সাদাকালো-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রমজানেই নয় সারা বছরের জন্য দরকার by আহমদ রফিকসাদাকালো-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রমজানেই নয় সারা বছরের জন্য দরকার by আহমদ রফিক
রমজান আসছে। রমজান সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়াতে শুরু করেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা- এমন খবর ও প্রতিবেদন পত্রিকা থেকে পত্রিকাজুড়ে। কিন্তু বিষয়টি আরো ব্যাপক। কারণ পাঠক লক্ষ করবেন, বাংলাদেশের সব বাজারই সারা বছর অস্থিতিশীল, অর্থাৎ থেকে থেকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, কখনো সংগত কারণে, বেশির ভাগ
সময় যুক্তিহীনভাবে। বাদ যায় না ওষুধপত্রও, যে ওষুধ সাধারণ-অসাধারণ যা-ই হোক, রোগীর জীবন রক্ষা ও রোগ প্রতিকারের সহায়ক।
তাই শুধু রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য কাগজে কাগজে লেখা, টিভিতে টক শো বা সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি সমগ্র বিষয়ের একাংশের প্রতি নজর দেওয়ার মতো একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। এই তো কিছুদিন আগে হঠাৎ করে বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হলো, আর তা নিয়ে কাগজে কাগজে হৈচৈ। কিন্তু কী ব্যবস্থা নিয়েছে ওষুধ প্রশাসন? তারা বিবৃতি দিয়েও এই মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলতে পারত।
মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থাপিত একটি টক শোতে অধ্যাপক মাহবুব-ই-রশিদ বেশ জোরের সঙ্গে ওষুধের অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বললেন। কিন্তু অন্য একজনকে দেখা গেল মূল্যবৃদ্ধির সমর্থনে কথা বলতে। তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তা মাঝপথে অনুষ্ঠান দেখার কারণে ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু তাঁর যুক্তি বা কথাবার্তা যথেষ্ট টেকসই ছিল না।
আজকের আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেও ওষুধের দাম বাড়ার ঘটনা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িত শরীর-স্বাস্থ্য, জীবন-মরণের সমস্যা। এই তো কাল একজন গৃহকর্মীকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সাদামাটা চার ধরনের ওষুধ কয়েক পাতা কিনতে ৫০০ টাকা খরচ হওয়ায় তাঁকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেল। তাঁর ভাষায়, 'এসব ওষুধ ছয় মাস আগেও এত দাম ছিল না।' তাঁর প্রতিবাদ হয়তো শতভাগ ঠিক নয়, কিন্তু বেশ কিছুটা ঠিক। সপ্তাহ কয়েক আগে কাগজের খবর ও নিজে ওষুধ দোকানির সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কয়েকটি ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
নিত্যদিনের জিনিসপত্রের দাম বাড়া যে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি অর্থাৎ বিকিকিনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাখ্যারও খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তবু দেখছি দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জনৈক তরুণ অর্থনীতিবিদ ঠিকই বলেছেন, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। যেমন- বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, ইচ্ছামাফিক কোচিং ফি বাড়ানো, এমনকি চিকিৎসকের ফি ও পরীক্ষাদির কমিশন নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ঠিকই, অর্থনীতির সামগ্রিক দিক নিয়ন্ত্রণ করা, পণ্য ও সেবা খাত উভয়কে নিয়ন্ত্রণ করা জাতীয় বিবেচনায় জরুরি। জরুরি কৃষকের বেচাকেনার দিকটাতে নজর দেওয়া, যাতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায়। কারণ তাকেও কিনতে হয় বাড়তি দামের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সংগতি রাখার প্রশ্ন নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনার পাশাপাশি কিছু বাস্তব সত্যও বুঝে নেওয়া দরকার। তা হলো আমাদের সমাজে বাজারে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত মুনাফাবাজির বিষয়টি।
তত্ত্ব ও বাস্তব যে কত ফারাক এবং সে প্রভেদের আঁচ যে প্রায়ই ভোক্তার সহ্যসীমা অতিক্রম করে যায়, তা সচ্ছল বুদ্ধিজীবী অনেক সময় অনুমান করতে পারেন না। বুঝতে পারে বাঁধাধরা আয় বা নির্দিষ্ট বেতনভুক নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে সর্বনিম্ন আয়ের মানুষ। নিত্যদিনের বাজার তাদের জন্য আতঙ্কের এবং তা শুধু রমজান মাসেই নয়, থেকে থেকে বছরের নানা মাসে।
