স্মরণ-অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম by সৈয়দ জাহাঙ্গীর

মাজহারুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হলেই চোখে ভেসে ওঠে এক সুন্দর সুঠাম শরীরের টগবগে ইনটেলেকচুয়াল। কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেন না। প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার তাবৎ কৌশল যেন তাঁর আগে থেকেই জানা। অদ্ভুত মেধাসম্পন্ন অস্থির এক স্থপতি।


মাজহারুল ইসলাম মজু ভাই প্রচুর পড়াশোনা করতেন, রীতিমতো তাক লাগানো সব স্থাপত্য নকশা তৈরি করতেন আর আমরা শুধু অবাকই হতাম। তাঁর নকশায় নির্মিত হয়েছে শাহবাগে আর্ট ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি বিল্ডিং- এমন আরো অনেক ভবন। মনে পড়ে, মজু ভাই রাওয়ালপিণ্ডির ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সুইমিং পুলের পাড়ে একটা ডেক চেয়ার নিয়ে আরাম করে শুয়ে শুয়ে ইংরেজি নভেল পড়তেন। ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতেন। রাজনীতি নিয়েও কম আলোচনা হতো না। ইন্টারকন হোটেল আমার প্রায় আড়াই শ ছবি কিনেছিল, যার সুবাদে ওখানে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। ফ্রি ছিল সাঁতার কাটা। সপ্তাহে তিন-চার দিন সাঁতার কাটতে যেতাম ওখানে। আমি সাঁতার কাটার ফাঁকে ফাঁকে মজু ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নিতাম আর বড় মগে করে বিয়ার খেতাম। মজু ভাই এসবে অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু সঙ্গ দিতে, আলাপে কোনো ত্রুটি করতেন না। এমনি ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তিনি সরকারি কাজে পিণ্ডি যেতেন আর ইন্টারকনে থাকতেন। আমার বাসায় ইন্টারকন থেকে হেঁটে আসতে লাগত বড়জোর পাঁচ মিনিট। মজু ভাইকে অনেক আগে থেকে চিনতাম স্থপতি এবং আমার বড় ভাই সিকান্‌দার আবু জাফরের বন্ধু হিসেবে। সিকান্‌দার আবু জাফরের ধানমণ্ডির একতলা বাড়িটা মাজহারুল ইসলামেরই ডিজাইন করা ছিল। তিনি আরো অনেক বন্ধুর বাড়ির নকশা করেছিলেন। তাঁর বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার মকবুলর রহমান, এ কে এম আহসান, শওকত ওসমান প্রমুখ পুরনো ওস্তাগারের ডিজাইনে বাড়ি নির্মাণ বাদ দিয়ে তিনি নতুন বসতবাড়ির স্থাপত্য নকশার প্রবর্তন করেছিলেন, বিশেষ করে ষাটের দশকে। ধানমণ্ডিতে তাঁর নিজের বাড়িটাও ছিল এক অপূর্ব ভাস্কর্য যেমন। তিনি পিণ্ডি এলে আমাকে ফোন করতেন। আমিও সময় বুঝে চলে যেতাম তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে। বিখ্যাত স্থপতিদের কাজের কথা, বিশেষ করে তাঁদের কাজের বৈশিষ্ট্য জানতে। ফ্রাংক লয়েড রাইট, ল্যা কোরবুসিয়ে, লুই কান প্রমুখ স্থপতির কাজের বৈচিত্র্য সম্পর্কে। নিজস্ব ক্রিয়েটিভ চিন্তাধারার ডিজাইন সম্পর্কে আলাপ হতো। যেমন- ফ্রাংক লয়েড রাইট তাঁর নিজের বাড়ি বানালেন একটা ঝরনার ওপর, অর্থাৎ বাড়ির ঠিক তলা দিয়ে ঝরনার পানি বয়ে চলেছে, যার বারান্দায় বসে অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ভিজুয়াল ডিজাইন আর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন নিয়েও আলোচনা হতো। গোগেন হাইম মিউজিয়ামের স্থাপত্য নকশার বৈচিত্র্য অনন্যসাধারণ। নিরীক্ষামূলক এই ভবন তৈরি করে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে যান স্থপতি ফ্রাংক লয়েড রাইট। এমনই আরো কত কথা! দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি প্রেসক্লাবের সামনে মজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সমাজতান্ত্রিক দলের অফিসের সামনে বড় রেইনট্রিটার নিচে দাঁড়িয়ে। তিনি তখন মণি সিংহের দলের একজন উচ্চপদের নেতা। আমাকে দেখে রসিকতা করে বললেন, 'কী স্যার, চ্যেঁসালিজম করছেন?'
জবাবে আমি বললাম, আমি চ্যেঁসালিজম করি না। আমি শিল্পী, ছবি আঁকি। শুনে মজু ভাই একটু হাসলেন। এর ঠিক মাসখানেক পর হঠাৎ কাগজে পড়লাম, মাজহারুল ইসলাম, মণি সিংহসহ মাওপন্থীরা সদলবলে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। সুযোগ হয়েছিল পরে কোনো একসময়- এবার কোন চ্যেঁসালিজম করছেন, স্যার? মজু ভাই হেসে উড়িয়ে দিলেন প্রশ্নটা। 'ওটা আপনি বুঝবেন না'- বললেন মজু ভাই। আজ সকালে (১৪ জুলাই) মজু ভাই ইহলোক ত্যাগ করেছেন, এ কথা আমার প্রিয় শিল্পী শেখ আফজালের কাছে শুনলাম। শুনলাম, মজু ভাইয়ের মরদেহ আর্ট কলেজের চত্বরে নেওয়া হয়েছে। আগে জানতে পারিনি, তাই যেতে পারিনি। অত্যন্ত সৃজনশীল একজন শিল্পী তাঁর অমর সব কীর্তি রেখে নীরবে চলে গেলেন। কী অদ্ভুত একটা দুষ্টুমি করা হাসি লেগে থাকত তাঁর মুখে সর্বদা! ঢাকায় একসময় তিনি তৈরি করেছিলেন একটি স্থাপত্যকলা স্টুডিও। নাম দিয়েছিলেন 'ইসলাম, সিকান্‌দার ফ্রিশম্যান'। কিছুদিন কাজ হয়েছিল, কিন্তু পরে পেশাদারির মনোমালিন্যে ওই সংগঠন আর চলেনি। আমার অগ্রজ সিকান্‌দার আবু জাফরের সঙ্গে আমি বেশ কয়েকবার গেছি তাঁদের স্টুডিওতে। মাঝে মাঝে মজু ভাই কিছু রং আর কম্পোজিশনের জন্য আমার মতামত চাইতেন। আমি ড্রইং করে ছবি এঁকে দেখিয়ে দিতাম।
