চরাচর-দোতারা by সুস্মিতা সাহা

ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে... কোন দিন আসিবেন বন্ধু, কয়া যাও, কয়া যাও রে...। ভাওয়াইয়া গানের এই সুরের কথা মনে হলেই এর সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যে যন্ত্রটির সুর আমাদের মনে ভেসে ওঠে, তা হলো দোতারা। ভাওয়াইয়ার ভাষায় এর নাম দো-তরা। দো-তরার গান বলতে ভাওয়াইয়াকে বোঝায়। দোতারা তত শ্রেণীর লোকযন্ত্র।


তার দ্বারা নির্মিত যন্ত্র তত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। দোতারা নাম হলেও সব সময় এটা দুই তারবিশিষ্ট নয়, সাধারণত দোতারা চার বা পাঁচ তারবিশিষ্ট হয়। ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতকে বাউল ও ফকির সংঘে এর ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিম বাংলা ও বিহারে এর প্রচলন লক্ষ করা যায়। মধ্য এশিয়ায় লুট-এর মতো দেখতে দোতারার ব্যবহার রয়েছে। সাধারণত এসব এলাকার পল্লীগীতিতে দোতারা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া গানে দোতারা প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে বাংলার মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে দোতারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেক দোতারায় ধাতব (মেটাল) তার ব্যবহৃত হয়, যা একে স্বতন্ত্র টোন (স্বর/সুর) এনে দেয় অন্য যন্ত্র থেকে। কিছু দোতারায় তার হিসেবে তাঁত বা পশুর অন্ত্রে তৈরি সুতা ব্যবহার করা হয়। যদিও দোতারার চার-পাঁচ তার রয়েছে, কিন্তু প্রতিটি গান মূলত প্রধান দুটি তারের সাহায্যেই গাওয়া যায়। অন্য তারগুলো অধিক বৈচিত্র্য আনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ কারণে একে দোতারা বলা হয়।
অন্য লোকযন্ত্রের মতো দোতারায়ও বিভিন্ন এলাকায় কাঠামোগত দিক থেকে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে প্রধানত দুই ধরনের দোতারা লক্ষ করা যায়। এক ধরনের উত্তরবঙ্গে, অন্যটির ব্যবহার দক্ষিণে। এগুলোর মধ্যে কাঠামো, টোন (স্বর/সুর) ও ব্যবহারের দিক থেকে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে।
দক্ষিণের এই দোতারার প্রচলন বাংলা গানে (বাংলাদেশে) বেশি দেখা যায়। দোতারার ওপরের অংশের নকশা কোনো প্রাণী, ময়ূর কিংবা অন্য কোনো পাখির মুখের মতো করে তৈরি করা হয়। দোতারা নিম কাঠ বা অন্য কোনো শক্ত কাঠ দ্বারা তৈরি হয়। এটা দেখতে অনেকটা সরোদের মতো। এর পটরি (ফিঙ্গার বোর্ড) ধাতব পাতে মোড়ানো থাকে। এতে ধাতব তার ব্যবহৃত হয়। এই শ্রেণীর দোতারা জওয়ার আঘাতে বাজানো হয়। বাজানোর এই ভঙ্গি সুন্দর সুর বা স্বর তৈরি করে। বাউল ও ফকিরদের মধ্যে এ ধরনের দোতারা খুবই জনপ্রিয়।
উত্তরবঙ্গে যে দোতারার প্রচলন রয়েছে, তা তেমন প্রচলিত নয়। বাংলাদেশে এই দোতারা আদিবাসীদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। আবার এই ধরনটা পশ্চিম বাংলা, আসাম ও বিহারে দেখা যায়। এই দোতারার সঙ্গে দক্ষিণের দোতারার অনেক ব্যবধান রয়েছে। এ দোতারায় অলংকরণ কম হয়। এর তার তাঁত ও পশুর অন্ত্রে তৈরি হয়। এর পটরি কাঠের হয়। শব্দ ও কাঠামোর দিক দিয়ে এ দোতারা রাবাবের কাছাকাছি। সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই দোতারাই ভাওয়াইয়া, জলপুরিয়া ও মহিষালী গানের জন্য বেশি গ্রহণযোগ্য। যে গানেই ব্যবহার হোক না কেন, দোতারা বাংলা গানের অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্র বলেই বিবেচিত হয়।
সুস্মিতা সাহা

No comments

Powered by Blogger.