সৈয়দ জামিল আহমেদ-বহু দিন পরে মঞ্চ আলোয় by সুজাত হোসেন
সৈয়দ জামিল আহমেদ আমাদের নাটকের এক উজ্জ্বল মুখ—বিশ্ববিদ্যালয়ে ও নাট্যমঞ্চে। কিন্তু মঞ্চে তিনি অনেক দিন ধরেই ছিলেন না। দীর্ঘ ২০ বছরের বিরতির পর আবার মঞ্চের কাজে এলেন। মামুনুর রশীদের টার্গেট প্লাটুন নাটকে করলেন মঞ্চসজ্জা আর আলো।
তাঁকে নিয়েই আজকের মূল রচনা
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি। ঢাকা জিলা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হচ্ছিল ঢাকা থিয়েটারের দুটি নাটক। সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় সংবাদ কার্টুন এবং হাবিবুল হাসানের রচনা ও নির্দেশনায় সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ। দুটি নাটকেই অভিনয় করেছিলেন আল মনসুর। টেলিভিশন নাটকে আল মনসুরের অভিনয় দেখে ভালো লেগেছিল সৈয়দ জামিল আহমেদের। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া তরুণ। নাটকের বিজ্ঞাপনে আল মনসুরের নাম দেখেই বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলেন নাটক দুটি দেখতে। নাটকের দর্শনী মূল্য ছিল দুই টাকা। তাঁর পকেটে ছিল ১০ টাকা। এক বন্ধুর কাছে ছিল ২ টাকা। ফলে ঢোকার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
গভীর মনোযোগ দিয়ে নাটক দেখলেন, তারপর আর কি! তাঁর মনোজগতে ক্রিয়া শুরু করে নাট্যশিল্পের রসায়ন। কদিন পরই যোগ দিলেন ঢাকা থিয়েটারে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্র, অন্যদিকে ঢাকার থিয়েটারে সদ্য যোগদান—এভাবেই পেয়ে গেলেন নাট্যশিল্পে সুদূর পথ পাড়ি দেওয়ার প্রথম সোপান।
তাঁকে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন ছেড়ে চলে যান এনএসডিতে। ‘এনএসডিতে আমার বিষয় ছিল পরিচালনা এবং সেট ডিজাইন। আমার সৌভাগ্য যে আমি আল কাজী, বিবি কারান্থ এবং বানচিকাউলের মতো মহারথীদের কাছে ইউরোপিয়ান থিয়েটার ও দেশজ নাটক সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি।’ বললেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এনএসডিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করলেন ফেলোশিপ, তারপর ফিরলেন দেশে। দেশে এসে নাট্যচর্চায় পুরোদমে সম্পৃক্ত করলেন নিজেকে। ১০ বছর কোনো চাকরি করেননি। কখনো একাডেমিক আবার কখনোবা ফ্রিল্যান্স—নানাভাবে নাট্যশিল্পের সঙ্গে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তখন দেশে এ শিল্পমাধ্যমটি হাঁটিহাঁটি পা-পা করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল কেবল।
প্রথম নির্দেশনা ও ডিজাইন করেছেন সমুদ্র সওয়ার নাটকে। নাট্যচক্রের স্কুলে তিনি নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন ’৭৯ সালে। এ ছাড়া ডিজাইনের কাজ করেছেন ঢাকা লিটল থিয়েটারের সঙ্গে। আর নিজের সংগঠন ঢাকা থিয়েটার তো ছিলই।
’৮৭ সালে চলে যান ইংল্যান্ডে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারইক থেকে ক্লাইভ বার্কারের অধীনে সম্পন্ন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এই সময় অগাস্তো বোয়াল, ইউজিনো বার্বা, রিচার্ড শেকের সঙ্গে কর্মশালা করার সুযোগও হাতছাড়া করেননি। ইংল্যান্ডে বসে দেখে ফেলেন পিটার ব্রুকের মহাভারতসহ ইউরোপের আরও ৫২টি নাটক।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি উঠে গেলেন ভেতরের ঘরে। এনে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডার ২০১২ নামে একটা ছোট বই। বুঝতে আর বাকি নেই, কেন বইটি হাতে দিলেন। ’৮৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ’৯৪ সালে হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান। তার তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যমঞ্চ নাটমণ্ডল। ফুল ব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন আমেরিকার অ্যান্টিঅক