অর্থনীতিবিদ যদি বলেন, ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কত শতাংশ খরচই বা বাড়ে, তখন তাঁর চিন্তা বাস্তব পরিস্থিতির নাগালে থাকে না। কারণ ভোজ্য তেল থেকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ভোক্তার প্রাত্যহিক প্রয়োজনের বিষয়। আর সমাজনীতির বিবেচনা সামনে নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, ওই ভোজ্য তেলে বা পেঁয়াজ-রসুন-আদা-হলুদ-ছোলা ও ডালের মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মুনাফাবাজি কত শতাংশে পৌঁছে সমাজকে অস্থিতিশীল করছে। করছে যেমন অর্থনৈতিক দিক থেকে, সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকেও।
সে আয়বৈষম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যাবে বিত্তবান ব্যবসায়ী মুনাফাবাজ-মজুদদারের পক্ষে। যারা হিসাব-নিকাশ করে সারা বছর একটার পর একটা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়াতে থাকে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখে এতটাই বাড়াতে থাকে যে ওই শতাংশ হিসাব তখন আর বাস্তবে মেলে না। একেকটি পণ্য তাই বাজারে হিসাবি দামের দেড় গুণ, দুই গুণ, কখনো আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। বৃহৎ ব্যবসায়ীর মুনাফার জেদ তখন অবিশ্বাস্য মাত্রায় বাড়ে। কখনো বাড়ে খুচরা বিক্রেতার, অবস্থাভেদে।
কাগজ থেকে নেওয়া একটা সাম্প্রতিক হিসাব : 'আমদানি মূল্যের সঙ্গে নির্ধারিত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১০ শতাংশ পরিবহন খরচ এবং সেই সঙ্গে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীর ১ শতাংশ হারে ও খুচরা ব্যবসায়ীর ১০ শতাংশ হারে মুনাফা ধরে সম্প্রতি আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা বিক্রয়মূল্য পড়ে ১৪.২৬ টাকা। সেই পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা দরে।' তাহলে মুনাফার শতাংশ কত হলো? জানি না উন্নত দেশগুলোতে নিত্যভোগ্যপণ্য নিয়ে এ ধরনের অবিশ্বাস্য মুনাফাবাজি চলে কি না। আর চললেও সাধারণ বিবেচনায় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য।
পেঁয়াজ তো সাধারণ পণ্য, যার ব্যবহার কমানো যায়। কিন্তু কমানো যায় না, এমন পণ্যের দামও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এমন উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে তা ছোঁয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে। কখনো সহজলভ্য, সস্তা নুনের দামও দেখা যায় দুই শ-আড়াই শ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই তো কিছুদিন আগে সয়াবিন তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পরও ওই বর্ধিত মূল্য ১ শতাংশও কমানো হয়নি। মুনাফার এমনই চাহিদা।
প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য কৃষক উৎপাদক পান না। তা ধান চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন আদা যা-ই হোক না কেন। সেখানে ভূমিকা রাখে ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগী। ফলে হতাশ কৃষক তার উৎপাদন ভাবনায়। হয়তো তখন তার লক্ষ্য এমন দ্রব্য উৎপাদন, যাতে লাভ বেশি, হোক না তা সামাজিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই মধ্যবঙ্গে-উত্তরবঙ্গে তামাক চাষের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে।
তাই এ বিষয়টাতে সরকারের নজর দেওয়া দরকার, যাতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়। যে পেঁয়াজের খুচরা বাজারমূল্য কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকা সে পেঁয়াজ যদি কৃষক দুই টাকা পাঁচ টাকা দরেও বেচতে না পারে, তাহলে সে কৃষকের পক্ষে লাভজনক বিকল্প পণ্যের উৎপাদনে নজর দেওয়া স্বাভাবিক। তাতে ক্ষতি দেশের, দশের। কারণ তখন ওই পেঁয়াজ আমদানিতে বিদেশি মুদ্রা খরচ হবে, আর ভোক্তাকে বেশি দামে ওই আমদানি করা পেঁয়াজ কিনতে হবে। ক্ষতি উভয়ত। আর অবারিত আমদানিতে লাভ প্রধানত আমদানিকারক ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর। এ জন্যই আমাদের সর্বদা ঝোঁক পণ্য আমদানির দিকে; দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নয়। বিত্তবানমুখী অর্থনীতির পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।