১৯৫৯ সালে ঢাকা রেসকোর্স মাঠে অনুষ্ঠিত মজু ভাইয়ের করা পশ্চিম পাকিস্তানি হস্তশিল্প প্রদর্শনী প্যাভিলিয়ন। তিনি ডিজাইন করেছিলেন স্থানীয় হস্তশিল্প নকশার আদলে এবং স্থানীয় নানা সরঞ্জাম দিয়ে। খুবই সুন্দর হয়েছিল ডিজাইনটা। এই প্যাভিলিয়ন প্রথম পুরস্কার লাভ করেছিল। প্রদর্শনী ভবনের সামনের অংশে তিনি পিঠার নকশা নিয়ে দুটি ডায়মন্ড শেপের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন ছোট ছোট কাঠের টুকরো জুড়ে। আমার এত পছন্দ ছিল ওই ভবনটা যে প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি ওটা সাত হাজার টাকায় কিনে জাফর ভাইয়ের ধানমণ্ডির খালি প্লটের ওপর ওটাকে নতুন করে স্থাপন করেছিলাম দেখার জন্য, নকশা উপভোগ করার জন্য।
আসল কথাই তো বলা হয়নি। ওই প্রদর্শনী উপলক্ষে লাহোর থেকে এসেছিলেন এক মহিলা কর্মকর্তা। উচ্চশিক্ষিত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা সাদাসিধে শাড়ি পরা সুন্দরী মহিলার নাম ছিল মিস আনিস সাইফুল্লাহ। প্রদর্শনসামগ্রী নিয়ে তিনি এসেছিলেন প্রদর্শনীর তদারকিতে। আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় ওই প্যাভিলিয়নে কাজ করার সময়। আমি সবে আমেরিকাফেরত তুখোড় গল্পবাজ শিল্পী, বিশেষ করে মাজহারুল ইসলামের স্নেহভাজন। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া আর এখানে-সেখানে রিকশায় করে ঘুরে বেড়ানো। পরে অবধারিত পরিণতি ছিল আমাদের বিয়ে। তখন তিনি হলেন আনিস জাহাঙ্গীর। মজু ভাইও খুব স্নেহ করতেন তাঁকে। আমাদের রাওয়ালপিণ্ডির বাড়িতে মজু ভাই গেছেন বহুবার। আনিস রান্না করে খাওয়াত। ১৯৫৮ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল আমেরিকার এডুকেশন ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার এবং একবার সুযোগ হয়েছিল ইয়েল ইউনিভার্সিটি দেখতে যাওয়ার। তখন জানতাম না যে মজু ভাই ওই ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যকলায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। একদিন ওখানে গিয়ে আর্ট ফ্যাকাল্টি, আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টিও দেখেছি; সেই সঙ্গে অভিনয় বিভাগও ঘুরে দেখলাম, যেখানে বিশ্বখ্যাত অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো অভিনয় শিখেছিলেন। এরপর ফ্রাংক লয়েড রাইটের বাড়িটাও দেখা হয়েছিল, যার বর্ণনা মজু ভাইয়ের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনেছিলাম। আসলে ফ্রাংক লয়েডের বাড়ি দেখে মনে হয়েছিল, মজু ভাই আর্ট ইনস্টিটিউটের নকশায় প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে স্থাপত্য নকশায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আর্ট কলেজের ভেতরে একটা পুকুরকে ঘিরে তাঁর নকশাবিন্যাস এ কথাই মনে করিয়ে দেয়। মজু ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক ভবনের নকশার স্থপতি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর একজন আমেরিকান সহপাঠী স্থপতি টাইগারম্যান ছিলেন কিছুদিন এসব ভবনের নকশা সহযোগী। জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই কানের সহযোগী হিসেবে মজু ভাই যুক্ত ছিলেন।
মজু ভাই স্মৃতি হয়ে থাকলেও তাঁর স্থাপত্যকীর্তি চির অম্লান হয়ে থাকবে এ দেশের আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে। এই তো সেদিন মজু ভাইয়ের মেয়ে ডালিয়া নওশিন দাওয়াত দিল র‌্যাডিসন হোটেলে একটা অনুষ্ঠানে। আমি খুব আগ্রহী হয়ে গেলাম, মজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে। ভাবির সঙ্গে দেখা হলো। মজু ভাই ছিলেন না। মজু ভাই বেশ অসুস্থ- জানালেন ভাবি। স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন। কাউকে চিনতে পারেন না। ভেবে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। এখন তো সব কিছুরই ঊধর্ে্ব চলে গেলেন আমার প্রিয় মজু ভাই।

লেখক : চিত্রসমালোচক ও চিত্রশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.