তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলের কয়েদখানা by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
দু'টি প্রধান কারণে তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে : সামরিক শক্তির সঙ্গে দণিপন্থী মতার ট্রাডিশনাল যুক্ততার েেত্র ভাঙ্গন এবং দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে : রাষ্ট্র শক্তি অর্থাৎ পর্দার অন্তরালের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে পপুলার মুভমেন্টের উদ্ভব।
তত্ত্বাবধায়ক সামরিক শক্তির ল্য দণিপন্থী রাজনৈতিক শক্তির পুনর্নির্মাণ এবং পুনর্বাসন করা। সেই পুনর্নির্মাণ এবং পুনর্বাসনের জন্য নির্যাতন জরুরী। সামরিক শক্তির ল্য তাদের নিজস্ব পলিটিক্যাল শাসন রিএসার্ট ও কনসলিডেট করা। সে জন্য দরকার গণআতঙ্ক।
সামরিক স্ট্র্যাটেজির কতিপয় ল্য : ১. রাষ্ট্রের এ্যাপারাটাস রা করা; ২. সিভিলিয়ান প্রতিরোধকে বিভক্ত করা এবং দণিপন্থী সামরিক কতর্ৃত্বের অধীন করা; এবং ৩. রাজনীতিবিদদের হাত থেকে দেশ শাসনের ভার কেড়ে নেয়া। তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা গ্রেফতারকালীন সময় সম্বন্ধে লিখেছেন, তাদের লেখা পড়লে সামরিক স্ট্র্যাটেজি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন জিজ্ঞাসাবাদকারী বললেন, 'আপনি কি আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন।' আমার চোখ বাঁধা ছিল। আমি যে টুলে বসেছিলাম এর থেকে কিছু দূরে কাউকে পেটানোর শব্দ আর 'মাগো, মাগো' আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। আমি বললাম, শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন টেবিলে জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল, 'এটা আপনার েেত্রও হতে পারে।' আতঙ্কে আমি বোবা হয়ে গেলাম। বেশ অসহায় বোধ করছিলাম, আমাকে মনে হয় কোন টর্চার সেলে রেখেছিল এরা। স্বপ্নেও ভাবিনি ৭০ বছর বয়সে এসে এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
আমি আর্মি অফিসারদের কথা ভাবছিলাম। এদের নিয়েই কি আমরা এত গর্ব করি? এদের বয়স কত? চিৎকার তখনও শোনা যাচ্ছিল। এরাই কি বাংলার সোনার ছেলেরা? এদের কি প্রশিণ দেয়া হয় বড়দের সঙ্গে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের? এরা কি পরিবারের েেত্রও এতটা নিষ্ঠুর? কিংবা সাধারণ নাগরিকদের প্রতিও মিলিটারি একাডেমীতে মানবিক মূল্যবোধ শিা দেয়া হয় না? আমি জানতাম সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য হলো বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রা করা। সেনাবাহিনী কাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে? এদের পারিবারিক ইতিহাস কি? এরা কি চাষার সন্তান? এরা কি সরকারী চাকরিজীবী নাকি সেনা কর্মকর্তাদের ঘর থেকে এসেছে? রাজনীতিকদের ওপর এদের এত রাগ কেন? এই নোংরা কাজের আদেশ তাদের কে দিয়েছে? এসব যখন ভাবছিলাম একজন এসে চেন আর রড দিয়ে আমার হাত পেছনে বাঁধল। আমি মনে করেছিলাম এরা মনে হয় পুরোপুরি পিঠ ও হাঁটু চেন দিয়ে বাঁধবে। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানীরা ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে বাঁধত। তারা অবশ্য তা করল না। খোলাখুলিভাবেই বলল, 'আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য চিৎকার শোনানো হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'এ সবের মানে কি?' তারা বেশ বিরক্তের সঙ্গেই দেশের পরিস্থিতির কথা বলল। হঠাৎ করে সবাই উঠে দাঁড়াল। আমার সঙ্গে আবার কথা বলবে বলে চলে গেল। দু'জন এসে আমার দুই হাত ধরে নিয়ে চলল। সরু গলি দিয়ে একটি ছোট রুমে আমাকে আনল। রুমের দরজা-জানালা টিনের পাত দিয়ে বন্ধ করা ছিল। কোন ভেন্টিলেশন ছিল না। খাট ছিল কিন্তু সেখানে তোষক, বালিশ এমনকি চাদরও ছিল না। রুমের কোনায় প্রস্রাব করার জন্য একটি মগ ছিল। লোকগুলো আমার চোখ খুলে দিয়ে রুম তালাবদ্ধ করে চলে যায়। অন্ধকার সেই ঘরে আমাকে কাটাতে হয় সকাল থেকে প্রায় আট ঘণ্টা, একাকী। নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হচ্ছিল। আমাকে কেন গ্রেফতার করে এখানে আনা হলো? নিজেই বার বার প্রশ্ন করছিলাম। আমি সদুত্তর পাইনি। পত্রিকায় দুনর্ীতিবাজদের তালিকায় আমার নামও ছিল না। আর এ ব্যাপারে কোন দুর্নামও ছিল না। সুতরাং আমি ধরে নিলাম আমার গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ছিল রাজনৈতিক এবং আমি এর বিশেষ শিকার।
এই যুবক অফিসারদের বোধ করি শেখানো হয়নি, একটি দেশের উদ্ভব রাজনীতির মধ্য দিয়ে এবং রাজনীতিকরাই দেশ গঠন করে। রাষ্ট্রই রাজনীতি, রাজনীতিই রাষ্ট্র। রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র হতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে মানুষ প্রত্য করেছে রাজনীতিবিহীন সমাজ হচ্ছে পাগলামি, অবৈজ্ঞানিক উন্মত্ততা। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এগুলোর ধ্বংস মানে রাষ্ট্রের ধ্বংস। আমাদের অফিসারসহ সমরনায়কদের মনে হয় স্বাধীনতা বা ইতিহাস সম্পর্কে দায়সারা গোছের পাঠ দেয়া হয়। বাংলাদেশের জন্ম সম্বন্ধে তাদের গভীর দৃষ্টিপাত করা উচিত। এদের কেউই মনে হয় ভাষা আন্দোলন দেখেনি, কোনদিন মানবতার খাতিরে জেলও খাটেনি, '৬৯-এর গণঅভু্যত্থান বা '৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে কৃষক-ছাত্রদের আত্মদানও এদের কাছে মনে হতে পারে গল্পের মতো। বর্তমান সেনাপ্রধানও তখন তরুণ ছিলেন এবং স্বাধীনতার পরে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ছিল না। রাজীতিবিদরা দেশের জন্য কিছুই করেননি। এ রকম কথা তারা বলতেই পারে।' (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, রিমান্ডের দিনগুলো, যুগান্তর, ১ জানুয়ারি ২০১০)
নির্যাতনের আর এক ইতিহাস লিখেছেন, ওবায়দুল কাদের : 'শেরাটন হোটেল পার হলে দু'জনই বলল : স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনার চোখ কালো কাপড়ে ঢাকতে হবে। কিছু করার নেই, উপরের অর্ডার। আমার তো তখন না করার উপায় নেই। বুঝে ফেললাম, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ি যতই এগিয়ে চলছে, মনের কষ্ট ততই বাড়ছে। জানি না, সামনে আরও কত কষ্ট আছে কপালে। অসুস্থ শরীরে এই বয়েসে নির্যাতন