মৎস্যভান্ডার সম্পর্কে ধারণা নেই খোদ মৎস্য বিভাগের-সমুদ্র জরিপ হচ্ছে না ২১ বছর by আব্দুল কুদ্দুস,

‘১০ বছর আগেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে এলিফ্যান্ট পয়েন্টে সাগরে জাল ফেললেই ধরা পড়ত ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ। উপকূল থেকে সকালে গিয়ে রাতে মাছ ধরে পরের দিন সকালে ঘাটে ফিরতেন জেলেরা। মাছ বিক্রির টাকায় চলত জেলেদের সংসার। আর এখন সাগরের ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারেও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।


১০ থেকে ২০ দিন সাগরে কাটিয়ে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে সামান্য কিছু মাছ নিয়ে।’
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটে আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলেন স্থানীয় জেলে আবদুল মজিদ (৫৬)। তিনি ২৬ বছর ধরে সাগরে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরছেন। মজিদের কথার সমর্থন করেন জেলে মনির উল্লাহ (৪৫) ও গিয়াস উদ্দিন (৪৯)।
নুনিয়াছটা এলাকার ট্রলার মালিক গিয়াস উদ্দিন জানান, ২০ জন জেলে নিয়ে একটি ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে গেলে খরচ হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। সাগরে থাকতে হয় ১০ থেকে ১৫ দিন। ঘুরে ফিরে প্রায় সময় মাছ ছাড়াই ফিরছে ট্রলারগুলো। তখন খরচের তালিকা দীর্ঘ হয়।
কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, জেলার আটটি উপজেলায় ছোটবড় সাত হাজার ট্রলার প্রায় ১২০ কিলোমিটারের এই বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ট্রলার মাছ ছাড়াই ঘাটে ফিরে আসছে। মাছ না থাকায় হাজার হাজার ট্রলার ঘাটে নোঙর করে আছে। এতে ৮০ হাজারের বেশি জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। বঙ্গোপসাগর ক্রমান্বয়ে মাছ শূন্য হচ্ছে কেন? মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র ঠিক আছে কিনা-এসব অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে।
জরিপ কার্যক্রম বন্ধ ২১ বছর ধরে: বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ জলসীমানায় মৎস্যসম্পদ বা ভান্ডারের মজুদ কত? এই হিসাব খোদ মৎস্য বিভাগেই নেই। কারণ গত ২১ বছর ধরে সাগরের মৎস্যভান্ডারের জরিপ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে সাগরে বিচরণরত মাছের প্রজাতি, মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র এবং মজুদের পরিমাণ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে না।
এর সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শাহাবুদ্দিন জানান, প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমার বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডারের মজুদ নির্ণয়, মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করাসহ নানা সম্ভাবনার দুয়ার উদ্ঘাটনের জন্য সরকার অত্যাধুনিক একটি সমুদ্র জরিপ জাহাজ কিনছে। সমুদ্র জরিপসহ মাছের বংশবৃদ্ধি-উন্নয়ন, পরিকল্পনা, মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমপ্রতি প্রায় ১০০ কোটি টাকার ‘মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০ কোটি টাকায় জরিপ জাহাজ কেনা হচ্ছে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এবং মালয়েশিয়া সরকার যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে। প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা দিতে গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকার সাভারে মৎস্য কর্মকর্তাদের তিন দিনের বিশেষ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই কর্মশালায় যোগ দেন কক্সবাজার সদর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মইনুদ্দিন আহমদ।
মইনুদ্দিন আহমদ জানান, ওই কর্মশালায় বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ মজুদ নির্ণয়সহ সামুদ্রিক নানা বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চলতি সালেই এই সমুদ্র জরিপ পরিচালিত হবে।
তিনি আরও জানান, ২১ বছর ধরে বঙ্গোপসাগর জরিপের কাজ বন্ধ রয়েছে। তাই সাগরের কোন লেভেলে কোন কোন মাছ বিচরণ করে, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মাছ আহরণও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে জাপানের সহায়তায় প্রথম বঙ্গোপসাগরে মৎস্যসম্পদ জরিপ পরিচালিত হয়। এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিশ্বখাদ্য সংস্থার (এফএও) সহায়তায় অনুদানে পাওয়া দুটি জাহাজ ‘আরভি অনুসন্ধানী’ ও ‘আরভি মাছরাঙা’ দিয়ে সমুদ্র জরিপের কাজ পরিচালনা করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে জাহাজ দুটি বিকল হলে জরিপের কার্যক্রমও দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বন্ধ থাকে।

No comments

Powered by Blogger.