ইউনিভার্সিটিতে। প্রথম বাংলা নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করলেন সেলিম আল দীনের চাকা নাটকের। নাটকটি সেখানে মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকটির অভিনয়রীতি নিয়ে যৌথ নির্দেশনা দিয়েছেন ডেনি প্যাট্রেজের সঙ্গে। একই সঙ্গে করেছেন মঞ্চ ও আলোক নির্দেশনার কাজটিও।
পরবর্তী সময়ে ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় দেশের মঞ্চে চাকা নাটকটির নির্দেশনা দেন ১৯৯১ সালে।
বললেন পরিবর্তনকামী নাটক নিয়ে কাজ করার প্রতি তার ভালো লাগার কথা। লোকনাট্যের ওপর ড. আনিসুজ্জামানের অধীনে তিনি পিএইচডি করেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করলেন ৭০টি লোকনাট্য রীতি। নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে নাটক হয়।
এ ছাড়া তিনি বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক নাটকের জন্য ঘুরে বেরিয়েছেন ভারত, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বার্মা এবং থাইল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে। তবে নাটকের ওপর লেখা তাঁর প্রথম গ্রন্থ হাজার বছর: বাংলাদেশের নাটক ও নাট্যকলা। এ ছাড়াও রয়েছে ৭০টি লোকনাট্য নিয়ে গ্রন্থ ‘অচিন পাখি’।
পরিবর্তনকামী বা উন্নয়নকামী নাটকের প্রসঙ্গ আসতেই জানালেন, এ ক্ষেত্রে তিনি অগাস্তো বোয়ালের নাট্যরীতিতেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের করাচিতে এক হাজার অওর এক থি রাঁতে নাটকে নির্দেশনা দিলেন। এনএসডিতে সেলিম আল দীনের চাকা নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন হিন্দি ভাষায়। ২০১০ সালে এনএসডিতে পুনরায় নির্দেশনা দেন শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটক। ২০১২ সালে কলকাতায় উষা গাঙ্গুলির আমন্ত্রণে শ্যামার উড়াল নাটক-এর নির্দেশনা দিয়েছেন।
গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে অনেকগুলো বছর কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ও ডিজাইনগুলো সম্পর্কে বললেন, ‘আমি কোনো কাজকেই ছোট বা বড় বলে পার্থক্য করতে চাই না। কিন্তু কিছু কাজ হয়তো আমার ভালো লেগেছে, সেগুলোর কথা বলা যায়। যেমন নাগরিকের অচলায়তন, বিসর্জন, ঢাকা পদাতিকের এই দেশে এই বেশে, থিয়েটারের সাত ঘাটের কানাকড়ি, ঢাকা থিয়েটারের চাকা, কীর্তনখোলা, ফণীমনসা, কেরামত মঙ্গল, আরণ্যকের গিনিপিগসহ এ রকম আরও অনেক নাটকের ডিজাইনের কাজটি করেছিলাম। নির্দেশনার কাজটি করেছিলাম ঢাকা পদাতিকের তালপাতার সেপাই, বিষাদসিন্ধু, ঢাকা থিয়েটারের চাকা, চট্টগ্রামে বাদল সরকারের ভোমা এবং বার্টল্ড ব্রেখটের সমাধান নাটকসহ আরও বেশ কিছু নাটকের সঙ্গে।
