রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে ২০০১-এর নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা by মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
(গতকালের পর) জাতীয়তাবাদের এই সজ্ঞান পরিবর্তন অর্থাৎ বাঙালী থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাঙালী থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পরিকল্পিত পরিবর্তনের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন।
বাঙালী জাতীয়তাবাদ শুধু ভাষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে, এর বিপরীতে “বাংলাদেশ” সর্বপ্রথম সেই এলাকার পরিচয় বহন করে, যে এলাকা বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে এই পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য ছিল না। তৎসময়ে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে “ধর্মনিরপেক্ষতা” অন্যতম মূল্যনীতি বাতিল করার ফলে বাংলাদেশের সংবিধান সাম্প্রদায়িক সংবিধানে পরিণত হয়। বাংলাদেশের আরেকটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি “সমাজতন্ত্র” পরিবর্তন করে সংবিধানে “সামাজিক ন্যায় বিচার” অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ধ্বংসকারী এই পরিবর্তনসমূহ ছিল সুপরিকল্পিত এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পরিচিতির মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দেশী ও বিদেশী শক্তির কাছে জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রয়াস।
জিয়াউর রহমান হত্যার স্বল্পকাল পরেই অপর সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরির মতোই ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পরবর্তীত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমূহকে আরও অগ্রসর করে নিয়ে গেলেন। এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মৌলবাদী অনুভূতিগুলোকে সর্বাত্মকভাবে জাগরিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নামে একটি দল গঠিত হয়, যে দলটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তার পূর্বসূরির ন্যায় অভিন্ন। ১৯৮৮ সালের ৭ জুলাই এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নীতি এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে গুরুতর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হয়।
এরশাদ পতনের পর বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর দল বিএনপি এবং তিনি আর মরহুম স্বামী জিয়াউর রহমানের নীতিগুলোই অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার হয়। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মরহুম স্বামী জিয়াউর রহমানের ভারত বিরোধী নীতি অনুসরণ করেন। এই নীতি পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দুবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনা শক্তিশালী হতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাজনীতির মূল শ্রোতে পুনর্বাসিত হয় এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের চূড়ান্ত শিখরে তাদের অবস্থান সুসংহত হতে থাকে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয় ভূলুণ্ঠিত, যা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার নামান্তর।
বর্ণিত রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলবাদী উন্মাদনার বিস্তার ঘটতে থাকে। ইসলামের প্রকৃত চেতনায় নয় এবং বিকৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল ঐ গোষ্ঠী। তৎকালীন শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, আইনজীবীসহ প্রগতিশীল চিন্তাধারার ব্যক্তিদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন ও নিপীড়ন এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার শাসনকালে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করায় ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের অনুকূলে সংবিধান সংশোধনের কোন উপায় এ সরকারের ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণ করার স্বার্থে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের শরণার্থী হিসেবে ফিরে যাওয়া চাকমাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করার বিষয়টি বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকারী বাঙালীদের দখলে থাকা আদিবাসীদের ভূমি ফেরত দেয়ার শর্তটি কাক্সিক্ষতভাবে বাস্তবায়িত হয় নাই। ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্বে সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইনকে সংশোধন করে একটি বিল পাস করা হয়। ঐ সংশোধনী অবশেষে নীতিগতভাবে সংখ্যালঘুদের ব্যবসা ও সম্পদ ফেরত দেয়ার পথ সহজতর হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী ক্ষমতাসীন দলের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্থাৎ মূল ধারায় প্রবর্তন করার সুযোগ ছিল না। যদিও এটা ছিল আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনীতির ভিত্তি। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রকট আকারে বিদ্যমান ছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনাতেই সকল সম্প্রদায়ের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পেরেছে এবং এই প্রশ্নের কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ পূর্তির পরে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী ২০০১ সালের ১৬ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। নির্বাচনে অবৈধ উপায় অবলম্বন করার প্রশ্নে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রয়েছে। ভোট গণনার পূর্বে ভুয়া ব্যালট পেপার দিয়ে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে, কোন কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখা, প্রতিপক্ষ দলের ভোট কম করে গণনা করা, ভুয়া কাগজপত্র সৃষ্টি করে মিডিয়াতে ভুল ফল ঘোষণা করাসহ বিভিন্ন উপায়ে ভোট কারচুপি হয় বিধায় জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনগণের রায়ের সঠিক প্রতিফলন হয় না। এই অভিজ্ঞতার আলোকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। অরাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব পরবর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান। সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এই সরকার নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত ব্যতীত শুধু দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রধান দল বা জোটগুলো প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের নিয়োগকে সমর্থন করে এই আশা থেকে যে, তারা সরকারে অবস্থান করার সময় নিরপেক্ষ থাকবেন। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকেই এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে যে, পররাষ্ট্রনীতিসহ সরকারের সকল নীতি, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব পালনের অধিকার তাদের রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের সবচেয়ে সক্রিয় সরকার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিল। সরকার গঠনের পরমুহূর্ত থেকেই তাদের প্রশ্নবিদ্ধ আরচণের ফলে জনমনে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উৎকণ্ঠা ও হতাশার সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে ১৪০০-এরও বেশি সরকারী কর্মকর্তাদের বদলি করে। প্রধান উপদেষ্টা ২০০১ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখ রাতেই শপথ নেয়ার পরক্ষণই অশোভনীয় দ্রুততার সঙ্গে ১৩ জন গুরুত্বপূর্ণ সচিবকে বদলি করে এর সূচনা করেছিলেন। সচিবালয়সহ বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা যাঁরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নির্বাচনের কাজে ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন তাঁদের নির্বিচারে বদলি করা হয়। সচিবালয়সহ মাঠ পর্যায়ে সাজানো প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা-ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতকর্মীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকা-ে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ও দর্শনের পরিবর্তনকারী শক্তির নীতি ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ওপর কৌশলগত নির্যাতনের ফলে তারা স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের জন্য সুসংগঠিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভীতি ও হুমকির মুখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী এবং সমর্থক দল ও গোষ্ঠীর নেতা ও কর্মীর অনেক ক্ষেত্রে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল, বিধায় নির্বাচনের প্রচার ও সাংগঠনিক কর্মককা-ে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তৎসময়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার অভাব সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। বস্তুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকা- রাষ্ট্র এবং সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে, দেশকে সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে রেখে যায় এবং রাজনৈতিক বিভক্তি বৃদ্ধি পায়। নৈরাজ্যের শক্তি সক্রিয় হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিত সহিংসতার সূচনা করা হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে খুন, জখম, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ সকল ধরনের অপরাধের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং এই ধারা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আরও প্রকটরূপে অব্যাহত থাকে।
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। নির্যাতনকারীরা প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ভোট প্রদানের জন্য অভিযোগ করেছে। সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক খ্যাত হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে বাঙালীর সংখ্যা হ্রাস ও হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদান থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে ভোটের ভারসাম্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। যখন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করা হয় তখন সংখ্যালঘু এবং নির্যাতনকারীদের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সমর্থনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে যাই থাকুক না কেন সেই সময় অনুপস্থিত ছিল। নির্বাচনোত্তর জয়ী রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সমর্থক সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের সহায়তায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংস আক্রমণের সময় নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় নেত্রীবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শূন্যতার সৃষ্টি হয় ও প্রতিপক্ষের তুলনায় ক্ষমতার ভারসাম্যে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আক্রমণকারীরা এই সহিংসতায় বিজিত রাজনৈতিক দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নিকট স্থানীয় পর্যায়ে কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি।
অত্র কমিশনের মাঠপর্যায়ে তদন্তকালে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা বিশ্লেষণে চার প্রকৃতিতে ঐ সকল সন্ত্রাসকে চিহ্নিত করা যায়। সক্রিয়তা ও সম্পত্তির দখল সংক্রান্ত সন্ত্রাস, মানসিক অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন যার চরমরূপ হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যা। দেশ শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভোটাধিকার। সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দর্শনগত ভিন্নতার জন্য ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তির দখল সংক্রান্ত সহিংসতার বর্বর পৈশাচিক নগ্নরূপ মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়েছিল বলে কমিশনের নিকট প্রতিভাত হয়েছে। নির্বাচনোত্তর সহিংসতার প্রকটরূপ প্রত্যক্ষ করে শক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ার অপরাধে জননেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবের হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম, কর্নেল (অব) শওকত আলী, মুক্তচিন্তার অনুসারী লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসীর মামুন প্রমুখের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতনের বিষয়টি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। নিগৃহীত হয়েছেন বিশিষ্ট নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর।
