বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৫৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ আবু বকর সিদ্দিকী, বীর বিক্রম অনন্য সাহসী এক যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র-শিক্ষকসহ পুলিশ-আনসার ও ইপিআর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। এই দলে ছিলেন আবু বকর সিদ্দিকী।


তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাডেট কলেজের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ (বীর প্রতীক)। তিনি খবর পেলেন পাবনা থেকে এক দল পাকিস্তানি সেনা রাজশাহী আসছে। সিদ্ধান্ত নিলেন ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করার।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে ঈশ্বরদীতে সফলভাবে অ্যামবুশ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দল পাবনা থেকে সেখানে এলে তাঁরা আক্রমণ চালান। তখন সেখানে প্রচণ্ড পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই দলে কর্মকর্তা ও সেনা ছিল প্রায় ৬০ জন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে মেজর আসলামসহ ৪০ জন হতাহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়। অ্যামবুশের সফলতায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে বেশ আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।
কয়েকদিন পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিরাট দল ঢাকা থেকে রাজশাহী অভিমুখে আসতে থাকে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। ১১ এপ্রিল ভোরে তারা রাজশাহীর চারঘাটে উপস্থিত হয় এবং সেখানে প্রতিরক্ষা নিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
পরদিন আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। একটি দলের নেতৃত্ব দেন আবু বকর সিদ্দিকী। তাঁর দলের ওপর দায়িত্ব ছিল চারঘাটে প্রধান সড়কে বাজারসংলগ্ন স্থানে ডিলেইং পজিশন সৃষ্টি করে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেওয়া। যাতে পাকিস্তানিরা সামনে অগ্রসর হতে না পারে।
পরিকল্পনানুযায়ী আবু বকর সিদ্দিকী ১২ এপ্রিল ভোরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই দলের একাংশ সেখানে উপস্থিত হলে তিনি আক্রমণ করেন। আকস্মিক আক্রমণে হকচকিত সেনারা কিছু সময় যুদ্ধের পর পশ্চাদপসরণ করে। পরে নতুন শক্তি নিয়ে আবার অগ্রসর হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে বিপুল বিক্রমে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করে।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। দিনভর যুদ্ধ চলে। বিকেলের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলের অবস্থান থেকে গুলিবর্ষণ ক্রমে কমে যায়। একপর্যায়ে আবু বকর সিদ্দিকীর দলের অবস্থানেও একই ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় গুলি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্রতিরক্ষা অবস্থানে তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা এক সহযোদ্ধা ছাড়া আর কেউ ছিল না।
আবু বকর সিদ্দিকী এতে ভীতসন্ত্রস্ত বা বিচলিত হননি। বীরত্বের সঙ্গে একাই পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল অসম। একপর্যায়ে তাঁর গুলি শেষ হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাংকার ঘিরে ফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন তিনি। সেনারা তাঁকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর মরদেহ ক্ষতবিক্ষত করে। পরদিন স্ত্রী খবর পেয়ে স্থানীয় একজনের সহায়তায় তাঁর মরদেহ থানার পাশে সমাহিত করেন। এই সমাধি সংরক্ষিত।
আবু বকর সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত চারঘাট যুদ্ধে, সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আবু বকর সিদ্দিকীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬০।
শহীদ আবু বকর সিদ্দিকীর পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার দেলুয়াকান্দি গ্রামে। বাবার নাম মনসুর আলী, মা বেগম সোনাভান। স্ত্রী সাহানা বেগম। স্ত্রী বর্তমানে ঢাকায় বাস করেন। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদ সিদ্দিকী (শহীদ আবু বকর সিদ্দিকী বীর বিক্রমের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.