এবারই নয়, প্রায়ই ধান উৎপাদনেও কৃষক ন্যায্য মূল্য পায় না, তা বাম্পার ফলন দেশের জন্য যত সহায়কই হোক। সব সুবিধা কেড়ে নেয় মধ্যস্বত্বভোগী ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর মতো সুবিধাভোগী শ্রেণী। সে ক্ষেত্রে নিরুপায় কৃষককে ভিন্ন উপায় খুঁজে নিতে হয়, যা দেশের পক্ষে মঙ্গলকর নয়। আসলে নানা দিক থেকে দেশটা অসাধু ব্যবসা ও মুনাফাবাজিতে এতটা ভরে গেছে যে তা কখনো কখনো মূল ব্যবসায়ীর স্বার্থকেও আঘাত করে, সর্বদাই করে উৎপাদক শ্রেণীকে।
মুনাফাবাজি ও অসাধু ব্যবসা যে বাংলাদেশের বাজারে কী ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার ছোট্ট একটি উদাহরণ কাগজে ছাপা হয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, '৫০ টাকা কেজি দরে হলুদ বিক্রি করছে কৃষক। সেটি গুঁড়া করে মোড়ক লাগিয়ে কিভাবে কিছু কম্পানি ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।' অর্থাৎ এলেম থাকলে ঢেউ গুণেও টাকা কামানো যায়। এসব অসাধু তৎপরতারও নিয়ন্ত্রণ দরকার।
কিন্তু প্রশ্ন, কোনো সরকারের পক্ষে এত দিকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব? সমাজ যেখানে এতটা দূষিত, সেখানে সুবিধাভোগী শ্রেণীর আধিপত্য দৌরাত্ম্যে পর্যায়ে পৌঁছাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম কাগজে-কলমে মেনে নিয়েও অগ্রাহ্য করছে ব্যবসায়ী শ্রেণী। দিব্যি ইচ্ছামতো দামে চলছে জিনিসপত্র বেচা। রমজানের আগেই বাজার চড়া। কোনো কোনো পণ্য নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ দরে বিক্রি হচ্ছে- এমনটাই কাগজের খবর।
সঠিক শিরোনাম কাগজে : 'রমজানের আগেই বাজার চড়া' কিংবা 'দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য' বা 'কৃষকের মুখে হাসি নেই'। না থাকুক কৃষকের মুখে হাসি, হাসি ঠিকই আছে ব্যবসায়ী শ্রেণীর মুখে, যাদের নিয়ন্ত্রণে বাজার। বোরো ধান চাষ করে গরু বিক্রি করতে হয় ঠাকুরগাঁওয়ের যে কৃষককে, তার পাশে থাকার নৈতিক দায়িত্ব সরকারের। তাই বাজারদর নিয়ন্ত্রণ সরকারকেই করতে হবে, মুনাফার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। শুধু টিসিবিতে চলবে না। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজারদরটাও মুঠোয় রাখতে হবে- শুধু রমজানে নয়, বছরের বাকি ১১ মাসও। শেষ প্রশ্ন : কোনো রমজানে কি দ্রব্যমূল্য সরকারি ইচ্ছার দরে ধরে রাখা গেছে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
তাই শুধু রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য কাগজে কাগজে লেখা, টিভিতে টক শো বা সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি সমগ্র বিষয়ের একাংশের প্রতি নজর দেওয়ার মতো একপেশে হয়ে দাঁড়ায়। এই তো কিছুদিন আগে হঠাৎ করে বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হলো, আর তা নিয়ে কাগজে কাগজে হৈচৈ। কিন্তু কী ব্যবস্থা নিয়েছে ওষুধ প্রশাসন? তারা বিবৃতি দিয়েও এই মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলতে পারত।
মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থাপিত একটি টক শোতে অধ্যাপক মাহবুব-ই-রশিদ বেশ জোরের সঙ্গে ওষুধের অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বললেন। কিন্তু অন্য একজনকে দেখা গেল মূল্যবৃদ্ধির সমর্থনে কথা বলতে। তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি তা মাঝপথে অনুষ্ঠান দেখার কারণে ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু তাঁর যুক্তি বা কথাবার্তা যথেষ্ট টেকসই ছিল না।
আজকের আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেও ওষুধের দাম বাড়ার ঘটনা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িত শরীর-স্বাস্থ্য, জীবন-মরণের সমস্যা। এই তো কাল একজন গৃহকর্মীকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সাদামাটা চার ধরনের ওষুধ কয়েক পাতা কিনতে ৫০০ টাকা খরচ হওয়ায় তাঁকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেল। তাঁর ভাষায়, 'এসব ওষুধ ছয় মাস আগেও এত দাম ছিল না।' তাঁর প্রতিবাদ হয়তো শতভাগ ঠিক নয়, কিন্তু বেশ কিছুটা ঠিক। সপ্তাহ কয়েক আগে কাগজের খবর ও নিজে ওষুধ দোকানির সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কয়েকটি ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
