জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি-কমরেড নলিনী দাস by নজরুল হক অনু

ব্রিটিশ বিতাড়ন আন্দোলনে যে ক'জন অগি্নপুরুষ সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের একজন কমরেড নলিনী দাস। তাঁর বাহাত্তর বছর জীবনকালের তেইশ বছর কেটেছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বন্দী জীবনসহ হিজলী, আলীপুর আর প্রেসিডেন্সী কারাগারে। দেশভাগের পর পাকিস্তানের কারাগারেও থাকতে হয়েছে।


জেল-জীবনের বাইরের বাকি জীবনের ২০ বছর ৯ মাস তাঁকে থাকতে হয়েছে আত্মগোপন করে দুই বাংলার পথে প্রান্তরে।
১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৪০ সালের সত্যাগ্রহ, ৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিযুদ্ধ, নৌ বিদ্রোহসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন চলছিল তখনও নলিনী দাস ছিলেন কারাবাসে।
ব্রিটিশরাজের রোষানলে পড়ে তিনি জীবনভর কারাগার আর আত্মগোপনে থাকার কারণে সংসার জীবন থেকে বিচু্যত ছিলেন। বিয়েও করতে পারেননি। পারেননি মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিাগ্রহণ করতে।
বিপ্লবী হিসেবে এক সময় নলিনী দাসের পরিচিতি ছিল গোটা ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে। সেই নলিনী দাস এখন বিস্মৃতির পথে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটি নাম ছাড়া আর কিছুই নন তিনি। জন্মস্থান ভোলায় তাঁর নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকার সুবাদে এলাকাবাসী তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত হলেও এক সময়ের ভারতবর্ষ কাঁপানো রাজনীতিককে নিয়ে এখন কেউই আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। জানবার সুযোগ পাচ্ছেন না এই মহান ব্যক্তির আত্মত্যাগের সেই সাহসী কীর্তিগাথা সম্বন্ধে। ১ জানুয়ারি ১৯১০ এই মহান বিপ্লবীর জন্মদিন। ১ জানুয়ারি ২০১০ ছিল তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী। আজ থেকে ১শ' বছর আগে তিনি ভোলার প্রখ্যাত জমিদার কালীনাথ রায়ের নায়েব দুর্গামোহন দাসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান উত্তর শাহবাজপুর গ্রাম। প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর আভিজাত্য কোন কিছুতেই তাঁর কমতি ছিল না। কিন্তু এর কিছুই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে পারেনি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। চলেছেন সাধারণ মানুষের মাঝে। নিবেদিত ছিলেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে।
মাত্র ১১ বছর বয়সে নলিনী দাস পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯২১ সালে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির আহ্বানে হরতাল ও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন এবং ভোলায় যে ৫ জন তরুণ গ্রেফতার হন নলিনী দাস ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক কিশোর। ১৯২৮ সালে তিনি ভোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা (মেট্রিক) পাস করেন। একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে গোটা বরিশাল অঞ্চলে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। অগি্নযুগের বিপ্লবী তৎপরতায় যুক্ত থাকার কারণে তিনি লেখাপড়া খুব একটা করতে পারেননি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এনট্রান্স পাশ করেছিলেন প্রথম বিভাগে এবং আত্মগোপন অবস্থায়ই।
১৯৩৩ সালের ঘটনা। ২২ মে পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দেয়। দরজা ভেঙ্গে পুলিশ ভেতরে ডুকে হ্যান্ডস আপ বলামাত্রই বিপ্লবীরা পুলিশকে ল্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে পুলিশের ডিএসপি পোলার্ড ও গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর মুকুন্দ ভট্টাচার্য আহত হন। অপর দিকে পুলিশের গুলিতেও বিপ্লবীরা আহত হয়ে ধরা পড়েন। এ সময় নলিনী দাস গুলি করতে করতে ৩টি বাড়ির ছাদ লাফিয়ে দূরে চলে যান। কিন্তু তাঁর গুলি শেষ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। গ্রেফতারের পর বিচারে দীনেশ মজুমদারকে ফাঁসির আদেশ ও নলিনী দাসকে দ্বীপান্তরে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রথমে