হুমায়ূন আহমেদ, হুগো শাভেজ এবং আমাদের মুজাহিদ by মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান

ভয়াল ঝড়ের মুখে তিনটি প্রাণ : মুজাহিদের ক্যান্সার হয়েছে শুনেই 'ও আল্লাহ' বলে ধপাস করে সোফায় বসে যাই। হুমায়ূন আহমেদ ও হুগো শাভেজের একই ভাগ্য_হায়! ভীষণ এক কষ্ট গলার কাছে আটকে আছে। ঢোক গিলতেও ভুলে গেছি। যেন আমার মধ্যে আমি নেই। জাকিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। রাত তখন সাড়ে ১১টা।


দ্রুত রেডি হয়ে গাড়ি আসতেই হাসপাতালে ছুটে গেলাম। নোমান ও মহি ভাইকে নিয়ে কেবিনে ঢুকতেই মুজাহিদকে আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় দেখতে পেলাম। আমাকে দেখেই ও সোজা হয়ে বসল। ওর মাথায় হাত রাখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাইয়া, কেমন লাগছে?' ও বলে, 'ভাইয়া ভালো।' চেহারায় ক্লান্তির ছোঁয়া লাগলেও আত্মবিশ্বাসের ছাপ সুস্পষ্ট। খুব স্বাভাবিকভাবেই ও বলে চলে 'অপারেশনের পর আপাতত ভালো লাগছে। তবে পরের চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা বিদেশে যেতে বলেছেন। পায়খানার রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে রক্ত যেত। সিরিয়াস কিছু ভাবিনি। অপারেশনের পর টিউমার ধরা পড়েছে। বায়োপসি রিপোর্ট খারাপ এসেছে।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে আমার একই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া অসম্ভব মেধাবী, সদাহাস্য, বিনয়ী, এককথায় 'কিউট' ছোট ভাইটির জীবনে আঘাত হানা এক ভয়াল ঝড় আমার মস্তিষ্ককে যেন শূন্য করে দিয়েছে। ওর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে আসার সময় সবাইকে লক্ষ করে বললাম, 'ওর মিসেস কি আছে?' কেউ একজন জবাব দিল, 'হ্যাঁ, ওতো এখানে আছে।' কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের মধ্যখানে ওকে দেখলাম। ওকে লক্ষ্য করে বললাম, 'ভাইয়া, সাহস রাখ। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবে।' খুব আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে সায় দিয়ে বলল, 'ঠিক আছে ভাইয়া।' বছরখানেক আগে বিয়ে হয়েছে। একটি পুত্রসন্তান এসেছে তাদের বুকজুড়ে। এক বিশাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল তিনটি প্রাণের। রাত ১টার পরে বাসায় ফিরেছি মুজাহিদকে দেখে এসে। বারবার মন ছুটে যাচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে আসা সোনালি দিনগুলোতে...আধো ঘুম আধো চেতন...এই অবস্থায় কেটে গেল সারা রাত।
শুরু হলো সংগ্রাম : খোলার দিন অফিসে গিয়ে কলিগদের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন। মুজাহিদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হলে ভালো। যদি না হয়, তবে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে মুজাহিদ ও তার পরিবারের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ভাবছিলাম_আমাদের সহযোগিতা নেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা সংকোচও করতে পারেন। এই অবস্থায় আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মুনতাসিরকে খোঁজ নিতে বললাম।
একটি রক্তের ফোঁটা ও ভালোবাসার আহ্বান : মুনতাসির খুব দ্রুত খোঁজ নিয়ে জানল, মুজাহিদ ও তাঁর পরিবার দ্বিধান্বিত থাকলেও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর পীড়াপীড়িতে সংকোচটা কাটিয়ে উঠেছে। আজিজ ভাই, মুনতাসির, ওসমান ভাই ও জসীমের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। কিভাবে এগোব বুঝতে পারছি না। বিচারক হিসেবে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা এই প্রথম ভয়াবহভাবে অনুভব করলাম। অনেকেই পরামর্শ দিল চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি আছেন, তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। কেউ বলল, 'তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়ার দরকার নেই, তার চেয়ে বরং পত্রিকায় নিউজ দেওয়া হোক_যার ইচ্ছা হয় সে এগিয়ে আসবে। এখনো মানুষ মানুষকে ভালোবাসে।' বাইরের সাহায্যের বিষয়টি নিয়ে পরে ভাববো বলে ধরে নিয়ে আমাদের বিচার বিভাগীয় পরিবারের অন্য সদস্যরা কী করছেন তা জানার চেষ্টা করলাম। ফারুকীর কাছে শুনলাম, বান্দরবানে আসাদ ভাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সবাইকে মবিলাইজ করার জন্য। তিনি নাকি অনেক দূর এগিয়েছেন। একদিন সন্ধ্যায় রায়হান এসে হাজির। ও জানাল, 'ভাইয়া আমি ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। যদি কিছু করা যায় মুজাহিদের জন্য!' ওর চেহারায় এক উজ্জ্বল পবিত্র আভা খেলা করছিল। সেই পবিত্র আভা আমার আড়ষ্ট সত্তায় প্রবেশ করে জাগিয়ে তুলল। খাগড়াছড়ির খবর নিলাম। সেখানে মামুনের অশ্রুপতন অনেকেই শুনতে পেয়েছেন। সাড়া দিয়েছেন অনেকেই। হাতিয়া থেকে ফারুকী নামের এক উজ্জ্বল আলো সবখানে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার তীব্র আবেদন_মুজাহিদকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিতে চাই না। স্থির স্বভাবের আজিজ ভাই কেমন যেন বোকা বনে গেছেন। বললেন, 'ভাই আমাকে একটা এসএমএস ড্রাফট করে দেন।' মুনতাসিরকে কয়েকদিন থেকে দেখছি খুব ছটফট করছে। ভয়াবহ অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। ক্ষণে ক্ষণে ফোন করছে আর বলছে, 'ভাই, একটা কিছু করেন।' ওসমান ভাই বারবার বলছিলেন, 'আমাদের ভাইয়ের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতেই হবে।' চাপা স্বভাবের জসীম কোনোভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। দুঃখ করে বলল, 'কখন যে কী হয় মানুষের জীবনে। যা-ই করতে হোক না কেন, আমরা মুজাহিদের সঙ্গে আছি।' ঢাকায় আদনান, কেশব ও রেজার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা সবাই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তাদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রতিটি শব্দে আমি খুঁজে পেয়েছি সুতীব্র ভালোবাসা। আর শুনতে পেয়েছি হৃদয়ের আকুতি 'আমার ভাইকে বাঁচাতেই হবে।' বিভিন্ন জেলায় কথা হয়েছে। চৌকি স্টেশনগুলোও পিছিয়ে নেই। বাঁশখালীতে মুরাদ একাই অনেক দূর এগিয়েছে। সন্দ্বীপে আবু হান্নান ভাইয়ের চোখের নোনা জল বঙ্গোপসাগরকেও হার মানিয়েছে। সবার হৃদয়ের ক্ষরিত রক্ত যেন বারবার বলছে, আমাদের ভাইকে আমরা অকালে হারাতে চাই না। 'আমার' বলতে কিছু নেই, সব কিছুই যেন আমাদের। সবাই মিলে যেন একটি রক্তের ফোঁটা। এই রক্তের ফোঁটা যেন পুরো বাংলাদেশকে আহ্বান করছে শুধুই ভালোবাসার দিকে, শুধুই জীবনের দিকে। যে জীবন কেবল বেঁচে থাকতে চায় না, বরং সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়।
হৃদয়ের বিস্তার ও অশ্রুভেজা ওয়েবপেজ : একটি জাতীয় দৈনিকে মুজাহিদকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর সহপাঠী, বন্ধু ও সহকর্মীরা। তাঁরা সবাই বিচারক। বিচারক বলে সরাসরি সাহায্য চাওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও সম্মানিত বিচারকরা নিজেদের বিচারিক সত্তাকে মানবিক সত্তাতে বিস্তৃত করেছেন। 'একজন বিচারককে বাঁচানোর স্বপ্ন...' শিরোনামের লেখাটির প্রত্যেকটি বর্ণ ভালোবাসায় মোড়ানো। আসাদ ভাই ফেসবুকে যথার্থই লিখেছেন : 'বৃক্ষের বিস্তার আছে, হৃদয়েরও বিস্তার আছে। খুব কম লোকই বিস্তারিত হতে পারে। একজন ভাইয়ের বিপদে অন্য ভাই বোনেরা দেখিয়ে দিল আদিগন্ত তাদের বিস্তার। হলফ করে বলতে পারি...সুদিন অপেক্ষা করছে। প্রিয় ভাই-বোনেরা তোমরা পারবে। তোমাদের দ্বারাই সম্ভব।'
অন্যদের কথা কি বলব, যে যেভাবে পারছে মুজাহিদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছে। কোন জেলায় কি করা হচ্ছে সেই সম্পর্কে ফেসবুক প্রতিনিয়ত আপডেট...ই-মেল এবং ফেসবুক যেন বেদনার্ত হৃদয়ের আশ্রয়...চোখের পানিতে যেন ভাসছে সব ওয়েবপেজ!
মুজাহিদ, তোমাকে বাঁচতেই হবে : যতদূর জানি লেখক হুমায়ূন আহমেদ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেই সূত্রে তুমি এক রকম তাঁর সতীর্থ। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকেও। তাঁর লেখাগুলো এবং তাঁর সম্পর্কে লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় পড়ি আর কাঁদি। বিশেষ করে তিন কন্যাকে নিয়ে তাঁর লেখাটি পড়ে। এক সকালে খুব কেঁদেছি। তাঁকে বলতে ইচ্ছে করছিল আর এত কষ্ট দেবেন না, প্লিজ। মুজাহিদ, তুমিও নিশ্চয় পড়েছ তাঁর অনেক লেখা। তাঁর আত্মবিশ্বাস তোমার মাঝেও দেখতে পাই। তোমাদের দুজনের মতোই একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কট্টর সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে অনেকটা মুখের ওপর শয়তান বলে সম্বোধন করা অনেক সাহসের ব্যাপার। এর চেয়েও বড় সাহসের ব্যাপার ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করা। এ ক্ষেত্রেও তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত। তোমাদের তিনজনের মধ্যে অদ্ভুত মিল। তোমরা তিনজনেই যুদ্ধে লিপ্ত। তিনজনই যোদ্ধা। হুমায়ূন আহমেদ কলমযোদ্ধা। হুগো শাভেজ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যোদ্ধা। আর তুমি ন্যায় প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা। অন্যরা তোমার তুলনায় বিখ্যাত হলেও তোমার কাজটি কিন্তু তাঁদের কাজের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই জন্যই হয়তো নিয়তি তোমাদের তিনজনকে কর্কটবিরোধী যোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছে। তোমাদের আমরা মরতে দিতে চাই না। জয় তোমাদেরই হবে। পৃথিবীর সব রোগাক্রান্ত মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে তোমাদের দেখে।
যদি পার ভালোবেসে এসো করুণা করে এসো না...
আজিজ ভাই, কেশব, আদনান, পারভেজ ও সালামরা লিখেছে 'স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মুজাহিদ সেই স্বপ্নেরই মানুষ। আমরা তাঁকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তাঁর জীবন আবার আনন্দ-হাসিতে ভরে উঠুক। দুরারোগ্য ব্যাধিকে জয় করে মুজাহিদ এই পৃথিবীতে আরও অনেক দিন বেঁচে থাকবেন। বিচারকের আসনে বসে সত্য ও ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত রাখবেন। তাঁর মেধা ও দক্ষতা মানুষের ন্যায়বিচার পেতে সহায়ক হবে।
মুজাহিদের জন্য সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা : ফারজানা সুমি, হিসাব নম্বর ১১৯-১২২০০০৩০৯৫-৫, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। প্রবর্তক মোড় শাখা, চট্টগ্রাম।
তবে আমি তাঁদের সঙ্গে একটা কথা যোগ করতে চাই, ভালোবেসে এগিয়ে আসুন, করুণা করে নয়।

লেখক : মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিএমএম কোর্ট, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.