ফলাফল বিশ্লেষণ-একটি বিষয়, একটি জেলা এবং একটি বোর্ড by শরিফুজ্জামান

উচ্চমাধ্যমিকে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে এই প্রথম বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, নতুন এই প্রশ্নে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বরিশাল বোর্ড, আর ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রাম বোর্ডের।
ঢাকা বোর্ডে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে গোপালগঞ্জ জেলা।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি ওই জেলায় হওয়ার কারণে বিষয়টি শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অনেকেরই নজরে এসেছে।
দেশের আটটি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সব সময় পিছিয়ে থাকা সিলেট বোর্ডে এবার পাসের হার সবচেয়ে বেশি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বাড়ি সিলেট, এ কারণে ওই বোর্ডের প্রথম হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
সৃজনশীল বাংলার প্রথম বছর: এ বছর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্রে সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করা হয়। আট বোর্ডের মধ্যে বরিশাল বোর্ডে বাংলায় পাসের হার ১৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর বরিশাল বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্রে পাসের হার ছিল ৮১ শতাংশ, সৃজনশীল প্রশ্ন হওয়ায় এবার তা বেড়ে হয়েছে ৯৭ শতাংশ। আর ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম বোর্ডে গত বছর বাংলা প্রথম পত্রে পাসের হার ছিল ৯২.৮৯ শতাংশ, এবার তা কমে হয়েছে ৮৩.৯৬ শতাংশ।
তবে ঢাকা বোর্ডে বাংলায় পাসের হার কিছুটা বেড়েছে। কমেছে কুমিল্লা ও যশোর বোর্ডে বাংলায় পাসের হার।
ইংরেজির ধাক্কায় ঢাকা বোর্ডে পাস বেড়েছে: ঢাকা বোর্ডে গত বছরের চেয়ে পাসের হার প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর ওই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হারও প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।
গত বছর ঢাকা বোর্ডে পাসের গড় হার ছিল ৭৬ দশমিক ৭৪, এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮১ দশমিক ৪১। অন্যদিকে গত বছর ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ৮৪, এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮৭ দশমিক ৩৮। আবার বাংলায়ও পাসের হার ২ শতাংশের মতো বেড়েছে, এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে পাসের ওপর।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন বলেন, তাঁর বোর্ডে পাস-ফেল, পাসের হার হ্রাস-বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক ফলাফল সন্তোষজনক।
সিলেট বোর্ডের বিস্ময়কর এগিয়ে চলা: বোর্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর সিলেট কখনোই উচ্চমাধ্যমিকে সেরা ফল করতে পারেনি। এবার ওই বোর্ডের শিক্ষার্থীরা আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সেরা ফল করেছেন। গত মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলেও আট বোর্ডে প্রথম হয়েছিল সিলেট বোর্ড।
সিলেট বোর্ডের এই বিস্ময়কর সাফল্য শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কানাঘুষা তৈরি করেছে। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, প্রায় সব পরীক্ষার ফলাফলে সিলেট বোর্ড পিছিয়ে থাকে। আর্থসামাজিক কারণে ওই বোর্ডের চারটি জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকে। হাওর-বাঁওড় এলাকার ফলাফলে আকস্মিক এই উল্লম্ফন অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক সিলেট বোর্ডে ভালো ফলের কারণ জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সিলেটসহ অন্যান্য পশ্চাৎপদ এলাকায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই ফল ভালো হয়েছে।
গতকাল শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে সিলেটের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তাঁর অভিনন্দন বিবৃতি পাঠানো হয়। এতে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি এবং বিদেশ থেকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছি। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বই প্রদান করা হয়। সর্বোপরি আমি নিয়মিত সরাসরি তত্ত্বাবধান করি। যার ফলে এই ফল সিলেটের ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি।’
এ বছরে সিলেট বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন দুই হাজার ৬৫ শিক্ষার্থী, গত বছর ওই সংখ্যা ছিল ৮৬৫। এ বছর পাসের হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৩৭ শতাংশে। গত বছর ওই হার ছিল ৭৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০০৮ সালে সিলেট বোর্ডে পাসের হার ছিল আরও কম, ৭১ দশমিক ১৭ শতাংশ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা বোর্ডে ২০০৮ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ০৪ শতাংশ, গতকাল প্রকাশিত ফলাফলে ওই হার ৮১ দশমিক ৪১। এর মাঝখানে পাসের হার কিছুটা ওঠানামা করেছে।
আবার কুমিল্লা বোর্ডে ২০০৮ সালে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ, এ বছর তা ৭৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু সিলেট বোর্ডের অবস্থান পেছন থেকে প্রথমে চলে এসেছে।
সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, সিলেট বোর্ড সব সময় পিছিয়ে থাকত। বতর্মান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের এলাকা হিসেবে প্রশাসন, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন শিক্ষামন্ত্রী। এরই অংশ হিসেবে সিলেটবাসীকে সচেতন করা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঢাকা বোর্ডে পিছিয়ে গোপালগঞ্জ: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিজ নিজ জেলা নিয়ে মানুষের বিশেষ আগ্রহ থাকে। ওই সব জেলার নাগরিকেরা এক ধরনের গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জেলা গোপালগঞ্জে এবার পাসের হার ঢাকা বোর্ডের আওতাভুক্ত ১৮ জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম, ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডের মধ্যে ফলাফলে এগিয়ে ঢাকা মহানগর, পাসের হার ৯১ দশমিক ০৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৭ হাজার ১৮৭ জন।
অন্যদিকে ঢাকা জেলায় পাসের হার ৭৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৫৭ জন। ঢাকা জেলার চেয়ে ভালো করেছে নরসিংদী জেলা, পাসের হার ৮৩ দশমিক ৪০ এবং ওই জেলায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮৬৬ শিক্ষার্থী। এই বোর্ডে মাদারীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় পাসের হার যথাক্রমে প্রায় ৮২ ও ৮১ শতাংশ।
অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী পাস করা প্রতিষ্ঠান ২৯৯৫: বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের তিন হাজার ৪১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আটটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন, এমন প্রতিষ্ঠান দুই হাজার ৯৯৫টি। শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্নমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে ভালো করছে, এটা খুবই ইতিবাচক।
এ বছর সারা দেশে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১১২টি। অন্যদিকে শূন্য ভাগ শিক্ষার্থী পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আট বোর্ডে ১৯টি। ২০০৮ সালে আট বোর্ডের শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৭০টি, আর ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করতে পারেনি।

No comments

Powered by Blogger.