বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের কৃতিত্ব ও নাম পরিবর্তন by কাজী গোলাম মোস্তফা
বিজয় দিবসের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জামায়াত তাদের কৃতিত্বের দাবি জানিয়েছে_'একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে'! কিছুৃদিন আগে একাত্তরের ঘাতকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার নামে প্রহসনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে_এরই ধারাবাহিকতায় এখন গাইছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের কৃতিত্ব গাথা।
একবার ভাবুন তো কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া হলে এমন দাবি করা যায়। তারা বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিকে অবমূল্যায়ন করছে, নাকি অবজ্ঞা করছে; অথবা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীন প্রচেষ্টায় মাঠে নেমেছে। হতে পারে ইতিহাস বিকৃতির এ এক নতুন প্রয়াস। তারা কেমন করে ভাবতে পারল বাংলার মানুষ এত সহজে তাদের একাত্তরের ঘৃণ্য ভূমিকা ও অপকর্মের কথা ভুলে যাবে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের বর্তমান নেতারা প্রায় সবাই সে সময়ে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিহ্নিত দোসর। তাদের সৃষ্ট রাজাকার, আল্-বদর ও আল্-শামস বাহিনী দেশের অগুনতি নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে। মা-বোনদেরকে পাকসেনাদের নির্যাতন, নিপীড়ন, লালসা ও গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ দুঃসহ স্মৃতি এত সহজে মুছে যাবার নয়। এই দলটির নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে দেশে-বিদেশে পাকিস্তানের প েপ্রকাশ্য সমর্থন, বিবৃতি ও দূতিয়ালি করে বেরিয়েছে। কথাটি তারা মনে না রাখলেও বাংলার মানুষ এত সহজে ভুলবে না। মানুষ ভুলবে না দেশকে মেধাশূন্য করার মানসে বুদ্ধিজীবী হত্যার কথাও। তারা তো আসলে জ্ঞানপাপী, যা কিছু করছে একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে করছে। ওরা ভাবছে ধর্মকে ব্যবহার করে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহসনমূলক সংবর্ধনা দিয়ে ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জামায়াতের কৃতিত্বের দাবি জানিয়ে একসময়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ধোঁকা দিয়ে তাদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট করতে পারবে।
চারদলীয় জোটের অংশীদার হয়ে মতায় থাকাকালীন সময়ে জামায়াত গোয়েবল্সীয় থিওরিতে ভালই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তারা দেখেছে বিএনপি কর্তৃক দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধুর প েস্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করাকে অভিনব প্রচারণার গুণে স্বাধীনতার ঘোষণাকে রূপান্তরের প্রয়াস। আরও দেখেছে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার চার নম্বর জন্মদিন পালনের মাধ্যমে পৃথিবীতে এক জনমে চারবার জন্ম নেয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জনে প্রচারণার মাহাত্ম্য। হয়ত এই শিা হতে একই কায়দায় জামায়াত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের দলের কৃতিত্ব দাবি করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জামায়াত ভাবছে কয়েক বছর যাবত এ দাবি অব্যাহত রাখলে একসময় হয়ত নতুন প্রজন্মের কাছে বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পেতেও পারে। ভাবছে এভাবে জামায়াত কালিমামুক্ত হবে এবং দেশের রাজনীতিতে একদিন শক্তিশালী অবস্থানে যেতে সমর্থ হবে।
দেশে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীনতার চেতনা যতদিন জাগ্রত থাকবে ততদিন তাদের সে আশায় গুড়েবালি। বিষয়টি জামায়াতের ভালভাবেই জানা আছে, আর এ কারণে তারা প্রস্তাবিত শিানীতির বিরোধিতায় নেমেছে। মানুষকে প্রকৃত অর্থে শিতি করায় তাদের ঘোরতর আপত্তি। মাদ্রাসা শিা ব্যবস্থায় ধর্মীয় লেখাপড়ার পাশাপাশি জাতির সত্য ইতিহাস, বিজ্ঞান, ইংরেজী ও সাধারণ জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করায় তাদের আপত্তি। শিানীতিতে ধমর্ীয়শিার কোনটাই বাদ দেয়ার কথা বলা হয়নি, শুধু আধুনিকীকরণের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটি বৃহৎ ছাত্রসমাজ জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আধুনিক শিায় শিতি হওয়াটা তাদের পছন্দনীয় নয়। জ্ঞান অর্জন কি ধর্মহীনতা? তা যদি না হয় তবে শিানীতির বিরোধিতা কেন? আসল বিষয়টি হলো বৃহৎ ছাত্রসমাজকে জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা হতে বঞ্চিত করে তাদের অন্ধকারে রেখে জামায়াতের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে অপব্যবহার করা। জামায়াত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্বের দাবি করছে, অথচ তাদেরই ছায়া ও ভ্রাতৃসংগঠনগুলো মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াতে আপত্তি জানাচ্ছে _এতেই তাদের প্রকৃত মুখোশটি উন্মোচিত হচ্ছে। যে দলই সরকার গঠন করুক সরকার পরিবর্তনের অনুষঙ্গ হিসেবে আসে আমলাতন্ত্র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন। আরও হয় ছবি নামানো-ওঠানো, শিা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, গবর্নিং বডির পরিবর্তন, কিছু দিবস পালনের পরিবর্তিত উদ্যোগ, দরপত্র, ইজারা, টোল ইত্যাদিতে দলীয় লোকজনের কতর্ৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ভাগ নিয়ে দলীয় কোন্দল ইত্যাদি। এছাড়াও চলে নাম পরিবর্তনের হিড়িক। সব এখন প্রায় প্রথায় পরিণত হয়েছে। তবে প্রথমদিকে কিছুদিন বিরোধী দল এবং মিডিয়াগুলো এর বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে। এই প্রক্রিয়া চলে ছয়-সাত মাস ধরে। তারপর ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে, অন্তর্দ্বন্দ্ব কমে সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং একসময় হৈ চৈ যায় থেমে। তবে একটি বিষয়ে ব্যতিক্রম দেখা গেল এবার, সরকার গঠনের প্রায় এক বছর পরে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির মহাসচিব এবং স্থায়ী কমিটির কতিপয় নেতা সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেন এবং জিয়ার নাম পরিবর্তনের মাসুল দিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। যাঁরা সরকারকে হুঁশিয়ার করলেন তাঁরাও যে একই দোষে দুষ্ট সে কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন। তারা বঙ্গবন্ধু সেতু, নভোথিয়েটার, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামসহ আরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ফেলেছিলেন। তখন সরকারে থাকার সময় তাঁরা একবারও ভাবেননি কোন দিন আওয়ামী লীগ সরকারে এলে এর খোলনল্চে সবই পাল্টে যাবে। অনুরূপভাবে বর্তমান সরকারও ভাবছে না পরবর্তীতে আবার বিএনপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মন্ত্রিসভার প্রথম পর্যায়ের কোন বৈঠকেই জিয়ার নামসহ সকল নামই পুনর্বহাল হবে। নাম পরিবর্তন প্রথা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নয়, এইটি সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিক দলকেই পাল্টাপাল্টির এই ইঁদুর-বেড়াল খেলাটা বন্ধ করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে কেবল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে যাবে তা নয়, অনেক কিছুতেই আসবে পরিবর্তন। বর্তমান সরকার শুধু অহংবোধের কারণে একটি গণদাবিকে উপো করছে, তারা একবারও ভাবছে না শীতকালে পূর্বের সময় পুনর্বহাল না করাতে মানুষকে কী অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সরকারের গণবিচ্ছিন্ন মাথাভারি উপদেষ্টারা কী পরামর্শ দিয়েছেন জানি না, তবে বিরোধী দল এই গণদাবিকে লুফে নিয়ে ভবিষ্যতে তা পূরণে আশ্বস্ত করলে নিঃসন্দেহে মানুষ তাদের দিকে বেশি ঝুঁকবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ডে-লাইট সেভিং উদ্দেশে সময়ে পরিবর্তন আনা হয়, তবে সে পরিবর্তন হয় অস্থায়ী, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুনরায় গ্রীনিচ মান সময় পদ্ধতিতে তারা ফেরত যায়। আর আমরা স্থায়ীভাবে গ্রীনিচ মান সময় পদ্ধতি হতে বিচু্যত হতে চলেছি, অহংবোধেদুষ্ট এই ব্যবস্থা নিশ্চয় টেকসই হতে পারে না। তাছাড়া সরকার ইচ্ছে করলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রীনিচ মান সময় পদ্ধতির সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড সময়ের পার্থক্য প্রতিপালন না করে ভূগোলকে বদলে দিতে পারে না। এই বিষয়ে সরকারের দৃঢ় অবস্থান অনেকটা অপরিণামদর্শিতারই নামান্তর।
সম্প্রতি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন উপল েগুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে তিনি জানেন না। অথচ না জেনেই তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন 'কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনকে ভিার ঝুলি পূর্ণ করার সুযোগ ভেবে দেশবাসীকে অপমান না করতে।' প্রতিদিন দেশের প্রত্যেকটি সংবাদপত্রে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনের হালনাগাদ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান বিষয়ে অপমানসূচক কিছু কখনও দেশবাসীর নজরে পড়েনি। উপরন্তু মনে হয়েছে বাংলাদেশ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া গত তিন মাস যাবত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি সফরে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দৃঢ়ভাবে বলেছেন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর অধিক কার্বন নিঃসরণ দায়ী। তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যের রুদ্র রোষের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অভিযোজন খাতে অর্থ প্রদানের দায় উন্নত দেশগুলোর ওপরই বর্তায়। তিনি আরও বলেছেন স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার অতিরিক্ত শর্তবিহীন অভিযোজন তহবিল প্রদান করতে হবে। তাছাড়া স্বল্পোন্নত জি-৭৭ ভুক্ত ১৩০টি দেশের সঙ্গে থেকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য পৃথক তহবিল গঠনে আলাদা অবস্থান গ্রহণ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বলিষ্ঠ ও দৃঢ় অবস্থান বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নজর কেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা টেলিফোনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন ও বিশ্বের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অভিঘাত মোকাবেলায় সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেছেন। এ সকল কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এর চেয়ে বরং বিরোধীদলীয় নেতা ভিার ঝুলি পূর্ণ করার কথা বলে দেশের অবস্থানকে অপমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দেশবাসী আশা করে বিরোধীদলীয় নেতা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইসু্যতে ভালভাবে জেনে নিয়ে দেশের স্বার্থে আরও গঠনমূলক অবদান রাখবেন।
No comments