চারদিক-‘ডেইলি দুইডা মিছা কথা কই’ by ফারুখ আহমেদ

গ্রীষ্ম শেষ হয়ে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। কখনো ঝুম বৃষ্টি, কখনো কটকটে রোদ্দুর। রোদ্দুরের একটি দিনে চলে এলাম ইসলামপুর গাছতলায়। ঝোপঝাড় আর গাছগাছালিতে ঘেরা চমৎকার একটি গ্রাম। গাছগাছালির জন্যই কিনা গ্রামের নাম ইসলামপুরের সঙ্গে গাছতলা যুক্ত হয়েছে।


এখানে বাঁশগাছ প্রচুর। আছে হিজল, ছাতিম, কদম্ব, বাবলা, কালোজাম, আম-কাঁঠাল আর খেজুরগাছ। আর আছে প্রচুর পটপটি, শিয়ালকাটা, কন্টিকারি আর ভান্ডিফুল। ইসলামপুরের যেখানটায় আমাকে রিকশা নামিয়ে দিল, সেখান থেকে একটু এগিয়ে একটি চায়ের দোকান, তারপর আরেকটি, শেষে একটি বটগাছ আর ডাকাতিয়া নদী।
ইসলামপুর চাঁদপুরের একটি গ্রাম। চাঁদপুর বা ইচলী লঞ্চঘাটে নেমে এখানে আসতে হয়। আমরা ইচলী হয়ে এখানে এসেছি। আজ সারা দিন আড্ডা হবে, ইলিশ-আড্ডা! ইলিশের মৌসুম চলছে। ইলিশের এই সময় এখানে ইলিশ-আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। আড্ডাবাজ বাঙালির আড্ডাবাজির এ এক অনন্য নমুনা!
ভোরের স্তব্ধতায় আমরা যখন আড্ডাস্থল ইসলামপুর গাছতলায় এসে পৌঁছি, তখন পুরো এলাকা ফাঁকা ছিল। দিনের আলো ফুটে উঠতেই লোকজনের ভিড় জমে যায়। এসব লোকের সমাগম আমাদের জন্য। একটি ছোট্ট শিশু কতক্ষণ আমাদের আশপাশে ঘুরঘুর করছিল, টের পাইনি। বয়স তার ১০-১১ হবে, নাম সেলিম। সেলিমকে দেখে কাছে ডাকি। তার নামসহ আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করি। গাছতলার একজন আমাকে ওর সঙ্গে গল্প করতে দেখে চুপিচুপি বলে যায়, ‘ওরা বাইদ্যা। নাওত ঘুরি বেড়ায়। ওর বাপের নাম জাহাঙ্গীর। বাড়িঘর নাই। মাছ ধইরা বিক্রি কইরা জীবন চলে। ওগো বাড়ির মাইয়ারা রাস্তায় ঘুইরা বেড়ায়, সাপ খেলা দেহায় আর ওষুধ বিক্রি করে।’
বুঝতে পারি, লোকটির এসব বলার উদ্দেশ্য। লোকটি বোঝাতে চেষ্টা করল, সেলিমেরা নিচু জাত, সুতরাং ওর সঙ্গে কিসের এত কথা! কিন্তু আমি চুটিয়ে গল্প করে যাই। সেলিমই জানায়, ‘আইজকা আমার বাপ এক হাজার ট্যাকার মাছ ধরছে। পইত্যেক দিন মাছ ধরে, আর বেইচা দেয়। ইলিশ, জাটকা, চিংড়ি—কত রহমের মাছ!’ একথা-ওকথার ফাঁকে সেলিমকে যখন যাযাবর জীবনযাপনের কথা বলি, সে তখন কাছের একটি নৌকা দেখিয়ে বলে, ‘আমরা ওই নৌকায় থাহি।’ এরপর সে তার শিশুসুলভ চপলতায় বলে, ‘আমার কাছে ছিপ আছে, মাছ ধরবেন?’ আমি শুধু রাজি নয়, একটু বেশি উৎসাহী হয়েই বলি, নিয়ে আসো, মাছ ধরি!
