচুক্তি স্থগিত করে দেয় বিশ্বব্যাংক। বাকি উন্নয়ন সহযোগীরাও বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করলে সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গত ২৯ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক।
এ পরিস্থিতিতে এখন দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাকেযাগ্য হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেই মূল দরপত্রে অংশ নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তবে প্রথমে মূল সেতু ও নদী শাসনের দরপত্রের কার্যক্রম শুরু হবে বলে সেতু বিভাগ জানিয়েছে।
সেতু বিভাগের সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য প্রকল্প কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরুর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বিদেশে আছেন। তিনি দেশে ফিরলে কার্যক্রম আরও জোরদার হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ছয়টি কাজের মধ্যে মূল সেতুর জন্য পাঁচটি, নদী শাসনের জন্য ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। অন্য দরপত্রগুলোতেও পাঁচ থেকে সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হয়। তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্যও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছিল। দরপত্র মূল্যায়ন ও কারিগরি বিষয় দেখার জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
সূত্র জানায়, পুনরায় কার্যক্রম শুরুর অংশ হিসেবে জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে দরপত্র মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে সেতু ভবনে বৈঠক করেছেন। সব দরপত্রের দলিলই তৈরি করেছিল পদ্মা সেতুর নকশাপ্রণেতা প্রতিষ্ঠান মনসেল একম। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। পুনরায় দরপত্র কার্যক্রম চালুর প্রাক্কালে তাদের সঙ্গেও চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া চলছে বলে সূত্র জানায়।
কত টাকা লাগবে: দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলে আগামী চার বছরে কী পরিমাণ টাকা লাগবে, তারও একটা হিসাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগ। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে। কিন্তু বরাদ্দ আছে ৮০০ কোটি টাকা। পরবর্তী দুই বছরে লাগবে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা করে। শেষ বছর প্রয়োজন হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর পরও কিছু সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বাকি থাকবে এবং সেটা সেতু উদ্বোধনের পর সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ঠিকাদারদের যে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে দেশীয় অর্থায়নের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে বলে পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা সবগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণকাজে আগ্রহী না হলে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে।
দাতাদের সঙ্গে আলোচনা: এদিকে দেশীয় অর্থায়নে কাজ শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতারা সম্পৃক্ত হবে বলে সরকারের আশা। অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা নিরসনে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছে, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রসিকিউশন ও দক্ষ অনুসন্ধানী টিম গঠনে তারা সম্মত। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শর্ত পূরণ করায় বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বলে বিবৃতি দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, পুনর্বিবেচনার কথা বলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংককে সরাসরি কোনো চিঠি লেখেনি, আবেদনও করেনি। একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক এম নন্দন প্রসাদকে। বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি তারা পায়নি। তবে এম নন্দন প্রসাদ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে তাঁরা জেনেছেন। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক এলেন গোন্ডস্টেইন এখন ওয়াশিংটন আছেন। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে করণীয় কিছু নেই বলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন।
এদিকে শর্ত পূরণ নিয়েও কিছু বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা গ্রহণ করা হয়নি। গেজেট প্রকাশ হয়নি। আবার বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়নি বলেও সূত্রগুলো বলছে। বিশেষ করে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় একজনের নাম রয়েছে, যিনি এখনো বহাল আছেন। তা ছাড়া সরকারের মধ্য থেকেও বিশ্বব্যাংক নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য ও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। এতেও নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকাসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের অতীতের দেওয়া নির্দেশনা মেনেই পুনরায় কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। যাতে বিশ্বব্যাংক ও অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা এগিয়ে এলে নতুন করে সংঘাত সৃষ্টি না হয় এবং নতুন দরপত্র আহ্বানের ঝামেলা এড়ানো যায়। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালের মধ্যে আহ্বান করা দরপত্রের ওপর ভিত্তি করেই প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা সরকারের। সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন সহযোগীর নিজ নিজ নির্দেশনা (গাইড লাইন) আছে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই নতুন দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। যাতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা মিটে গেলে তাদের সঙ্গে কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থান সৃষ্টি না হয়।
তদারকি পরামর্শক নিয়োগ: মূল সেতু ও নদী শাসনের পাশাপাশি তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ-প্রক্রিয়াও নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে সেতু বিভাগ। কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে ওই দরপত্রের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডভিত্তিক হালক্রো গ্রুপকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। হালক্রো গ্রুপের যমুনা সেতু প্রকল্পেরও তদারিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
এর আগে সেতু বিভাগ গত বছর এসএনসি-লাভালিনকে তদারকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিল। এসএনসি-লাভালিনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল। এরপরই বিশ্বব্যাংক এই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ আনে। কানাডায় এ নিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বব্যাংকও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভাও এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা হালক্রো গ্রুপকে নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
No comments