কণ্ঠস্বর-রাজনীতির বাস্তবতা শিখলেন মমতা by রাহাত খান
প্রণব মুখার্জিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে অবশেষে মমতা রাজি হয়েছেন। অর্থাৎ দূরদর্শিতার রাজনীতিতে তার পরাজয় ঘটেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ইস্যুতে আন্দোলনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন, তবে আইনের লড়াইয়ে টাটার কাছে হেরেছেন তিনি।
এদিকে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর গ্রামের লোকজনই চাইছে টাটা তাদের একফসলি জমিতে প্রতিশ্রুত শর্তের বিনিময়ে ন্যানো কিংবা অন্য কলকারখানা করুক_ কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি থাকার কোনো কারণও নেই। হিসাবেই দেখা যায়, টাটার কলকারখানা হলে সেটাই তাদের এলাকার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি দিতে পারে
সবশেষে রাজনীতির বাস্তবতা কাকে বলে, সেটা শিখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এতদিন তার স্বভাবসিদ্ধ একগুঁয়েমি ও জেদ নিয়ে ছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন করবেন না, কিছুতেই না, এই অটল মনোভাব বজায় রেখেছেন এতদিন। প্রথমদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ভারতের পরমাণু-গুরু, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে। পরে কালাম এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দিলেন নিজেই।
এতেও দমলেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজে থেকে উপরাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক গভর্নর গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীকে। ছেলের দিক থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাতি তিনি। গান্ধী পরদিন উপরাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়ানোর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মমতা তাতেও থামলেন না। তবে ক্রমে তিনি বুঝলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইস্যুতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তিনি নিতান্তই একা এবং নিঃসঙ্গ। বুঝলেন তার লোকসভা ও রাজ্যসভার সমর্থন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঈপ্সিত 'ম্যাজিক নম্বর' প্রণব মুখার্জি পেয়ে যাবেন। এও মমতা বুঝলেন, তিনি ধরা খেয়ে গেছেন। তিনি যে নানা রকম ঘোঁট পাকিয়ে দিলি্ল 'শাসন' করতে চাইছেন এটা বিহারের নীতিশ কুমার, মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার, তামিলনাড়ূর করুণানিধি এবং উত্তর প্রদেশের মুলায়ম সিং যাদবের মতো সর্বভারতীয় নেতাদের কাছে আর গোপন নেই। তারা কার্যত মমতার আবেদনের প্রতি নিস্পৃহ থেকে মমতাকে জানিয়ে দিলেন, সর্বভারতীয় রাজনীতি অত্যন্ত জটিল বিষয়। সেখানে জীবনে প্রথমবার কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'খেলার' যোগ্যতা-পারঙ্গমতা কোনোটাই অর্জন করতে পারেননি। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি পদে ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে সেরা প্রার্থী। এমনকি বিরোধী এনডিএভুক্ত জোটের নীতিশ কুমার এবং শিবসেনার বাল ঠাকরে পর্যন্ত প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন জানিয়েছেন জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে। বাল ঠাকরে তো বলেছেন, প্রণব দাদা (প্রণব মুখার্জি) হচ্ছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে 'সুপার প্রার্থী'। তাকে সমর্থন না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নীতিশ কুমার, মুলায়ম সিং যাদবেরও একই কথা। রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেহাত 'ওয়াক ওভার' না দেওয়ার প্রশ্নে বিজেপি তথা এনডিএর বৃহৎ অংশটি প্রণবের বিপক্ষে ভারতীয় পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার পিএ সাংমাকে সমর্থন দিয়েছেন বটে। তবে তারাও জানেন, উপরাষ্ট্রপতি পদে বরং তাদের প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংয়ের জয়লাভের ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন যে বঙ্গসন্তান প্রণব মুখার্জি_ এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিজেপি তথা এনডিএর বৃহৎ ভগ্নাংশ এটাও জানে, নিরপেক্ষতা এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের গুরু হিসেবে প্রণব মুখার্জির তুলনা স্বয়ং প্রণব মুখার্জি আর কেউ নয়। তার ন্যায়বোধের ওপর আস্থা রাখতে পারে ভারতের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই।