১৯৯২ সালে ঢাকা পদাতিকের বিষাদসিন্ধু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন ড. বিপ্লব বালা এবং সংগীতের কাজটি করেছিলেন অশোক কর্মকার। তারপর দীর্ঘ ২০ বছর কেটে গেল।’ এই দীর্ঘ বিরতির পেছনে গল্প কী? নাকি কোনো অভিমান? হাসতে হাসতে বললেন, অভিমানের তো প্রশ্নই আসে না। আসলে এত প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে পারছিলাম না। এই দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে তিনি হয়তো গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করেননি, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের নাট্য নির্দেশনার কাজটি ঠিকঠাক করে গেছেন। তিনটি ভার্সনে বেহুলার ভাসান, সংভংচং, কমলা রানীর সাগরদীঘি, চাকাসহ আরও বেশ কয়েকটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রশ্ন করি, শুনেছি মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক টার্গেট প্লাটুন-এর সঙ্গে কাজ করছেন। ২০ বছরের বিরতির পর আবার একাডেমীর বাইরে কাজ—এ প্রসঙ্গে একটু বলুন।
‘একদিন হঠাৎ মামুনুর রশীদের ফোন। বললেন, উনি একটা নাটক করবেন এবং আমাকে সে নাটকের আলোক নির্দেশনার কাজটি করতে হবে। নাটকের গল্প ও ডিজাইনের কথা শুনে প্রস্তাবটা বেশ লোভনীয় মনে হয়েছিল। মামুন ভাইয়ের কাজে নতুনত্বের একটা আবছা ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। প্রচুর কাজ করার জায়গা রয়েছে নাটকটিতে। তারপর রাজি হয়ে যাই। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক অন্যদিকে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা সব মিলে অনুভূতি বেশ ভালো।’
বিকেল চারটায় আমরা কথা বলা শুরু করেছিলাম, ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকেছে সন্ধ্যা ছয়টায়। এবার বিদায়ের পালা। বহুদিন পর ঢাকার মঞ্চ সৈয়দ জামিল আহমেদের মঞ্চ ও আলোর কাজ দেখবে। এই কীর্তিমান মানুষটির কাছে এলে বোঝা যায়, নাটক করার সঙ্গে পড়াশোনা, মেধা ও সৃজনশীলতার মেলবন্ধনে তিনি নিজেকে যেখানে নিয়ে গেছেন, সে উচ্চতায় পৌঁছানো সহজ নয়। সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাধনাই তো একজন শিল্পীর মনকে ঋদ্ধ করতে পারে।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি। ঢাকা জিলা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হচ্ছিল ঢাকা থিয়েটারের দুটি নাটক। সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় সংবাদ কার্টুন এবং হাবিবুল হাসানের রচনা ও নির্দেশনায় সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ। দুটি নাটকেই অভিনয় করেছিলেন আল মনসুর। টেলিভিশন নাটকে আল মনসুরের অভিনয় দেখে ভালো লেগেছিল সৈয়দ জামিল আহমেদের। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া তরুণ। নাটকের বিজ্ঞাপনে আল মনসুরের নাম দেখেই বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলেন নাটক দুটি দেখতে। নাটকের দর্শনী মূল্য ছিল দুই টাকা। তাঁর পকেটে ছিল ১০ টাকা। এক বন্ধুর কাছে ছিল ২ টাকা। ফলে ঢোকার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
গভীর মনোযোগ দিয়ে নাটক দেখলেন, তারপর আর কি! তাঁর মনোজগতে ক্রিয়া শুরু করে নাট্যশিল্পের রসায়ন। কদিন পরই যোগ দিলেন ঢাকা থিয়েটারে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্র, অন্যদিকে ঢাকার থিয়েটারে সদ্য যোগদান—এভাবেই পেয়ে গেলেন নাট্যশিল্পে সুদূর পথ পাড়ি দেওয়ার প্রথম সোপান।
তাঁকে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন ছেড়ে চলে যান এনএসডিতে। ‘এনএসডিতে আমার বিষয় ছিল পরিচালনা এবং সেট ডিজাইন। আমার সৌভাগ্য যে আমি আল কাজী, বিবি কারান্থ এবং বানচিকাউলের মতো মহারথীদের কাছে ইউরোপিয়ান থিয়েটার ও দেশজ নাটক সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি।’ বললেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এনএসডিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করলেন ফেলোশিপ, তারপর ফিরলেন দেশে। দেশে এসে নাট্যচর্চায় পুরোদমে সম্পৃক্ত করলেন নিজেকে। ১০ বছর কোনো চাকরি করেননি। কখনো একাডেমিক আবার কখনোবা ফ্রিল্যান্স—নানাভাবে নাট্যশিল্পের সঙ্গে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। তখন দেশে এ শিল্পমাধ্যমটি হাঁটিহাঁটি পা-পা করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল কেবল।
প্রথম নির্দেশনা ও ডিজাইন করেছেন সমুদ্র সওয়ার নাটকে। নাট্যচক্রের স্কুলে তিনি নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন ’৭৯ সালে। এ ছাড়া ডিজাইনের কাজ করেছেন ঢাকা লিটল থিয়েটারের সঙ্গে। আর নিজের সংগঠন ঢাকা থিয়েটার তো ছিলই।
’৮৭ সালে চলে যান ইংল্যান্ডে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারইক থেকে ক্লাইভ বার্কারের অধীনে সম্পন্ন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এই সময় অগাস্তো বোয়াল, ইউজিনো বার্বা, রিচার্ড শেকের সঙ্গে কর্মশালা করার সুযোগও হাতছাড়া করেননি। ইংল্যান্ডে বসে দেখে ফেলেন পিটার ব্রুকের মহাভারতসহ ইউরোপের আরও ৫২টি নাটক।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি উঠে গেলেন ভেতরের ঘরে। এনে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডার ২০১২ নামে একটা ছোট বই। বুঝতে আর বাকি নেই, কেন বইটি হাতে দিলেন। ’৮৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ’৯৪ সালে হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান। তার তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যমঞ্চ নাটমণ্ডল। ফুল ব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে শিক্ষকতা করেছেন আমেরিকার অ্যান্টিঅক
ইউনিভার্সিটিতে। প্রথম বাংলা নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করলেন সেলিম আল দীনের চাকা নাটকের। নাটকটি সেখানে মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকটির অভিনয়রীতি নিয়ে যৌথ নির্দেশনা দিয়েছেন ডেনি প্যাট্রেজের সঙ্গে। একই সঙ্গে করেছেন মঞ্চ ও আলোক নির্দেশনার কাজটিও।
পরবর্তী সময়ে ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় দেশের মঞ্চে চাকা নাটকটির নির্দেশনা দেন ১৯৯১ সালে।
বললেন পরিবর্তনকামী নাটক নিয়ে কাজ করার প্রতি তার ভালো লাগার কথা। লোকনাট্যের ওপর ড. আনিসুজ্জামানের অধীনে তিনি পিএইচডি করেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করলেন ৭০টি লোকনাট্য রীতি। নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে নাটক হয়।
এ ছাড়া তিনি বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক নাটকের জন্য ঘুরে বেরিয়েছেন ভারত, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বার্মা এবং থাইল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে। তবে নাটকের ওপর লেখা তাঁর প্রথম গ্রন্থ হাজার বছর: বাংলাদেশের নাটক ও নাট্যকলা। এ ছাড়াও রয়েছে ৭০টি লোকনাট্য নিয়ে গ্রন্থ ‘অচিন পাখি’।
পরিবর্তনকামী বা উন্নয়নকামী নাটকের প্রসঙ্গ আসতেই জানালেন, এ ক্ষেত্রে তিনি অগাস্তো বোয়ালের নাট্যরীতিতেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের করাচিতে এক হাজার অওর এক থি রাঁতে নাটকে নির্দেশনা দিলেন। এনএসডিতে সেলিম আল দীনের চাকা নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন হিন্দি ভাষায়। ২০১০ সালে এনএসডিতে পুনরায় নির্দেশনা দেন শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটক। ২০১২ সালে কলকাতায় উষা গাঙ্গুলির আমন্ত্রণে শ্যামার উড়াল নাটক-এর নির্দেশনা দিয়েছেন।
গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে অনেকগুলো বছর কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ও ডিজাইনগুলো সম্পর্কে বললেন, ‘আমি কোনো কাজকেই ছোট বা বড় বলে পার্থক্য করতে চাই না। কিন্তু কিছু কাজ হয়তো আমার ভালো লেগেছে, সেগুলোর কথা বলা যায়। যেমন নাগরিকের অচলায়তন, বিসর্জন, ঢাকা পদাতিকের এই দেশে এই বেশে, থিয়েটারের সাত ঘাটের কানাকড়ি, ঢাকা থিয়েটারের চাকা, কীর্তনখোলা, ফণীমনসা, কেরামত মঙ্গল, আরণ্যকের গিনিপিগসহ এ রকম আরও অনেক নাটকের ডিজাইনের কাজটি করেছিলাম। নির্দেশনার কাজটি করেছিলাম ঢাকা পদাতিকের তালপাতার সেপাই, বিষাদসিন্ধু, ঢাকা থিয়েটারের চাকা, চট্টগ্রামে বাদল সরকারের ভোমা এবং বার্টল্ড ব্রেখটের সমাধান নাটকসহ আরও বেশ কিছু নাটকের সঙ্গে।
১৯৯২ সালে ঢাকা পদাতিকের বিষাদসিন্ধু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন ড. বিপ্লব বালা এবং সংগীতের কাজটি করেছিলেন অশোক কর্মকার। তারপর দীর্ঘ ২০ বছর কেটে গেল।’ এই দীর্ঘ বিরতির পেছনে গল্প কী? নাকি কোনো অভিমান? হাসতে হাসতে বললেন, অভিমানের তো প্রশ্নই আসে না। আসলে এত প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে পারছিলাম না। এই দীর্ঘ সময়ের বিরতিতে তিনি হয়তো গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করেননি, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের নাট্য নির্দেশনার কাজটি ঠিকঠাক করে গেছেন। তিনটি ভার্সনে বেহুলার ভাসান, সংভংচং, কমলা রানীর সাগরদীঘি, চাকাসহ আরও বেশ কয়েকটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রশ্ন করি, শুনেছি মামুনুর রশীদের রচনা ও নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক টার্গেট প্লাটুন-এর সঙ্গে কাজ করছেন। ২০ বছরের বিরতির পর আবার একাডেমীর বাইরে কাজ—এ প্রসঙ্গে একটু বলুন।
‘একদিন হঠাৎ মামুনুর রশীদের ফোন। বললেন, উনি একটা নাটক করবেন এবং আমাকে সে নাটকের আলোক নির্দেশনার কাজটি করতে হবে। নাটকের গল্প ও ডিজাইনের কথা শুনে প্রস্তাবটা বেশ লোভনীয় মনে হয়েছিল। মামুন ভাইয়ের কাজে নতুনত্বের একটা আবছা ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। প্রচুর কাজ করার জায়গা রয়েছে নাটকটিতে। তারপর রাজি হয়ে যাই। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক অন্যদিকে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা সব মিলে অনুভূতি বেশ ভালো।’
বিকেল চারটায় আমরা কথা বলা শুরু করেছিলাম, ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকেছে সন্ধ্যা ছয়টায়। এবার বিদায়ের পালা। বহুদিন পর ঢাকার মঞ্চ সৈয়দ জামিল আহমেদের মঞ্চ ও আলোর কাজ দেখবে। এই কীর্তিমান মানুষটির কাছে এলে বোঝা যায়, নাটক করার সঙ্গে পড়াশোনা, মেধা ও সৃজনশীলতার মেলবন্ধনে তিনি নিজেকে যেখানে নিয়ে গেছেন, সে উচ্চতায় পৌঁছানো সহজ নয়। সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর সাধনাই তো একজন শিল্পীর মনকে ঋদ্ধ করতে পারে।
No comments