শেখ হাসিনা অনমনীয় : তাঁর শক্তি, তাঁর সমস্যা by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাব নিয়ে অনেক কথা বাজারে চালু আছে। অনেকেই মনে করেন, সরকারি নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয় মনোভাব; অনেক সময় দেশ আর তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের জন্যে বিপদ ডেকে আনে।
যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাঁর অনমনীয় মনোভাব দেশকে এক মহাসংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নোবেল জয়ী ড. ইউনূসকে দৃষ্টিকটুভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; শেখ হাসিনার এসব একরোখা নীতি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তবে শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাব শুধু যে সমস্যারই জন্ম দেয়, তা কিন্তু নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর এ অনমনীয় মনোভাবই তাঁর সরকার পরিচালনার শক্তি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের নাখোশ হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব।
বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ জোগান নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে রশি টানাটানির পর নিজস্ব অর্থেই নির্মাণ করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ় ও অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভা, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও দেশের সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে এত দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের আরেকটু সময় নেওয়া উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, তাদের সরকার টাট্টু ঘোড়ার মতোই চলছে। যেকোনো ইস্যুতে প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গতিশীল প্রশাসন আমাদেরও কাম্য। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণই প্রশাসনের গতিশীলতা নিশ্চিত করে না। গতিশীল প্রশাসনের দাবি হলো, সমস্যার সার্বিক পর্যালোচনা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ও পরিণামদর্শিতা। অপরিণামদর্শী দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিতভাবে টাট্টু ঘোড়ার মুখ থুবড়ে পড়া অনিবার্য করে অনেক সময়।
পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাব দেখে বিরোধীরা প্রকারান্তরে এমন কথা বলছেন যে ক্ষমতার দম্ভ শেখ হাসিনাকে গ্রাস করেছে, তাই বিশাল ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে তিনি দাতা দেশগুলোর তোয়াক্কা করছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনযাপন বা চালচলনে সত্যিই কোনো পরিবর্তন নেই। প্রধানমন্ত্রী হয়েও সাধারণ জনগণকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের নম্বর। যার নজির আমাদের দেশে বিরল।
যা হোক, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলে শেখ হাসিনার সরকার যে কিছুটা ঘাবড়ে যায়নি, তা কিন্তু নয়। কারণ প্রকল্প বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিচলিত না হয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রেক্ষিতে এখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ তো বটেই জনগণেরও বিরাট একটা অংশ তাঁর পেছনে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানও বেশ প্রশংসনীয়। বলা যায়, আন্তর্জাতিক শত চাপের মধ্যে থেকেও দেশের স্বার্থের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে নাখোশ করার ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। এসব বিবেচনায় বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই আপসহীন।
তুলনায় খালেদা জিয়ার দল বিএনপি বা অন্য প্রধান বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টি পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে যে ভূমিকা বা বক্তব্য রাখছে, তা কেবলই রাজনীতি, বিরোধিতা করতে হবেই বলে বিরোধিতা করা, যেকোনো মূল্যে শাসক দলকে কোণঠাসা করার ব্রতই এ রাজনীতির একমাত্র ব্যাখ্যা। যদিও এ রাজনীতির নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাংক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্কসহ নানা কার্যকারণ।
কিন্তু এসব কার্যকারণও বড় হয়ে উঠতে পারত না যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতেন। দেশে ও বিদেশে মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ ওঠার পরও তাতে কর্ণপাত করেননি প্রধানমন্ত্রী, বরং আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভায় ধরে রাখার ব্যাপারে একরোখা মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে সরিয়ে দিলেও করা হয়েছে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। অথচ বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পর মন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে একেবারে বাদ দিয়ে যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা করলে হয়তো পদ্মা সেতুর জন্য এত চাঁদা তোলাতুলির দরকার হতো না।
তাই বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয়তা যেমন তাঁর শক্তি; কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয়তা তেমনই তাঁর সীমাবদ্ধতা।
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com
বিশেষ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থ জোগান নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে রশি টানাটানির পর নিজস্ব অর্থেই নির্মাণ করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ় ও অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভা, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও দেশের সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে এত দ্রুত এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের আরেকটু সময় নেওয়া উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, তাদের সরকার টাট্টু ঘোড়ার মতোই চলছে। যেকোনো ইস্যুতে প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। গতিশীল প্রশাসন আমাদেরও কাম্য। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণই প্রশাসনের গতিশীলতা নিশ্চিত করে না। গতিশীল প্রশাসনের দাবি হলো, সমস্যার সার্বিক পর্যালোচনা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ও পরিণামদর্শিতা। অপরিণামদর্শী দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিতভাবে টাট্টু ঘোড়ার মুখ থুবড়ে পড়া অনিবার্য করে অনেক সময়।
পদ্মা সেতু নির্মাণে শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাব দেখে বিরোধীরা প্রকারান্তরে এমন কথা বলছেন যে ক্ষমতার দম্ভ শেখ হাসিনাকে গ্রাস করেছে, তাই বিশাল ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে তিনি দাতা দেশগুলোর তোয়াক্কা করছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনযাপন বা চালচলনে সত্যিই কোনো পরিবর্তন নেই। প্রধানমন্ত্রী হয়েও সাধারণ জনগণকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের নম্বর। যার নজির আমাদের দেশে বিরল।
যা হোক, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলে শেখ হাসিনার সরকার যে কিছুটা ঘাবড়ে যায়নি, তা কিন্তু নয়। কারণ প্রকল্প বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিচলিত না হয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রেক্ষিতে এখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ তো বটেই জনগণেরও বিরাট একটা অংশ তাঁর পেছনে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানও বেশ প্রশংসনীয়। বলা যায়, আন্তর্জাতিক শত চাপের মধ্যে থেকেও দেশের স্বার্থের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে নাখোশ করার ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। এসব বিবেচনায় বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই আপসহীন।
তুলনায় খালেদা জিয়ার দল বিএনপি বা অন্য প্রধান বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টি পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে যে ভূমিকা বা বক্তব্য রাখছে, তা কেবলই রাজনীতি, বিরোধিতা করতে হবেই বলে বিরোধিতা করা, যেকোনো মূল্যে শাসক দলকে কোণঠাসা করার ব্রতই এ রাজনীতির একমাত্র ব্যাখ্যা। যদিও এ রাজনীতির নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাংক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড. ইউনূসের সম্পর্কসহ নানা কার্যকারণ।
কিন্তু এসব কার্যকারণও বড় হয়ে উঠতে পারত না যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতেন। দেশে ও বিদেশে মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ ওঠার পরও তাতে কর্ণপাত করেননি প্রধানমন্ত্রী, বরং আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভায় ধরে রাখার ব্যাপারে একরোখা মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে সরিয়ে দিলেও করা হয়েছে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। অথচ বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পর মন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে একেবারে বাদ দিয়ে যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা করলে হয়তো পদ্মা সেতুর জন্য এত চাঁদা তোলাতুলির দরকার হতো না।
তাই বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয়তা যেমন তাঁর শক্তি; কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয়তা তেমনই তাঁর সীমাবদ্ধতা।
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com
No comments