স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় বলে মনে করেন নিজেকে, তিনি কি কথাটা জানতেন না? একেবারে জানতেন না, এটা হয়তো ঠিক নয়। পুরোটা না জানলেও কিছুটা তো জানতেন। কিন্তু প্রণব মুখার্জির বিপক্ষে মমতার মহাক্রোধ এখানে যে, ভারতীয় 'বাঙালি' হয়েও অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটা আর্থিক দাবি পূরণে অপারগতা প্রদর্শন করেছেন। মমতার মতে, ৩২ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা কমরেডরা লাখো কোটি টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে তবে বিদায় নিয়েছেন। লাখো কোটি টাকার বেশিরভাগ 'কমরেড, লাল সালাম'ওয়ালাদের লুটপাটে গেছে।
মমতার এই অভিযোগ মিথ্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে শাব্দিক অর্থেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে কমিউনিস্ট সরকার। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার একটা বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছিলেন কয়েক বছরের 'মরেটরিয়াম'সহ। টাকা দিতে রাজি ছিলেন প্রণব মুখার্জি তার রাজনৈতিক শিষ্য ও ছোট বোন মমতাকে। কিন্তু সুযোগ ও নীতি নেই বলে 'মরেটরিয়াম' দিতে রাজি ছিলেন না। ব্যস, তখন থেকেই কেন্দ্রের সঙ্গে ক্রোধ ও অসহযোগিতামূলক আচরণের শুরু মমতার। কিন্তু প্রণব তো পুরো ভারতের অর্থমন্ত্রী। নীতির বাইরে গিয়ে তো ছোট বোনসম মমতাকে কোনো অর্থ বরাদ্দ বা ছাড় দেওয়ার উপায় নেই তার!
কেন্দ্র থেকে মরেটরিয়ামসহ এই বিশেষ বরাদ্দ নিয়ে বহু কাণ্ড করেছেন মমতা, যা মোটেও রাজনীতিসুলভ নয়। যেমন কর্মসংস্থানে সাহায্য হয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, সে জন্য মার্কিন সাহায্যের একটা অফার ভারত সরকার পেয়েছিল। মাঝারি ও ক্ষুদ্র এই সম্ভাব্য ঋণে প্রভূতভাবে উপকৃত হতে পারত পশ্চিমবঙ্গও। সেখানে লাখ লাখ শিক্ষিক ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকারের সব শরিক দল এবং বিজেপিও এই প্রস্তাবে গররাজি ছিল না।
কিন্তু বেঁকে বসলেন মমতা। কেন্দ্রকে জানালেন, এই ধরনের প্রস্তাবে তারা সমর্থন তো দেবেনই না উপরন্তু কেন্দ্র থেকে প্রস্তাব গৃহীত হলে তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ-২ সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। তৃণমূল সরকার কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার অর্থ সরকারের পতন। সুতরাং মার্কিন এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া কোয়ালিশন সরকার টিকিয়ে রাখার দ্বিতীয় পথ ছিল না।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মমতা। হাসিনা-মনমোহন ঢাকা চুক্তির অন্যতম দুটি স্তম্ভ ছিল ছিটমহল বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মেনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন। মনমোহনের ঢাকা সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আসার কথা ছিল। আসা দূরের কথা, হুমকি দিলেন পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা না মিটিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে_ ভারতের সব ক'টি রাজ্যের চাহিদা মিটিয়ে যদি গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার সূত্র মানতে হয় তাহলে তো দেখা যাবে লিন সিজন বা শুকনো মৌসুমে কয়েক ফোঁটার বেশি পানি বাংলাদেশের কপালে জুটবে না।
অথচ আন্তর্জাতিক আইন মমতার সূত্র বা দাবি কোনোটাই সমর্থন করে না। আলাদা দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পানির গড়পড়তা একটা হিসাব করাই আছে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শুকনো মৌসুমের জন্য পানি বণ্টন হবে সেই সংখ্যাতত্ত্ব ও হিসাব ধরেই। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতার বক্তব্য মেনে না নিলে আবার কেন্দ্র থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের 'কার্ড' খেলবেন বলে হুশিয়ারি দেওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পতনের ভয়ে আবার চুপ। মমতাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো যাবে এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাবে বলে ভারত সরকারের হাতে বাংলাদেশের কাছে বিকল্প আর কোনো প্রস্তাব নেই।
মমতা বারবার তার সমর্থন প্রত্যাহারের কার্ড খেলে ভারতীয় রাজনীতিতে ভেলকিবাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এতে করে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটা নেতিবাচক বার্তাই পাঠাচ্ছেন মমতা। ভারতে বহু রাজ্যে তিনি ইতিমধ্যে সংকীর্ণমনা, হিংসাপরায়ণ এবং দায়িত্বহীন একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তিনি নিন্দিত হচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সর্বাত্মক সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তিহীন, অর্থহীন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে। পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন তখনকার পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাইগ্রেট করা বহু লোক। তারা ভোটার এবং সংখ্যার হিসাবে শতকরা ৩০ ভাগ তো হবেই, এর বেশি হওয়াও বিচিত্র নয়। বাংলাদেশের প্রতি অর্থহীন, যুক্তিহীন হিংসা ও জেদের কারণে মমতা যে মাইগ্রেট করা ভারতীয় বাঙালিদের সহানুভূতি-সমর্থন থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত হবেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
প্রণব মুখার্জিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে অবশেষে মমতা রাজি হয়েছেন। অর্থাৎ দূরদর্শিতার রাজনীতিতে তার পরাজয় ঘটেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ইস্যুতে আন্দোলনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন, তবে আইনের লড়াইয়ে টাটার কাছে হেরেছেন তিনি। এদিকে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর গ্রামের লোকজনই চাইছে টাটা তাদের একফসলি জমিতে প্রতিশ্রুত শর্তের বিনিময়ে ন্যানো কিংবা অন্য কলকারখানা করুক_ কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি থাকার কোনো কারণও নেই। হিসাবেই দেখা যায়, টাটার কলকারখানা হলে সেটাই তাদের এলাকার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি দিতে পারে।
আরও বহু ছোট-বড় ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা তাদের এই কিছুদিন আগেও খুব প্রিয় 'দিদি'র কাছ থেকে ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং জনবিরোধী মনোভাব ও কর্মতৎপরতার প্রমাণ পেয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী তো মমতার দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের 'বাংলা আকাদেমী'র চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়ে মমতাকে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর মমতার সঙ্গে নেই। অনেকে মনে করেন, ভারতীয় কংগ্রেস কোয়ালিশনে ১৯টি লোকসভা সদস্যের প্রত্যাহার কার্ড মুহুর্মুহু খেলে মমতা নিজের ভাবমূর্তিকেই হেয় করছেন। মাত্র এক বছরের শাসনামলেই ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন তিনি।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সবশেষে রাজনীতির বাস্তবতা কাকে বলে, সেটা শিখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এতদিন তার স্বভাবসিদ্ধ একগুঁয়েমি ও জেদ নিয়ে ছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন করবেন না, কিছুতেই না, এই অটল মনোভাব বজায় রেখেছেন এতদিন। প্রথমদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ভারতের পরমাণু-গুরু, সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে। পরে কালাম এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দিলেন নিজেই।
এতেও দমলেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজে থেকে উপরাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক গভর্নর গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীকে। ছেলের দিক থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাতি তিনি। গান্ধী পরদিন উপরাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়ানোর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মমতা তাতেও থামলেন না। তবে ক্রমে তিনি বুঝলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইস্যুতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তিনি নিতান্তই একা এবং নিঃসঙ্গ। বুঝলেন তার লোকসভা ও রাজ্যসভার সমর্থন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঈপ্সিত 'ম্যাজিক নম্বর' প্রণব মুখার্জি পেয়ে যাবেন। এও মমতা বুঝলেন, তিনি ধরা খেয়ে গেছেন। তিনি যে নানা রকম ঘোঁট পাকিয়ে দিলি্ল 'শাসন' করতে চাইছেন এটা বিহারের নীতিশ কুমার, মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ার, তামিলনাড়ূর করুণানিধি এবং উত্তর প্রদেশের মুলায়ম সিং যাদবের মতো সর্বভারতীয় নেতাদের কাছে আর গোপন নেই। তারা কার্যত মমতার আবেদনের প্রতি নিস্পৃহ থেকে মমতাকে জানিয়ে দিলেন, সর্বভারতীয় রাজনীতি অত্যন্ত জটিল বিষয়। সেখানে জীবনে প্রথমবার কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'খেলার' যোগ্যতা-পারঙ্গমতা কোনোটাই অর্জন করতে পারেননি। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি পদে ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে সেরা প্রার্থী। এমনকি বিরোধী এনডিএভুক্ত জোটের নীতিশ কুমার এবং শিবসেনার বাল ঠাকরে পর্যন্ত প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন জানিয়েছেন জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে। বাল ঠাকরে তো বলেছেন, প্রণব দাদা (প্রণব মুখার্জি) হচ্ছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে 'সুপার প্রার্থী'। তাকে সমর্থন না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নীতিশ কুমার, মুলায়ম সিং যাদবেরও একই কথা। রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেহাত 'ওয়াক ওভার' না দেওয়ার প্রশ্নে বিজেপি তথা এনডিএর বৃহৎ অংশটি প্রণবের বিপক্ষে ভারতীয় পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার পিএ সাংমাকে সমর্থন দিয়েছেন বটে। তবে তারাও জানেন, উপরাষ্ট্রপতি পদে বরং তাদের প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিংয়ের জয়লাভের ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন যে বঙ্গসন্তান প্রণব মুখার্জি_ এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিজেপি তথা এনডিএর বৃহৎ ভগ্নাংশ এটাও জানে, নিরপেক্ষতা এবং ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের গুরু হিসেবে প্রণব মুখার্জির তুলনা স্বয়ং প্রণব মুখার্জি আর কেউ নয়। তার ন্যায়বোধের ওপর আস্থা রাখতে পারে ভারতের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই।
স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বভারতীয় রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় বলে মনে করেন নিজেকে, তিনি কি কথাটা জানতেন না? একেবারে জানতেন না, এটা হয়তো ঠিক নয়। পুরোটা না জানলেও কিছুটা তো জানতেন। কিন্তু প্রণব মুখার্জির বিপক্ষে মমতার মহাক্রোধ এখানে যে, ভারতীয় 'বাঙালি' হয়েও অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটা আর্থিক দাবি পূরণে অপারগতা প্রদর্শন করেছেন। মমতার মতে, ৩২ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা কমরেডরা লাখো কোটি টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে তবে বিদায় নিয়েছেন। লাখো কোটি টাকার বেশিরভাগ 'কমরেড, লাল সালাম'ওয়ালাদের লুটপাটে গেছে।
মমতার এই অভিযোগ মিথ্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে শাব্দিক অর্থেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে কমিউনিস্ট সরকার। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার একটা বিশেষ বরাদ্দ চেয়েছিলেন কয়েক বছরের 'মরেটরিয়াম'সহ। টাকা দিতে রাজি ছিলেন প্রণব মুখার্জি তার রাজনৈতিক শিষ্য ও ছোট বোন মমতাকে। কিন্তু সুযোগ ও নীতি নেই বলে 'মরেটরিয়াম' দিতে রাজি ছিলেন না। ব্যস, তখন থেকেই কেন্দ্রের সঙ্গে ক্রোধ ও অসহযোগিতামূলক আচরণের শুরু মমতার। কিন্তু প্রণব তো পুরো ভারতের অর্থমন্ত্রী। নীতির বাইরে গিয়ে তো ছোট বোনসম মমতাকে কোনো অর্থ বরাদ্দ বা ছাড় দেওয়ার উপায় নেই তার!
কেন্দ্র থেকে মরেটরিয়ামসহ এই বিশেষ বরাদ্দ নিয়ে বহু কাণ্ড করেছেন মমতা, যা মোটেও রাজনীতিসুলভ নয়। যেমন কর্মসংস্থানে সাহায্য হয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, সে জন্য মার্কিন সাহায্যের একটা অফার ভারত সরকার পেয়েছিল। মাঝারি ও ক্ষুদ্র এই সম্ভাব্য ঋণে প্রভূতভাবে উপকৃত হতে পারত পশ্চিমবঙ্গও। সেখানে লাখ লাখ শিক্ষিক ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকারের সব শরিক দল এবং বিজেপিও এই প্রস্তাবে গররাজি ছিল না।
কিন্তু বেঁকে বসলেন মমতা। কেন্দ্রকে জানালেন, এই ধরনের প্রস্তাবে তারা সমর্থন তো দেবেনই না উপরন্তু কেন্দ্র থেকে প্রস্তাব গৃহীত হলে তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ-২ সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। তৃণমূল সরকার কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার অর্থ সরকারের পতন। সুতরাং মার্কিন এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া কোয়ালিশন সরকার টিকিয়ে রাখার দ্বিতীয় পথ ছিল না।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মমতা। হাসিনা-মনমোহন ঢাকা চুক্তির অন্যতম দুটি স্তম্ভ ছিল ছিটমহল বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মেনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন। মনমোহনের ঢাকা সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আসার কথা ছিল। আসা দূরের কথা, হুমকি দিলেন পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা না মিটিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে_ ভারতের সব ক'টি রাজ্যের চাহিদা মিটিয়ে যদি গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার সূত্র মানতে হয় তাহলে তো দেখা যাবে লিন সিজন বা শুকনো মৌসুমে কয়েক ফোঁটার বেশি পানি বাংলাদেশের কপালে জুটবে না।
অথচ আন্তর্জাতিক আইন মমতার সূত্র বা দাবি কোনোটাই সমর্থন করে না। আলাদা দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পানির গড়পড়তা একটা হিসাব করাই আছে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শুকনো মৌসুমের জন্য পানি বণ্টন হবে সেই সংখ্যাতত্ত্ব ও হিসাব ধরেই। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতার বক্তব্য মেনে না নিলে আবার কেন্দ্র থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের 'কার্ড' খেলবেন বলে হুশিয়ারি দেওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পতনের ভয়ে আবার চুপ। মমতাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো যাবে এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাবে বলে ভারত সরকারের হাতে বাংলাদেশের কাছে বিকল্প আর কোনো প্রস্তাব নেই।
মমতা বারবার তার সমর্থন প্রত্যাহারের কার্ড খেলে ভারতীয় রাজনীতিতে ভেলকিবাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এতে করে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটা নেতিবাচক বার্তাই পাঠাচ্ছেন মমতা। ভারতে বহু রাজ্যে তিনি ইতিমধ্যে সংকীর্ণমনা, হিংসাপরায়ণ এবং দায়িত্বহীন একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তিনি নিন্দিত হচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সর্বাত্মক সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তিহীন, অর্থহীন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে। পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন তখনকার পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাইগ্রেট করা বহু লোক। তারা ভোটার এবং সংখ্যার হিসাবে শতকরা ৩০ ভাগ তো হবেই, এর বেশি হওয়াও বিচিত্র নয়। বাংলাদেশের প্রতি অর্থহীন, যুক্তিহীন হিংসা ও জেদের কারণে মমতা যে মাইগ্রেট করা ভারতীয় বাঙালিদের সহানুভূতি-সমর্থন থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত হবেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
প্রণব মুখার্জিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে অবশেষে মমতা রাজি হয়েছেন। অর্থাৎ দূরদর্শিতার রাজনীতিতে তার পরাজয় ঘটেছে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ইস্যুতে আন্দোলনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন, তবে আইনের লড়াইয়ে টাটার কাছে হেরেছেন তিনি। এদিকে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর গ্রামের লোকজনই চাইছে টাটা তাদের একফসলি জমিতে প্রতিশ্রুত শর্তের বিনিময়ে ন্যানো কিংবা অন্য কলকারখানা করুক_ কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি থাকার কোনো কারণও নেই। হিসাবেই দেখা যায়, টাটার কলকারখানা হলে সেটাই তাদের এলাকার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি দিতে পারে।
আরও বহু ছোট-বড় ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা তাদের এই কিছুদিন আগেও খুব প্রিয় 'দিদি'র কাছ থেকে ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং জনবিরোধী মনোভাব ও কর্মতৎপরতার প্রমাণ পেয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী তো মমতার দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের 'বাংলা আকাদেমী'র চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়ে মমতাকে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর মমতার সঙ্গে নেই। অনেকে মনে করেন, ভারতীয় কংগ্রেস কোয়ালিশনে ১৯টি লোকসভা সদস্যের প্রত্যাহার কার্ড মুহুর্মুহু খেলে মমতা নিজের ভাবমূর্তিকেই হেয় করছেন। মাত্র এক বছরের শাসনামলেই ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন তিনি।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments