এইচএসসি পরীক্ষা: পাসের হার ৭৬.৫০%, জিপিএ-৫ ৫১,৪৬৯-দেশজুড়ে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস

মেঘময় শ্রাবণ সকালে আশা-উৎকণ্ঠার চাদর মুড়ি দিয়ে গতকালের দিনটি শুরু করেছিলেন দেশের নয় লাখ ১৭ হাজার ৬৭৩ তরুণ শিক্ষার্থী। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই তরুণদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কাছে ম্লান হয়ে গেছে শ্রাবণধারা। শহর-গ্রাম মিলিয়ে দেশের এ-কোণ থেকে ও-কোণে তাঁরা যে আনন্দের ভেলা ছুটিয়েছেন তাতে পরিবার-পড়শী যুক্ত হয়ে সারা দেশকে যেন উৎসবে মাতিয়েছেন।


এ আনন্দের উপলক্ষ এবারের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অনন্য ফলাফল। পাসের হার আর জিপিএ-৫—দুটোতেই গতবারকে ছাড়িয়ে গেছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে আনন্দে উদ্বেল ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
গতকাল বুধবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা ফলাফলের হিসাবে দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এ বছর গড় পাসের হার ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫১ হাজার ৪৬৯ জন শিক্ষার্থী, যা গতবারের চেয়ে ১৭ হাজার ৮৪ জন বেশি।
আর মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডসহ ১০ বোর্ডের গড় উত্তীর্ণের হার ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। ১০টি বোর্ডে এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬১ হাজার ১৬২ জন। গতবার পেয়েছিলেন ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এবারের ফলাফলে সব সূচকেরই উন্নতি হয়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আন্তরিক চেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতায় এই ফল সম্ভব হয়েছে।
এবার এইচএসসিতে প্রথমবারের মতো বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা হয় সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এই বিষয়টিতে আগের চেয়ে এবার ভালো ফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ঢাকা বোর্ডে গত বছর বাংলা প্রথম পত্রে পাসের হার ছিল ৯৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এবার হয়েছে ৯৯ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ সৃজনশীল প্রশ্নপত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের যে ভয় ছিল, তা কেটে গেছে।
আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিম, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা (বিএম) ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা ইন বিজনেস স্টাডিজ (ডিআইবিএস) পরীক্ষার ফলও গতকাল একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।
দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী। এর আগে সকালে তাঁর নেতৃত্বে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলাফলের কপি হস্তান্তর করেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী রাজশাহী সরকারি কলেজ ও রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের ফল ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠিয়ে সেখানকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন। ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করায় এখন প্রতিবছরই শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা মেধাবী। প্রতিবছর ভালো ফলই তার প্রমাণ।’
হিসাব-নিকাশ: এবার আটটি সাধারণ বোর্ডের মোট সাত লাখ ৪২ হাজার ৪৪৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪০ জন। আট বোর্ডে বিজ্ঞান শাখায় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ, মানবিকে ৭০ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় পাসের হার ৮৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এবারও পাঁচটি মানদণ্ডে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের ২০টি সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। এতে ঢাকা বোর্ডে বরাবরের মতো এবারও শীর্ষে অবস্থান করছে রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। তবে নরসিংদীর আব্দুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ ঢাকা বোর্ডে দ্বিতীয় হয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে গ্রামেও পড়াশোনা ভালো হচ্ছে। গ্রামের প্রতিষ্ঠানও শীর্ষে চলে আসছে। এগুলোই শিক্ষার ইতিবাচক লক্ষণ।
এ বছর সারা দেশের এক হাজার ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থীই উত্তীর্ণ হয়েছেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গতবারের চেয়ে ১৪৪টি বেড়েছে। বিপরীতে ২৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজনও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। গতবারও এই সংখ্যা ২৪ ছিল। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এখানে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেখতে চাই না।’
আনুষ্ঠানিকভাবে বেলা আড়াইটায় ফল প্রকাশের কথা থাকলেও দুপরের পর থেকেই তা জানা যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের আগেই ফল জেনে যায়। পাশাপাশি ওয়েবসাইট থেকে ও মুঠোফোনে সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠিয়েও ফল জানা গেছে। ফল প্রকাশের পরই বাঁধভাঙা আনন্দে ভাসতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ (চতুর্থ), নটর ডেম কলেজসহ (পঞ্চম) বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীদের নেচে-গেয়ে আনন্দ করতে দেখা গেছে।
সিলেট বোর্ডে সর্বোচ্চ: এবার আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হার সবচেয়ে বেশি সিলেট বোর্ডে—৮৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন দুই হাজার ৬৫ জন। এই বোর্ডের শিক্ষার্থীরা বরাবরই পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু গত এসএসসি এবং এবারের এইচএসসিতে শীর্ষে অবস্থান করায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এলাকা সিলেট অঞ্চলে উল্লেখ করে গতকাল এক সাংবাদিক এই বোর্ডে ভালো ফলের কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সিলেটসহ অন্যান্য পশ্চাৎপদ এলাকায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই ফল ভালো হয়েছে।
পিছিয়ে বরিশাল: এ বছর পাসের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৬৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক হাজার ৮৯৫ জন।
অন্যান্য বোর্ডের ফল: ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এ বছর পাসের হার ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ। গতবার ছিল ৭৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা সারা দেশের মধ্যে সর্বাধিক—২৫ হাজার ১০৪ জন। অবশ্য বরাবরই এই বোর্ডের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জিপিএ-৫ পেয়ে আসছেন।
রাজশাহীতে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ছয় হাজার ৮৭২ জন।
কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৭৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন দুই হাজার ১৫০ জন। যশোরে পাসের হার ৬৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২২৯ জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাস করেছেন ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিন হাজার ১৪৫ জন। দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন পাঁচ হাজার নয়জন।
বিদেশের কেন্দ্রের ফল: ঢাকা বোর্ডের অধীন বিদেশের পাঁচটি কেন্দ্রে ১৭৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৬৯ জন। পাসের হার ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩২ জন।
ভর্তির জন্য পর্যাপ্ত আসন আছে: সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আসনের অভাবে কোনো শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে পারবে না, এটা ঠিক নয়। পর্যাপ্ত আসন আছে। এবার বেশ কিছু নতুন কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে কিছু আসন বাড়ে। সুতরাং আসন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তবে পছন্দমতো জায়গায় ভর্তির সমস্যা তো থাকবেই। এটা অস্বীকার করার কারণ নেই।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দ্রুতই সভা করে ভর্তির সমস্যাসহ অন্য বিষয়গুলোর সমাধান করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নোমান উর রশীদ, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুন নূরসহ বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা।

No comments

Powered by Blogger.