আনোয়ারায় ভূমি অধিগ্রহণ-উচ্চ আদালত চেয়েছিলেন মূল ফাইল, ডিসি পাঠান ফটোকপি!

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। প্রায় দুই হাজার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। এ অধিগ্রহণপ্রক্রিয়া অস্বচ্ছ এবং অধিগ্রহণ বেআইনিভাবে করা হচ্ছে দাবি করে দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন।


অথচ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনার প্রতি কোনো সম্মান দেখাচ্ছেন না।
সূত্র জানায়, জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জানতে মূল ফাইল তলব করেছিলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ উচ্চ আদালতে মূল ফাইল পাঠাননি। পাঠিয়েছেন সত্যায়িত ফটোকপি আর মূল ফাইল নিয়ে কার্যক্রম চালিয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে মূল ফাইল না পাঠিয়ে সত্যায়িত ফটোকপি পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর কামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মূল অর্ডার না দেখে মন্তব্য করা যাবে না। তবে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী উচ্চ আদালতে মূল ফাইলই পাঠাতে হয়।'
জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নোটে ভূমি মন্ত্রণালয়কে ওই ভূমির বিষয়ে নতুন রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশনা দেন। কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে, রিপোর্ট দাখিল না করে সরাসরি অধিগ্রহণ অনুমোদিত হয়েছে মর্মে মন্ত্রণালয় থেকে একটি নথি জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ কার্যক্রম চালায়। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কাজ স্থগিত করতে উচ্চ আদালত থেকে ফাইল চেয়ে পাঠানো হলেও ডিসি মূল ফাইল না পাঠিয়ে ফটোকপি পাঠানোর ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাইকোর্ট ফাইল তলব করা মানেই কোনো কার্যক্রম স্থগিত রাখা, ডিসি সাহেবের উচিত ছিল সে নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো।
ভূমি অধিগ্রহণপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও ভুল থাকায় এ-সংক্রান্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুলনিশি জারি করে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো) বজায় রাখার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু প্রতিপক্ষ সিপিএলএ দাখিল করে চেম্বার জজের মাধ্যমে স্ট্যাটাস কো স্থগিত করে। তবে গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর আদালতে মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পিডিবির প্রকল্প নিয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জনস্বার্থে ওই রিট করেন। এর রায়ে ওই এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ছাড়পত্র বা পূর্বানুমতি নেওয়া ছাড়া কোনো ধরনের উন্নয়নকাজ না করার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়।
আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্ট গার্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণ। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর, বিমানবাহিনী, চট্টগ্রাম বন্দর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরসহ যেসব কর্তৃপক্ষ বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কারো কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) সংগ্রহ করেননি ডিসি।
আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির একটি প্রতিবেদনেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ওই কমিটির প্রতিবেদনে আনোয়ারার পরিবর্তে বাঁশখালী থানার খানখানাবাদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশকেও পাত্তা দিচ্ছেন না জেলা প্রশাসক।
উল্লেখ্য, বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি কম্পানি দেশের বৃহত্তম তেল শোধনাগার নির্মাণের জন্য আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর মৌজায় ২০০৩ ও ২০০৬ সালে তিন ক্যাটাগরির ৩৫৭.৪৫ একর জমি অত্যন্ত স্বচ্ছ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদি লিজ, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ৫০ বছরের জন্য লিজ গ্রহণ এবং বৈধ মালিকদের কাছ থেকে কিনে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এর উন্নয়ন করেছে। প্রস্তাবিত এ তেল শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার, পরোক্ষভাবে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এই জমি বাবদ বসুন্ধরা গ্রুপ জেলা প্রশাসনকে নিয়মিতভাবে শিল্পভূমি হারে খাজনা দিয়ে আসছে, লিজ ভাড়া বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বছরে আট কোটি ৪৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে আসছে, ভ্যাট ও উৎসে কর পরিশোধ করছে বছরে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ভূমি উন্নয়ন, সীমানাবাঁধ নির্মাণ, ভাঙন রোধের ব্যবস্থা ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে এ জমিকে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.