করলে কী যে হবে ভাবতেও শিউরে উঠছিলাম। তবু নিজেকে নিয়তির কাছে সপে দিয়ে মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। কপালে যা আছে তাই হবে। নতুন করে চোখ বেঁধে শুইয়ে দেয়া হলো। ভারি গলায় একজন বললেন, ভয় নেই, আপনার মেডিক্যাল চেকআপ হবে। শার্ট খুলে ইসিজির যন্ত্রপাতি চিত হয়ে শোয়া শরীরে সেট করা হলো। বুঝে নিলাম, সামনে র্'ণবযণর্্রলমল্র মরঢণটফ' আমার জন্য অপো করছে। ডাক্তার বললেন : ভালই তো আছে। তারপর ডবল কালো পট্টি বেঁধে একটা কাঠের আসনে বসিয়ে দেয়া হলো। বলতে বলতেই 'টর্চার' শুরু হয়ে গেল। তিনটি গ্রুপ একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। প্রথম গ্রুপ আচরণে খারাপ। দ্বিতীয় গ্রুপ ভয় প্রদর্শনে পটু। তৃতীয় গ্রুপ নরম গলায় সত্য বলতে অনুরোধ করছিল। মনে হলো ওখানকার এটাই নিয়ম। এভাবে বিভীষিকাময় রাতটা শেষ প্রহরে উপনীত হলে আপাতত বিরতি। তারপর ডাক্তারি পরীা অন্ধকারে উদোম দাঁড় করিয়ে। হয়ত আলো ছিল। কিন্তু আমার চোখ জুড়ে কেবলই অন্ধাকারের ভয়ঙ্কর ছবি। একজন সিপাহী হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা রুমে। চোখ খুলে দিল। আলো দেখলাম প্রলম্বিত অন্ধকার শেষে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। রুমে সাধারণ একটা ছোট খাট, একটি মাত্র কম্বল, কভার ছাড়া বালিশ। জানালা বন্ধ। ভাগ্যিস ফ্যান ছিল একটা। তবে তার খটখট বিশ্রী আওয়াজে ঘুম পালাতে বাধ্য। দরজায় একটা টোকা দিতেই ম্লান হাসি দিয়ে জওয়ান বলল, বাথরুমে যাবেন? আবার চোখ বেঁধে বাথরুমে নিয়ে গেল। চোখ খুলে দরজা বন্ধ করে দিল। সেই বাথরুমের যা অবস্থা। কোনো রকমে অজু করে আবার চোখ বন্ধ অবস্থায় গৃহে প্রবেশ। এক থালায় ডাল-ভাত-সবজির সঙ্গে এক টুকরো মাছ। ুধায় এই খাবার অমৃত মনে হলো। নামাজ পড়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়তেই ভাবলাম আবার কখন ডাক পড়বে। রুমটিতে শোবার খাট ছাড়া আসবাবপত্র বলতে আর কিছুই নেই। কান্ত অবসন্ন যন্ত্রণাময় শরীরটা খাটে এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে গেল। ঘড়ি নেই। মনে হয় ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে প্রচণ্ড ব্যথায় উঠতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। তবু কোন রকমে টয়লেট সারলাম। এসেই দেখলাম মেঝেতে এক প্লেটে ব্রেকফাস্ট। দুই রুটি, এক ডিম। খাওয়া শেষ হতেই সিপাহী দরজা খুলে বলল, এুনি রেডি হয়ে নিন। স্যাররা এসে গেছেন। আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত। ভয়াল রাতের স্মৃতি মনে করে ভীষণ ভয় ভয় করছিল। উপায় নেই। রেডি হলাম। চোখ বন্ধ করে আবার কোথায় যেন নিয়ে গেল। আবারও ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গেল। টার্গেট শেখ হাসিনা। তাঁকে ঘিরেই এত জিজ্ঞাসাবাদ। আমার দুনর্ীতি কিংবা অন্য কোন অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন নেই। সত্য সেটাই যেটা আমার কাছে তারা শুনতে চায়। সেই পরিবেশে সত্যের নামে কত মিথ্যাই না বলতে বাধ্য হলাম। বলতে হবে, এ দেশের সব সর্বনাশের মূলে শেখ হাসিনা। বলতে হবে, শেখ হাসিনা দুনর্ীতিবাজ। বলতে হবে, শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের মদদদাতা, বাস পোড়ানোর হোতা। না বললে ভয়ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন।' ( যে কথা বলা হয়নি, ২০০৯)।
এই হচ্ছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ইতিহাস, কি প্রক্রিয়ায় তারা নির্যাতন করে, তার ইতিহাস।
সামরিক স্ট্র্যাটেজির কতিপয় ল্য : ১. রাষ্ট্রের এ্যাপারাটাস রা করা; ২. সিভিলিয়ান প্রতিরোধকে বিভক্ত করা এবং দণিপন্থী সামরিক কতর্ৃত্বের অধীন করা; এবং ৩. রাজনীতিবিদদের হাত থেকে দেশ শাসনের ভার কেড়ে নেয়া। তত্ত্বাবধায়ক সামরিক আমলে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা গ্রেফতারকালীন সময় সম্বন্ধে লিখেছেন, তাদের লেখা পড়লে সামরিক স্ট্র্যাটেজি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন জিজ্ঞাসাবাদকারী বললেন, 'আপনি কি আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন।' আমার চোখ বাঁধা ছিল। আমি যে টুলে বসেছিলাম এর থেকে কিছু দূরে কাউকে পেটানোর শব্দ আর 'মাগো, মাগো' আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। আমি বললাম, শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন টেবিলে জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল, 'এটা আপনার েেত্রও হতে পারে।' আতঙ্কে আমি বোবা হয়ে গেলাম। বেশ অসহায় বোধ করছিলাম, আমাকে মনে হয় কোন টর্চার সেলে রেখেছিল এরা। স্বপ্নেও ভাবিনি ৭০ বছর বয়সে এসে এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
আমি আর্মি অফিসারদের কথা ভাবছিলাম। এদের নিয়েই কি আমরা এত গর্ব করি? এদের বয়স কত? চিৎকার তখনও শোনা যাচ্ছিল। এরাই কি বাংলার সোনার ছেলেরা? এদের কি প্রশিণ দেয়া হয় বড়দের সঙ্গে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের? এরা কি পরিবারের েেত্রও এতটা নিষ্ঠুর? কিংবা সাধারণ নাগরিকদের প্রতিও মিলিটারি একাডেমীতে মানবিক মূল্যবোধ শিা দেয়া হয় না? আমি জানতাম সেনাবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য হলো বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রা করা। সেনাবাহিনী কাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে? এদের পারিবারিক ইতিহাস কি? এরা কি চাষার সন্তান? এরা কি সরকারী চাকরিজীবী নাকি সেনা কর্মকর্তাদের ঘর থেকে এসেছে? রাজনীতিকদের ওপর এদের এত রাগ কেন? এই নোংরা কাজের আদেশ তাদের কে দিয়েছে? এসব যখন ভাবছিলাম একজন এসে চেন আর রড দিয়ে আমার হাত পেছনে বাঁধল। আমি মনে করেছিলাম এরা মনে হয় পুরোপুরি পিঠ ও হাঁটু চেন দিয়ে বাঁধবে। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানীরা ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে বাঁধত। তারা অবশ্য তা করল না। খোলাখুলিভাবেই বলল, 'আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য চিৎকার শোনানো হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'এ সবের মানে কি?' তারা বেশ বিরক্তের সঙ্গেই দেশের পরিস্থিতির কথা বলল। হঠাৎ করে সবাই উঠে দাঁড়াল। আমার সঙ্গে আবার কথা বলবে বলে চলে গেল। দু'জন এসে আমার দুই হাত ধরে নিয়ে চলল। সরু গলি দিয়ে একটি ছোট রুমে আমাকে আনল। রুমের দরজা-জানালা টিনের পাত দিয়ে বন্ধ করা ছিল। কোন ভেন্টিলেশন ছিল না। খাট ছিল কিন্তু সেখানে তোষক, বালিশ এমনকি চাদরও ছিল না। রুমের কোনায় প্রস্রাব করার জন্য একটি মগ ছিল। লোকগুলো আমার চোখ খুলে দিয়ে রুম তালাবদ্ধ করে চলে যায়। অন্ধকার সেই ঘরে আমাকে কাটাতে হয় সকাল থেকে প্রায় আট ঘণ্টা, একাকী। নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হচ্ছিল। আমাকে কেন গ্রেফতার করে এখানে আনা হলো? নিজেই বার বার প্রশ্ন করছিলাম। আমি সদুত্তর পাইনি। পত্রিকায় দুনর্ীতিবাজদের তালিকায় আমার নামও ছিল না। আর এ ব্যাপারে কোন দুর্নামও ছিল না। সুতরাং আমি ধরে নিলাম আমার গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা ছিল রাজনৈতিক এবং আমি এর বিশেষ শিকার।
এই যুবক অফিসারদের বোধ করি শেখানো হয়নি, একটি দেশের উদ্ভব রাজনীতির মধ্য দিয়ে এবং রাজনীতিকরাই দেশ গঠন করে। রাষ্ট্রই রাজনীতি, রাজনীতিই রাষ্ট্র। রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র হতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে মানুষ প্রত্য করেছে রাজনীতিবিহীন সমাজ হচ্ছে পাগলামি, অবৈজ্ঞানিক উন্মত্ততা। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এগুলোর ধ্বংস মানে রাষ্ট্রের ধ্বংস। আমাদের অফিসারসহ সমরনায়কদের মনে হয় স্বাধীনতা বা ইতিহাস সম্পর্কে দায়সারা গোছের পাঠ দেয়া হয়। বাংলাদেশের জন্ম সম্বন্ধে তাদের গভীর দৃষ্টিপাত করা উচিত। এদের কেউই মনে হয় ভাষা আন্দোলন দেখেনি, কোনদিন মানবতার খাতিরে জেলও খাটেনি, '৬৯-এর গণঅভু্যত্থান বা '৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে কৃষক-ছাত্রদের আত্মদানও এদের কাছে মনে হতে পারে গল্পের মতো। বর্তমান সেনাপ্রধানও তখন তরুণ ছিলেন এবং স্বাধীনতার পরে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ছিল না। রাজীতিবিদরা দেশের জন্য কিছুই করেননি। এ রকম কথা তারা বলতেই পারে।' (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, রিমান্ডের দিনগুলো, যুগান্তর, ১ জানুয়ারি ২০১০)
নির্যাতনের আর এক ইতিহাস লিখেছেন, ওবায়দুল কাদের : 'শেরাটন হোটেল পার হলে দু'জনই বলল : স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনার চোখ কালো কাপড়ে ঢাকতে হবে। কিছু করার নেই, উপরের অর্ডার। আমার তো তখন না করার উপায় নেই। বুঝে ফেললাম, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গাড়ি যতই এগিয়ে চলছে, মনের কষ্ট ততই বাড়ছে। জানি না, সামনে আরও কত কষ্ট আছে কপালে। অসুস্থ শরীরে এই বয়েসে নির্যাতন করলে কী যে হবে ভাবতেও শিউরে উঠছিলাম। তবু নিজেকে নিয়তির কাছে সপে দিয়ে মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। কপালে যা আছে তাই হবে। নতুন করে চোখ বেঁধে শুইয়ে দেয়া হলো। ভারি গলায় একজন বললেন, ভয় নেই, আপনার মেডিক্যাল চেকআপ হবে। শার্ট খুলে ইসিজির যন্ত্রপাতি চিত হয়ে শোয়া শরীরে সেট করা হলো। বুঝে নিলাম, সামনে র্'ণবযণর্্রলমল্র মরঢণটফ' আমার জন্য অপো করছে। ডাক্তার বললেন : ভালই তো আছে। তারপর ডবল কালো পট্টি বেঁধে একটা কাঠের আসনে বসিয়ে দেয়া হলো। বলতে বলতেই 'টর্চার' শুরু হয়ে গেল। তিনটি গ্রুপ একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। প্রথম গ্রুপ আচরণে খারাপ। দ্বিতীয় গ্রুপ ভয় প্রদর্শনে পটু। তৃতীয় গ্রুপ নরম গলায় সত্য বলতে অনুরোধ করছিল। মনে হলো ওখানকার এটাই নিয়ম। এভাবে বিভীষিকাময় রাতটা শেষ প্রহরে উপনীত হলে আপাতত বিরতি। তারপর ডাক্তারি পরীা অন্ধকারে উদোম দাঁড় করিয়ে। হয়ত আলো ছিল। কিন্তু আমার চোখ জুড়ে কেবলই অন্ধাকারের ভয়ঙ্কর ছবি। একজন সিপাহী হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা রুমে। চোখ খুলে দিল। আলো দেখলাম প্রলম্বিত অন্ধকার শেষে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। রুমে সাধারণ একটা ছোট খাট, একটি মাত্র কম্বল, কভার ছাড়া বালিশ। জানালা বন্ধ। ভাগ্যিস ফ্যান ছিল একটা। তবে তার খটখট বিশ্রী আওয়াজে ঘুম পালাতে বাধ্য। দরজায় একটা টোকা দিতেই ম্লান হাসি দিয়ে জওয়ান বলল, বাথরুমে যাবেন? আবার চোখ বেঁধে বাথরুমে নিয়ে গেল। চোখ খুলে দরজা বন্ধ করে দিল। সেই বাথরুমের যা অবস্থা। কোনো রকমে অজু করে আবার চোখ বন্ধ অবস্থায় গৃহে প্রবেশ। এক থালায় ডাল-ভাত-সবজির সঙ্গে এক টুকরো মাছ। ুধায় এই খাবার অমৃত মনে হলো। নামাজ পড়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়তেই ভাবলাম আবার কখন ডাক পড়বে। রুমটিতে শোবার খাট ছাড়া আসবাবপত্র বলতে আর কিছুই নেই। কান্ত অবসন্ন যন্ত্রণাময় শরীরটা খাটে এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে গেল। ঘড়ি নেই। মনে হয় ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে প্রচণ্ড ব্যথায় উঠতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। তবু কোন রকমে টয়লেট সারলাম। এসেই দেখলাম মেঝেতে এক প্লেটে ব্রেকফাস্ট। দুই রুটি, এক ডিম। খাওয়া শেষ হতেই সিপাহী দরজা খুলে বলল, এুনি রেডি হয়ে নিন। স্যাররা এসে গেছেন। আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত। ভয়াল রাতের স্মৃতি মনে করে ভীষণ ভয় ভয় করছিল। উপায় নেই। রেডি হলাম। চোখ বন্ধ করে আবার কোথায় যেন নিয়ে গেল। আবারও ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গেল। টার্গেট শেখ হাসিনা। তাঁকে ঘিরেই এত জিজ্ঞাসাবাদ। আমার দুনর্ীতি কিংবা অন্য কোন অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন নেই। সত্য সেটাই যেটা আমার কাছে তারা শুনতে চায়। সেই পরিবেশে সত্যের নামে কত মিথ্যাই না বলতে বাধ্য হলাম। বলতে হবে, এ দেশের সব সর্বনাশের মূলে শেখ হাসিনা। বলতে হবে, শেখ হাসিনা দুনর্ীতিবাজ। বলতে হবে, শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের মদদদাতা, বাস পোড়ানোর হোতা। না বললে ভয়ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন।' ( যে কথা বলা হয়নি, ২০০৯)।
এই হচ্ছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ইতিহাস, কি প্রক্রিয়ায় তারা নির্যাতন করে, তার ইতিহাস।
No comments