বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় গত ১৯ নবেম্বর ঘোষিত হয়। -এরপর পাঁচ বিচারপতি গত ১৭ ডিসেম্বর সে ঐতিহাসিক রায়ে স্বার করেন। রায়টির পূর্ণ বিবরণ এখানে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো_

পূর্ব প্রকাশের পর) এইভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ ও ৮৮ ধারার শর্তাবলী পূরণ করা হয়। উপরোক্ত আসামীরা পলাতক থাকায় বিধির ৩৩৯ খ ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নোটিস সংবাদপত্রে যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। নথিপত্রে আরও দেখা গেছে যে, পলাতকদের আদালতে হাজির করার জন্য সকল সম্ভাব্য ও বাস্তবানুগ পদপে নেয়া হয়েছিল।


বিজ্ঞ দায়রা জজ তাঁর ৭.৪.১৯৯৭ তারিখের ১৫ নং আদেশবলে আসামীদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত অভিযোগ গঠন করেন।
প্রথম অভিযোগ : আসামীরা প্রয়াত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রয়াত মাহবুবুল আলম চাষী, রিসালদার সৈয়দ সারোয়ার হোসেন ও ক্যাপ্টেন এম মোস্তফা হোসেনের যোগসাজশে তাদের ব্যক্তিগত ােভের প্রতিবিধান করা, যৌথ স্বার্থ হাসিল করা এবং অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার ল্যে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনদের হত্যা করার জন্য ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস থেকে বিভিন্ন তারিখে ও বিভিন্ন স্থানে যথা ঢাকা সেনানিবাসে লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের বাসভবনে, কুমিল্লার বার্ড-এ, গাজীপুরের শালনায়, খন্দকার মোশতাক আহমদের গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি থানার দাসপাড়ায় ও ঢাকার বাসভবন ৫৪ নং আগামসি লেনে, রমনা পার্কে, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের সেনানিবাসস্থ বাসভবন ও অন্যান্য স্থানে একত্রে মিলিত হয় ও ষড়যন্ত্র করে। এই ল্য অর্জনের জন্য তারা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের দিবাগত রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানার অন্তর্গত বালুঘাটে সমবেত হয় এবং নিজেদের ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করতে গিয়ে আসামীরা ১৫ আগস্ট সকালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনসহ ১১ ব্যক্তিকে হত্যা করে। এইভাবে তারা দণ্ডবিধির ১২০ খ ধারার অধীন এক অপরাধ সংঘটিত করে।
দ্বিতীয় অভিযোগ : উক্ত পূর্বকল্পিত ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নিতে এবং নিজেদের অভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে (উক্ত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ল্য বাস্তবায়িত করতে) প্রথম অভিযোগে উলি্লখিত আসামীরা প্রয়াত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রয়াত মাহবুবুল আলম চাষী, রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হোসেন ও ক্যাপ্টেন এম মোশতাক আহমেদের যোগসাজশে তাদের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মধ্য দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ এবং যৌথ স্বার্থ ও উচ্চাভিলাষ হাসিল করার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান, রাইফেলের মতো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নং রোডের ৬৭৭নং বাড়িটিতে হামলা চালায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল ও ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে। তাছাড়া তারা পুলিশের এএসআই সিদ্দিকুর রহমান, সেনাবাহিনীর সিপাই শামসুল হক এবং রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকেও হত্যা করে এবং এইভাবে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটিত করে।
বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ জজ ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্যপ্রমাণ গায়েব করার কারণ ঘটানোর জন্য দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় আরেকটি অভিযোগও গঠন করেন।
আপীলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) বিচারিক আদালতে উপস্থিত ছিল। তারা অভিযোগসমূহের ব্যাপারে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে এবং সুবিচার প্রার্থনা করে। তাদের পছন্দক্রমে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাদের প সর্থন করে। অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীরা বাকি ১৪ জন পলাতক আসামীর প সমর্থন করেন।
সরকার প ৬১ জন সাীর সা্য গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাীকে টেন্ডার করা হয় এবং বিবাদী প তাদের জেরা করেনি। বিবাদী প কোন সা্যপ্রমাণও হাজির করেনি। সরকার পরে সাীদের সা্য গ্রহণ শেষ হবার পর কাঠগড়ায় তিন আপীলকারীকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় জেরা করা হয়। জেরার জবাবে তারা পুনরায় নিজেদের নির্দেষ দাবি করে। জেরার ধরন থেকে আসামী পরে অবস্থান বুঝা গিয়েছিল। তারা অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, আপীলকারীরা নির্দোষ এবং যেভাবে অভিযোগ করা হয়েছে ঘটনা সেভাবে ঘটেনি যতটা না ঘটেছে সেনাবাহিনীর কিছু লোকের সফল বিদ্রোহের পরিণতি হিসাবে।
বিচারিক আদালত এরপর রেকর্ডভুক্ত সা্যপ্রমাণ এবং মামলার প্রকৃত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৮. ১১. ১৯৯৮ তারিখে রায় ও আদেশক্রমে চারজন আসামি যথা ১) তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, ২) অনারারি ক্যাপ্টেন এ ওয়াহাব জোয়ার্দার ৩) দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ৪) এলডি মোঃ আবুল হামেশ মৃধা (পলাতক)কে খালাস দেন এবং বাকি ১৫ জন আসামীকে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা ও ১২০খ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আপীলকারীরাসহ এই ১৫ জন আসামীর সবাইকে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় মৃতু্যদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং তাদের ওপর দণ্ডবিধির ১২০খ ধারায় পৃথক কোন দণ্ডাদেশ আরোপিত হয়নি। আপীলকারীরাসহ উপরোক্ত ১৫ জন আসামী দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় দোষী প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরই ঐ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। ( ক্রমশ)

No comments

Powered by Blogger.