কলকাতার চিঠি-এক বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার লড়াই আজ by অমর সাহা

ছয় দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বপ্ন ছিল, ভারতের শাসনক্ষমতার দুই কেন্দ্রবিন্দু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসুন একজন বাঙালি। এবার ওই স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। ভারতে এই প্রথম একজন বাঙালি রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা।


আজ বৃহস্পতিবার ১৯ জুলাই সেই বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার লড়াই। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পি এ সাংমা। ভারতের সংসদ লোকসভার সাবেক স্পিকার।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. রাধাকৃষ্ণান, ড. জাকির হোসেন, বরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি, ফকরুদ্দিন আলী আহমেদ, নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, জ্ঞানী জৈল সিং, আর ভেঙ্কটরমণ, ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা, কে আর নারায়ণন, এ পি জে আবদুল কালাম ও প্রতিভা দেবী সিং পাতিল। এ ছাড়া আরও দুজনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ হিদায়েতুল্লাহ ও বি ডি জাত্তি।
১৯৯৬ সালে আরেক বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামপন্থী নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। যুক্তফ্রন্টের আমলে। কিন্তু তাঁর দল সিপিএম তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সেদিন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রশ্নে আয়োজিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন সিপিএমেরই সাত বাঙালি কেন্দ্রীয় নেতা। ফলে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব সেদিন ২২-২৭ ভোটে খারিজ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী হন জনতা দলের প্রধান এইচ ডি দেবগৌড়া।
তাই প্রণব জিতলে ২৫ জুলাই তিনি ভারতের ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনা করবেন। শপথ নেবেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি।
এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণবের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতম প্রার্থী হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের নাম উত্থাপন করে তাঁর পক্ষে প্রচারণাও শুরু করেন প্রথম দিকে। প্রচারণা চালান তাঁর ফেসবুকেও। কলকাতায় নাগরিক সমাজের পক্ষে কালামকে রাষ্ট্রপতি চেয়ে মিছিল, সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। যদিও কালাম শেষ পর্যন্ত এক লিখিত বিবৃতিতে জানিয়ে দেন, তিনি রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হতে আগ্রহী নন। প্রার্থী হচ্ছেন না।
প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দুই দিন আগ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি তাঁর দল কাকে ভোট দেবে। তিনি কি প্রণবকে ভোট দেবেন, নাকি ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন ইত্যাদি প্রশ্ন উঠে আসে ভারতজুড়ে। তখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরাও মনে করেছেন, মমতার জন্য দুটি পথই খোলা রয়েছে। এর বাইরে যেতে পারবেন না মমতা। প্রথম পথ, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও জোট রাজনীতির স্বার্থে শেষ পর্যন্ত মমতাকে ভোট দিতে হবে প্রণবকে। দুই, অন্যথায় ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে তাঁকে। এ ছাড়া তাঁর তৃতীয় পথ খোলা নেই। কারণ, বিজেপি-সমর্থিত প্রার্থী পি এ সাংমাকে যে ভোট দিতে পারবেন না মমতা, এটা জানা ছিল রাজনৈতিক মহলের। এর পেছনের কারণ, সাংমাকে ভোট দিতে গেলে তাঁর হারাতে হতে পারে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট। তাই মমতা কখনো চাইবেন না তাঁর সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকে ফাটল ধরাতে। বিজেপির প্রার্থী পি এ সাংমাকে ভোট দিলে সংখ্যালঘুদের যে তিনি বিরাগভাজন হবেন, সেটি উপলব্ধি করেই শেষ পর্যন্ত মমতা ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হলেন প্রণবকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে। তাই মমতা নির্বাচনের মাত্র ৪০ ঘণ্টা আগে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে মঙ্গলবার বিকেলে ঘোষণা দেন তাঁর দল রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং জোট রাজনীতির স্বার্থে ইচ্ছে না থাকলেও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভোট দেবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে এই মুহূর্তে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তাতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ২২ জুলাই পর্যন্ত। কারণ, ওই দিনই প্রকাশিত হবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়ে এবার ইউপিএর সব শরিকই সমর্থন দিয়েছে প্রণবকে। শুধু তা-ই নয়, উত্তর প্রদেশের মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টিও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন জানিয়েছে। উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজপার্টির নেত্রী মায়াবতীও সমর্থন দিয়েছেন প্রণবকে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা বা এনডিএর শরিকদের একাংশও প্রণবকে সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে। সমর্থন দিয়েছে ঝাড়খন্ডের শিবু শোরেনের ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চাও। বামদল সিপিএম ও ফরোয়ার্ড ব্লকও প্রণবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে নিশ্চিত হয়ে গেছে প্রণবের জয়।
এদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে লোকসভার সাবেক স্পিকার পি এ সাংমাকে প্রার্থী করা হলেও প্রণব মুখোপাধ্যায়েরই পাল্লা ভারী হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট হয় প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা ভবনে। ভোট দেন ভারতের আইনসভার দুই কক্ষ রাজ্যসভা ও লোকসভা এবং প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভার সদস্যরা। ভারতে রয়েছেন এখন রাজ্যসভা ও লোকসভায় ৭৯০ জন সাংসদ ও রাজ্য বিধানসভায় চার হাজার ১২০ জন বিধায়ক।
এখন ইউপিএর ভোট রয়েছে ৪১ দশমিক ০৭ শতাংশ, কংগ্রেসের একার ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ, তৃণমূলের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, সমাজবাদী পার্টির ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং বামপন্থীদের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অপরদিকে এনডিএর ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিজেপির একার রয়েছে ২১ দশমিক ২ শতাংশ ভোট।
ফলে অঙ্কেই দেখা যাচ্ছে প্রণব মুখোপাধ্যায় বিপুল ভোটে জিতছেন।
আজ বৃহস্পতিবার সেই লড়াই। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পি এ সাংমার। লড়াই প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হওয়ার। সেই লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। সঙ্গে গোটা ভারতবর্ষের ১২০ কোটি মানুষ। আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে, লড়াই শেষে কখন বীর বাঙালির বেশে রাষ্ট্রপতি পদে বসবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়?
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.