তাঁকে পাঠানো হয়ে আলীপুর জেলে। সেখানে তিনি জেল জীবনের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিবাদে অসুস্থ অবস্থায়ও ১৫ দিন অনশন পালন করেন। সেখান থেকে তাঁকে প্রেসিডেন্সী জেল এবং পরবতর্ীতে আন্দামানে পাঠানো হয়। তিনি ব্রিটিশদের কাছে ডেঞ্জারাস বন্দী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে তাঁকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নেয়া হয়। সেখানে বসে তিনি সাম্যবাদে দীা নেন। ভারতবর্ষকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। দ্বীপান্তরে বন্দী কমিউনিস্ট মতবাদে দীতিদের নিয়ে গোপন গ্রুপ গঠন, কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গঠন, মে দিবস পালন, সেলুলার জেলকে বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার আন্দোলন ও শিা কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ গ্রহণ ও পাঠদান, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, হাতে লেখা কাগজ 'দি কল' প্রকাশসহ জেল জীবনের উন্নয়ন এবং নানাবিধ কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন। ফলে ১৯৩৫ সালের ২৬ এপ্রিল কমিউনিস্ট কনসলিডেশন সংগঠিত হয় এবং ১ মে ৩৫ জন কমিউনিস্ট প্রকাশ্যে এই কনসলিডেশনে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দামান বন্দীরাসহ নলিনী দাস মুক্তি পেলেন। ১৩ বছর পর নলিনী দাস আলোর পথে ফিরে এলেন। দেশভাগের পর তিনি এ দেশে থেকে পুনরায় নির্যাতনের শিকার হলেন। ৪৮ থেকে ৫০ সাল পর্যন্ত আত্মগোপন, ৫০ থেকে ৫৬ সাল পর্যন্ত পুনরায় আত্মগোপন করে থাকেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণই ছিল তাঁর অপরাধ। ৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভারতে গিয়ে তিনি প্রশিণ লাভ করেন। তিনি '৭২ থেকে '৮২ পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জেল-জুলুম-নির্যাতন, পলাতক জীবনযাপন করার কারণে তিনি শেষ জীবনে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। ৮২ সালে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর অনুরাগী, বন্ধুবান্ধব এবং আন্দামানের সহযোদ্ধারা উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসা করান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে। চিকিৎসার জন্য তাঁর হিতাকাঙ্ীরা তাঁকে তাঁর ভোলার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির পরামর্শ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভোলার সকল সম্পত্তি তাঁর বাবা দুর্গামোহন দাসের নামে 'দুর্গামোহন দাস জনকল্যাণ ট্রাস্ট' করে জনকল্যাণে দান করেন। তাঁর সম্পত্তিতে ভোলায় এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, একটি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস, কিন্ডারগার্টেন আর পাঠাগার চলছে। কয়েক কোটি টাকার সম্পদ তিনি দান করে গেলেও তাঁর স্মৃতি শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ফলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। তাঁর ভোলার অনুসারীরা তাঁর যথার্থ সম্মান আর মর্যাদা অুণ্ন রাখতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। মহান এই ব্যক্তি তাঁর কোটি কোটি টাকার সম্পদ জনস্বার্থে দান করে বলতে গেলে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য সহযোগিতায় নামমাত্র চিকিৎসায় দীর্ঘ তিন মাস মৃতু্যর সঙ্গে লড়ার পর ৮২ সালের ১৯ জুন মৃতু্যবরণ করেন। দেশভাগের পর মাতৃভূমির টানে নলিনী দাস এই ভূখণ্ডে থেকে গেলেন। এমনকি সবকিছু ফেলে একেবারে নিজ বাড়ি শহরের ওয়েস্টার্ন পাড়ার বাসায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বহু লোভনীয় প্রস্তাব তিনি উপো করে এখানে থেকে গেলেন। তাঁর সহকমর্ীদের অনেকে যখন ভারতের মন্ত্রিসভায়, সংসদে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে তখনও নলিনী দাস জন্মভূমি ভোলার মানুষের কল্যাণে স্বপ্ন দেখেছেন। কাজ করেছেন নীরবে নিভৃতে। এ বছর ১ জানুয়ারি তাঁর জন্মশত বার্ষিকী উপল েঘুরে দাঁড়িয়েছে দুর্গামোহন দাস জনকল্যাণ ট্রাস্ট। আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হচ্ছে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।

No comments

Powered by Blogger.