পূর্বের পর্যবেক্ষণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের ঘটনা ছিল সুপরিকল্পিত সুদূরপ্রসারী ও উদ্দেশ্যমূলক। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেনাশাসক ও তাদের উত্তরসূরী সরকারে ও দলে চরম ডানপন্থী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাবিরোধী মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর শুধুমাত্র সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং তারা ছিল দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারক। ফলশ্রুতিতে বিএনপিসহ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসন আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ জনগণের কাক্সিক্ষত সংবিধানের মৌলিক চরিত্র বিনষ্ট করে ঐ শক্তি ইসলামের মূল চেতনায় নয়, বরং বিবৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার দুঃস্বপ্নে লিপ্ত ছিল। তাদের এই দুঃস্বপ্নকে দ্রুততার সাথে অগ্রসর করার মানসে ঐ অশুভ শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভাবনীয় পুনরুত্থান এবং জঙ্গীবাদের বিকাশ ঘটে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগসূত্র ও মদদে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটতে থাকে। (চলবে)
লেখক : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ
জিয়াউর রহমান হত্যার স্বল্পকাল পরেই অপর সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরির মতোই ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পরবর্তীত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সমূহকে আরও অগ্রসর করে নিয়ে গেলেন। এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মৌলবাদী অনুভূতিগুলোকে সর্বাত্মকভাবে জাগরিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নামে একটি দল গঠিত হয়, যে দলটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তার পূর্বসূরির ন্যায় অভিন্ন। ১৯৮৮ সালের ৭ জুলাই এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নীতি এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে গুরুতর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হয়।
এরশাদ পতনের পর বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর দল বিএনপি এবং তিনি আর মরহুম স্বামী জিয়াউর রহমানের নীতিগুলোই অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার হয়। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মরহুম স্বামী জিয়াউর রহমানের ভারত বিরোধী নীতি অনুসরণ করেন। এই নীতি পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দুবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনা শক্তিশালী হতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাজনীতির মূল শ্রোতে পুনর্বাসিত হয় এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের চূড়ান্ত শিখরে তাদের অবস্থান সুসংহত হতে থাকে। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয় ভূলুণ্ঠিত, যা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার নামান্তর।
বর্ণিত রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলবাদী উন্মাদনার বিস্তার ঘটতে থাকে। ইসলামের প্রকৃত চেতনায় নয় এবং বিকৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল ঐ গোষ্ঠী। তৎকালীন শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, আইনজীবীসহ প্রগতিশীল চিন্তাধারার ব্যক্তিদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্যাতন ও নিপীড়ন এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার শাসনকালে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করায় ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুসম্পর্কের অনুকূলে সংবিধান সংশোধনের কোন উপায় এ সরকারের ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণ করার স্বার্থে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের শরণার্থী হিসেবে ফিরে যাওয়া চাকমাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করার বিষয়টি বাস্তবায়িত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকারী বাঙালীদের দখলে থাকা আদিবাসীদের ভূমি ফেরত দেয়ার শর্তটি কাক্সিক্ষতভাবে বাস্তবায়িত হয় নাই। ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্বে সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইনকে সংশোধন করে একটি বিল পাস করা হয়। ঐ সংশোধনী অবশেষে নীতিগতভাবে সংখ্যালঘুদের ব্যবসা ও সম্পদ ফেরত দেয়ার পথ সহজতর হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী ক্ষমতাসীন দলের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্থাৎ মূল ধারায় প্রবর্তন করার সুযোগ ছিল না। যদিও এটা ছিল আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনীতির ভিত্তি। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রকট আকারে বিদ্যমান ছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনাতেই সকল সম্প্রদায়ের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পেরেছে এবং এই প্রশ্নের কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ পূর্তির পরে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী ২০০১ সালের ১৬ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। নির্বাচনে অবৈধ উপায় অবলম্বন করার প্রশ্নে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রয়েছে। ভোট গণনার পূর্বে ভুয়া ব্যালট পেপার দিয়ে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে, কোন কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখা, প্রতিপক্ষ দলের ভোট কম করে গণনা করা, ভুয়া কাগজপত্র সৃষ্টি করে মিডিয়াতে ভুল ফল ঘোষণা করাসহ বিভিন্ন উপায়ে ভোট কারচুপি হয় বিধায় জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনগণের রায়ের সঠিক প্রতিফলন হয় না। এই অভিজ্ঞতার আলোকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। অরাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব পরবর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান। সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এই সরকার নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত ব্যতীত শুধু দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রধান দল বা জোটগুলো প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের নিয়োগকে সমর্থন করে এই আশা থেকে যে, তারা সরকারে অবস্থান করার সময় নিরপেক্ষ থাকবেন। ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকেই এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে যে, পররাষ্ট্রনীতিসহ সরকারের সকল নীতি, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব পালনের অধিকার তাদের রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের সবচেয়ে সক্রিয় সরকার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিল। সরকার গঠনের পরমুহূর্ত থেকেই তাদের প্রশ্নবিদ্ধ আরচণের ফলে জনমনে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উৎকণ্ঠা ও হতাশার সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে ১৪০০-এরও বেশি সরকারী কর্মকর্তাদের বদলি করে। প্রধান উপদেষ্টা ২০০১ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখ রাতেই শপথ নেয়ার পরক্ষণই অশোভনীয় দ্রুততার সঙ্গে ১৩ জন গুরুত্বপূর্ণ সচিবকে বদলি করে এর সূচনা করেছিলেন। সচিবালয়সহ বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা যাঁরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নির্বাচনের কাজে ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন তাঁদের নির্বিচারে বদলি করা হয়। সচিবালয়সহ মাঠ পর্যায়ে সাজানো প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা-ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতকর্মীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকা-ে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ও দর্শনের পরিবর্তনকারী শক্তির নীতি ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ওপর কৌশলগত নির্যাতনের ফলে তারা স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের জন্য সুসংগঠিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভীতি ও হুমকির মুখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী এবং সমর্থক দল ও গোষ্ঠীর নেতা ও কর্মীর অনেক ক্ষেত্রে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল, বিধায় নির্বাচনের প্রচার ও সাংগঠনিক কর্মককা-ে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তৎসময়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার অভাব সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। বস্তুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকা- রাষ্ট্র এবং সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে, দেশকে সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে রেখে যায় এবং রাজনৈতিক বিভক্তি বৃদ্ধি পায়। নৈরাজ্যের শক্তি সক্রিয় হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিত সহিংসতার সূচনা করা হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে খুন, জখম, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ সকল ধরনের অপরাধের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং এই ধারা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আরও প্রকটরূপে অব্যাহত থাকে।
৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। নির্যাতনকারীরা প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ভোট প্রদানের জন্য অভিযোগ করেছে। সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক খ্যাত হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে বাঙালীর সংখ্যা হ্রাস ও হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভোটদান থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে ভোটের ভারসাম্য বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। যখন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করা হয় তখন সংখ্যালঘু এবং নির্যাতনকারীদের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সমর্থনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে যাই থাকুক না কেন সেই সময় অনুপস্থিত ছিল। নির্বাচনোত্তর জয়ী রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সমর্থক সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের সহায়তায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংস আক্রমণের সময় নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় নেত্রীবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শূন্যতার সৃষ্টি হয় ও প্রতিপক্ষের তুলনায় ক্ষমতার ভারসাম্যে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আক্রমণকারীরা এই সহিংসতায় বিজিত রাজনৈতিক দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নিকট স্থানীয় পর্যায়ে কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি।
অত্র কমিশনের মাঠপর্যায়ে তদন্তকালে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা বিশ্লেষণে চার প্রকৃতিতে ঐ সকল সন্ত্রাসকে চিহ্নিত করা যায়। সক্রিয়তা ও সম্পত্তির দখল সংক্রান্ত সন্ত্রাস, মানসিক অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন যার চরমরূপ হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যা। দেশ শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ভোটাধিকার। সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দর্শনগত ভিন্নতার জন্য ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তির দখল সংক্রান্ত সহিংসতার বর্বর পৈশাচিক নগ্নরূপ মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়েছিল বলে কমিশনের নিকট প্রতিভাত হয়েছে। নির্বাচনোত্তর সহিংসতার প্রকটরূপ প্রত্যক্ষ করে শক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ার অপরাধে জননেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবের হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম, কর্নেল (অব) শওকত আলী, মুক্তচিন্তার অনুসারী লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসীর মামুন প্রমুখের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতনের বিষয়টি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। নিগৃহীত হয়েছেন বিশিষ্ট নেত্রী মতিয়া চৌধুরী ও নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর।
পূর্বের পর্যবেক্ষণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের ঘটনা ছিল সুপরিকল্পিত সুদূরপ্রসারী ও উদ্দেশ্যমূলক। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেনাশাসক ও তাদের উত্তরসূরী সরকারে ও দলে চরম ডানপন্থী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাবিরোধী মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর শুধুমাত্র সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং তারা ছিল দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারক। ফলশ্রুতিতে বিএনপিসহ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসন আমলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ জনগণের কাক্সিক্ষত সংবিধানের মৌলিক চরিত্র বিনষ্ট করে ঐ শক্তি ইসলামের মূল চেতনায় নয়, বরং বিবৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার দুঃস্বপ্নে লিপ্ত ছিল। তাদের এই দুঃস্বপ্নকে দ্রুততার সাথে অগ্রসর করার মানসে ঐ অশুভ শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভাবনীয় পুনরুত্থান এবং জঙ্গীবাদের বিকাশ ঘটে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগসূত্র ও মদদে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটতে থাকে। (চলবে)
লেখক : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ
No comments