নিত্যদিনের জিনিসপত্রের দাম বাড়া যে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি অর্থাৎ বিকিকিনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাখ্যারও খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তবু দেখছি দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জনৈক তরুণ অর্থনীতিবিদ ঠিকই বলেছেন, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। যেমন- বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, ইচ্ছামাফিক কোচিং ফি বাড়ানো, এমনকি চিকিৎসকের ফি ও পরীক্ষাদির কমিশন নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ঠিকই, অর্থনীতির সামগ্রিক দিক নিয়ন্ত্রণ করা, পণ্য ও সেবা খাত উভয়কে নিয়ন্ত্রণ করা জাতীয় বিবেচনায় জরুরি। জরুরি কৃষকের বেচাকেনার দিকটাতে নজর দেওয়া, যাতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায়। কারণ তাকেও কিনতে হয় বাড়তি দামের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সংগতি রাখার প্রশ্ন নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনার পাশাপাশি কিছু বাস্তব সত্যও বুঝে নেওয়া দরকার। তা হলো আমাদের সমাজে বাজারে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত মুনাফাবাজির বিষয়টি।
তত্ত্ব ও বাস্তব যে কত ফারাক এবং সে প্রভেদের আঁচ যে প্রায়ই ভোক্তার সহ্যসীমা অতিক্রম করে যায়, তা সচ্ছল বুদ্ধিজীবী অনেক সময় অনুমান করতে পারেন না। বুঝতে পারে বাঁধাধরা আয় বা নির্দিষ্ট বেতনভুক নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে সর্বনিম্ন আয়ের মানুষ। নিত্যদিনের বাজার তাদের জন্য আতঙ্কের এবং তা শুধু রমজান মাসেই নয়, থেকে থেকে বছরের নানা মাসে।
অর্থনীতিবিদ যদি বলেন, ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কত শতাংশ খরচই বা বাড়ে, তখন তাঁর চিন্তা বাস্তব পরিস্থিতির নাগালে থাকে না। কারণ ভোজ্য তেল থেকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ভোক্তার প্রাত্যহিক প্রয়োজনের বিষয়। আর সমাজনীতির বিবেচনা সামনে নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, ওই ভোজ্য তেলে বা পেঁয়াজ-রসুন-আদা-হলুদ-ছোলা ও ডালের মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মুনাফাবাজি কত শতাংশে পৌঁছে সমাজকে অস্থিতিশীল করছে। করছে যেমন অর্থনৈতিক দিক থেকে, সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকেও।
সে আয়বৈষম্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যাবে বিত্তবান ব্যবসায়ী মুনাফাবাজ-মজুদদারের পক্ষে। যারা হিসাব-নিকাশ করে সারা বছর একটার পর একটা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়াতে থাকে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখে এতটাই বাড়াতে থাকে যে ওই শতাংশ হিসাব তখন আর বাস্তবে মেলে না। একেকটি পণ্য তাই বাজারে হিসাবি দামের দেড় গুণ, দুই গুণ, কখনো আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। বৃহৎ ব্যবসায়ীর মুনাফার জেদ তখন অবিশ্বাস্য মাত্রায় বাড়ে। কখনো বাড়ে খুচরা বিক্রেতার, অবস্থাভেদে।
কাগজ থেকে নেওয়া একটা সাম্প্রতিক হিসাব : 'আমদানি মূল্যের সঙ্গে নির্ধারিত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১০ শতাংশ পরিবহন খরচ এবং সেই সঙ্গে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীর ১ শতাংশ হারে ও খুচরা ব্যবসায়ীর ১০ শতাংশ হারে মুনাফা ধরে সম্প্রতি আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা বিক্রয়মূল্য পড়ে ১৪.২৬ টাকা। সেই পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা দরে।' তাহলে মুনাফার শতাংশ কত হলো? জানি না উন্নত দেশগুলোতে নিত্যভোগ্যপণ্য নিয়ে এ ধরনের অবিশ্বাস্য মুনাফাবাজি চলে কি না। আর চললেও সাধারণ বিবেচনায় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এ দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য।