সেলিম হাফ প্যান্ট-জামা খুলে সেসব এক হাতে নিয়ে ডাকাতিয়ায় নামে। তারপর অন্য হাতে নদী সাঁতরে তাদের নৌকায় গিয়ে ছিপ সঙ্গে অন্য আরেকটা জামা নিয়ে আবার সাঁতরে তীরে আসে। আমি বড়শিতে আদার লাগিয়ে নদীতে ছিপ ফেলে ফাতনায় দৃষ্টি রেখে সেলিমের সঙ্গে আলাপ জমাই।
বেদে আমাদের দেশের খুব পরিচিত জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনাচরণ সবকিছু নদী ও পতিত জায়গায়। একসময় সারা দেশেই বেদের বহর চোখে পড়ত, এখন খুব একটা দেখা যায় না। যা একটু চোখে পড়ে মুন্সিগঞ্জ, কাঠপট্টি আর সিরাজদিখানের দিকে গেলে। বেদে জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে অবহেলিতরা হচ্ছে শিশু। তাদের লেখাপড়া কিছুই হয় না, তার ওপর বিবাহ হয় বাল্যকালে। বাল্যবিবাহ বেদে সমাজের অন্যতম রেওয়াজ। সেলিম বেদে সমাজেরই একজন প্রতিনিধি হওয়ায় আমি দুষ্টুমি করে জানতে চাই, তোর কি বিয়ে হয়েছে? লাজুক হেসে সেলিম বলে, ‘কী যে কন ভাইজান!’ তারপর সে আমার হাত থেকে ছিপ নিয়ে জোরসে একটান দিতেই বড়শিতে দেখা যায়, একটা পুঁটি মাছ ঝুলছে!
কথায় কথায় সেলিম জানায়, চাঁদপুরের মতলবে তাদের নিজের বাড়ি আছে। দেড় মাসে হয় এই ডাকাতিয়ার তীরে ঘর বেঁধেছে। তারা ছয় মাস বাড়িতে থাকে, বাকি ছয় মাস নদীতে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে একসময় বাড়ি ছিল, বিক্রি করে দিয়েছে। তার দুই বোন শেফালী ও শিউলি। ছোট বলে কোনো কাজও করতে পারে না। মা কাজে গেলে ওরা নৌকায় থাকে। তখন সেলিম ওদের দেখভাল করে। সেলিম গান গাইতে পারে। গলা ছেড়ে গান ধরে। গান শেষ হলে প্রশ্ন করি, তোর বাপ ঢাকার বাড়ি বিক্রি করল কেন?
‘বিক্রি করে নাই ভাইজান, বুঝলেন না, আমি আপনেরে মিছা কইছি, আমরা বাড়ি পামু কই, আবার ঢাকার মতন জায়গায়!’
‘ক্যান মিছা কথা কইলা?’
‘ভাইজান, ভালা লাগে এমুন মিছা কইতে। মিছাডা গলা দিয়া বাইর অইয়া যায়।’
‘তার মানে, তুমি যা বললা, সব মিথ্যা!’
‘না, আমি সব মিছা কই নাই। ডেইলি দুইডা মিছা কথা কই। এই যেমুন ঢাকায় বাড়ির কথা মিছা আর মতলবে যে বাড়ির কথা কইছি, হেইডাও মিছা কথা। কী করমু, সব মাইনসের বাড়ি আছে, খালি আমাগো বাড়ি নাই, আমরা নদীত থাহি। আমাগো যদি বাড়ি থাকত, তয় তো আমরা বাড়িত থাকতাম, নদীত না। আমাগোও আর সবতের লাহান বাড়ি আছে, এমুন দুইডা মিছা কইতে আর মনে করতে খারাপ লাগে না। হুনেন, আমি ইয়া বড় বাড়ির স্বপন দেহি। একদিন আমি ঠিকই আপনেগো লাহান ইয়া বড় বাড়ি বানামু।’
আমি ছোট্ট সেলিমের স্বপ্নভরা চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। ইলিশ-আড্ডার দিকে পা বাড়াই।
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.