বিশ্লেষণ-ফলাফলে বিশাল চমক by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

১০ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার রেকর্ড ফল হয়েছে। পাসের হার এবং জিপিএ ৫ উভয় সংখ্যাই গতবারের চেয়ে বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার ইতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে ফলাফলে।


গতকাল বুধবার চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একসময় পরীক্ষায় নকল নামের যে ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল, তা এখন নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় অনেক মনোযোগী। অভিভাবকরা সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক যত্নবান হয়েছেন। শিক্ষকরা খাতা দেখায় আগের চেয়ে অনেক উদার। নম্বর দিতে কার্পণ্য করেন না। এসবের পাশাপাশি এবার ইংরেজি, বিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ভালো করেছে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলায় সার্বিক পাসের হার বেড়েছে।
চমকপ্রদ এই ফলের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ঝরে পড়া কমে গেছে। সে জায়গায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের ওপর মনিটরিং বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় তাঁরাও এখন পাঠদানের প্রতি আন্তরিক হয়েছেন।
আন্তশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ায় ফলের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগমও জানান, প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় ভালো ফল হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করছে। অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতা বেড়েছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে বাংলা
উচ্চ মাধ্যমিকে এবারই প্রথম একটি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এর সুফলও দেখা গেছে। এই পদ্ধতিতে নেওয়া বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় পাসের হার ৯৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার যেসব শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে বাংলা পরীক্ষা দিয়েছে, তারা প্রথমবারের মতো এসএসসিতেও ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতিতে বাংলা পরীক্ষা দিয়েছিল। অর্থাৎ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু হওয়ার প্রথম ব্যাচ এই পরীক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতেও শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। এতে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীরা এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
বিষয়ভীতি কমেছে : উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। এবারের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা এই কয়টি বিষয়ে বেশ ভালো করেছে।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৮৭.৩৮ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮২.৮৪ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৮৭.৭৭ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮৮.১৮ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৮৭.১৬ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭৬.৯৩ শতাংশ। যশোর বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৭২.৬৮ শতাংশ, গত বছর ছিল ৬৭.১৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৭৭.৫৭ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮০.৫১ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৮৪ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮১ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৯১.৪০ শতাংশ, গত বছর ছিল ৮১.৮১ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজিতে এবার পাসের হার ৮৩.৮৫ শতাংশ, গত বছর ছিল ৭৩.৯৫ শতাংশ।
পদার্থবিজ্ঞানে ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৮৬.৯৫, রাজশাহীতে ৭৫.৮৪, কুমিল্লায় ৭৭.৬৫, যশোরে ৭৭.১৮, চট্টগ্রামে ৮৩.৫৭, বরিশালে ৯৩.৩৮, সিলেট ৮৭.৫০, দিনাজপুরে ৭৭.২৯ শতাংশ।
রসায়ন বিজ্ঞানে ঢাকা বোর্ডে ৯০.৭৩, রাজশাহী বোর্ডে ৮২.৯৫, কুমিল্লা বোর্ডে ৮২.৮৪, যশোর বোর্ডে ৮৬.৩০, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮৩.১০, বরিশাল বোর্ড ৯৩.১২, সিলেট বোর্ডে ৯৪.২০ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ৮০.৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
হিসাববিজ্ঞানে ঢাকা বোর্ডে ৯৮.৪২, রাজশাহী বোর্ডে ৯৪.৬৮, কুমিল্লা বোর্ডে ৯৫.৪৫, যশোর বোর্ডে ৯৮.৪০, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৯৭.৫২, বরিশাল বোর্ড ৮৮.৭৯, সিলেট বোর্ডে ৯৭.৩৪ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ৯১.৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন এ বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এতেই প্রমাণিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা কঠিন বিষয়গুলোকে আয়ত্ত করতে পারছে। এ কারণে এসব কঠিন বিষয়েও পাসের হার বেড়েছে।
মেধাবীর সংখ্যা বাড়ছে : এবারের ফলের সঙ্গে অতীতের ফল তুলনা করে দেখা গেছে, মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এখন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের কাগজে-কলমে মেধাবী বলা হয়। এবার আট বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫১ হাজার ৪৬৯ জন শিক্ষার্থী। এক বছরে মেধাবীর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ হাজার ৮৪ জন।
বাণিজ্য বিভাগে সবচেয়ে বেশি পাস : এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় গ্রুপভিত্তিক ফলে দেখা যায়, বিজ্ঞান ও মানবিকের চেয়ে ব্যবসায় শিক্ষায় বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। বাণিজ্যে ৮৪.১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর মধ্যে ছাত্র ৮২.৫৩ এবং ছাত্রী ৮৬.৮৭ শতাংশ। বিজ্ঞানে পাসের হার ৭৮.৩৮ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্র ৭৬.৭৫ এবং ছাত্রী ৮০.৯৭ শতাংশ। মানবিকে ৭০.৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর মধ্যে ছাত্র ৬৮.৪০ এবং ছাত্রী ৭২.৩৪ শতাংশ।
ছাত্রীরা এগিয়ে : প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো করেছে। সব বোর্ডের অধীনে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে চার লাখ ৯০ হাজার ৯১৮ জন ছাত্র এবং চার লাখ ২৬ হাজার ৭৫৫ জন ছাত্রী। এর মধ্যে পাস করেছে ছাত্র তিন লাখ ৮৪ হাজার ৪২ জন এবং ছাত্রী তিন লাখ ৩৭ হাজার ৯৩৭ জন। ছাত্রদের পাসের হারে ৭৮.২৩ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ৭৯.১৯ শতাংশ। মেয়েদের পাসের হার বাড়াকে আশা জাগানিয়া বলে উল্লেখ করছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
মফস্বলের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছে : শহরের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। আছে নানা সীমাবদ্ধতা। এমন সুবিধাবঞ্চিত মফস্বলের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট সাত হাজার ৪৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৩ জন পরীক্ষার্থী এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ফলের ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলেও পরিবর্তন এসেছে। গ্রামে সাধারণত মানবিক বিভাগে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এবার মানবিকে ভালো ফল হয়েছে। এতে বোঝা যায়, ভালো করার প্রতিযোগিতা শুধু শহরে নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় মফস্বলের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অতীতের সীমাবদ্ধতা আর থাকবে না বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
ঘুরেফিরে একই প্রতিষ্ঠান : প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ভালো ফলের ক্ষেত্রে এবারও সেই পুরনো চিত্র দেখা গেছে। ঘুরেফিরে পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই ভালো করেছে। ঢাকা বোর্ডে সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নটর ডেম কলেজ, রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করেছে। পাশাপাশি ক্যাডেট কলেজগুলোও শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। অন্য বোর্ডগুলোতেও পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোই ভালো করেছে।
মাদ্রাসা বোর্ড এবারও আলোচনায় : কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় মাদ্রাসা বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষায় এবারও তাক লাগানো ফল হয়েছে। সাধারণ বোর্ডে যেখানে সর্বোচ্চ পাসের হার ৮৫.৩৭ শতাংশ, সেখানে মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯১.৭৭ শতাংশ। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এত ভালো ফলের কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসায় কম ইংরেজি পড়তে হয়। সাধারণে যেখানে ২০০ নম্বরের ইংরেজি পড়তে হয়, সেখানে তাদের পড়তে হয় ১০০ নম্বরের। এটিও একটি কারণ।
তবে মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর নূর জানান, সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের কারণে ফল ভালো হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষকরাও আন্তরিক। মাদ্রাসার ছাত্ররা বেশি সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা আকাশ সংস্কৃতির সুযোগ কম নেয়। মূলত এসব কারণেই ফল ভালো হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.