পেঁয়াজ তো সাধারণ পণ্য, যার ব্যবহার কমানো যায়। কিন্তু কমানো যায় না, এমন পণ্যের দামও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এমন উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে তা ছোঁয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে। কখনো সহজলভ্য, সস্তা নুনের দামও দেখা যায় দুই শ-আড়াই শ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই তো কিছুদিন আগে সয়াবিন তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পরও ওই বর্ধিত মূল্য ১ শতাংশও কমানো হয়নি। মুনাফার এমনই চাহিদা।
প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য কৃষক উৎপাদক পান না। তা ধান চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন আদা যা-ই হোক না কেন। সেখানে ভূমিকা রাখে ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগী। ফলে হতাশ কৃষক তার উৎপাদন ভাবনায়। হয়তো তখন তার লক্ষ্য এমন দ্রব্য উৎপাদন, যাতে লাভ বেশি, হোক না তা সামাজিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই মধ্যবঙ্গে-উত্তরবঙ্গে তামাক চাষের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে।
তাই এ বিষয়টাতে সরকারের নজর দেওয়া দরকার, যাতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়। যে পেঁয়াজের খুচরা বাজারমূল্য কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকা সে পেঁয়াজ যদি কৃষক দুই টাকা পাঁচ টাকা দরেও বেচতে না পারে, তাহলে সে কৃষকের পক্ষে লাভজনক বিকল্প পণ্যের উৎপাদনে নজর দেওয়া স্বাভাবিক। তাতে ক্ষতি দেশের, দশের। কারণ তখন ওই পেঁয়াজ আমদানিতে বিদেশি মুদ্রা খরচ হবে, আর ভোক্তাকে বেশি দামে ওই আমদানি করা পেঁয়াজ কিনতে হবে। ক্ষতি উভয়ত। আর অবারিত আমদানিতে লাভ প্রধানত আমদানিকারক ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর। এ জন্যই আমাদের সর্বদা ঝোঁক পণ্য আমদানির দিকে; দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নয়। বিত্তবানমুখী অর্থনীতির পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।
এবারই নয়, প্রায়ই ধান উৎপাদনেও কৃষক ন্যায্য মূল্য পায় না, তা বাম্পার ফলন দেশের জন্য যত সহায়কই হোক। সব সুবিধা কেড়ে নেয় মধ্যস্বত্বভোগী ও বৃহৎ ব্যবসায়ীর মতো সুবিধাভোগী শ্রেণী। সে ক্ষেত্রে নিরুপায় কৃষককে ভিন্ন উপায় খুঁজে নিতে হয়, যা দেশের পক্ষে মঙ্গলকর নয়। আসলে নানা দিক থেকে দেশটা অসাধু ব্যবসা ও মুনাফাবাজিতে এতটা ভরে গেছে যে তা কখনো কখনো মূল ব্যবসায়ীর স্বার্থকেও আঘাত করে, সর্বদাই করে উৎপাদক শ্রেণীকে।
মুনাফাবাজি ও অসাধু ব্যবসা যে বাংলাদেশের বাজারে কী ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার ছোট্ট একটি উদাহরণ কাগজে ছাপা হয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, '৫০ টাকা কেজি দরে হলুদ বিক্রি করছে কৃষক। সেটি গুঁড়া করে মোড়ক লাগিয়ে কিভাবে কিছু কম্পানি ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।' অর্থাৎ এলেম থাকলে ঢেউ গুণেও টাকা কামানো যায়। এসব অসাধু তৎপরতারও নিয়ন্ত্রণ দরকার।
কিন্তু প্রশ্ন, কোনো সরকারের পক্ষে এত দিকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব? সমাজ যেখানে এতটা দূষিত, সেখানে সুবিধাভোগী শ্রেণীর আধিপত্য দৌরাত্ম্যে পর্যায়ে পৌঁছাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম কাগজে-কলমে মেনে নিয়েও অগ্রাহ্য করছে ব্যবসায়ী শ্রেণী। দিব্যি ইচ্ছামতো দামে চলছে জিনিসপত্র বেচা। রমজানের আগেই বাজার চড়া। কোনো কোনো পণ্য নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ দরে বিক্রি হচ্ছে- এমনটাই কাগজের খবর।
সঠিক শিরোনাম কাগজে : 'রমজানের আগেই বাজার চড়া' কিংবা 'দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য' বা 'কৃষকের মুখে হাসি নেই'। না থাকুক কৃষকের মুখে হাসি, হাসি ঠিকই আছে ব্যবসায়ী শ্রেণীর মুখে, যাদের নিয়ন্ত্রণে বাজার। বোরো ধান চাষ করে গরু বিক্রি করতে হয় ঠাকুরগাঁওয়ের যে কৃষককে, তার পাশে থাকার নৈতিক দায়িত্ব সরকারের। তাই বাজারদর নিয়ন্ত্রণ সরকারকেই করতে হবে, মুনাফার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। শুধু টিসিবিতে চলবে না। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজারদরটাও মুঠোয় রাখতে হবে- শুধু রমজানে নয়, বছরের বাকি ১১ মাসও। শেষ প্রশ্ন : কোনো রমজানে কি দ্রব্যমূল্য সরকারি ইচ্ছার দরে ধরে রাখা গেছে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments