অরণ্যে রোদন-কম খাচ্ছি, বাড়িও কম কম যাব? by আনিসুল হক

গত রোববার বিকেলে ধানমন্ডির একটা শাকসবজির দোকানে গেছি। কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা কিনতে হবে। কাঁচা মরিচ কত করে? ২৫০ গ্রাম ৭৫ টাকা। মানে কী? ৩০০ টাকা কেজি? হ্যাঁ। আচ্ছা, দাও, ১০০ গ্রাম দাও। ১০০ গ্রামের দাম দিলাম ৩০ টাকা। গুনলে ৩০টার বেশি হবে না। একটা কাঁচা মরিচ এক টাকা? তারপর ধনেপাতা।


কত করে? ৫০ টাকায় ১০০ গ্রাম। মানে কী? ৫০০ টাকা কেজি। সবচেয়ে কম কত টাকার দিতে পারো! বলল, ১০ টাকারও পারি। দোকানি উদার। আমি বললাম, তাহলে তাই দাও। সে দিল। দুই রকমের জিনিস একটা ঠোঙায় ভরে বুক পকেটে পুরে নিয়ে চলে এলাম। বাসায় এসে ঘোষণা দিয়েছি, ঐতিহাসিক ঢাকা ঘোষণা ২০১১, যত দিন পর্যন্ত দাম না কমবে, ধনেপাতা আর কেনা হবে না, আর কাঁচা মরিচ কম খাব। মাত্র ১০ টাকার ধনেপাতা কিনেছি, তাতে যে আমার মাসের খরচে টান পড়েছে, তা নয়; কিন্তু এত দাম দিয়ে খেতে হবেই বা কেন? গদ্যকার্টুন কলামে একবার ধনেপাতার প্রশস্তি গাওয়ার জন্য মানপত্র রচনা করেছিলাম। সেবার ধনেপাতার কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এবার ৫০০ টাকায় নিজে কিনেছি। এবার অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি।
ধনেপাতা, পূর্ববঙ্গে ও সাধু ভাষায় ধনিয়াপাতা, উর্দু ও হিন্দি ধনিয়া বা ধইন্যা, আরবিতে কুজবারাহ বা কাজবারাহ, আর্মেনিয়ানে কিন্জ, বার্মিজে নান নান বিন, জাপানিতে কোয়েন্দোরো, ইংরেজিতে কোরিয়ান্ডার, ঢাকায় ধইন্যা পাতা ৫০০ টাকা কেজি কিনে খেতেই হবে! না খেলে কী হয়? এটা আমার নীতিগত প্রতিবাদ। যত দিন ধনেপাতার দাম ১০০ টাকার নিচে না নামছে, তত দিন ধনেপাতা খাবই না। মাননীয় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী, আমি আপনাদের পাশে আছি। বেশি খেয়ে খেয়েই আমরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে ফেলেছি। আর খাব না।
আর ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষ, আর দেশের ১৪ কোটি ওরফে ১৬ কোটি মানুষ, সবাই যদি একযোগে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করে, আর যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, যানজট বাঁধবেই। কাজেই এবার ঈদে বাড়ি যেতে না পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু মায়ের ডাক, ‘ঈশ্বরচন্দ্রকে বাড়ি যাইতেই হইবে। ঠিক করেছি, সাঁতরে যাব। বুড়িগঙ্গায় নামলে একসময় যমুনা, সেখান থেকে করতোয়া হয়ে ঠিকই ঘাঘট নদীতে পড়ব।’ মুসা ইব্রাহীমকে বুদ্ধিটা দিলেই ও রাজি হয়ে যাবে। শেষ বিদায় কাফনের কাপড় স্টোরের কাছ থেকে স্পন্সর জোগাড় করে নিলেই চলবে।
এটা অর্থনীতির একেবারে প্রথম পাঠ—চাহিদা বাড়লে সরবরাহ যদি স্থির থাকে, জিনিসের দাম বাড়বে। রাস্তার পরিমাণ যদি একই থাকে, একই সময়ে সব গাড়িঘোড়া বের হলে যানজট বাঁধবেই। কিন্তু একই সময়ে দেশের সব রাস্তাঘাট একই সঙ্গে ভেঙেচুরে আফগানিস্তানের রিলিফম্যাপ হয়ে যাবে, এর ব্যাখ্যা অর্থনীতির কোনো বইয়ে পাওয়া যাবে না। এটা সীমাহীন অদক্ষতা, অযোগ্যতা, নির্লিপ্ততার প্রমাণ। এবং তার পরও পদত্যাগ না করাটা নির্লজ্জতার চরম দৃষ্টান্ত। একটা দুর্ঘটনার পরে সভ্য দেশের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন, সত্য বটে। ওই মন্ত্রী নিজে গাড়ি চালাচ্ছিলেন না, ওই মন্ত্রীর বদলে অন্য মন্ত্রী চেয়ারে বসে থাকলেও একই দুর্ঘটনাই ঘটত। কিন্তু এটা একটা দায়িত্বের ব্যাপার, এটা একটা সাধারণ সদিচ্ছার প্রমাণ যে আমি চাই, আমরা চাই, আপনারা ভালো থাকুন। যেহেতু আমার মন্ত্রিত্বের সময়ই এ দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। দেখুন, আমি পদত্যাগ করলাম। এই সেদিনও মুম্বাইয়ে বোমা হামলার পরে রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এটা কেবল ওই মন্ত্রীর সদিচ্ছারই ব্যাপার না, সরকার যে জাগ্রত আছে, তার কাছে দেশের মানুষের ভালো থাকা না-থাকা যে গুরুত্ব পায়, তারও প্রমাণ। আর পদত্যাগ না করাটা একগুঁয়েমি ও অহংকারের প্রমাণ। কে না জানে, অহংকার পতনের মূল। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময় এবং ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।
ঈদের আগে আগে ঢাকা থেকে সারা দেশে যত নৌপথ, রেলপথ, সড়কপথ আছে, সব যে জট পাকাবে, এটা এমনিতেই স্বাভাবিক। তার ওপর রাস্তাঘাট ভাঙা, আসলে রাস্তা নেই। এবার কী হবে, কেউ জানে না। অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি বাড়ি গিয়ে ঈদের নামাজ ধরতে চান, এখনই বেরিয়ে পড়ুন। তা না হলে এবার ঈদ রাস্তাতেই করতে হবে। আচ্ছা, একবার ঈদের সময়ে দেখেছিলাম, মহাসড়কে সেনাসদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে। তাঁরা শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটা করছেন। তাতে বেশ উপকার করা হয়েছিল। এবার কি তা করা যায় না? অন্তত অতিরিক্ত পুলিশ তো মোতায়েন করা যায়। দেশের মানুষের ভোগান্তি কমাতে সরকার যে সচেষ্ট, তার কোনো প্রমাণ তো থাকতে হবে।
শুধু যে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, তা নয়। ঢাকার ভেতরেও বহু রাস্তাঘাট একেবারে খানাখন্দে পরিণত হয়েছে, দেশের অনেক জায়গায় একই সমস্যা। দেশজুড়েই রাস্তাঘাট অগম্য হয়ে পড়েছে। কাগজে দেখলাম, এবার কুষ্টিয়ায় সড়ক মেরামতের দাবিতে যান চলাচল বন্ধের ঘোষণা এসেছে (পরে অবশ্য সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে)। ব্যাপারটা এক দিনে হয়নি। ঢাকার ভেতরের রাস্তা বা পৌরসভার ভেতরের রাস্তা বা উপজেলার ভেতরের রাস্তার দায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নয়। একেকটার মালিক একেক বিভাগ। তারা সবাই মোটামুটি সুখে নিদ্রা যাচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে অযোগ্যতা, নির্লিপ্ততা, টাকার অভাব, দরিদ্র অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি। বিআরটিএ হচ্ছে বাংলাদেশের দুর্নীতির অভয়ারণ্য। ওখানকার মাটিও টাকা খায়, দেয়ালও টাকা খায়। আমার এক বন্ধু একবার বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েছিলেন। আমি তাঁকে টেলিফোন করে আমার প্রায়-নতুন গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট টাকাপয়সা খরচা না করে বের করার উদ্যোগ নেওয়ায় চালক আমাকে বকাঝকা করেছিল, ‘আপনার জন্য এত হয়রানি হলো, টাকা দিলে কখন কাম সারতে পারতাম।’ বলা বাহুল্য, আমার কাছে আমার বন্ধু অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এটাই ওখানকার সিস্টেম।’ বন্ধুটি এখন বিশাল বড়লোক। থাক, সেসব কথা আর বলতে চাই না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কথা কি কিছু বলব? শুধু একটা কথাই বলি, এর সদ্য পদত্যাগী প্রধান প্রকৌশলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গঠিত ট্রুথ কমিশনের কাছে নিজের দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছিলেন। আর ওই ট্রুথ কমিশনের কাছে যাঁরা নিজেদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে টাকাপয়সা জমা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রকৌশলীরা আছেন বিপুল সংখ্যায়, সগৌরবে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা তো থাকবেনই। আমি নিজে প্রকৌশলী, কাজেই ওপরের দিকে আর থুতু ছিটানো ঠিক হবে না। আর নিশ্চয়ই এমন প্রকৌশলীও অনেক আছেন, যাঁরা ঘুষ খান না। তাঁদের কাছে মাফ চেয়ে নিয়ে রাখি। আমার এক আত্মীয় ঠিকাদারি করেন। বহু বছর আগে ঢাকার ধানমন্ডির দোতলা বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, সব বাড়ি নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ারদের। বেচারা। এইমাত্র ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাড়ি থেকে বেরোলেন টাকার থলে নিবেদন করে। সেই দিন অবশ্য আর নেই। প্রকৌশলীরাই কেবল দুর্নীতি করেন না। এখন মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি-চেয়ারম্যান, যে যেখানে পারছেন, দুর্নীতি করছেন। এমনকি সাংবাদিকদেরও দুর্নাম কম নয়। কাজেই বিচিত্র নয় যে ৬৯০ কোটি টাকা বরাদ্দের খবরে শুঁটকি রান্না করার সময় যেমন করে বিড়াল পাগল হয়ে যায়, তেমনি টাকার গন্ধে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, ঠিকাদার-প্রকৌশলী-সাপ্লায়ার—সব পাগল হয়ে গেছেন। টেলিভিশনে দেখি, বাসের চালক থেকে শুরু করে নিরীহ পথচারীও অসংকোচে বলছেন, হরিলুট হচ্ছে। বালু আর খোয়া ফেলা হচ্ছে। বালুও বালু নয়, মাটি। মানুষের আশঙ্কা, এই ৬৯০ কোটি টাকার পুরোটা মাটিই হয়ে যাবে।
দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে আছে অনিয়ম। বিটুমিনের প্রধান শত্রু পানি। পানি জমলে রাস্তা নষ্ট হবেই। তাহলে সড়কে-মহাসড়কে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। মহাসড়কের দুই পাশের জমিও সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরেরই, সেখানে ভবন ওঠে কীভাবে? পৌরসভা বা হাটবাজারগুলোয় রাস্তার দুই ধারে দোকানপাট ও ভবন উঠে পানি নেমে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। সেটা দেখার দায়িত্ব কার? পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার সংস্থা, নাকি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের? আমরা যদি নির্বিচারে নিচু জমি ভরাট করতে থাকি, রাস্তাঘাটে পানি জমবেই। তাহলে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কেউ সেটা করছে না। পানি জমছে। আর পানি জমলে রাস্তা খারাপ হবেই। আর তার ওপর যদি অতিরিক্ত ওজনের মালবাহী ট্রাক ওই রাস্তায় চলে, তাহলে রাস্তার বারোটা বাজতে বাধ্য। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের অকালপ্রয়াণের পরে অনেকেই বলছেন, মহাসড়কে বিভাজক চাই। তিন লেনের সড়কে বিভাজক দেওয়া সম্ভব নয়। তাতে একটা গাড়ি দাঁড়ালেই রাস্তা অচল হয়ে পড়বে। সড়ক কমপক্ষে চার লেনের করতে হবে। সে ক্ষেত্রে টাকা লাগবে। আমাদের মহাসড়কগুলো আদৌ মহাসড়ক নয়, এতে বাজার বসে, গরুর গাড়ি চলে, রিকশাভ্যান-নছিমন তো চলেই। ইচ্ছামতো লোকে দৌড়ে রাস্তা পারাপার হয়। গরু-ছাগল চরে। আমরা হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েই চলি।
উচ্চশিক্ষিত চালক আমরা পাব না। কাজেই যে কথাটা আগেও বলেছিলাম, আবার বলছি, চালকদের লাইসেন্সপ্রাপ্তির যোগ্যতা হওয়া উচিত—১. নির্ভুলভাবে ও দক্ষভাবে গাড়ি চালাতে পারা। ২. সব নিয়মকানুন ঠিকমতো জানা। ৩. মূল্যবোধ থাকা। মানুষের জীবন মূল্যবান, এ কথাটা তাকে অবশ্যই বুঝতে হবে। ফলে লাইসেন্সের চেয়েও বেশি দরকার প্রশিক্ষণ। সে যেন যেখানে-সেখানে গাড়ি না থামায়, গতিসীমার চেয়ে দ্রুত গাড়ি না চালায়, যেখানে ওভারটেক করা নিষিদ্ধ, যেখানে সড়কের মধ্যের দাগটা অবিচ্ছিন্ন, সেখানে ওভারটেক না করে, অতিরিক্ত মাল বা যাত্রী না তোলে, আবার অতিরিক্ত পরিশ্রমও না করে। এ জন্য দরকার প্রশিক্ষণ। সব চালকের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। সে জন্য বিআরটিএকেই প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলতে হবে।
কিন্তু যে কথা আগে অনেকবার বলেছি, তা আবারও বলতে হবে। আমাদের যোগাযোগ-ব্যবস্থার দর্শন হওয়া উচিত, আমরা নৌপথ ও রেলপথকে অগ্রাধিকার দেব। নৌপথ ও রেলপথে পরিবহন খরচ কম, তা পরিবেশবান্ধবও। নৌপথকে নিরাপদ করতে বড় ও বিপ্লবী কর্মসূচি নেওয়া উচিত। আমাদের নৌযানের নকশায় নিশ্চয়ই ত্রুটি থাকে, তা না হলে এগুলো এত সহজে ডুবে যায় কেন? জলপথের পরই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত রেলের দিকে। রেল চিরকালের দুয়োরানি হয়ে আছে। কারণ, এতে টাকা হরিলুটের জায়গা কম। বাস-ট্রাক আমদানি-রপ্তানিকারকদের স্বার্থ, বাস-ট্রাকমালিকদের স্বার্থ, প্রকৌশলীদের স্বার্থ, নীতিনির্ধারকদের স্বার্থের কারণে জনস্বার্থ বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। সারা দেশে রেলনেটওয়ার্ককে আধুনিক করুন। ঢাকা-চট্টগ্রাম সোজাসাপ্টা রেললাইন স্থাপন করুন।
অর্থাৎ দরকার একটা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা। এ জন্য দরকার নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু সবার আগে দরকার এটা প্রমাণ করা যে মানুষের কথা নেতৃত্বের কাছে পৌঁছায় এবং তা তাঁরা আমলে নেন, মন্ত্রিপরিষদের জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে এবং ব্যর্থ মন্ত্রীরা সরে যান বা যেতে বাধ্য হন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.